বৃক্ষজগতের এক অপরূপ বিস্ময় নাগলিঙ্গম। বহুকাল আগে, প্রথম দৃষ্টিতে একে দেখেই আমার মনে প্রশ্ন উদয় হয়েছে, কোনো জাগতিক গাছ কি এমন হতে পারে? অজস্র ফুল, ফল আর লতানো পুষ্পমঞ্জরি দেখে মনে হয়, গাছ বেষ্টন করে যেন আঁকা হয়েছে অদ্ভুত সব আলপনা।
মূলত দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন অরণ্যের আদিবাসী হলেও পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে নাগলিঙ্গম গাছ। এর ফুল-ফল-পাতার সৌন্দর্যের কারণে আধুনিক ভূদৃশ্যে এর উপস্থিতি লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে চলেছে। তবে এর নাম এবং স্বভাব নিয়ে আমাদের মনে সবসময়েই কিছু না কিছু বিভ্রান্তি বিরাজ করে। কেউ কেউ মনে করেন, এই গাছ ভারতবর্ষ থেকে উদ্ভূত, অনেক আগে থেকেই আছে, যার কোনো জোরালো যুক্তি পাওয়া যায় না।
নাগলিঙ্গমের বৈজ্ঞানিক নাম কুরুপিতা গিয়ানেনসিস (Couroupita guianensis Aubl.)। কুরুপিতা ও গিয়ানেনসিস দুটো গ্রিক শব্দই এসেছে ‘ফ্রেঞ্চ গাইয়ানা’ থেকে যে দেশের অবস্থান উত্তর আমেরিকার উত্তরভাগে, ব্রাজিলের সীমান্তে। ফরাসি উদ্ভিদবিদ Aublet ১৭৭৫ সালে এর নামকরণ করেন। গাছটি লেসিথিডেসিয়ি (Lecythidaceye) বা ব্রাজিল নাট পরিবারের অন্তর্গত। গ্রিক শব্দ ‘লেকিথস’ থেকে এর উৎপত্তি যার অর্থ সরু-গলা পাত্র। নাগলিঙ্গমের খোল থেকে আমাজন এলাকায় এই পাত্র তৈরি হয় যা পানপাত্র হিসাবেও ব্যবহার করে আদিবাসীরা।
আমাদের দেশে এই পরিবারের আরো দুটি পরিচিত গাছ দেখা যায়, হিজল (Barringtonia acutangula) এবং গুস্তাভিয়া বা দাদরা গাছ (Gustavia augusta)। এদের ফুল ও ফুলের ছড় পরখ করে দেখলে কিছুটা সাদৃশ্য অনুমান করা যায়। কুরুপিতা গণের আরো দুটি গাছ ‘কুরুপিতা নিকারাগুয়ারেনসিস’ এবং ‘কুরুপিতা সেসিলিস’। তিনটি গাছেরই ফল প্রায় একই রকম, কামানের গোলা বা Cannon ball-এর মতো যে-কারণে তিনটি গাছই ক্যাননবল নামে অভিহিত। প্রায় ১৫ সিন্টিমিটার ব্যাসের নাগলিঙ্গমের ভারী ফল বছর ধরে গাছে ঝুলে থেকে যা ভক্ষণযোগ্য নয়। পুষ্ট ফল ভূপাতিত হলে ভূমি থেকে এই ফল ইঁদুর-জাতীয় প্রাণি ভক্ষণ করে বীজ বিসরণ ঘটায়।
নাগলিঙ্গম শব্দ শুনে মনে হয় এটা বাংলা ও সংস্কৃতের একটি শ্রুতিমধুর সঙ্কর যা আমরা আত্তীকরণ করেছি পরিবর্তন না করেই। নাগ শব্দের অর্থ সাপ কিন্তু এর আরেক অর্থ হাতি। নাগলিঙ্গম ফুলের পুংকেশরের যে বাঁকানো ‘হুড’ থাকে তাকে নাগের ফণা বা হাতির শুঁড় দুটোই ধরা যেতে পারে। বাঙ্গলাদেশে নামের সঙ্গে মিল দিয়ে আমরা একে নাগের ফণাই কল্পনা করে থাকি। নাগলিঙ্গমকে ভারতে শিবলিঙ্গমও বলা হয়। এই ফুল দিয়ে শিবঠাকুরের পুজো হয়। শিবমন্দিরের প্রাঙ্গণে এদের প্রায়শই দেখা যায়। বাংলাদেশে এই গাছ খুবই কম। যাহোক, মন্দিরের প্রাঙ্গণে এই সুন্দর