লেখক ও ব্যাংকার মাশরুর আরেফিন বলেছেন, লেখকদের দায়বদ্ধতা থাকতে নেই৷ দায়বদ্ধতাকে তিনি ফাঁদ বলেছেন৷ ওনি বাঙালি লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের ভিতরের কথাই বলেছেন৷ দায়বদ্ধতা অনুভব করতে হয়— শুধু লেখায় নয়, সমাজের জন্যও৷ এই ঢাকা লিট ফ্যাস্টেই এসেছেন সোমালীয় লেখক নুরুদ্দিন ফারাহ৷ তিনি সারা জীবনই একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন৷ দেখিয়েছেন কিভাবে সমাজের ভিতরে মাশরুর আরেফিনরা থাকলে একনায়কের জন্ম হয়৷
দরিদ্র দেশে লেখক-শিল্পীরা প্রায়শই তোষামোদী করেন। একসময় রাজদরবারেই থাকতেন লেখকগণ। তাদের কাজই ছিল রাজাকে সন্তুষ্টু করে স্তুতি লেখা। ফলে লেখকদের দাসত্বে বাঁধা পড়া নতুন কিছু নয়। দাসত্বে থাকা লেখকদের মূল লক্ষ্যই থাকে অন্যদের দাসে পরিণত করা। এসব করেই তারা দীর্ঘকাল জীবিকা নির্বাহ করেছে। সম্রাট আকবরের রাজদরবারে বীরবলদের কাজ কি ছিল? মধ্যযুগের লেখকগণ বিভিন্ন রাজ দরবারের আনুকূল্য পেয়েছেন। একসময় রাজারাতো নিজেরা লিখতেন না। ইউরোপে হিটলার, মুসোলিনী পক্ষেও লেখক চিত্রশিল্পীরা ছিলেন। এরশাদের পক্ষেও আল মাহমুদ ও সৈয়দ আলী আহসানরা ছিলেন। এরশাদও ওই সময় কবিতা লেখা শুরু করেন। অনেকে অবশ্য দাবি করেন, তার কবিতাগুলো অন্যের লেখা। ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকার প্রধান মুসোলিনি নিজেই নাটক লিখতেন। চিত্রশিল্পী ছিলেন নাৎজি হিটলার নিজেই। ফলে এটা বলাই যায় যে, শিল্প-সাহিত্যের সাথে থাকলেই তিনি ফ্যাসিবাদের বা স্বৈশাসকদের পক্ষে থাকবেন না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
ইউরোপের কালচারটা বদলে গিয়েছে। এখন সেখানে শুধু শিল্পী-সাহিত্যিকরাই শুধু নন, সরকারের অন্যায় আচরণে সোচ্চার হয়ে উঠেন সর্বস্তরের মানুষই। তারা জানেন সরকার স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদী হয়ে পড়লে তার জ্বালা কতো। তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার-মুসোলিনী-ফ্রাঙ্কোদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। কি ভয়ানক অবস্থার মধ্যেই না জনগণকে ফেলে দিয়েছিল স্বৈরশাসকরা। সচেতন জনগণই রুখে দিতে সক্ষম এখন উড়তে চাওয়া স্বৈরশাসকদের। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও রয়েছে স্বৈরশাসকের উত্থান রুখতে৷ চাইলেই ইউরোপে ভোট ডাকাতি করা সম্ভব নয়। স্বৈরশাসকদের পক্ষে স্তুতি করেও কোন লেখকের পক্ষেও টিকে থাকা কঠিনই। ভয়ানক নিন্দার মুখেই তাকে পড়তে হবে। শুধু ভাল লিখলেই হবে না, লেখকের আরো দায়তো রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে সব লেখক হিটলারের সমর্থক ছিল তাদের নামও এখন কেউ নেয় না। হিটলার-মুসোলিনী-ফ্রাঙ্কোদের প্রতিরোধে যারা নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তারাই সুধীজনের কাছে গ্রহণীয় হয়েছেন। রোমা রোলাঁ, লোরকা, আন্দ্রে মালরো, আনেস্ট হেমিংওয়ে, আঁরি বারব্যুস, আন্দ্রে জিদ, জ্যঁ পল সাত্রে, রেমার্ক, টমাস মান, ব্রেখট, পাবলো নেরুদা, বার্নাড শ, রাসেল, ফস্টারসহ আরো অসংখ্য লেখক মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেই।
