এক
অফিস থেকে বেরিয়ে বৌবাজারের জানাশোনা ফলের দোকানে যাওয়ার জন্য সরাসরি হাড়কাটা গলির রাস্তাটা ধরল যতীন। কাল, রবিবার নতুন ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশ, তাই পুজোর জন্যে কিছু ফল, মিষ্টি নিয়ে ভাড়ার ফ্ল্যাট (কনাই ধর লেন) এ ফিরতে হবে। আবার বউ সুমিতা আর একমাত্র সন্তান জানকে নিয়ে সল্টলেকের আগে, হাডকোর মোড়ে যেতে হবে।
‘কবিদা, ও কবিদা, একটু শোননা প্লিজ…
যতীনের কানে কিছুই ঢোকেনি, মনটাও ব্যস্ত, তাই খুব তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আপনমনেই চলেছে হনহনিয়ে। হঠাৎ একজন পাশ থেকে বলল, ‘দাদা, আপনাকে ঐ পিছন থেকে একটি মেয়ে ডাকছে বলে মুচকি হেসে পাশ কাটাল।
থমকে দাঁড়িয়ে… একে তাড়া, তার ওপর এরকম জায়গায় একটা মেয়ে ডাকছে… ব্যাপারটা মাথাতেই আসছে না। তাও পেছনে মুখ ঘুরিয়ে ইতিউতি চাইতেই নজরে পড়ল, একটা পুরনো দোতলা বাড়ির কোণ থেকে একটা সুন্দরী মেয়ে, হাতছানি দিয়ে বলছে, ‘এই যে কবিদা, আমি এখানে, একটু শোন না প্লিজ…
আশপাশের পথ চলতি লোকজন তো রসের গন্ধ পেয়ে, দুজনের দিকেই তাকিয়ে টিপ্পনী কাটতে-কাটতে এগিয়ে গেল, ‘দাদা, সুন্দরি ডাকছে… যান যান…
এরকম একটা অকওয়ার্ড পোজিশনে পথ-চলতি লোকজনের টিটকিরির শিকার হয়ে ভাববার বা ইতস্তত করবার চেয়ে, মেয়েটির উদ্দেশ্যে কয়েক পা পিছু হাঁটতেই… আরে মেয়েটা তো খুব চেনাচেনা লাগছে… আরও দুপা এগিয়েই মনে পড়ে গেল যতীনের… বঙ্গবাসী কলেজের অপরাজিতা মিত্র, আমার আদরের অপু তো…
অবাক হয়ে, ‘কিরে অপু, তুই এখানে এরকম মলিন পোষাকে? এখানে তুই এলি কি করে! কি এমন হল যে শেষ পর্যন্ত এই অন্ধকার পাঁকে নামতে হল!
যতীনকে চুপ করিয়ে দিয়ে অপু বলল, ‘ প্লিজ কবিদা, তুমি যদি পাঁচটা মিনিট আমার বক্তব্যটা শোন… তোমার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে… আমার সব-কথাই তোমাকে বলব, তুমি ছাড়া এখন তো ভরসা করার মত কেউ নেই, তোমার মত দাদাই পারে বোনের সমস্যার সমাধানে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। কবিদা প্লিজ…
আমারও আজ একটু তাড়া ছিল রে, অনেক কষ্টে হাডকোর মোড়ের কাছে দোতলায়, দু’কামরার একটা ফ্ল্যাট কিনেছি, কাল গৃহপ্রবেশ তাই বাজার করে আবার বউ-মেয়েকে নিয়ে… যাকগে চল, তোর কথাতেই পাঁচটা মিনিট… অপুর পিছনে আধো অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে অপুর ছোট্ট ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসার সঙ্গেসঙ্গে যতীনের পা দুটো জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কান্না অপুর…
আরে পা ছেড়ে উঠে বসে চোখ মুছে বল তো ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে, তুই এখানে কিভাবে এসে পড়লি? তোর মত নম্র, ভদ্র স্বভাবের মেয়ে… তবে কি সংকল্পই এর জন্য দায়ী? নাহ, সেটাও তো হিসেবে মিলছেনা…
অকারণ দেরি হচ্ছে তোমার… আমিই সংক্ষেপে তোমায় বলছি, তোমরা তো সব পাশ করে বেরিয়ে গেলে কিন্তু সংকল্প কেমিষ্ট্রিতে ফার্ষ্টক্লাস সেকেণ্ড হয়ে অনায়াসেই ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে এ্যাডমিশন পেয়ে গেল। পলাশের ওয়েটিং এ নাম ছিল, পরে ও ও এ্যাডমিশন পেয়ে গেল। রোজই ক্লাসের শেষে আমাকে মিট করত সংকল্প, অনেকটা রাস্তা পায়েপায়ে এগিয়ে যেতাম, ওর বাস এলে উঠে পড়ত বাই করে।
আমার পার্ট-টুর এক্সাম হয়ে গেল, কদিন পর সংকল্পরও ফাইনাল পরীক্ষা, ইতিমধ্যেই ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে বেশ ভাল একটা জব পেয়ে গেল ইনফোসিসে, তবে প্রথমে মাসখানেক কলকাতা অফিসে থেকে কাজ বুঝে নিয়ে, ক্যালিফোর্ণিয়ায় একটা প্রজেক্ট নিয়ে বছরখানেক থাকতে হবে। ও দেখলাম সানন্দে রাজি, বলল, ‘ডোন্ট ওরি ডিয়ার, একটু সেটল হলে আমি নিজে এসে তোমায় নিয়ে যাব।‘
ওর যাওয়া ফাইনালাইজেসন হয়ে গেলে শেষ দিনে আমরা চুটিয়ে আড্ডা মারব, মুভি দেখব, খাব, তারপর বাড়ি, সব আগাম প্ল্যান হল।
আমি যথারীতি হাজির হলাম, কিন্তু চোখ ফেটে জল আসছে বারবার, আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে আঁচলটাই ভিজিয়ে ফেলেছি।
সংকল্প বুঝতে পারল, সামথিং রঙ, নিজের রুমাল দিয়ে চোখ মুছিয়ে বললন, ‘নো মোর শেডিং টিয়ার, প্লিজ শেয়ার মি দি ডিটেইলস। ‘
অপরাজিতা শুরু করল, ‘আমার বাবার গ্রসারিটা থেকে লোকজন ধারে মাল নিতে নিতে বাবাকে একেবারে দেউলিয়া করে দিল। বারবার তাগাদা দিয়েও এক পয়সাও উদ্ধার করতে না পেরে, এক ধান্দাবাজ মহাজনকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হল। তারপরে ঐ লোকটার নজরে পড়লাম আমি, আমাকে পাওয়ার আশায় বেশ কিছু ক্যাশ বাবার হাতে গুঁজে দিয়ে- আমাকে দাবি করে বসল। বাবারও ভীমরতি, ঐ আধাবয়সি, হেঁপো-কেশো রুগীর হাতে তুলে দেওয়াই সাব্যস্ত করে ফেলল, এখন আমি কি করব? তুমি আমায় পথ দেখাও…
সংকল্প সব শুনে বলল ‘আমাকে ফলো কর‘ বলে সোজা ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে গিয়ে, ঠাকুরের সামনে মন্দিরের ডালার গোলা-সিঁদুর ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে আমার পুরো সিঁথিটা লম্বা করে রাঙিয়ে দিতেই, চোখ বন্ধ করে সোহাগ সিঁদুর গ্রহণ করেই ঢিপ করে প্রণাম করতে যেতেই সংকল্প আমাকে তুলে বুকে চেপে ধরে বলল, ‘আজ থেকে তুমি আমার স্ত্রী, আর তোমার চিরন্তন স্থান আমার বুকে, আই মিন হৃদয়ে।‘
‘তারপর অনেকক্ষণ দুজনে গায় গায় বসে সন্ধ্যারতি দেখছিলাম… কখন আকাশ কালো হয়ে এসেছে, আমরা খেয়ালই করিনি। আসলে মনে তখন দুজনেরই নবদম্পতির আমেজ, ক্রমশ শরীরেও সেই সুখানুভুতির শিহরণ…
প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি শুরু হতেই অন্যান্য লোকজন বাড়ির উদ্দেশ্যে দৌড় দিল, সঙ্গেসঙ্গেই লোডশেডিং। এবার ঠাকুরমশাই একটা লন্ঠন জ্বেলে মন্দিরে তালা লাগিয়ে, পাশেই নিজের ডেরায় ফিরে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমরা বৃষ্টির ছাঁট থেকে রক্ষা পেতে, নিবিড়ভাবে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলাম…
মাঝেমাঝে বিদ্যুতের ঝলকে আরো চমকে-চমকে উঠছিলাম। অবধারিত ভাবেই দুটো শরীর একাকার হয়ে যেতে লাগল, প্রথম কোন পুরুষের সঙ্গে মিলন… যেন ফুলশয্যার পরশ এনে দি।।
ঘণ্টাখানেক পর ঝড়-বৃষ্টি থেমে গিয়ে ঝকঝকে আকাশে চাঁদ উঠল, লাইটও জ্বলে উঠল, আমরাও তখন দেহে মনে পরিপৃক্ত, নিজেদেরকে গুছিয়ে নিয়েছি। একসঙ্গে বেরোলাম, সংকল্প আশ্বস্ত করল, ‘যদি অসাবধানতাবশতঃ কিছু ঘটে যায়, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি কখনো দায়িত্ব এড়িয়ে যাব না। আর আমরা তো এখন বিবাহিত, অন্য কেউ না-মানলেও, নিজেরা তো জানি।‘
হঠাৎ খেয়াল হল, কবিদাকে দেরি করেয়ে দিচ্ছি, লজ্জায় মাথা নীচু করে বলল অপু, ‘কবিদা তোমার দেরি করিয়ে দিলাম গো, এখনো এখানে কিভাবে এসে পড়লাম সেই ব্যাপারটাই বলা হয়নি…
থাক সেটা না-হয় অন্য যেদিন তোমার সময় হবে, এরকম সময় আমি ফ্রি থাকি।‘
‘তাহলে তাই আসব রে অপু, আমারও তো জানা হলনা ব্যাপারটা। আজ একটু তাড়া আছে, তাই চলিরে… শীগগিরিই আসব। জানিস তো, আমার কথার খেলাপ হয়না।‘
বেরিয়ে অপুকে ভাবতে-ভাবতেই হনহনিয়ে চলল যতীন…
দুই
যতীন বেরিয়ে যেতেই অত্যুৎসাহী চার/পাঁচটি মেয়ে হুড়মুড়িয়ে অপরাজিতার ঘরে ঢুকেই, ‘হ্যাঁলা অপা, কে এসেছিল রে তোর ঘরে, তুইই তো ডেকে নিয়ে এলি দেখলুম। তোর চেনাজানা কোন মিনসে নাকি রে?