গাছটির রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে, এটা বৃক্ষ জগতের জন্য সুসংবাদ। কিন্তু নাগের সঙ্গে লিঙ্গ শব্দ যুক্ত হলো কী করে! সর্প-লিঙ্গ আদৌ চাক্ষুস নয়। সাপ পুরুষ না স্ত্রী তা নির্ণয় করার জন্য অনেকক্ষেত্রেই বিজ্ঞানীদের প্রোব (Probe) ব্যবহার করতে হয়। প্রাচীন বাংলা অভিধান, যেমন ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ লিঙ্গ শব্দের অর্থ সদৃশ, সূচক, প্রকৃতি ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে। তাই নাগ-সদৃশ বলে নাগলিঙ্গম শদের উৎপত্তিকে যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়।
নাম-বিভ্রাট ঘোচাতে গিয়ে আমাদের ছোটো প্রবন্ধের জন্য নির্দ্ধারিত অনেকখানি জমিন পার হয়ে গেল অথচ বাকি রয়ে গেছে অনেক কথাই। এ প্রসঙ্গে একটি মজার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। ছোটোবেলায় বেশ অভিভূত হয়ে দেখতাম বাষ্প-ইঞ্জিন চালিত রেলগাড়ি। কয়লার আগুন দিয়ে বয়লারে প্রস্তুত বাষ্প-চাপ দিয়ে রেলগাড়ির চাকা ঘুরতো। আবার একই বাষ্প দিয়ে হুইসেলও বাজানো হতো। রশি ধরে টান দিলে নির্গত বাষ্পের সাথে বেশ হাস্কি-সুন্দর একটা কু-কু আওয়াজ বের হতো হুইসেল-যন্ত্র থেকে। বাংলা ক্লাসে রচনা লেখার সময় পার হয়ে যাচ্ছে অথচ কিছুই তেমন লিখিনি আমি, দুষ্টামিতে সময় চলে গেছে। স্যার টের পেয়ে কাছে এসে খাতা দেখে বললেন, ‘ওহে, হুইসেল দিতেই যদি সব বাষ্প বের হয়ে যায় তবে গাড়িটা চলবে কীভাবে!’
প্রকৃতিতে অধিকাংশ গাছের ফুল-ফল হয় ডালের আগায় কিন্তু নাগলিঙ্গম গাছের হয় গাছের গায়ে যেমনটা দেখা যায় কাঁঠাল, ডুমুর, চালমুগরা, কোকো, জাবুতিকাবা প্রভৃতি গাছে। এরা কলিফ্লোরি-জাতীয় (Cauliflory) গাছ যার ইংরেজি অর্থ ‘stem and flower’। বৃষ্টিবনে এ জাতীয় গাছ পরাগায়ন ও বীজ বিসরণের জন্য অনেকটাই নির্ভর করে ইঁদুর, বাদুড়, কাঠবিড়ালী ইত্যাদি প্রাণিদের উপর যারা সহজেই গাছের কাণ্ডে চলাচল ও অবস্থান করতে পারে। লেসিথিডেসিয়ি পরিবারের বৃক্ষসমূহ আমাজন অরণ্যেই বেশি বাস করে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা ৩ লক্ষ গাছের জরিপ থেকে বুঝেছেন ওই অরণ্যে এদের আধিক্য তৃতীয় অবস্থানে।
বিখ্যাত ‘ব্রাজিল-নাট’ (Bertholetia excelsa) গাছও লেসিথিডেসিয়ি পরিবারের সদস্য। এর বাদাম বা ‘নাট’ হাজার হাজার টন উৎপন্ন হলেও আঞ্চলিক চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হয় মাত্র ২৫ শতাংশ। ব্রাজিল নাটের গাছ খুব উঁচু হয়। বৃষ্টিবনে ক্যানপি লেয়ারের উপর দিয়ে এদের ১৬০ ফুট উঁচু গলা বাড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তবে ব্রাজিল-নাট সংগ্রহের জন্য গাছে না চড়লেও চলে। নাটগুলো গাছে অন্তত বছরখানেক থাকে তারপর পুষ্ট হলে মাটিতে