সমাজতত্ত্বের আলোচনায় ‛নারীবাদী আন্দোলনের’ পর্যালোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নারীবাদ হল একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি(Sociological Perspective)। সমাজতত্ত্বের এই দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করে নারীবাদী আন্দোলনকে বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। এখন আমাদের জানা প্রয়োজন ‛নারীবাদী আন্দোলন’ বা ‛নারী আন্দোলন’ আসলে কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা নীরা দেশাই এর কথা বলতে পারি। তাঁর মতে, মহিলাদের স্বাধীনতা ও সাম্যের সাধারণ লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার উদ্দেশ্যে সংগঠিত উদ্যোগই হল নারী আন্দোলন(Women Movement)। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে নারীর অধিকার রক্ষাকে কেন্দ্র করে ভারতে নারীবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়ে থাকে। মূলত ব্রিটিশদের সময় থেকেই ভারতে নারী আন্দোলনের ছবি লক্ষ্য করা গেছে। বিভিন্ন লেখনী থেকে জানা যায় যে, পূর্বে নারীদের জীবন ছিল খুবই যন্ত্রনাময়। তারা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অধিকার থেকে সর্বদা বঞ্চিত হতো। তারা সর্বদা উৎপীড়িত ও নিপীড়িত ও ধর্মীয় সংস্কারের বলি হতেন। তারা এই দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পেতে এবং অধিকারের সমানতা বুঝে নিতে শেষপর্যন্ত নারী আন্দোলনের সূচনা করেন।
ভারতীয় নারী আন্দোলনের সূত্র খুঁজতে গেলে ভারতীয় নবজাগরণ বা রেনেসাঁসকেই সূত্রপাত হিসেবে দেখতে হবে। যাইহোক, ভারতে যে নারী আন্দোলন গুলি লক্ষ্য করা যায় তাহল- তেভাগা আন্দোলন(১৯৪৬-৪৭), খাদ্য আন্দোলন(১৯৬০), নকশাল আন্দোলন(১৯৬৯-৭০), জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলন, মহারাষ্ট্রে মদ্যপান বিরোধী আন্দোলন(১৯৭২), চিপকো আন্দোলন(১৯৭৪), নারী ভোটাধিকারের আন্দোলন(১৯১৭) প্রভৃতি। নারী আন্দোলনের জন্য যেসকল নারী আন্দোলনের সংগঠন গড়ে উঠে সেগুলি হল- সখি সমিতি(১৮৮৫), ভারত স্ত্রী মহামন্ডল(১৯১০), ভারত মহিলা পরিষদ(১৯০৪), YWCA(১৯৩৭), NFTW(১৯৫৪), SEWA(১৯৭২), স্ত্রী সংঘ(১৯৭৯) প্রভৃতি। নারী আন্দোলন বা নারীবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে যাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য তাঁরা হলেন- ঝাঁসি রানী লক্ষ্মীবাঈ, সরোজিনী নাইডু, রমাবাঈ, বেগম রোকেয়া, ইলা মিত্র, এলা ভাট, লীলা নাগ, মীরা বেহন ও সরলা বেহন, চারুলতা ঘোষ প্রমুখ।
সূচক শব্দ- নারীবাদী আন্দোলন, নবজাগরণ, SEWA, NFTW, YWCA, নারীর অধিকার।
সমাজতত্ত্বের আলোচনায় ‘নারীবাদী আন্দোলন’ বা ‘নারী আন্দোলন’ একটি বহুল চর্চিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভারতে নারীবাদী আন্দোলনের সূচনা হয় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে নারীর অধিকার রক্ষাকে কেন্দ্র করে। ভারতে সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলন হিসাবে এই নারী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। নারী আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যদি লক্ষ্য করা যায় তাহলে দেখা যায়, মূলত ব্রিটিশরাজ ও পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও দর্শনের সূত্রপাতের মধ্য দিয়েই এই ধরনের আন্দোলনের উদ্ভব হয়ে থাকে। ভারতে নারী আন্দোলনের সূত্র খুঁজতে গেলে ভারতীয় নবজাগরণ বা রেনেসাঁসকেই সূত্রপাত হিসেবে দেখতে হবে। ভারতে পিতৃতান্ত্রিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে নারী সংগ্রাম অনেক ধীর গতিতে শুরু হয়। দেখা যায়, অষ্টাদশ শতকে নারীদের নিয়ে যে সমস্ত লেখালেখির কাজগুলি হয়েছে তাতে কোনোভাবেই সক্রিয় নারীবাদী সংগ্রাম বা প্রতিবাদের বর্ণনা প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু এইসময় পুরুষতান্ত্রিকতার বা পুরুষ আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংখ্যায় কম হলেও নারীরা কিছু কিছু সংগ্রামে সামিল হয়েছিলেন। এইপ্রসঙ্গে ভক্তি আন্দোলনের কথা বলা যেতে পারে। অষ্টাদশ শতকের পাশাপাশি যদি নারী আন্দোলনের উনবিংশ শতকের ঘটনাটি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যায়, এই শতকে নারীদের মধ্যে এক অভাবনীয় সচেতনতা ঘটে এবং তারা যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দ্বারা লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত হচ্ছে সে সম্পর্কে এক নারীবাদী পরিচিতি সচেতনতা তৈরি হতে শুরু করে। যদিও এই সচেতনতা এই সময় সম্পূর্ণভাবে নারী আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করেনি।