পৃথিবীর দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ দেশগুলোতে যখনই কোন স্বৈরশাসক মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তার পক্ষে বহু লেখক-শিল্পীই অবস্থান নেন। যদি কেউ স্বৈরশাসক বা ফ্যাসিবাদী শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সাথে সাথেই তারা বিভিন্ন তুলনা হাজির করে। যেমন ভারতে মোদির বিজেপির হাতে মুসলিম নিপীড়নের কথা বললেই একটা চক্র বখতিয়ার খিলজির সাথে তুলনা দিতে চায়। তারা পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিপীড়নের কথা টেনে এনে, মুসলিম নিপীড়নকে সমর্থন দিতে চায়। অনেকে সম্রাট আকবরকে টেনে আনেন— কিভাবে যোধা বাইকে মুসলিম বানিয়েছিলেন বিয়ে করে। বাংলাদেশে যেমন সুষ্ঠু ভোটের কথা বললে টেনে আনা হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের কথা। এসব কথা যারা বলেন তারা সেই হিটলার-মুসোলিনীর প্রেতাত্মার অনুচরই। এরাও কথিত লেখক/কবি বা বুদ্ধিজীবী। এদের কণ্ঠ উঁচু, হাতে আছে গেস্টাপো, পকেটে আছে অঢেল অর্থ। তাদের কথা শুনতেই হয় আর আমাদের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আছে।
আমাদের নাগরিকগণ নিজের স্বার্থটাও বুঝতে পারেন না। নিজের স্বার্থ বুঝতে পারাও সহজ নয়। অনেকেই টাকা দ্বিগুণ করে দেয়ার লোভ দেখিয়ে লুট করে নেয়। ওই মানুষ একবারও প্রশ্ন করে না, ‘আপনি আমার টাকা দ্বিগুণ করে কিছু চাইছেন, তার চেয়ে আপনার টাকা নিজেই দ্বিগুণ করে নিন না কেন?’ পীরগণ মুরিদদের পুরসিরাত পার করার কথা বলে, কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। মুরিদরা একবারও প্রশ্ন করে না, ‘হুজুর কোরআনে লেখা আছে ধর্ম প্রচারের বিনিময় গ্রহণ করা হারাম’। এখনো চিকিৎসার জন্য অনেকে ধর্মব্যবসায়ীদের দারস্ত হন। কেন এগুলো থামানো যায় না? আমাদের মানুষ অতটা বুঝে উঠতে পারে না। ফলে তারা অন্ধ বিশ্বাস করে ঠকতেই থাকে। অন্ধ বিশ্বাসে ভরসা করতে সুশিক্ষা লাগে না। আমাদের রাজনীতিবিদরাও বিষয়টা বুঝেন। তারা জানেন আমাদের অনেক মানুষই এখনো কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, শিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের উপর ভরসা করে। তারা যা বলবে তাই মেনে নিবে। এজন্যই তাদের জন্য একটু উচ্ছিষ্টর ব্যবস্থা রাখেন। সেই উচ্ছিষ্ট খেয়েই লেখকরা আমাদের দাসে পরিণত করতে চান। কিন্তু আমরাও ‘নো পাসারান’ বলা শিখেছি। আমরা বলতে পারি, ‘তোমরাই দাসে পরিণত হয়েছ, দাস থাকো, অন্যদের দাসে পরিণত করতে চেও না।’
কলমে- মুজিব রহমান