‘খবরদার ওনাকে নিয়ে একটাও খারাপ কথা বলবে না তোমরা, উনি আমার মাসতুতো দাদা, আমাকে কত খুঁজেও পায়নি। তাই আজ দেখতে পেয়ে আমিই ডেকে এনেছিলাম। আবার যেদিন আসবে…
‘দ্যাখ লো অপা, ওরম মাসতুতো, পিসতুতো অনেক দাদাই দেখলুম, তুই আর লোক চেনাস নে আমারে। এখেনে তো কম দিন হলনা কো… চলি।।, তা তোর পেয়ারের মাসি জানে? ‘
‘এই তো সবে গেল, চিন্তা করনা এখনি গিয়ে মাসিকে বলব‘- বলে ওদের সামনে দিয়ে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে মাসির ঘরে ঢুকল অপরাজিতা।
‘হ্যারা খুকি এতখন কমনে ছিলিস, ছেলেডা মা-মা করতেছেল।‘
‘কোথায় আর যাব মাসি, নিজের ঘরেই ছিলাম। তোমাকে বলেছিলাম না, আমি মাসির কাছেই মানুষ হয়েছি, একটা মাসতুতো দাদা আছে। সে দাদা তো খুঁজেখুঁজে হাল ছেড়েই দিয়েছিল, আজ আমিই দেখতে পেয়ে ঘরে ডেকে নিয়ে এসেছিলাম…
‘ওমা, মাগো সেকি কতা খুকি, তুই এট্টা জোয়ান মদ্দরে ঘরে ঢুকোলি, মোরে কিচু না বোলে কোয়ে, অননো বিটিরা তো পেয়ে বসপে। খপরদার আর য্যাকোন ত্যাকোন কোন মিনসে রে ঘরে ঢুকোপিনে মোরে না জানিয়ে…
‘মাসি আমার কথা তুমি অবিশ্বাস করছ? এতদিনে তুমি আমাকে এই চিনেছ? তোমাকে আগে বলতে গেলে কি আর দাদাকে ধরতে পারতাম, ঠিক আছে…
‘আচচা রে বাবা হয়েচে তোর আর কানতি হবেনা, তোরে অবিশ্যেস করলি তো মোর দোজকেও ঠাঁই হবেনা কো, পরের দিন যকোন আসপে সোন্গে কোরে মোর কাচে আগে নে আসপি। যা চোকেমুকে পানি দে পোসকার হয়ে নে। জা দিনি, তুই কানলি মোর কি ভালো নাগে? ‘
অপরাজিতা, মাসির আশ্বাসবানীতে নিশ্চিন্ত হয়ে বাথরুমে ঢুকল…
রোজই বিকেলবেলা বাড়িটার নিরালা কোণটা থেকে রাস্তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে থাকে অপু, কবে ওর সম্ভাব্য উদ্ধারকারী কবিদা আসবে। যথেষ্ট ভরসা ওর কবিদার ওপরে, কবিদার মত পরোপকারী ও নিজে অন্ততঃ দেখেনি। কলেজের যে কেউ, চেনা হোক বা অচেনা. তার সমস্যাটা জেনে নিয়ে আপ্রাণ লড়ে, টাকা-পয়সার ব্যাপার হলে (নিজে তো মধ্যবিত্ত ঘরের ) সঙ্গেসঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী যার যেটুকু সম্ভব, চেয়ে নিয়ে বাকিটা বন্ধুদের আর নিজের পকেট থেকে পুষিয়ে নিয়ে, সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করত। ছেলেমেয়েরাও ওনাকে এত বিশ্বাস করত, কোন প্রশ্ন না-করেই স্বচ্ছন্দে ওনার হাত ভরিয়ে দিত। যে বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে জানে, তাকেই তো লোকে বিশ্বাস করে…
ওমা ঐ তো, কবিদা এদিকেই আসছে…
চট করে একটু গলির মুখের কাছ থেকে মুখটা বের করে হাতছানি দিয়ে ডাকতেই এগিয়ে এল কবিদা। মুখে আঙুল দিয়ে চুপচাপ গলির আর একটু ভিতরে ঢুকে দাঁড়ালাম, যাতে অন্য কারোর চোখে না পড়ি…
এবার মৃদুস্বরে সংক্ষেপে আমার বাকি কথাগুলো শেষ করলাম…
সংকল্পর সঙ্গে ওর যাওয়ার আগে আর দেখা হওয়া সম্ভব ছিলনা, হয়ওনি। মাস দুয়েক পেরোতেই বুঝলাম আমি মা হতে চলেছি, এদিকে সে বুড়ো তো বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে তাগাদা দিচ্ছে, শেষে পাঁজি দেখে দিন ঠিক হল… হাতে মাত্র তিনটে দিন, সংকল্পকে জানানোর কোন উপায় না-পেয়ে বাবার অনুপস্থিতির সুযোগে সন্ধেবেলাতেই বেরিয়ে পড়লাম। সংকল্পর সল্টলেকের এ্যাড্রেস জানা সত্ত্বেও, জেনেশুনে সাপের গর্তে পা দিলাম না।
এরকম ঘটনা আমার কয়েকটা জানা ছিল। ছেলের অনুপস্থিতিতে কোন অন্তসত্ত্বা মেয়ে যদি ওর মায়ের কাছে গিয়ে দাবি করে… মেয়েটির সন্তানের পিতা, তাঁরই ছেলে। মা মেনে তো নেনই না উপরন্তু যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করতেও ছাড়েন না।
এটা তুই একদম ঠিক কথা বলেছিস অপু, তারপর?
উদভ্রান্তের মত ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলে খুব অসুবিধায় পড়লাম, একে তো দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ঐ বুড়োর হাত থেকে রেহাই পেতে বাধ্য হয়ে ঘর ছেড়েছি, মাত্র দশটি টাকা হাতে নিয়ে… হঠাৎ খেয়াল হল খুব ক্ষিধে পেয়েছে, কিন্তু কাছেপিঠের ছোটখাটো দোকানগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছেচ। বুঝলাম আজ আর কপালে খাওয়া নেই। পাশেই একটা কল থেকে খানিকটা জল খেয়ে রাতটুকু কাটানোর জন্যে আশ্রয়ের সন্ধানে আবার এগোতে লাগলাম। দু-একটা বাড়িতে কড়া নাড়তে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি ছাড়া কিছু জুটল না।। যদিও জানতাম সেটাই স্বাভাবিক। গা-টা পাক দিয়ে উঠতে রাস্তার ধারে হড়হড় করে খানিকটা বমি করে নেতিয়ে পড়লাম…
এক মহিলার ডাকে চোখ খুলে দেখি সকাল হয়ে গেছে, ঐ মহিলা গায়ে হাত দিয়ে ডাকছিলেন। উঠে বসতে যেতেই বুঝলাম গা-হাত পায় প্রচণ্ড ব্যথা…
তুই কেডা রে মেয়ে, একেনে এলি কমনের তে? গা তো জরে পুড়তিছে… আহারে আসতে আসতে চলদিনি ঐ গলিতি মোর ঘরে। জাতি পারবি, ড্যাঁড়া হাতখান ধোরে চল…
সেই মহিলাই যে আমাদের মাসি, কোথায় এসে পড়েছি সেটা বুঝতেই তিন দিন লাগল কারণ কদিন জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ ছিলাম তো। ঐ মাসিই যত্ন করে আমাকে সারিয়ে তুলে আমার অবস্থা জেনে নিজের কাছেই রাখল, ছেলে হওয়া পর্যন্ত খাওয়াল। আমি ঘরেই রান্নাবান্না করতাম, বাচ্চার তিন মাস বয়স পর্যন্ত রেহাই পেয়েছিলাম, তারপরই আমাকে ঐ ঘরটা দিয়ে রোজগারের ধান্দায় পাঠাল। তবে একটা ব্যবস্থা মাসি করেছিল, পয়সাওয়ালা বয়স্ক লোকদেরই আমার ঘরে পাঠাত বা এখনও তাঁরাই আসেন আমার ঘরে, ওঁরা নাচ-গানের জন্যই আসেন। আজ পর্যন্ত শরীর কাউকে দিতে হয়নি, সেজন্য মাসির কাছে কৃতজ্ঞ আমি, প্রথম থেকেই আমার ওপরে একটু মায়া পড়ে গেছিল। এখন তো নাতির দায়িত্ব পুরো নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিয়েছে, আমি এখনো সারাদিন ঘর সংসারের কাজ করি।
কবিদা আর পারছিনা, তুমি যেভাবে পার আমাকে বাঁচাও। সংকল্প তো আমার নাগালের বাইরে… তুমিই ভরসা।
সে তো যে করে হোক এখান থেকে বের করতেই হবে তোকে, আমার নজরে যখন পড়েছিস… কিন্তু সংকল্পর পাত্তা… সে আমি দেখছি।‘
ব্যাস ব্যাস, ওতেই হবে, তোমার আশ্বাস যখন পেয়েছি, এখন তুমি একটু মাসির ঘরে যাও, সেদিনই আমাকে বলে রেখেছে… একটু সাবধান, মেজাজটা বেশ চড়া আর এটা মনে রাখবে, তুমি আমার মাসতুতো দাদা, ছোটবেলা থেকে মা-হারা আমি মানুষ হয়েছি মাসির কাছে…
তিন
অপুর দেখিয়ে দেওয়া পথে সিঁড়ি ভেঙে সোজা দোতলায় উঠেই ‘কইরে মিতুল সোনা (অপুর কাছে ওর ছেলের নামটা শোনা ছিল ) ‘ভিতরে ঢুকতে পারব কিনা কে জানে? আর ভিতরে না ঢুকতে পেলে পটাবোই বা কি করে? সিঁড়ির শেষ প্রান্তে গিয়ে দেখি… মিতুল দরজার ফাঁক দিয়ে আমাকে দেখে, বেশ খুশিখুশি মুখে বলছে, ‘ও নানী, আমার মামু এসেছে, আমার জন্য একটা ক্যাডবেরী এনেছে…’
উত্তর শুনলাম বাজখাঁই গলায়, ‘কেডা? তোর আবার কোতাকার মামু? যেরম আজ বাতের ব্যাতাডাও বেরেছে তেমনি আবার কোন ড্যাকরা এয়েছে দেখি… ’বলে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বুড়ি উঠে আসছিল। আমিও সুযোগ বুঝে দৌড়ে গিয়ে মহিলাকে প্রায় পাঁজাকোলা করে ধরে ফেলে, ‘আহা করকি করকি মাসি, তোমার এই বাতের ব্যাথা নিয়ে… আরে ডাক দিলে আমিই তো তোমার সামনে এসে যেতাম বলে ধরে খাটের ওপর বসিয়ে দিলাম।
-তুই কেডা বল দিনি, দুম করে মাসি বলে ডেকে… কোন বদ মতলব নিই তো?
-মাসি তুমি কি-যে বল, আমি তো তোমার মেয়ের সেই মাসতুতো দাদা গো… এতদিন ধরে খুঁজে খুঁজে এইবার সন্ধান পেয়েছি। আর তোমার মত একটা মা পেয়ে, তার আশ্রয়ে আছে দেখে মনটাও হালকা হয়েছে। তাই তো তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম… কিন্তু তোমার যা অবস্থা দেখছি…। বাতে তোমায় প্রায় পঙ্গু করে ফেলেছে। তা তুমি ডাক্তার-বদ্যি দেখাও না মাসি?
-আর দুক্কের কতা বলিসনে বাপ… এই দেহডার পেছনে যে কতকগুনো ট্যাকা গুণোগার দেল… মেয়েডাও রোজই এডা-সেডা মালিস দেচ্চে, তাও এট্টুও কমার লোক্কনই নিইকো…
বুঝলাম ঠিক জায়গায় কোপ মেরেছি, বুড়ির আমার ওপরে সহজেই বিশ্বাস এসে গেছে, মনে হয় প্রথম ধাপটা সহজেই পেরিয়ে এলাম.. তাহলে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে… বললাম, ‘মাসি, জানো সত্যি কথা বলতে, এই বাত-রোগটা বড় খিটকেল। এ ডাক্তারি ওষুধে বড় একটা যায় না। ঐ সব তাবিজ, কবচ করলে…
-একদোম ঠিক বোলিছিস… তা আমি একেনে সেরম তাবিজ টাবিজ কমনে পাব বল দিনি, আর আমার আছেই বা কেডা জে এনে কোরে দেবে?