যাইহোক, ভারতের নারী আন্দোলনকে আমরা তিনটি তরঙ্গের উপর ভিত্তি করে আলোচনা করতে পারি। যথা – ভারতে প্রথম তরঙ্গের নারী আন্দোলনের সূচনা ঘটে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময়। এইসময় স্বাধীনতা সংগ্রামে তথা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারীদের গণ অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়েছিল। দ্বিতীয় তরঙ্গের নারী আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৬০ এর দশকে। এই সময় নারীর রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করেছিল। এবং তৃতীয় তরঙ্গের নারীবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯৭৯ এর দশকে। এই সময় ভারতীয় নারীরা ক্ষমতায়নের জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছিল।
প্রথম তরঙ্গ: প্রাক স্বাধীন ভারতের নারী আন্দোলন:
ভারতের পিতৃতন্ত্রের পাশাপাশি সমাজ সংস্কার, জাতীয় আন্দোলন, ধর্মসংস্কার এমনকি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নানা দাবিকে কেন্দ্র করে ভারতীয় নারীরা আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। প্রাক স্বাধীন ভারতে যেসমস্ত নারী আন্দোলনগুলি সংগঠিত হয়েছিল সেগুলি হল-
সমাজ সংস্কার আন্দোলন ও ভারতীয় নারী:
ভারতে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারীর অবস্থানের উন্নতির জন্য মূলত কিছু পুরুষ এই সমাজসংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। পরবর্তীকালে এই আন্দোলনগুলো তাঁদের স্ত্রী, কন্যা প্রমুখেরা এগিয়ে নিয়ে যান। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বহু বিবাহ, বাল্য বিবাহ, বিধবা বিবাহ, সতীদাহ প্রথার মতো সামাজিক প্রথা গুলির অবসান ঘটানো, জাতপাতে সংস্কার সাধন, নারীদের মর্যাদাগত অবস্থার উন্নতি, ধর্মীয় কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে দূর করা প্রভৃতি। এই সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল কলকাতা। যদিও ধীরে ধীরে এই আন্দোলন বাংলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের পথিকৃৎরা হলেন – রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ। এইসমস্ত সমাজসংস্কারগণরা নারীদের অবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে নানান সংগ্রাম তথা আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। এপ্রসঙ্গে রাজারামমোহন রায়ের কৃতিত্ব হল ১৮২৯ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং এর সহযোগিতায় আইনানুগভাবে (prevention of Sati Act) সতীদাহ প্রথা রদ, ডিরোজিওর নেতৃত্বে Young Bengal গোষ্ঠী নারীশিক্ষা ও নারীর সামাজিক অধিকারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে তত্ত্ববোধিনী সভা নারী শিক্ষার বিষয়টির ওপর মনোনিবেশ করে, বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় আইনানুগভাবে (Widow Remarriage Act) ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন, বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহ রোধ এবং নারীশিক্ষার জন্য বিদ্যালয় নির্মাণ করা প্রভৃতি কর্মকান্ড। এছাড়াও ১৮৭৫ সালে বোম্বেতে দয়ানন্দ সরস্বতী নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন, ধান্দে কেলকার কার্ভে নারী শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় খোলেন এবং বোম্বেতে মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে নারীদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বেশ কিছু পুরুষ সমাজ সংস্কারক ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করতে থাকেন। কিন্তু এই সমাজসংস্কারদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। তবে সমাজের বেশকিছু উচ্চবিত্ত মহিলা এই পুরুষ সংস্কারদের সাথে হাত মিলিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন। এপ্রসঙ্গে রমাবাঈ, সরলাদেবী চৌধুরানী প্রমুখের কথা বলা যায়। রমাবাঈ নারীশিক্ষা, নারী স্বাধীনতা, জাতপাতের ঊর্ধ্বে বিবাহ, বিবাহে নারী সম্মতি প্রভৃতি বিষয়গুলির ওপর জোর দিয়েছিলেন। ১৯১০ সালে সরলাদেবী চৌধুরানী ‛ভারত স্ত্রী মহামন্ডল’ নামে একটি সংগঠন স্থাপন করেন। যা মহিলাদের সর্বভারতীয় সমস্যা নিয়ে কাজ করবে। এছাড়াও ১৯২০ এর দশকে মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত All India Women’s Conference (AIWC), Women’s Indian Association (WIA) ইত্যাদির মতো সংগঠন গড়ে ওঠে। যা সমভোটাধিকার এবং আইন সভায় মহিলাদের প্রতিনিধিত্বের মতো রাজনৈতিক দাবী প্রভৃতি বিষয়গুলির ওপর কাজ করে। Jana Matson Everett পাঁচটি উপাদানকে চিহ্নিত করেছেন যেগুলি ভারতের সংস্কারবাদী নারী আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছে। এগুলি হল – (১) ক্রমোচ্চশীল জাতব্যবস্থা, (২) হিন্দু ধর্ম, (৩) যৌথ পরিবার ব্যবস্থা, (৪) মুসলিম শাসন, (৫) ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ।৩ যাইহোক ভারতের সংস্কার আন্দোলনে পুরুষের পাশাপাশি মহিলাদের ভূমিকাও অনস্বীকার্য ছিল।
ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী:
পাশ্চাত্য বুর্জোয়া দর্শন ভারতে প্রাথমিকভাবে জাতীয়তাবাদী চিন্তা ও আলোকপ্রাপ্তির যুগের সূচনা করেছিল। ১৮৮৫ সালে ভারতে জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হয়। এই জাতীয় কংগ্রেসে উচ্চবিত্ত মহিলারা মূলত যোগদান করেছিল। এপ্রসঙ্গে কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, স্বর্ণকুমারী ঘোষাল, রমাবাঈ প্রমুখদের কথা বলা হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফলে যে সংগ্রাম ও আন্দোলন হয়েছিল তাতে প্রথম থেকেই নারীরা বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এছাড়াও স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনেও নারীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। এপ্রসঙ্গে ভগিনী নিবেদিতা, সরলা দেবী, ভিকাজি রুস্তম, কে.আর.কামা প্রমুখদের কথা বলা হয়ে থাকে। ১৯০৭ সালে যিনি সর্বভারতীয় রাজনীতির প্রথম সারিতে উঠে আসেন এবং হোমরুল আন্দোলন শুরু করেন, তিনি হলেন অ্যানি বেসান্ত। বিভিন্ন তাত্ত্বিকরা মতপ্রকাশ করেন যে, স্বাধীনতা আন্দোলন নারীদের মুক্তি সংগ্রামে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেছে।কারণ নারীবাদ ও জাতীয়তাবাদ গভীর ভাবে সংযুক্ত।সুভাষচন্দ্র বসুও মহিলাদের নিয়ে ‘মহিলা রাষ্ট্রীয় সংঘ’ গঠন করেছিলেন যেটি স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশনিয়েছিল।এ প্রসঙ্গে Aparna Basu এবং Pravin Sheth এর কথা বলা যায়। তাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামে গুজরাটের মহিলাদের ভূমিকাকে তুলে ধরেছেন। Sarojini Shintri এবং Raghavendra Rao কর্ণাটকের মহিলাদের ভূমিকা নিয়ে বিশেষভাবে আন্দোলন করেছেন। Uma Rao এবং Meera Devi উত্তরপ্রদেশের মহিলাদের অবদানকে তুলে ধরেছেন ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে।
এ সম্পর্কে Rajani Alexander বলেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে মহিলাদের ভূমিকা ছিল বৈচিত্র্যপূর্ন। তিনি এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “Women’s participation in the Independence Movement took diverse forms and was not always organised and orchestrated political protests for example , especially in western India , in Maharashtra and Gujrat , the Prabhat Pheri was used during the freedom struggle – as a medium for rousing patriotic fervor. All over India , countless women provided food and shelter for fugitives and underground activists , visited political prisoners- relatives and strangers – during their long terms , and in myriad ways dealt with the introduction of new and external stimuli into a domain normally insulated from all those , the home . Much of women’s involvement in the Independence Movement was of this nature- based on community and home.”
