সদ্য বিদায়ী ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে ৯ হাজার ৯৫১ জন নিহত হয়েছেন। যা বিগত ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। দুর্ঘটনার সংখ্যার দিক থেকে গত আট বছরের মধ্যে ভয়াবহ ছিল এ বছরটি।
সোমবার (২ জানুয়ারি) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত “বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন-২০২২ প্রকাশ” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, ২০২২ সালে সড়ক, রেল, নৌ-পথে সর্বমোট ৭ হাজার ৬১৭টি সম্মিলিত যানবাহন দুর্ঘটনায় ১০ হাজার ৮৫৮ জন নিহত এবং ১২ হাজার ৮৭৫ জন আহত হয়েছে।
এর মধ্যে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জন নিহত ও ১২ হাজার ৩৫৬ জন আহত হয়েছে। একই সময় রেলপথে ৬০৬টি দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত ও ২০১ জন আহত হয়েছে। নৌ-পথে ২৬২টি দুর্ঘটনায় ৩৫৭ জন নিহত ও ৩১৮ জন আহত হওয়ার পাশাপাশি ৭৪৩ জন নিখোঁজ হয়েছে।
দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক ও অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সড়ক, রেল ও নৌ-পথে দুর্ঘটনার সংবাদ মনিটরিং করে প্রতি বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে সড়কে দুর্ঘটনা ১৯.৮৯% ও প্রাণহানি ২৭.৪৩% বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত ৮ বছরে নিবন্ধিত যানবাহনের পাশাপাশি ছোট যানবাহন বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা ৪ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি ইজিবাইক, মোটরসাইকেল ও ত্রি-হুইলার সরকারী আদেশ অমান্য করে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে অবাধে চলাচলের কারণে বিগত ৮ বছরের মধ্যে বিদায়ী ২০২২ সালে সড়কে সর্বোচ্চ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, ২০২২ সালের মধ্যে ১৫ জুলাই সড়ক দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি সংগঠিত হয়েছে। ওইদিন ৩৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ জন নিহত ও ৯৭ জন আহত হয়েছে। সবচেয়ে কম সড়ক দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে ৬ সেপ্টেম্বর, ওইদিন ৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১২ জন নিহত ও ১৩ জন আহত হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় একদিনে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে ২৯ জুলাই, ওই দিন ২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪ জন নিহত ও ৮৩ জন আহত হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছে ১১ জুলাই, ওইদিন ২৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৭ জন নিহত ও ১২৪ জন আহত হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ মতে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বেপরোয়া গতি, বিপদজনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অবাধে চলাচল, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা, চালকের বেপরোয়া মনোভাব, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, ছোট যানবাহনের ব্যাপক বৃদ্ধি, সড়কে চাঁদাবাজি, রাস্তার পাশে হাট-বাজার, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন রাস্তায় নামানো, মালিকের অতিরিক্ত মুনাফার মানসিকতা, চালকের নিয়োগ ও কর্মঘণ্টা সুনির্দিষ্ট না থাকা, দেশব্যাপী নিরাপদ ও আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থার পরিবর্তে টুকটুকি ইজিবাইক-ব্যাটারিচালিত রিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা নির্ভর গণপরিবহন ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়াকে উল্লেখ করা হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সংগঠনটির পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। সেগুলো হলো- সড়ক নিরাপত্তায় বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করা, আইনের ত্রুটি চিহ্নিত করে সংস্কারপূর্বক ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ ও বিধিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা, সড়ক নিরাপত্তায় বাজেট বরাদ্ধ বাড়ানো, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে আলাদা সড়ক নিরাপত্তা ইউনিট গঠন করা, সড়ক নিরাপত্তায় ইতোমধ্যে প্রণীত যাবতীয় সুপারিশমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া, দেশের সড়ক-মহাসড়কে রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা ও জেব্রা ক্রসিং অংকন করা, গণপরিবহন চালকদের পেশাদার ট্রেনিং ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা, সড়ক পরিবহন সেক্টরে অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা, গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার পদ্ধতি উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ন করা, সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠনপূর্বক হতাহতদের দ্রুত উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, দেশব্যাপী চাহিদানুযায়ী পর্যাপ্ত মানসম্মত নতুন গণপরিবহন নামানোর উদ্যোগ নেওয়া, ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেনিং একাডেমী গড়ে তোলা, গণপরিবহনে সেবা ও নিরাপত্তার মান পর্যবেক্ষণের জন্য মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, সচিব, জেলা প্রশাসকদের প্রতিমাসে একদিন পরিচয় গোপন রেখে গণপরিবহন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সহ-সভাপতি তাওহিদুল হক লিটন, গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ আবদুল হক প্রমুখ।