-মাসি, আমি যখন এসে পড়েছি, তোমার আর চিন্তা করার দরকার নেই। আমার শ্বাশুড়িই তো বাতের ব্যথায় একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে গেছিলেন….. তখন আমার শালা কোথার থেকে একটা মাদুলি এনে দিয়েছিল। মাসি কি বলব , তোমার বিশ্বাসই হবেনা… একদম দশ দিনের মাথায় উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি।
তবে আমার তো সঠিক জায়গাটা জানা নেই, আমি তোমার বৌমার কাছ থেকে জেনে কাল তোমায় খবর দেব সব…
-তা বাপ, সুদু খপর নে আমি কি করবানি, আমারে এনে দেবে কেডা?
-ওঃ মা, এখনও তুমি আমার ওপর একটুও ভরসা করতে পারলে না? আমার মত তোমার একজন এমন জোয়ান ছেলে থাকতে, তুমি অন্য লোকের কথা ভাবছ?
-খোকা তুই আমারে মা বলে ডাকলি? জানিস আমারও এড্ডা খোকা ছেল… সে বেঁচে থাকলি তোর মতনই জোয়ান মদ্দ হত… তা আল্লা যে তারে তারাতারি ডেকে নেলে…’ বলে চোখের জল মুছতে দেখে, আমার রুমাল দিয়ে বুড়ির চোখ মুছিয়ে বললাম, ‘মাগো মনে কর-না, তোমার সেই ছেলেই ফিরে এসেছে…
-অত কোরে লোব দ্যাকাস নে, মার পেরানে ছেলের জন্যি যে কতডা ব্যাতা জোমে আছে…
-মা , তুমি এবার তো চুপ কর, তোমার এই ছেলে যখন তোমার কাছে এসেছে। অবশ্য তুমি যদি আমাকে তোমার ছেলে বলে স্বীকৃতি দাও (একটু দুখি-দুখি মুখ করে বললাম, যাতে টোপটা গেল…
-ওমা দ্যাকো দিনি কানডো, ওরে বাপ তোর মতোন ছেলেরে সিকার জাবে না কেডা রে? সে তালি মা না আক্কুসি বলবো, আয়রে বাপ বুকি আয়, মোর পেরানডা ঝ্যানো জুরগে পানি হোয়ে গ্যালো রে বাপ‘ বলে আমাকে বুকে চেপে ধরে, কপালে চুমুও খেল। আমার নিজের একদিনের ক্রেডিটে নিজেই অবাক হয়ে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম।
এমা মামু এতবড় ছেলে হয়ে নানীর আদর খাচ্ছে, ছিঃছিঃ… বলে হাততালি দিয়ে হাসতে লাগল মিতুল…
-এই ছোঁরা চুপ। মারদিনি, বডডো স্যায়না হোয়েছে খুকির আদোরে আদোরে…
না মা, ওকথা বললে আমি তো মানবনা। আমি অপুর কাছে তো শুনেছি , তুমিই আদরে-গোবরে নাতি মানুষ করছ…
-থোদিন খুকির কতা, এট্টাই তো মোটে নাতি, তারিরি এট্টু সোহাগ করবো না তালি করবো কারে বলদিন খোকা…
মাগো আজ রাত হয়েছে বাড়ি ফিরতে হবে, তোমার বৌমা আবার ভাত আগলে বসে থাকবে… আমি এখন আসি মা, কাল তোমার মাদুলির ব্যাপারে সব খবর নিয়ে বিকেলের দিকেই আসব…
-তা হ্যারা খোকা পেরথম দিন এলি, আমি তোরে শুদু মুকি কি করে যাতি দেই বলদিনি?
-আচ্ছা ঠিক আছে মা, তোমার ঘরে বাতাসা থাকলে তাই একখানা দাও, তাহলে হবে তো?
-সেতো আছে কিন্তুক ঐ ওঘরে তাকের উপরে, সে আমার খুকিই এই ব্যাটার জন্যি নুক্কে রেকেছে…
-ও, তুমি ব্যাস্ত হয়োনা মা, আমি নিজেই নিয়ে খাচ্ছি…
-একুনি চোলে জাচ্চিস, তা খুকির কতা তো কিছুই বলা হোলনা…
-সে আমি কাল এসে শুনব। তোমার খুকিও কোথাও চলে যাচ্ছেনা আর আমিও মরে যাচ্ছিনা…
-চুপ কর, চুপ কর… ঝ্যাতো সব অলুক্কুনে কতা। আল্লা তোদের সব ভালো রাকুক। ভালোয় ভালোয় বারিগে খাওয়া দাওয়া কর। তালি কাল বিকেলবেলা আমার মাদলির কতা সব ভালো কোরে সুনে আশপি বৌমার কাছদে…
চার
যতীনের ঘুম ভাঙলো, মেয়ে জানের ডাকে…
-বাবি ও বাবি, অফিস যাবে না? আটটা বাজে যে…
তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়েই চক্ষু ছানাবড়া। আধঘণ্টার মধ্যে আমাকে বেরোতেই হবে, আজ অফিস যাওয়া অত্যন্ত জরুরি। আজ সংকল্পর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে হবে… নইলে অপু, অপুর কি হবে?
-বাবি, তুমি কি বিড়বিড় করছ গো? অপু কে গো বাবি?
ওর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে, চোঁ চোঁ করে শরবতের মত চুমুক দিয়ে, ওর হাতে কাপটা ফেরত দিতে দিতে বললাম, ‘অপু তোর এক পিসিরে। ফিরে এসে বলবখন, এখন বড্ড তাড়া রে।
সঙ্গে সঙ্গে টয়লেটে, তারপর কোনরকমে নাকে মুখে গুঁজে ঠিক সময়েই বেরিয়ে পড়লাম। অফিসের কাজ কিছুটা সামলে, পলাশকে ফোন করে সংকল্পর ই-মেল আই-ডিটা নিয়ে কম্পিউটারে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম…
যথাসম্ভব সংক্ষেপে অপুর ইতিবৃত্ত জানিয়ে মেইল করে পাঠিয়ে দিলাম।
…ব্যাটা তো এখন নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে, কখন মেইল চেক করবে, তারপর তো রিপ্লাই করবে, সে পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা তো করতেই হবে।
…অতএব খানিকটা ফ্রি মনে হল, কারণ রিপ্লাই পেতে তো সেই কাল অফিসে কম্পিউটার ভরসা, আমার তো আর পিসি নেই… কেনার মত অত পয়সাও নেই, তবে ও যে ভাল কিছু রিপ্লাই দেবে, মানে আ্যভয়েড করবে না… সেটুকু অন্ততঃ ভরসা আছে। নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার মত ছেলে ও নয়। অবশ্য…
ভাবতেও ভয় লাগে, তবু… সাদা চামড়া দেখে যদি মাথা ঘুরে যায়…
অফিস থেকে ফিরে, রাতের খাওয়া-দাওয়ার পরে জান ঘুমিয়ে পড়লে, বসলাম বেটার হাফের সঙ্গে অপুর ব্যাপারটা নিয়ে ডিসকাস করতে। প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে, ফোন বেজে উঠতে অবাক হয়ে রিসিভ করেই শুনি, সংকল্পর গলা… ‘কবিদা একটু আগেই তোমার মেইলটা পড়লাম। তুমি আমার যে কি উপকার করলে… জুঁইয়ের খবরের জন্যে আমি অনেক চেষ্টা করেছি, পলাশটাও কোন ঠিকানা করতে পারেনি, তাই মরমে মরে ছিলাম… নাহ, ধন্যবাদ দিয়ে তোমাকে ছোট করতে চাইনা। কারণ আমি তোমাকে ভালই চিনি, এটাই তোমার আসল রূপ… নিজের যত কষ্টই হোক কারো উপকারে তুমি কখনও পিছ-পা হও না…
-ওসব ছাড় তো, এখন আমি কিভাবে তোক হেল্প করতে পারি, সেটাই বল। তোর বৌদির সঙ্গে সেই ব্যাপারটা নিয়েই কথা হচ্ছিল… আমাদের তো প্রথম কাজই হচ্ছে অপুকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঐ পাঁক থেকে উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু সেটা করতে গেলেই প্রথমে যেটা দরকার…
-দরকার প্রচুর টাকা, যেটা তোমার পক্ষে অসম্ভব কিন্তু ওটা নিয়ে একদম ভাববে না। যত টাকা লাগুক, আমি আছি। কিন্তু তার আগে যেটা করতে হবে, সে ব্যাপারে তুমি তো সিদ্ধহস্ত, তাই মাথা খাটিয়ে ঐ মাসি মহিলাকে তোমায় হাত করতে হবে। তারপর…
-থাক তারপরেরটা পরে ভাবলেও হবে। মোদ্দা কথা- আমাকে এখন কেঁচো হয়ে ঢুকে কেউটে হতে হবে। সে নিয়ে তুই ভাবিসনা, সে তোর বৌদি সবসময় আছে আমার সঙ্গে। আমার যেটুকু আছে, বাকি বুদ্ধিটা তোর বৌদি মাগনাই সাপ্লাই দেবে….
-সত্যি কবিদা , বৌদিও একেবারে জিনিয়াস। তোমরা বোধ হয় একে অপরের জন্যেই তৈরি হয়েছিলে…
-ওসব কথা এখন থাক, অনেক রাত হয়েছে। আসলে যেটা তোর দরকার হবে… আমার এ্যকাউন্ট নম্বর, মানি ট্রান্সফারের জন্য, সেটা তোকে কাল হোয়াটসআ্যপে জানিয়ে দেব, এই নম্বরে। এখন তোকে গুড মর্নিং জানিয়ে বিদায় নিচ্ছি।
-ওকে কবিদা গুড নাইট ’বলে সংকল্প ফোনটা কাটতে… বেশ ফুরফুরে মেজাজে গিন্নীকে একটু আদর করে শুতে চললাম…
পাঁচ
সকালে অফিস যাওয়ার আগেই দেখি ব্যাঙ্ক থেকে মেসেজ এসে গেছে, আমার একাউন্টে পঞ্চাশ হাজার টাকা ক্রেডিট হয়েছে। বুঝলাম… ব্যাটা এক মুহুর্ত দেরি না করে টাকা ট্রান্সফার করে দিয়েছে। নাহ, ছেলেটা ওদেশের জল হাওয়ায় পাল্টে যায়নি, তার অপুকে সে ভোলেনি। আর এখন তো মিতুলের কথা জানতে পেরে আরো উচ্ছ্বসিত। দেখি অফিসে গিয়ে মেইলটা খুলতে হবে… কি কি লিখেছে দেখা যাক।
তবে যাই বলুক ও, আমি আজ অফিসের পর অপুর ওখানে যাচ্ছিই। জানি, মাসির সঙ্গে দেখা করে পটাতে বেশ ক’দিন লাগবে, কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই আসেনা। আর সবাই জানে, হাল ছেড়ে দেওয়ার বান্দাও আমি নাই, তাই তো কবিদাকে সবাই এত ভরসা করে…
অফিসে কাজের ফাঁকে সংকল্পর মেইলটা চেক করে নিলাম… ঐ তো একই কথা… এখন যা পাঠালাম, ঐ দিয়ে নিশ্চিন্তে তোমার প্ল্যান মাফিক শুরু করে দাও, তবে সবার আগে তুমি ঐ টাকা থেকে একটা ভাল কোম্পানীর পিসি কিনে একেবারে ইন্টারনেটের কানেকশন করে নাও। তাহলে আমরা হোয়াটস আ্যপে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারব সরাসরি। পরের দিনের অফিস কম্পিউটারের জন্য অপেক্ষা করতে হবেনা। টাকার জন্য একদম ভাববে না, যখনই পারব আমি পাঠাতেই থাকব। এতদিন তো উদ্দেশ্যহীন ভাবে শুধু কামাইই করেছি, এখন আমার জীবনের নতুন করে বাঁচার পথের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, সেই দিশা কি টাকার অভাবে নষ্ট হয়ে যেতে দিতে পারি?