যাইহোক ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে মহিলারা নানাভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।মহিলারা রাজনৈতিক প্রতিবাদ থেকে শুরু করে স্বদেশী গান গাওয়া,বিদেশী দোকানের সামনে পিকেটিং করা, বিপ্লবীদের প্রয়োজনীয় খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যাবস্থাও করে দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় তরঙ্গ: ভারতের স্বাধীনতার পরবর্তীকালের নারী আন্দোলন:
ভারতের স্বাধীনতার পূর্বে এবং স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে নারী আন্দোলনের যে চিত্র দেখতে পাই তাতে একথা স্পষ্ট যে, দুই আন্দলনের মধ্যে এক বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। স্বাধীনতার পূর্বে নারী আন্দোলন ছিল মূলত সংস্কার মূলক প্রকৃতির এবং তাতে পুরুষের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের চিত্র যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যায়, এই সময় ভারতীয় মহিলারা সমাজে লিঙ্গগত শ্রমবিভাজন এবং নিপীড়ন মূলক পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানায় ও লিঙ্গ সাম্য প্রতিষ্ঠার দাবি করে। স্বাধীন ভারতে নারীদের প্রথম ও প্রধান দাবি ছিল সম্পত্তির ক্ষেত্রে সমানাধিকার। এছাড়াও চাকরির নিরাপত্তা প্রদান, জনসংখ্যা নীতির পরিবর্তন, মজুরির বৈষম্য হ্রাস, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ বন্ধ করা, মদ্য পান বন্ধ করা প্রভৃতি দাবিকে কেন্দ্র করে ভারতীয় নারীরা আন্দোলনে সামিল হন।
স্বাধীন ভারতে নারী আন্দোলনে যে বিষয়টির অবদান অনস্বীকার্য সেটি হল- ‘ভারতীয় সংবিধান’। স্বাধীন ভারতের সংবিধানে সমাজ জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের বৈষম্য দূর করার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ নং ধারায় এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে Veena Majumder বলেছেন, “The Constitution’s radical departure from inherited social values represented to women of that generation its greatest intrinsic quality . For the women ….. with definite memories of pre – independence society and of the freedom struggle , the acceptance of gender equality in the constitution was the fulfillment of a dream of women’s entitlement to an independent identity.”