পড়ে। মাটি-জল-কাদায় প্রোথিত এই ময়লা রঙের নাট সংগ্রহ করে প্রসেসিং-এর জন্য পাঠানো হয় ফ্যাক্টরিতে যেখান থেকে এগুলো ফিরে আসে আকর্ষণীয় কমার্শিয়াল মোড়কে। মুখরোচক নাট হিসাবে খাওয়া ছাড়াও ব্রাজিল নাটের গুঁড়ো দিয়ে আটা তৈরি হয়। গরুর দুধ আর সয়া-দুধের বিকল্প হিসাবেও ব্যবহার করা হয় একে। নানা খাবারে কোকো-মিল্কের মতোই এর ব্যবহার চলে আসছে বহুকাল ধরে। ব্রাজিল নাট, ঢাকা বা কলকাতার বাজারেও পাওয়া যায় যা কাজু বাদামের মতোই প্যাকেট করা থাকে ২০০ গ্রামের, মূল্য হতে পারে ৬৫০ টাকা। এই দামটা আখরোটের কাছাকাছি। তবে ‘পাইন নাট’ বা চিলগোজার দামই বোধ হয় নাটদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, যা কাজু বাদামের কমপক্ষে ৪ গুণ।
নিউট্রিশনে ভরপুর এই ব্রাজিল-বাদাম। এর ভেতরে প্রোটিন, ডায়েটারি ফাইবার, থায়েমিন, কপার, ম্যাগ্নেসিয়াম ছাড়াও থাকে মস্তিষ্কের জন্য একটি জরুরি উপাদান সেলেনিয়াম। এর অভাবে ইনফার্টিলিটি, দুর্বলতা ও অবসাদ দেখা দেয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। কিন্তু সঠিক পরিমাণে না খেলে তা আবার শরীরে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে। একটি ব্রাজিল নাটের ভেতর সেলেনিয়ামের পরিমাণ থাকে প্রায় ৯০ মাইকোগ্রাম (১ Mcg = এক মিলিগ্রামের হাজারভাগের একভাগ) আর আমাদের দেহের প্রাত্যহিক চাহিদা হলো ৫৫ মাইক্রোগ্রাম। অতএব মানবদেহের জন্য মাত্র একটি ব্রাজিল নাটই যথেষ্ট হতে পারে। কাজু বাদামও বেশি খাওয়াটা ঠিক নয় কারণ তাতেও সেলেনিয়াম ও অন্যান্য উপাদান থাকে যা পরিমাণের অতিরিক্ত খেলে বিপদ হতে পারে। অতি উপকারী জেনেও যে কোনো নাট-ই হিসাব করে, পরিমাণ মতো খেলে ভালো। অনেকটা ভেবেচিন্তে, আমি কখনো দিনে একটির বেশি ব্রাজিল নাট, এবং ৫-৬টির বেশি কাজু বাদাম খাই না।
পৃথিবীর নানা দেশে নাগলিঙ্গম গাছের পাতা-ফুল-ফল-কাণ্ড-শেকড় সবই ব্যবহৃত হয়ে আসছে প্র্থাগত সনাতন চিকিৎসায়। ভারতবর্ষে এর ব্যবহার হয়েছে চর্মরোগ, আমাশয়, অন্ত্ররোগ, ঠান্ডা, অর্শ ইত্যাদি রোগে। নাগলিঙ্গমের ফুলের ছড় কখনো প্রায় এক গজের মতো লম্বা হয়। এর সঙ্গে ফুলগুলো ঝাড়ের মতো ঝুলে থাকে। ৪-৫ ইঞ্চি চওড়া রাশিরাশি সুগন্ধি ফুল একদিনের বেশি গাছে থাকে না বলে গাছতলায় এই ফুল বিছিয়ে থাকে এবং মনোহর দৃশ্যের অবতারণা করে। আমাদের দেশে ভ্রমর, মৌমাছি ও বাদুড় সাধারণত এর ফুলে পরাগায়ন ঘটায়। নাগলিঙ্গম ফুলে মধু হয় না, তবে পরাগায়নকারীরা পরাগরেণু সংগ্রহের জন্য আসে। প্রজ ও অপ্রজ পুংকেশর থেকে পরাগ সংগ্রহের সময় এদের শরীরে যে প্রজ-পরাগ লেগে যায় তা অন্যগাছের ফুলে পরাগায়ন করে। তবে স্বপরাগায়নও হয়ে থাকে নাগলিঙ্গম ফুলে যাতে কোনোক্রমে বংশ রক্ষা হয় কিন্তু জীববৈচিত্র্য বজায় থাকে না।