আমার স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সংসার করার স্বপ্নকে সফল করতে দিতে যত টাকাই লাগুক, তোমার এই ভাইটা জুগিয়ে যাবে। এই ক’বছরে যা কামিয়েছি, তার তিনগুণ এখন কামাচ্ছি জান?
এটাও আমার ভাগ্যের জোর যে এখন আমি দেশ থেকে যে কোম্পানীর রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে এসেছিলাম, বেটার অফার পেয়ে ওটাতে রিজাইন দিয়েছি, নতুন লোকাল কোম্পানীই আমাকে দ্বিগুণ স্যালারি দিয়ে এ্যাপয়েন্ট করেছে । অতএব নির্দ্বিধায় এগিয়ে যাও… পরে দরকার মত আবার তোমার একাউন্টে বেশ খানিকটা ক্যাশ ট্রান্সফার করে দেব।
ওরে না এখনি লাগবেনা… পাগলের কাণ্ড দেখ…
তুমি যতই আমায় পাগল বলে উড়িয়ে দাও, আমি জানি মাঝেমঝে একটু বেহিসেবি হয়েই খরচ করতে হয়, বুঝলে কবিদা?
তবে আজ একবার আগে অপুর কাছে পুরো ব্যাপারটা শুনে তারপর তো মাসির কাছে…
সংকল্পর ইচ্ছার কথা জানিয়ে বলেছে, আজ যদি অপুর সঙ্গে দেখা করতে পার, ওকে বলো ওর সংকল্প ওকে ভোলেনি…
কারোর প্ল্যানই ঠিক ধোপে টিকলনা। মনমরা হয়ে বাড়ি ফিরে বেটার হাফের সঙ্গে বলতেই কাজটা হাফ ডান হয়ে গেল।
ছয়
ও বলল, ‘আরে তুমি তাবিজ/কবচের জন্য এত ভাবছ কেন? আমাদের কাজের মাসিই তো সেদিন বলছিল, ওদের রাজারহাটে কে নাকি পীরবাবা তাবিজ দেয়, তুমি কাল সকালে মাসির সঙ্গে কথা বলে দেখ। ওরা টাকা পেলেই খুশি হয়ে তোমার সমস্যার সমাধান করে দেবে।’
-আমাকে বাঁচালে গো ডার্লিং, মাসিকে দিয়ে কাজ উদ্ধারের দায়িত্ব আমার, কাল সকালেই মাসির সঙ্গে কথা বলে সব পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে তবে সন্ধেবেলা বুড়ির কাছে যেতে হবে। আজ সন্ধেবেলাই তো খবর দেব বলেছিলাম… তিনি হয়তো ফেরেববাজ বলে গালাগাল দিতে লেগে গেছেন….
-ওগো না, সে বুড়ি একবার যখন তোমাকে ছেলে বলে ডেকেছে, সহজে তোমার ওপর বিরূপ হবে না, আর ওরা তো এমনিতেই ধর্মভীরু। আমি হলফ করে বলতে পারি..
সকাল সকাল চায়ের কাপটা নিয়ে মাসির সামনে গিয়ে বসলাম, মাসি সেদিন বলছিলে তোমার খোকার নাকি খেলতে গিয়ে পায়ে চোট লেগেছে। তা এখন সে আছে কেমন? কমেছে নাকি?
-আর কমলো কই? সবার কাছদে পরামশ্য নে গিইলাম তো পিরবাবার থানে… তা এট্টুও ঝদি কমতো… আ্যত্তো বরো এট্টা মাদলি দেলে… একোন খোকার বাপ বলতেছ আ্যলোপেতির কাছে নে জানি। তা সেকেনে জাতি গেলি তো এট্টা-মুঠো ট্যাকার দরকার। আঙ্গার ঝা কপাল… কন তে অত্তডা ট্যাকা জোগার করবো বলদিনি? খোকার বাপেরও তো বয়েসডা কম হোলনা, আগের মতন সেরম আর রিসকা টানতি পারেনাকো। আমারো তো দেকতি দেকতি আড়াই কুরি আট হোল…. তোঙ্গা এই পাসাপাসি তিনডে বারি করি… তা দে আর কতো দিকি টানবো বলোদিনি।
-তা মাসি তুমি তো আমাদের সব বাড়ির থেকে কিছু টাকা নিয়ে ছেলেকে দেখাতে পারতে। এরপর বেশি দেরি হয়ে গেলে ব্যাপারটা তো আরো খারাপের দিকে যাবে…
-‘দুখ্যের কতা আর কি বলবো… মুই-জে আবার কারুর কাছে হাত পাততি পারিনে কো…
-‘আহাহা মাসি কেঁদোনা তুমি, ঠিক আছে আমিই তোমার ছেলেকে বড় ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করিয়ে দেব। যত টাকাই লাগুক তোমার ভাবতে হবে না। তুমি রোববার দিন সকালে ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে এস, আমি সব ব্যবস্থা করে রাখছি। তুমি শুধু আমার জানাশোনা একজনের জন্য বাতের ব্যাথার একটা তাবিজ এনে দেবে, সেও খরচ যা লাগবে আমি দেব।
-ওমা দ্যাকো দিনি দাদাবাবুর ঝেমোন কতা… আরে সে তো আঙ্গা হাতনের ওপোরেই ধরতি গিলি। চোপর দিন পুজো হচ্চে, ঘনটা বাজতেচ…আঙ্গার কানের গোড়ায় তো সব… ট্যাকাপয়সা নাগেনা কো, ঐ ঝে ভালো হয়ে ঝায়, সেইতি হাঁস দে পুজো দেয়। ঐ পিরবাবার থানে আবার তোঙ্গা কালি ঠাকরুন রোয়েচে তো, তাই ঐ হাঁস বলির বেওস্তা।
-তা মাসি তুমি তাহলে আমার জন্যে একটা মাদুলি এনে দিতে পারবে তো….
-ওমা তা আর পারবোনা। এই তো সামনেই অমাবস্যের দিন সোনিবারে মার থানে অনেক বরো কোরে পুজো হবে। সিদনেই তোমার জন্যি মাদলি আমি একখান এনে দেবানি ঠিক। ওকেনে তো নিয়ম, ঝার ব্যাতা তারির নিজিরই জাতি হবে, খালি প্যাটে চ্যান করে, ভিজে কাপরে বসে থাকতি হয়। পুজো হয়ি গিলি ডেকে ডেকে ঝারে ঝা মাদলি দোবার দেয়…. তা সে তোমার জন্যি খোকার বাপ কুব এনে দিতি পারে..’
-ঠিক আছে মাসি তাহলে তুমি রোববার সকালে তোমার ছেলেকে নিয়ে এসে আমাকে জিম্মা করে দিও। তারপর সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার সময় ছেলেকে নিয়ে যেও।
-সে রোববারেই তালি সক্কাল সক্কাল তোমার মাদলিডা নে তোমার হাতে দে দোব, ঐ সুঙ্গি খোকারেও নে আসপো। সব চে আগে আমি সোনিবার দিনকে পিরবাবার থানের তে মাদলিডা তো নে নেব। তার সুনগি এট্টু তেলপোরাও এনে দোবানি, ওডাদে মালিস দিলি উপগার হয় অনেকের। আবার নোকে সবসময় তো বিস্যেস জায়নাকো। কতায় বলে বিস্যেসে মেলায় বোসতু তক্কে বহুৎ দুর…
-সে মাসি আমার খুব বিশ্বাস আছে, আমি সব করতেই রাজি। তা ঐ তেলপোড়ার কথা কি বলছিলে… তেলটা কি আগুনে পুড়িয়ে দেয়?
-আরে নাগো দাদাবাবু, তেল এট্টু কোশ কোরে নে ফুঁক দে মনতোর পরে দ্যায়, সেই তেলডা এট্টা বোতলের তেলে মিসিয়ে নিলি অনেকদিন মালিসির কায করবে…
-আচ্ছা আচ্ছা, তুমি তেল একটু পড়িয়ে নিয়ে এস, আমি সব ঠিক করে নেব। তাহলে কাল বাদ পরশু তুমি সকালে আমাকে এনে দিও কিন্তু, ভুলোনা যেন…
-দাদাবাবুর কতা সোন… তুমি আমার জন্যি এত্ত বরো এট্টা উপগার করবা, আর আমি সামান্নি কতাডা ভোলব?
অফিসের পর মাসির ডেরায় যাওয়ার সময় যেন মনের মধ্যে লাড্ডু ফাটছে… ওঃ একখান জম্পেশ প্ল্যানের ব্যাবস্থা একদম পাক্কা। বুড়ি তো শুনেই খুশি হয়ে যাবে , আর যদি ঠিকমত একটু বিশ্বাস করাতে পারি…
ওপরে উঠেই দেখি, বুড়ি মাথা নীচু করে বসে আছে। গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, ‘মাগো তোমার এ অবস্থা কেন?
-আর বলিশনে বাপ, কালতে বাতের ব্যাদনায় মোরে জাচ্ছি…
-ওমা তোমার জন্যে খুব ভাল খবর আছে। শনিবারেই তোমার মাদুলি আর তেল নিয়ে আসব, তবে আমার তো ফিরতে রাত হবে। রবিবার বিকেলে আমি তোমার কাছে দিয়ে যাব, তুমি মঙ্গলবারে সক্কালবেলা বাসি মুখে চান করে মাদুলিটা ধারণ করবে, আর তারপরে আমি তোমার মালিশটা লাগিয়ে অপুকে দেখিয়ে দেব। তারপর তোমার মেয়ের যত্ন আর মাদুলির গুণে তুমি সাত দিনের মধ্যেই চাঙ্গা হয়ে উঠবে দেখ…
-ওরম কোরে লোব দ্যাকাশনে বাপ…
-মা তুমি কিন্তু এখনো আমাকে বিশ্বাস করতে পারলে না। একবার অন্ততঃ তোমার খোকাকে বিশ্বাস করে দেখ, ঠকবে না।
-ওরে নারে খোকা, বিস্যেশ কোরতি তো মন চায়, তাও ভয় নাগে ঝদি কায না হয়…
-আচ্ছা মা, তুমি তোমার ভাবনা নিয়ে থাক, আমি আজ উঠি, আসিরে মিতুল…’
-হ্যারা খোকা, তা কমনের তে আনবি, তা বোললিনে তো…. ঝরের মতোন এসেই আবার চোলে জাচ্চিস?
-ও, হ্যাঁ আসল কথাই তো বলা হয়নি। ঐ রাজারহাট-কাঞ্জিয়াল পাড়ার ভিতর দিকে, একজন মস্ত পিরবাবা কালীপুজো করে। সে নাকি খুব জাগ্রত, সবার ইচ্ছেই পুরণ হয়। আমি সেখানে নিজে গিয়ে তোমার জন্যে মাদুলি আর তেলপড়া নিয়ে আসব। দেখি কেমন তোমার কাজ না হয় , তবে মাদুলি যে আনবে , তার একটু নিয়ম কানুন মানতে হবে। সে তোমায় ভাবতে হবেনা, সে আমি সব শুদ্ধাচার মেনে নিয়ম পালন করে নিয়ে আসব… আজ তাহলে আসি’ বলে বেশ খুশি মনেই বাড়ি ফিরলাম।
সাত
শনিবার সকালেই মাসি মাদুলি নিয়ে এসে ডাকাডাকি…
ওর কাছ থেকে মাদুলি আর ছোট্ট শিশিতে তেলটা নিয়ে আবার শোওয়ার ঘরে ঢুকতেই মাসি হাঁহাঁ করে উঠল…‘ ও দাদাবাবু কর কি, একোন ওগুনো নে সোবার ঘরে জাবেন নাকো। তোমাদের ঠাকুরির থানে থুয়ে দ্যাও, তারপর চান কোরে বাসী মুখি ধারন করবেন, বোঝলেন?