নারী আন্দোলনে ‘Hindu Code Bill ‘ এর ভূমিকাও ছিল অনস্বীকার্য। Hindu Code Bill এর আওতায় চারটি স্বতন্ত্র আইন ১৯৫৫-৫৬ সালে পাশ হয়। এই আইন গুলি নারী আন্দোলনে যথেষ্ট অবদানও জুগিয়েছিল। এই আইন গুলি হল- হিন্দু বিবাহ আইন (Hindu Marriage Act), হিন্দু উত্তরাধিকার আইন (Hindu Succession Act), হিন্দু সংখ্যালঘু ও অভিভাবকত্ব আইন (Hindu Minority and Guardianship Act), এবং হিন্দু দত্তক ও খোরপোশ আইন (Hindu Adoption and Mainteance Act)। নারী আন্দোলনের একটি বড় প্রাপ্তি হিসাবে এই Hindu Code Bill কে দেখা হয়।
নারী আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল SEWA (Self Employed Womens)। ১৯৭২ সালে বয়ন শিল্পের ক্ষেত্রে গান্ধীবাদী সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ওপর ভিত্তি করে প্রথম শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে উঠেছিল। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা এলা ভাট পরবর্তীকালে নিপীড়িত অত্যাচারিত নারীদের নিয়ে আমেদাবাদে SEWA গড়ে তোলেন। এই সংগঠনটি নারীদের কাজের পরিবেশের উন্নয়নের পাশাপাশি তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ, আইনি পরামর্শ ও সাহায্য প্রদান, সাক্ষরতার প্রসার ঘটানোর মতো কর্মসূচিগুলিও পরিচালনা করত। নারী আন্দোলন গুলিকে সংগঠিত ও পরিচালনা করার কাজে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠন গুলি। যথা:- শ্রমিক মহিলা সংগঠন, মহিলা প্রগতিশীল সংগঠন, মহিলা সমতা সৈনিক দল প্রভৃতি।
১৯৮০ এর দশকে আবার নারী আন্দোলনের তিনটি ধারা লক্ষ্য করা যায়। এগুলি হল – উদারপন্থী (Liberal), বামপন্থী (Leftist) এবং বৈপ্লবিক (Radical)। উদারপন্থীরা গুরুত্ব দেয় আইনী সংস্কারের ওপর, বামপন্থীরা গুরুত্ব দেন সমাজ পরিবর্তনের ওপর এবং বৈপ্লবিক নারীবাদীরা গুরুত্ব দেয় পুরুষত্ব (Masculinity) এবং নারীত্ব (Femininity) ইত্যাদির ওপর। এছাড়াও আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলন এবং ১৯৯০ এ বেজিং শহরে অনুষ্ঠিত নারী সম্মেলন ভারতে নারীবাদী আন্দোলনকে প্রভূত মাত্রায় প্রভাবিত করে।
তৃতীয় তরঙ্গ: ভারতে সাম্প্রতিকালের নারী আন্দোলন:
ভারতে সাম্প্রতিককালের নারী আন্দোলন গুলিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এই আন্দোলন গুলিতে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাভাবনা, ক্রিয়াকলাপ ও মতাদর্শের সংমিশ্রণ ঘটেছে। ১৯৭৫ সালটিকে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ‛Year of Women’ হিসাবে ঘোষণা করার পর থেকেই এই ধরনের আন্দোলনগুলির সূচনা ঘটে।৭ এইসময় যে সংগঠন গুলি ভারতীয় নারী আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিল সেগুলি হল – Progressive Organization of Women (POW), Womens Liberation Organization ইত্যাদি। যেসমস্ত দাবী গুলিকে কেন্দ্র করে এই সাম্প্রতিক কালের নারী আন্দোলনগুলি সংগঠিত হয়েছিল বা হয়ে চলছে সেগুলি হল – পণ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন, মদ্যপান বিরোধী আন্দোলন, চিপকো আন্দোলন এবং নারীদের সমস্যাভিত্তিক নারী আন্দোলন ইত্যাদি। এই আন্দোলনগুলিকে নারীরা অনেক ক্ষেত্রে পুরানো পদ্ধতিতে পরিচালনা করেছেন আবার অনেক ক্ষেত্রে বর্তমান প্রযুক্তিকে (ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, টুইটার প্রভৃতি) কাজে লাগিয়ে আন্দোলনকে পরিচালনা করেছেন বা করে চলেছেন।
যাইহোক ভারতের বিভিন্ন আন্দোলন গুলি নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে প্রতিটি আন্দোলনেই নারীদের কম বেশি ভূমিকা রয়েছে। Gail Omvedt মন্তব্য করেন যে, স্বাধীনতা আন্দোলন , কৃষক আন্দোলন , উপজাতি আন্দোলন , ছাত্র আন্দোলনের মতো সামাজিক আন্দোলনগুলি নারীশক্তির বিকাশে সহায়ক হয়েছিল এবং নারীদের সমস্যাগুলিকে জনসম্মুখে আনতে নারী আন্দোলন বিকাশের একটা রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিল। Omvedt তাই বলেছেন , ” They reveal the power of women as a force in society , they allow women opportunity to begin to bring forward their own needs , and they are often part of a process leading to the development of women’s movements as such.”