তাড়াতাড়ি সামাল দিয়ে, গিন্নীর হাতে দিয়ে দিলাম, ঠাকুরের আসনে রাখার জন্য , তারপর আবার লটকে গেলাম বিছানায়। আজকের ছুটির দিনের সকালটা এভাবে মাটি হতে দিতে রাজি নই…
বেলা ন’টায় ঘুম থেকে উঠে, চা-টা আরামসে খেয়ে, মাদুলিটা আর মোম নিয়ে বসলাম। বেশ বড়সড়ই মাদুলিটা, তার মধ্যে জবার পাঁপড়ি আর বেলপাতার টুকরোর সঙ্গে একটু মাটিও ভরা আছে দেখলাম…
যাকগে যাক , যত্ত সব বুজরুকি… আমি মোম গলিয়ে সুন্দর করে মাদুলিটার মুখ এঁটে, লাল কারে ভরে রাখলাম। এবার আগে থেকে জোগাড় করা রেড়ির তেলের মধ্যে ঐ ছোট্ট শিশির তেলটা ঢালতে গিয়ে দেখি…. ‘ওমা, এও তো সেই রেড়ির তেলই মনে হচ্ছে… নিজের মাথা থাবড়িয়ে, নিজের বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারলাম না। আসলে ছোটবেলায় দেখতাম… ঠাকুমা বসেবসে পায়ে, রেড়ির তেল ডলত… বাতের ব্যাথার সেটাই ছিল তখন একমাত্র ওষুধ। এবার দুটো একজায়গায় রেখে, চান-খাওয়া সেরে সারাটা দিন ল্যাদ খেয়ে নিশ্চিন্তে কাটালাম।
রোববার তেমনি সারা দিনটা বেশ আড়িয়ে গড়িয়ে কাটিয়ে, পাঁচটা নাগাদ চুলগুলো একটু উস্কোখুস্কো করে, একটা আধময়লা আটহাতি ধুতি পরে শাওয়ারের নীচে মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে আধভেজা হয়ে নিয়ে, হাতে ওগুলো নিয়ে দুগ্গা দুগ্গা বলে বেরোলাম, বুড়ির বাড়ির উদ্দেশ্যে…
সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে গিয়ে দেখি আমার আগেআগে গজর গজর করতে করতে চলেছে, মাসির খাস চাকর , ১০/১২ বছরের মদনা। একটু দাঁড়িয়ে কান খাড়া করতেই শুনি, ‘এরম পোসায়, সেই ভোর থাকতি গে এতখনে ফিরতিচি…
আমি চট করে বললাম, ‘ও মদনা, রাজারহাটে পিরবাবার থান কেমন দেখলি রে?
এরে সববোনাস, তুমি আমারে দেকতি পেইলে, মুই তো তোমারে খুঁজিই প্যালাম না… ইদিকি মাসি তো তোমারি দেকতি… হায় আল্লা, মাসি ঝে তোমার সুঙ্গি বলতি মানা করে দেল…
ওরে মদনা, আমার পেছনেও দুটো চোখ আছে। তুই শুধুশুধু ভিড়ের মধ্যে কষ্ট করলি… (আসলে সবই তো আন্দাজে … বুড়ি বারটা ও গোলমাল করে , মদনাকে শনিবারের জায়গায় রোববারে পাঠিয়েছে ) যাকগে তোর চিন্তা করতে হবে না। তোর কথা আমি মাসির সঙ্গে কিচ্ছু বলব না। যা তুই আগে আগে ঘরে যা, আমি একটু পরে আসছি…বলে ওকে পাঠিয়ে দিয়ে ভাবলাম… বুড়ি, তুমি আমার পেছনেও টিকটিকি লাগিয়েছ? কিন্তু… তুমি চল ডালে ডালে আর আমি চলি পাতায় পাতায়। এ যাত্রা খুব জোর বেঁচে গিয়ে সুবিধে হল, এরপরে আর সন্দেহ তো করবেই না উপরন্তু বিশ্বাসটা আরো বেড়ে যাবে।
একেবারে ক্লান্ত ভাব দেখিয়ে মাসির দরজায় দাঁড়িয়ে, ‘মা.. লে ডাক ছাড়তেই, বুড়ি একেবারে গদগদ হয়ে, ‘আয়রে বাপ, খোকার আমার মুকখান এক্কেবারে সুক্কে গেচে গো। সেকি একেনে, আয় আয় বাপ আগে এট্টু থির হয়ে বোশ দিনি তারপর সব সোনবানি….’
-‘না মা, তুমি আগে আমাকে দেখিয়ে দাও এগুলো রাখব কোথায়?
-কমনে আর রাকপি, ঐ খুকির ঠাকুরির আসুনে থুয়ে দে। পরে খুকিই আমারে বুঝগে দেবানি।
-তা অপুকে এবার যে একটু ডাকতে হবে মা, আমি আগে তো তাকে বোঝাই, তবে তো সে তোমাকে বোঝাবে…
-ঐ দ্যাকো আমার ঝ্যামোন…. শত্তিই তো খুকিরে তো তুই আগে বুঝগে দিবি … বলতে বলতেই অপু ঘরে ঢুকল, কি হয়েছে দাদা, কি বোঝানোর কথা বলছিলে?
-এই যে রে মায়ের জন্যে মাদুলি আর তেলটা এনেছি। মঙ্গলবার সক্কালবেলা চান করে ভিজে কাপড়ে, বাসি মুখে পূর্ব দিকে মুখ করে মাদুলিটা মায়ের হাতে বেঁধে দিবি। তুইও কিন্তু চান করে ভিজে কাপড়ে থাকবি। ব্যাস, তারপর চা-টা যা খাওয়ার খাবি। আর এই তেলটা আমি আজ একটু দেখিয়ে দেব, কাল থেকে তুই মালিশ করে দিবি , সাতদিনের মধ্যেই ফল পাওয়া যাবে।
-আচ্চা বাপ এবার তো থো ওগুনো। চোকেমুকি ভালো কোরে জল দে আয়। আর খুকি তোর দাদারে এট্টু খাতি দে। সেই কোন ভোরে বেরগে গেচে… মুকখানার দিকি তাগানোই জাচ্চেনা…
-ঐ দেখ মাসি, তুমি ভুলেই গেছ, আমি তো শনিবারে এনেছি, ঠাকুরের আসনে রেখে দিয়েছিলাম। আজ মাদুলি নেওয়ার আগে আবার এট্টু চান করে ভিজে কাপড়ে…
-ঐ দেক আমার ঝ্যামা… ওরে এরেই বলে ভিমরোতি।
আমি এবার বাথরুমে গিয়ে, ভালো করে চোখেমুখে জল দিয়ে এসে আরাম করে বসে, এক বাটি পায়েস আর অপুর হাতের পাঞ্জাবী চা… ওঃ জব্বর কাজের সঙ্গে খাওয়াটাও বেশ ভালই হল। বুড়ির কোমরে ঐ রেড়ির তেল একটু মালিশ করে, চোখ টিপে অপুকে বললাম, এইরকম করে সাতদিন দুবেলা মালিশ করে দিবি, দেখবি বাতের ব্যাথা ওল তলা দিয়ে পালিয়েছে…
অপু তো বেরিয়ে গেল ডিউটির জন্যে রেডি হতে, আর মিতুলও টিউটরের কাছে পড়ছে…
-মাগো এবার আমিও তাহলে আসি…
-হ্যাঁ হ্যাঁ আয় বাপ, কাল তো চোপর দিন দেঁড়গে দেঁড়গে তোর পায়ে তো সেরম ব্যাদনা হবানি আবার আজগেরেও বারির তে এতো ডা পথ হেঁটে, যা বাপ এইবেলা বারি গে এটটু আরাম কর। তোর মাদলিডা দেকেইনা আমার ঝ্যানো কিরম মনে হচচে এডার কায না হোয়েই যাবে না…
-হ্যাঁগো মা, তুমি মাদুলিটা পরবার সময় কপালে ঠেকিয়ে একটু আল্লার নাম স্মরণ করে তাই পরো, আসছি মাগো। কালকে বাদে পরশু এসেই তোমাকে অনেকটা ভাল দেখব আশা করি… বলতে বলতে বেরিয়ে পড়লাম।
আজ রাত্তিরে সংকল্পকে গুডনিউজটা দিতেই হবে। আমার তো মনে হয়, বুড়ির ঐ বাতের ব্যাথার বাহানা এবার যাবে, আসলে ওটা অনেকটাই মানসিক…. আমার তো সেরকমই মনে হয়েছে। যদিও বলেছি, তেলটা ক’মাস মালিশ করতে হবে…
এই কাজটাতে সফল হতে পারলেই… নাঃ বেশি ভাবতে ভয় করে, তবু… পঞ্চাশ ভাগ কাজ হয়ে গেছে, বলাই যায়…
আট
রাত্রে সংকল্পকে মাদুলি বৃত্তান্ত বলতে, প্রথমটা তো হেসেই খুন তারপর বলল, ‘সত্যি কবিদা তোমার মাথায় আসেও বটে।‘
বুঝলাম ও খুব খুশি, কিন্তু কোন বাহবা দেওয়ার আগেই ওর মুখ বন্ধ করিয়ে বললাম, ‘শোন এখনই প্রকাশ করছি না তবে পরের দিনের প্ল্যানও মোটামুটি ছকে ফেলেছি, দেখি তারপর সুযোগ বুঝে দিন দুয়েক পরই কথাটা পাড়ব।
তবে এমন বাঁধনে বেঁধে ফেলেছি, সহজে এককথায় ঝেড়ে ফেলতে পারবে না ব্যাপারটা, এটা হলফ করে বলাই যায়। হয়তো গাঁইগুঁই করতে করতে… দেখিরে ভাই, আরো বেশি দূর ভাবতে ভয়ই করে, শেষে সেই দুধওয়ালির অবস্থা না হয়…’
-‘না, কবিদা তুমি যতই আমাকে থামিয়ে রাখ… এই ক’দিনে তুমি যা করেছ… অবিশ্বাস্য। যাক শোন, আমি আরো কিছু টাকা পাঠানোর চেষ্টা করছি… দেখ কবিদা যা কিছুই কর, সবই টাকার খেলা। আর এরকম কেসে, টাকা তোমাকে বেহিসেবী হয়েই খরচ করতে হবে। না লাগলেও তোমার কাছে রেখে দাও, দেখবে কখন হঠাৎ দরকার পড়বে….’
-‘আচ্ছা আচ্ছা অল্প কিছু পাঠাস। আমারও তো একটু বুঝে খরচ করতে হবে, ওদিকে আবার অপু আর মিতুলের পাসপোর্টের ব্যাপার আছে… যাকগে, আজ অনেক রাত হয়েছে, আবার পরের দিন, কাজ কিছুটা এগিয়ে এসে তোকে খবর দেব, অবশ্য যদি এগোতে পারি। রাখছিরে ভাই..
পরদিন অফিস থেকে ফিরে গিন্নীর সঙ্গে, সাউথ সিটি মলে গিয়ে একেবারে মন খুলে বাজার করলাম। বুড়ীর জন্য দুখানা বেশ দামী সাদা শাড়ি, অপুর দুখানা ভাল শাড়ি আর মিতুলের গোটা তিনেক সুন্দর ড্রেস। নিজের মেয়েটাকে আর বঞ্চিত করতে পারলাম না, ওর পছন্দমতই একটা ড্রেস কিনে দিলাম, তবে ওর মা-কে কিছুতেই একটা শাড়ি নেওয়াতে পারলাম না। শুধু একই কথা, ‘আগে কাজটা ভালোয় ভালোয় মিটুক, তখন সংকল্পর কাছ থেকে আমি নিজে চেয়ে নেব দেখ…’
আমি মনেমনে খুবই জানি, কোনদিন যে আমার কাছেই চাইল না, সে কিছুতেই অন্য কারুর থেকে চাইতে পারেই না। যাক এতে আমার নিজেকে ভাগ্যবানই মনে হয়।
মঙ্গলবার অফিসে ম্যানেজ করে একটু আগেই বেরোলাম, যাতে অপুর সঙ্গেও একটু কথা বলতে পারি…
দুই হাতে প্যাকেটগুলো ঝুলিয়ে, বেশ খোশ মেজাজে চললাম…
হ্যাঁ, ঠিক আন্দাজমতো বাড়ির কোণ থেকে লক্ষ্য করতে দেখলাম অপুকে দাঁড়িয়ে আমার আসার পথের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করতে। কাছে গিয়ে আশ্বাস দিয়ে বললাম, ‘ভাবিসনা রে বোন আমার, তোর কবিদা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মনে হয় আর খুব বেশি দিন তোকে অপেক্ষা করতে হবেনা। ওদিকে তো সংকল্পও অস্থির হয়ে গেছে, তোদের কাছে পাওয়ার জন্যে।’
-‘তুমি আবার দু’হাত ভর্তি করে কিসব কিনে এনেছ গো কবিদা ?’
-‘মাসির ঘরে আয়, সেখানেই দেখবি । আর আমার কেনার ক্ষমতা কোথায় , জানিসই তো ছাপোষা লোক। অনেক কষ্টে অফিস থেকে লোন নিয়ে তাই এতদিনে ফ্ল্যাটটা কিনেছি, আজীবন লোনের টাকা কাটবে, সবই সংকল্পর পয়সায়। চোখের জল মুছে তুই আয়, আমি এগোলাম…’
দোতলায় উঠেই ‘মা’ করে হাঁক দিতেই অবাক… বুড়ি নিজে এসে দরজা খুলে দাঁড়াল।
বললাম, ‘কিগো মা, তুমি আবার কষ্ট করে দরজা খুলতে উঠে…’
-‘ওরে থো দিনি তোর কসটো। কসটো সব দিচি পেটকে আমার সত্তুরির ঘরে। তোর মতোন এইরম ঝার ব্যাটা আচে তার আবার কিসির কসটো রে…
‘সত্যিরে বাপ , তোরে বলবো কি, সে ব্যাতা-ঝে কমনে গ্যালো তা বুজদিই পারলাম নাকো। সিদনে তোর ডলাতেই ভালো কাজ হোয়েলো, এ দুদিন আবার খুকি দেচে আর আজগে মাদলিডা নে সেই ত্যাকোনতে ঝ্যানো একদোম ব্যাতা ট্যাতা সব… তা হ্যারা বাপ, এত্তো সব কি আনিচিস, তোর পয়সা বুজি খুব সসতা হোয়েছে?’
আমি দেখছি, মুখে ওকথা বললেও, চোখ বেশ চকচক করছে… আমিও কিছু না বোঝার ভান করে, ‘আরে ওসব টাকা পয়সার কথা থাক মা, টাকা কি কারো সঙ্গে যাবে? দেখি তোমার তো মোটে দুখানা শাড়ি, অপুটাও পাঁচ জন বড়লোকের সামনে দাঁড়ায়… তারও একখানাও ভালো শাড়ি নেই, আর আমার একটা মাত্র ভাগনে, তারে একটু কিছু দিতেও তো আমার ইচ্ছে করে…’
-‘তা অবিস্যি ঠিকি বলিচিস তুই। খুকিডারে সেই পেথথম দিকি দুখান সারি দিইলাম… আর আমার ঝা কপ…’
-‘ওসব কথা রেখে এবার শাড়িগুলো দেখ তো। ঐ নাও অপু আবার এরই মধ্যে চা-টা নিয়ে এসেছে। ঠিক আছে ওর নিজের শাড়িগুলোও একটু দেখে যাক। ওর তো আর বেশি সময় নেই… তা অপু, এর মধ্যে তুই আবার এই মোহনভোগ বানাতে গেলি কেন?’
-‘চুপ মেরে খা দিনি। আপিসদে তো সোযা একেনে আসিশ তা খিদে তেষটা বুজি নাগে না? আমিই ওরে বোলেলাম ভালো কোরে এটটু মিসটি কোরে দিতি। তুই গরম থাকতি থাকতি খা দিনি…
হ্যাঁরা খোকা সারিগুনো কুব সোন্দর হয়েচে, তা আমার জন্যি এতো দাম দে আনার কোন দরকার ছেল, আমি কমনেই বা জাই…’
-‘এতদিন যাওনি বলে কি, এখন ও যাবে না… এমন কোন কথা আছে নাকি? এই যে তোমার ছেলে, তার বাড়ি তোমার যেতে তো হবেই। তোমার বৌমা, নাতনি, তাদের দেখতে ইচ্ছে হয় না তোমার? আমি তোমাকে আর মিতুলকে ঠিক নিয়ে যাব…
-‘ওরে খোকা ওরম করে লোব দ্যাকাসনে… আঙ্গাদের মতোন মানসে-রে কেউ কাউর বারি জাতি দেকেছে? আঙ্গা কোথথাও জাতি নেই কো। জাত জম্ম খুইয়ে… কতো মেয়ের সব্বোনাস করলাম… আল্লার দোজগেও ঠাঁই হবে নাক…’ বলে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল বুড়ি। বুঝলাম প্রস্তাবটায় একটু হলেও কাজ হবে । পারলে ৩/৪ দিনের মধ্যেই আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে যাব , যত্ন-আত্তি করলে, বুড়ির মন গলতে বেশি সময় লাগবে না…
মুখে বললাম, ‘দেখ মা, আমার সামনে অমন করে কাঁদবে না। আমার বুঝি কষ্ট হয়না? সবার সঙ্গে তুমি আমার তুলনা করোনা তো, আমি যে তোমাকে মা বলে ডেকেছি কি শুধু লোক-দেখানোর জন্যে? এই সামনের সপ্তাহেই আমি তোমাদের নিয়ে যাব। শনিবার তো আমার ছুটি, তুমি নিজে রেডি হয়ে, মিতুলকেও রেডি করিয়ে রেখ… আর অপুর তো যাওয়ার উপায় নেই এখন…
-আচ্চা আচ্চা সে হবানি, তা হ্যাঁরা খোকা, বউমা অকুসি হবে না তো?
-মা তুমি যে কি বল না… তোমার বৌমাই তো আমাকে তাগাদা দিচ্ছে সেই যেদিন তোমাদের কথা আমার মুখে শুনেছে, সেই দিন থেকে। মজার কথা কি জান, তোমার বৌমা তো অপুকেও দেখেনি কখনো তাই, তোমাদের দেখবে বলে সে খুব অস্থির হচ্ছে…
-আসেপাসের নোকেদের কিচু বলিস নেকো। কেউ কিন্তুক আঙ্গা ভালো চোকে দ্যাকেনা, ঘেননা করে অচ্ছেদ্দা করে…
-তুমি ওসব ছাড় তো মা। থাকি তো ফ্ল্যাটে, কার বাড়ি কে আসল গেল, তা নিয়ে কারুরই কোন মাথাব্যাথা নেই। আচ্ছা মা কথায় কথায় অনেক রাত হল, আজ তাহলে আসি…
-হ্যাঁ হ্যাঁ আয় বাপ, সাবদানে জাস…
নয়
বাড়ি ফিরে গিন্নীকে একটু তোয়াজ করেই বললাম, দেখ ডার্লিং, তোমাকে না জানিয়েই একটা কাজ করে ফেলেছি। একটু ক্ষমা-ঘেন্না করে যদি…
-রাখ তো তোমার নকশা, জানোই তো তোমার কোন কাজে আমি কখনো বাধা দিইনা। আসল কথাটা কি তাই বল তো?
-আরে সে তো আমি বিলক্ষণ জানি তবু… যাকগে শোন সামনের শনিবার আমি ঐ বুড়িকে আর মিতুলকে ফ্ল্যাটে নিয়ে আসব, তুমি ওদের দেখে বিরক্ত…
-তোমার নিয়ে আসাটা দরকার, তাই তুমি তাদের আনবে। আমার ডিউটি আমি বুঝে নেব। দেখ অমন একটা মেয়েকে উদ্ধারের দায়িত্ব তুমি নিয়েছ, আর আমি একটু অতিথি সৎকারের মধ্যে দিয়ে একজন মহিলাকে খুশি করে তোমায় হেল্প করতে পারব না? এতোদিনেও তাহলে তুমি আমায় চিনতে পারনি গো…
-আরে না না, আমি তোমাকে ভাল করে জানি বলেই তো তোমাকে বলার আগেই তার কাছে প্রস্তাব দিয়ে এসেছি। তবে বুড়ি খুব কিন্তু কিন্তু করছিল… ভদ্রলোকরা ওদের খুব ঘেন্না করে, কারোর বাড়িতে ওদের ছায়াও মাড়াতে দেয় না। এইসব আমি তোমার নাম করেই বলেছি, যেন তুমিই ওদের নিয়ে আসতে বলেছ। বুঝলে ম্যাডাম, তোমাকে ভরসা না করলে কি বলতে পারতাম?
রাত্রে খাওয়ার টেবলে, ওদের কি খাওয়ানো যায়, এসব আলোচনা করতে শুনে, জান খুশিতে ডগমগ হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কে আসবে গো বাবি?’
-ঐ একটা ভাই, আর তার আম্মুজান-তো খুব খুশি, কি মজা! কি মজা! আমি ভাইয়ের সঙ্গে খুব খেলা করব।
-হ্যাঁ হ্যাঁ করবি, পাগলি মেয়ে আমার, বলে ওকে একটু আদর করে দিলাম। রাত্রে সংকল্পর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করলাম, তবে নিজের ক্রেডিটটা অবলীলায় গিন্নীকেই দিয়ে দিলাম। কারণ এটা তো স্বীকার করতেই হবে। ও সাপোর্ট না করলে, আমার একার পক্ষে অসম্ভব হত সবই।
সংকল্পকে বলে দিলাম, এখন ক’দিন একটু ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা কর ভাই, শনিবারে বেশ খাতির যত্ন করে আরো একটু পটিয়ে নিই। তারপরে কাজ হাসিল অনেক সহজ হয়ে যাবে। তোকে ঐদিন রাত্রেই একটু আশার আলো দেখাতে পারব মনে হয়…
-কবিদা, তোমাকে অযথা বিরক্ত করবনা, কথা দিলাম। তোমার আর বৌদির ঋণ আমি জীবনেও শোধ করতে…
-এই থাম, আর একটা ও কথা খরচ করবি না। গুড মর্ণিং ফর ইউ, ব্যস মোবাইল অফ করে দিলাম… বলে সত্যিই মোবাইল অফ করে সংকল্পকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে খাটে লম্বা হয়ে গেলাম।
দশ
শনিবার সকাল থেকে, আমার ফ্ল্যাটে সাজসাজ রব। স্নিগ্ধার সহায়তায় মেনু তো ঠিক করাই আছে , শুধু দই আর মিষ্টিটা আনতে হবে।
স্নিগ্ধা নিপুণ হাতে ঘর দুখানা গোছগাছ করছে। জানের ও উৎসাহের অন্ত নেই, তার একটা ছোট্ট ভাই আসবে। ওর সঙ্গে তো পুতুল খেলা যাবেনা, তাই পুতুলগুলো সাজিয়ে রেখে ব্যাট-বলটা বের করে সামনে রাখল। এঘরে তো মায়েরা গল্প-গুজব করবে, তাই বাবির শোওয়ার ঘরে খেলার ব্যবস্থা করে রাখল।
ওদিকে অপুও খুব ব্যস্ত, ছেলেকে কোন জামাটা পরিয়ে পাঠাবে, মাসির জন্য , কবিদার দেওয়া ভাল শাড়ি একটা সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ, সব গুছিয়ে রেখে দিল। মাসিকে বলেও রেখে দিল। যেন দাদা আসার আগে রেডি হয়ে থাকে…
বিকেল চারটে নাগাদ আমি গিয়ে তাড়া দিতে লাগলাম, কিগো মা, তোমরা রেডি তো?