এছাড়াও নারীদের সংগঠিত ও সচেতন করে আন্দোলন পরিচালনার জন্য অসংখ্য নারীবাদী সংগঠন গড়ে উঠেছে। এই সংগঠন গুলি আবার দুই ভাগে বিভক্ত। কোনো কোনো সংগঠন রাজনৈতিক দলের সমর্থনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে আবার কোনো কোনো সংগঠন রাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়াই তাদের কাজকর্ম গুলোকে পরিচালনা করছে। তাই বলা যায়, প্রত্যেকটি নারীবাদী সংগঠনের মতাদর্শ, দাবি ও ক্রিয়াকলাপ এর মধ্যে বৈচিত্র্যতা রয়েছে। এপ্রসঙ্গে Supriya Akerkar বলেছেন, “women movements can be treated as ‘descursive practices’- redefine the traditional understandings of theory and praxis . They do not depend for their existence on prior theories of emancipation , but rather seek a new relation with theory through localized articulation and understandings of emancipation.”
উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে সর্বোপরি বলা যায় , ভারতে নারী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্যসূত্র:
১)চ্যাটার্জী, ড.শুভ্রজিৎ (২০২১); ‘সমাজতত্ত্ব:লিঙ্গ, যৌনতা ও নারী’,লেভান্ত বুকস, কলকাতা, পৃষ্ঠা- ১৯৯-২০০।
২)বসু, রাজশ্রী এবং চক্রবর্তী, বাসবী সম্পাদিত (২০১৬); ‘প্রসঙ্গ:মানবীবিদ্যা’ , রায় মুখার্জী, সঞ্চারী , ‘নারীবাদী আন্দোল’, উর্বী প্রকশন, কলকাতা, পৃষ্ঠা-৮
৪৩)চ্যাটার্জী, ড.শুভ্রজিৎ (২০২১); ‘সমাজতত্ত্ব:লিঙ্গ, যৌনতা ও নারী’,লেভান্ত বুকস, কলকাতা, পৃষ্ঠা- ২০৩
৪)তদেব, পৃষ্ঠা- ২০৫।
৫) তদেব, পৃষ্ঠা- ২০৫
৬) তদেব, পৃষ্ঠা- ২০৬
৭) তদেব, পৃষ্ঠা- ২০৮
৮) তদেব, পৃষ্ঠা- ২১৪
৯) তদেব , পৃষ্ঠা- ২২১
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী:
বাংলা:
১) দে, পার্থসারথি (২০১১); সমাজতত্ত্বের ইতিবৃত্ত, পিয়ারসন, দিল্লী।
২) মহাপাত্র, অনাদিকুমার(২০১৫); সমকালীন সমাজতত্ত্ব,সুহৃদ পাবলিকেশন, কলকাতা।
৩) মহাপাত্র, অনাদিকুমার(২০১৫); বিষয় সমাজতত্ত্ব প্রত্যয় ও প্রতিষ্ঠান,সুহৃদ পাবলিকেশন, কলকাতা।
৪) মহাপাত্র, অনাদিকুমার(২০১৬); ভারতীয় সমাজব্যবস্থা, সুহৃদ পাবলিকেশন, কলকাতা।
৫) বসু,রাজশ্রী (২০১৪); নারীবাদ,পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ,কলকাতা
৬) গাঙ্গুলী, রামানুজ ও মইনুদ্দিন, সৈয়দ আব্দুল হাফিজ (২০১৬) ; সমকালীন ভারতীয় সমাজ, পি.এইচ.আই.লানিং প্রাইভেট লিমিটেড, নিউ দিল্লী।
৭) রায়,মনিকা দত্ত, এবং দে, অপর্ণা সম্পাদিত (২০১৬); আইনে নারীর অধিকার, ত্রিপুরা মহিলা কমিশন, আগরতলা, ত্রিপুরা।
ইংরেজি:
1. Asthana,Pratima (1974); ‘Women’s Movement In India’, Vikas Publishing House, Uttar pradesh.
2. Kumar,Radha(1994); ‘The History of Doing’ , Vesro Publication, London, Newyork city.
3. Ramaswamy, B (2013); ‘Women’s Movement in India’, Isha Books, Delhi.