-দেকো দিনি খোকার কাণ্ড! হ্যারা, একুনি বেরুতি হবে নাকি? এট্টু আঁধার হলি গিলি হতো না, দিনির আলোয় কিরম ঝ্যানো নজ্জা নজ্জা নাগে। ঝ্যাতোই হোক ভদ্দরনোকের পাড়ায় দিনির বেলা ঝে কদ্দিন বেরোয়নি কো…খোকাডার চোলে যাবার পর দে… এই ব্যাওসায় নামলুম আর ভদ্দর পাড়ায় মুকও দেখাতি যাতি পারিনি। আজ আবার এতো বচ্ছর পরে…
-দেখ মা, প্রথম থেকেই বলেছি, তুমি তোমার হারানো ছেলে ফিরে পেয়েছ , আর কথায় কথায় অমন চোখের জল ফেলবে না। নাকি আজও তুমি আমাকে ছেলে বলে মানতে পারনি…
-ওরে নারে বাপ, এডা তো খুশির কান্না, বুজলি নে? কত্তদিন পর আবার ছেলের সুঙ্গি ভদ্দর পাড়ায় যাব মনে করলি আনন্দে চোখে পানি এসতেছে…
-এই অপু, মাকে আগে রেডি করে দে ত, আমি ভাগ্নেরটা করছি।
-ওরে দুর পাগল, ও আমারে কি রেডি করবে! ও কি আমার মতন পাতা কেটে চুল বানতি জানে? তুই চুপ মেরে বসে থাক, আমার এক্কুনি হয়ে যাবানি… খুকি তো কাপর চোপর সব ঠিক করেই একেছে…
-তাহলে তোমরা রেডি হয়ে বেরোও, আমি ট্যাক্সি ধরে নিয়ে আসি…
-আচ্ছা খোকা, শুদুশুদু আবার টেসকি ডেকে একগাদা খচ্চা না কল্লি চলবেনা? দিব্যু আমরা বাশেই যাতি পারতাম…
-মা তোমার ছেলে গরিব হতে পারে, কিন্তু তার মা আর ভাগ্নেকে এটুকু রাস্তা ট্যাক্সিতে নিয়ে যেতে পারে। আর দেখ বাচ্চাটা ট্যাক্সিতে যাবে শুনে কত খুশি দেখেছ? আমি মামা হয়ে এটুকু ওর জন্য করতে পারব না…
-আচ্ছা বাপ, যা তুই টেসকি দেক, আমরা এক্কুনি এগুচ্ছি…
একটু পরেই অপুর তৎপরতায় দুজনেই রেডি হয়ে রাস্তায় বেরোতেই আমাকে দেখল ট্যাক্সি থেকে নামতে। অপু ওদের হাত ধরে নিয়ে এসে বসিয়ে দিল, তারপর আমিও, অপুকে বাই করে এগোলাম নিজের ফ্ল্যাটের দিকে।
ওপর থেকে লক্ষ্য রাখছিল জান, বাবিকে নামতে দেখেই ছুট্টে নেমে এসে ভাইয়ের হাত ধরে ওপরে নিয়ে চলল। বুড়ি তো এক হাত ঘোমটার ফাঁক দিয়ে, ওদের দেখে খুব খুশি। বলেই ফেলল, বাপ তোর খুকিডা বেশ হয়েছে , আমার নাতিরে সুঙ্গে করে কিরম হাত ধরে নে গেল। ঠিক ঝেন নিজির মার প্যাটের ভাইর মতোন…
-মা, আমার মেয়েটা তো কদিন ধরেই ভাই ভাই করে অস্থির হয়ে গেছিল। ওর তো কোন ভাই নেই, তাই ভাই দেখার জন্য হাঁপিয়ে উঠেছিল…
ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়েছিল স্নিগ্ধা, সে একেবারে প্রায় জড়িয়ে ধরে বুড়িকে ভিতরে নিয়ে যেয়ে বসাতে, বুড়ি আনন্দে কেঁদেই ফেলল। তাই দেখে বললাম, সেকি গো মা, তুমি আবার কাঁদছ কেন?
-ওরে নারে বাপ, এ কান্না ঝে আমার খুসির কান্না। জেবনে কুনোদিন তো এতো আদর-জতন পাইনি কো। তাই বৌমার আদরেতে আমার চোকের তে পা… না, জল এসে গিইল। তোরা সগ্গুলি বেঁচে থাক বাপ, সুকে থাক। ও নাতনি একবার আমার ধারে আয় দিনি, এট্টু ভালো করে তোরে দেকি… ঠিক ঝ্যানো গোলাপ ফুলির মতো…
জান, বুড়ির কোলের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই, বুড়ি তার বটুয়া থেকে পাথর বসানো সুন্দর একটা কৌটো বের করে জানের হাতে দিয়ে বলল, দিদি খুলি দ্যাক দিনি পসোন্দ হয় নাকি…
জান-তো খুলে অবাক হয়ে বলল, দেখ মা-বাবি, আম্মু আমাকে কি সুন্দর একটা জিনিস দিয়েছে…
আমি আর স্নিগ্ধা তো দেখেই হাঁ হাঁ করে উঠলাম, একি মা, তুমি…?
-দ্যাক তোরা ইরির মদ্যি ঢুকপিনে কো খপরদার। আমার তো আর কিচু নিই কো, ঐ গিনি দুটো ছেল, তাই নাতিরি একখান দিয়েলাম আর আজগে নাতিনরে দে দায় উধ্যার হলাম…
-মা, তা বলে তোমার শেষ সম্বল দিয়ে দিলে, নিজের বলে তো আর কিছুই রইল না। ভবিষ্যৎ বলে তো…
-আরে চুপ মার দিনি খোকা। তোর মতোন এরম ব্যাটা আর অপুর মতন বিটি ঝার আচে তার আবার ভবিস্যত ভাবা নাগে?
সন্ধে পর্যন্ত বেশ হৈহৈ করেই কেটে গেল। বাচ্চাটাও এই প্রথম এমন বাড়ি, এমন দিদি পেয়ে খুব খুশি। বুড়িও এত আদর করে খাওয়ানো, স্নিগ্ধারও মা বলে ডাকা তে একেবারে উচ্ছসিত। বলল, খোকা এবার একদিন তোর সুঙ্গি খুকিরেও পেটকে দোবানি। ঝার নিজির দাদার বারি, সেইতিই দ্যাকপে না, এডা হয়?
আমরা দুজনেই তো অবাক… এ যেন মেঘ না চাইতেই জল… আমি তো ভেবেই রেখেছিলাম, দু/চারদিন পরেই প্রস্তাবটা করব… এখন তো মনেমনে আনন্দে লাড্ডু ফুটছে… ওদের ছেড়ে এসে আজ সংকল্পকে গুড নিউজটা দিতে হবে… অপুকে এখানে আনতে পারলে ওর পাসপোর্টের ব্যাপারটাও একটু ত্বরাণ্বিত করা যাবে। যাক সেসব পরে সংকল্পর সঙ্গে আলোচনা করা যাবে। আর আমার ফ্ল্যাটে আসার প্রস্তাবটা যখন নিজেই বুড়ি দিয়েছে… ওকে সংকল্পর হাতে তুলে দেওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা…
এবার ওদেরকে পৌঁছে দিয়ে যেন হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে বাড়ি ফিরলাম। ফ্ল্যাটে ঢুকেই দরজাটা লক করে, চোখের ঈশারায় জানতে চাইলাম… এদিকের খবর কি, সব ঠিকঠাক তো?
খরখর করে উঠল স্নিগ্ধা, ঠিক থাকার উপায় আছে নাকি? যেই তোমরা বেরিয়ে গেলে, দরজাটা সবে বন্ধ করতে যাচ্ছি…
-তোমাদের বাড়ি আজ কারা এসেছিল গো, আগে তো কখনো দেখিনি ওই মহিলাকে… সেকেলেদের মত পাতা কেটে চুল বাঁধা, আর গায়ের রঙ এবয়সেও যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। বড় সুন্দরি মহিলা, সঙ্গেরটি বুঝি নাতি? বাচ্চাটা ও খুব মিষ্টি… কে হয় গো তোমাদের?
মুখে এসে গেছিল… যেই হোক, তাতে আপনার কি… সামলে নিয়ে দেঁতো-হাসি হেসে বললাম… ও আপনি তাহলে সবই তো দেখেছেন… উনি আমার ননদের শ্বাশুড়ি, মুর্শিদাবাদে থাকেন, কলকাতায় ঘুরতে এসেছেন। হ্যাঁ, সঙ্গের বাচ্চাটা ওনার নাতি।
-তা তোমার ননদকে তো দেখলাম না, সে বুঝি কলকাতা আসে নি?
…না না এসেছে, ওরা শপিংয়ে গেছে, শিগগির আমেরিকা যাবে তো তাই। আসবে বৈকি, ক’দিন বাদে, যাওয়ার আগে তো আসবে বটেই, আমার ননদও খুব সুন্দরি… আর কিছু জানার আছে আপনার?
-না না যাই তরকারি চাপিয়ে… দেখি পুড়ে গেল কিনা… বলতে বলতে বিদায় হলেন… ওঃ ভাগ্য করে এমন প্রতিবেশী পেয়েছিলাম বটে… একেবারে হাঁড়ির খবর ওনার দরকার…
যতীনও শুনেটুনে হেসে বললো, আমিও ভাগ্য করে বউ পেয়েছিলাম… যেন আমার রক্ষাকবচ। ওঃ এই পর্বটা নিয়ে বড় চিন্তায় ছিলাম… এত ভাল ভাবে উতরে যাবে ভাবিনি…
এগার
রাতের খাওয়াদাওয়া মিটতে জানকে শুতে পাঠিয়ে, বেশ খোশ মেজাজে সস্ত্রীক হাসি গল্পে সময় কাটাচ্ছিলাম, আসলে সংকল্পর ফোনের প্রতীক্ষাতেই বসেছিলাম। খুশির খবর তাই স্নিগ্ধাও আজ আমার সঙ্গি! আজও সংকল্পর সঙ্গে একটু আলাপটা ও সেরে নিতে আগ্রহী…
নাহ! ইপ্সিত কল এসে গেল, একেবারে স্পিকারটা অন করে দিয়েই শুরু করলাম, কিরে আজ তো আরো আগেই তোর কল আশা করে বসেছিলাম, আজই এত…
মুখের কথা কেড়ে নিয়েই, হ্যাঁগো কবিদা, খুশ-খবরি শোনার জন্য আমিও তাড়াতাড়িই ফিরছিলাম, রাতে তাড়াতাড়ি ডিনার করে শুয়ে পড়লে সক্কালবেলাই ভাল খবরটা শুনতে পাব… আমার এক কলিগ কল করে বলল, ফেরার সময় অন দা ওয়েতেই ও একটা ফ্ল্যাটের পাত্তা পেয়েছে। ভাল পোজিশনে এবং একদম নতুন তৈরি ফ্ল্যাট, ওর চেনা একজনের। ওনারশিপ ফ্ল্যাটের বিজনেস করে, সেই ওকে স্পেশালি ওর নিজের জন্যই সাজেষ্ট করেছিল। তাই আমাকে কালকেই ফ্ল্যাটটা দেখে ওকে রেজাল্ট জানাতে বলল, নইলে ঐ ফ্ল্যাটটার যা ডিম্যাণ্ড… ওনার, অন্য কাউকে অনেক বেশি দামে বিক্রি করে দেবে।
এত বড় একটা অপরচুনিটি ছাড়া মানে হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা… অতএব ফ্ল্যাটটা প্রতিটা কোণ থেকে দেখে, কি বলব আমি তো দারুণ ইম্প্রেশড। কোন ঘরটা মিতুলের হবে, সেটার ডেকরেশন, আমাদের বেডরুমের ডেকরেশন তারপর কিচেনের জন্য কি কি কিনতে হবে… ঘরগুলোর বেশ কয়েকটা ছবিও তুলে এনেছি, ওদের অবশ্য মোটামুটি ওয়েল ফারনিশড, তাও নিজের মনের মত করে সাজাতে হবে তো। প্রথম স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে নতুন সংসার পাততে চলেছি…
রাত করে শুয়ে ঐ সব প্ল্যান-প্রোগ্রাম ভাবতে-ভাবতেই দেখি রাত প্রায় শেষই হয়ে এসেছে। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছি, ব্যাস…
এবার বল, যদিও জানি তুমি সেন্ট পার্সেন্ট সাকসেশফুল, তবু তোমার কাছ থেকে রসিয়ে রসিয়ে শোনার মজাটাই আলাদা…
ব্যাটা তুই তো একেবারে গাছে না-উঠতেই এক কাঁদি নামিয়ে ফেলছিস। আরে এখনো অপুকে কবে বের করে আনতে পারব জানিনা, তুই এর মধ্যে ফ্ল্যাট বুক করে ফেলছিস…
নে আজ কি হল ভাল করে শোন, আজকের পুরো ক্রেডিটটা যার, তার মুখ থেকেই…
-যাঃ কি যে বলনা, তুমি সব ব্যবস্থা না করলে…
আরেব্বাস আজ তো আমার বৃহস্পতি তুঙ্গে, আমার জিনিয়াস বৌদির সুরেলা কণ্ঠ যেন আমার কানে মধু ঢেলে দিল…
-থাক আর আদিখ্যেতা করতে হবে না, আমার কণ্ঠই যদি তোমার কানে মধু ঢালে, তাহলে অপুরটা কি ঢালবে?
-বৌদি, নো নো দিস ইজ ভেরি ব্যাড, আমাদের দেওর-বৌদির মিষ্টি কথাবার্তার মধ্যে আবার অপুকে টানছ কেন? অপুকে ওর জায়গাতেই থাকতে দাও, তুমি আমায় বল, আমার কাছে তুমি ইনাম হিসাবে কি চাও, যা চাইবে, তোমার জন্য আমি কল্পতরু হয়ে যাব…
-শোন ছেলের কথা, দেওর-বৌদির কি ইনামের সম্পর্ক? আমার দরকার মত কেড়েকুড়ে নেব তোমার থেকে…
-দ্যাটস গুড, দারুণ বলেছ, একদম…
-আরে রাখ তো তোদের দেওর-ভাজের চ্যাংড়ামি, আমাদের কি রাতে ঘুমাতে দিবি না? যদিও কাল রোববার, তবু ঘুমটা তো দরকার…
-স্যরি কবিদা, বল এবার তোমার জরুরি কথা।
-শোন, দুজনে মিলে বুড়িকে আজ যা পটিয়েছি, সে নিজেই বলেছে, এবার খুকিরে একদিন পেটকে দোবো, ঝারির দাদার ফেলাট, সেইতি নিজিই দ্যাকপেনা তা হোতি পারে?
-ইয়াও কবিদা, কি বাঁধনে যে বেঁধেছ বুড়িকে… একদম ছক্কা, বিশাল ছক্কা। অপু তোমার বাড়ি আসলেই পাসপোর্টের ফর্মে ওর সই-সাবুদ তো করব, তার আগে ওখানে গিয়ে অপু আর মিতুলের একসঙ্গে একটা ফটো তুলে আমাকে পাঠিয়ে দেবে। ওদের সঙ্গে আমার ফটো জুড়ে একদম ফ্যামিলি ফটো বানিয়ে তোমাকে পাঠাব। তুমি পজেটিভ করে নিয়ে, নাঃ থাক আমি একসঙ্গে ১০/১২ কপি পজেটিভ করে তোমাকে পাঁচকপি পাঠিয়ে দেব। রেজিষ্ট্রি মেইলে পাঠাব, তুমি ৩/৪ দিনের মধ্যেই পেয়ে যাবে, ঐ ফটো ফর্মে লাগিয়ে রাখবে, আমি এখানে আগেই ফটো সহ সাবমিট করে দেব, তাহলে দিন-তিনেকের মধ্যেই পাসপোর্ট পেয়ে যাবে। তারপর…
-তারপরটা পাসপোর্ট পেলেই কথা হবে, রাত একটা বাজে ভাই। তুই তো গড়গড় করে অনেক দূর চলে গেছিস… তোর বৌদি তো গিয়ে লম্বা হয়েছে, আমারও চোখ বুজে আসছে এবার…
-ওকে ওকে, সত্যিই বড্ড দেরি করিয়ে দিলাম… বাই…
বারো
কিরে বাপ, কাল চোপর দিনডা তোর জননি পথের পানে তাক্কে তাক্কেই কেটে গ্যালো। খুকি বলতেলো… দাদার তো হপতায় দুটো দিনিই ছুটি, তা কালকের ডাতো মোদের তালেই গেচে… জাক গে তোদের সরিল গোতিক ভালো তো?
-আরে হ্যাঁ গো মা, ওই অপুর কথাই ঠিক। সারা সপ্তাহে তো ওই বাজারটা ছাড়া কিছু করার সময় হয়না, সবই তোমার বৌমাই সামলায়। তাই রোববার টা বাড়ি থেকে একটু আধটু সংসারের কাজকর্ম করি। জানের ও একদিন বাবার সঙ্গে বিকেলে একটু ঘোরাঘুরি… বুঝতেই তো পারছ, তারপর তোমার জামাই, ওঃ ব্যাটা কথা বলতে বলতে এত রাত করাল, একদম একটা বেজে গেল, মেয়ে-বউ তো ঘুমিয়ে পড়েছিল আগেই…
-হ্যারা, তা জামাই অতো রাত্তিরি কতা কয় ক্যানোরে, দিনমানে কোতি পারেনা কো? ঐ ছোঁরা তুই মুচকি মুচকি হাষচিশ ক্যানো রে বডডো বেষি বুজে ফেলোচো না… ঝত বরো হচচে ততো…
আরে তুমি ওকে বকছ কেন, ও তো তোমার কথা শুনেই হাসছে। তোমার জামাই তো সকালেই কথা বলে, অফিস যাওয়ার আগে। ওদের সকাল মানে আমাদের এখানে রাত, বুঝেছ? মিতুল তো এখন পড়াশুনা করে জানতে পারছে…
-আললা রে মুই মুক্কু শুককু মানুস, ওষব কি মুই জানি? তা ষে বেটারে তুই দেকিচিষ খোকা? চ্যায়রা খান কেরম ভালো মতোন নাকি হাটডা গোটডা?
ওমা, সে তো আমার বন্ধুই ছিল, কলকাতার কলেজে একসঙ্গেই তো পড়তাম। ওর খুব ভাল মাথা, তাই ভাল রেজাল্ট করে আবার ইউনিভার্সিটিতে পড়ে খুব ভাল রেজাল্ট করেছিল। তারপর তো ভাল চাকরি পেয়ে আমেরিকায় গেছে, তবে কলেজের পরে আর আমার সঙ্গে সংকল্পর দেখা হয়নি… এর মধ্যে অপুর সঙ্গে যে এই সব ব্যাপার, আমি তো তার বিন্দুবিসর্গ ও জানিনে। এত ভাল ছেলে, তার সঙ্গেই যে… তা আমাকে কি মায়ের সঙ্গে বল, তা না করে বোকার মত ভয়েই বাড়ি থেকে পালাল (মিতুল পড়তে চলে গেছে তাই বললাম), তাও তুমি পেয়েছিলে তাই বেঁচে গেল… নইলে কোন বদমায়েস লোকের নজরে পড়লে…
এই খোকা তুরির কাচে ঐ কি ছাতার নাম, সোমকলপোর কোনো ফটোক আচে দেকা দিনি…
ওই দেখো, ফটোর কথা বললে তাই মনে পড়ল, সংকল্প ওদের একটা ফটো তুলে পাঠাতে বলেছে। ঐ ফটোর সঙ্গে সংকল্পর নিজের ফটো সেট করে একেবারে ফ্যামিলি ফটো বানিয়ে পাসপোর্টে লাগালে অপু আর মিতুলের পাসপোর্ট, ভিসা সব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। কালকেই আমার মোবাইলে ওদের ফ্যামিলি ফটো এসে যাবে, তখন একেবারে ভাল করে দেখ, মেয়ের সঙ্গে জামাই মানিয়েছে কিনা…
-মুই বোকা বোলেই তুই ঝাতা বুজগে দিলিই হবানি, এষব ষততি কোরে হোতি পারে, ষে কমনে রোয়েচে আর একেনের তে ফটোক তুলে…
-মা, আমি তোমার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলি কখনও? আরে একটা দিনের তো ব্যাপার, কালকেই তুমি সত্যি-মিথ্যে যাচাই করে নিও, মিতুল না-ফিরলে ফটো তোলা তো হবেনা। আমাকে এখন একটু বসতে হবে… অপুই বা কোথায় গেল?
-ষেইতি তো আননা ঘরে… একুনি দুজোনেই এষে জাবানি… তারির আগে মোরে এটটা কতা ক’দিনি, তুরির কতাবাত্রা ষুনে ঝা মালুম হচচে, জামাই একেনে এষেই খুকিরে শিঁদুর নাগিয়ে নে হাঁটা দোবার মতলোব কোরতিচে। এতো ডা ষোযা বেপার হোতি মুই দিলি তো…
(এইরে, বুড়ির মাথায় আবার কি পোকা কামড়াল… কে জানে বাবা মনেমনে তো ভয়ই লাগছে, শেষে কি তিরে এসে তরি ডুববে?)
-ষোন খোকা, তোঙ্গা ঝ্যামোন ঝ্যামোন ক্রিয়া কমমো মেনে বে হয়, মুই বেযাতির হলিউ মেয়েডা তো হিঁদু আবার জামাইডাও তোদেরি সজাতির…
(উঃ এতক্ষণে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল) …মা, তুমি এটা নিয়ে ভাবছ? দুর… সে আমি কালই সংকল্পকে মোটামুটি আভাস দিয়ে রেখেছি… তোমার কোন কথাই এখানে খাটবে না, আমার মা এতদিন ধরে অপুকে মেয়ের মত করেই রেখেছে তাই আমরা যা বলব, তোমাকে সেই মতই করতে হবে।
ওমা, আমি তো একটা জানাশোনা বিয়ে বাড়ির মালিকের সঙ্গেও কথা বলে রেখেছি, কিন্তু তোমার মত না নিয়ে তো ফাইনাল কথা বলতে পারিনি। তুমি দিনটা বল, তাহলেই বুক করে ফেলব, তবে মা দেখ ওই তো আমার একটা মাত্র মা-বাপ হারা বোন, আমার যথাসাধ্য খরচ করে বিয়ে দেব। ধর দান সামগ্রি তো কিছু দরকার নেই, অপুকে একটু সাজিয়ে দেওয়া, তাও অল্পস্বল্প গয়নাগাঁটি আর ক’খানা ভাল শাড়ি, আর সংকল্পর একটা গলার চেন আর বরের পোষাক…
তোমার যদি কিছু…
-হ্যারা, মোর মেয়ে, তারিরি কি মুই খালি হাতে বে দোব, মোর ঝা আচে তাই দে জামাই ডার ঝা নাগবে আর খুকির জন্যি এটটু গয়না পত্তর ঝা নাগবে…
-ওমা সে তো অনেক খরচ, তোমার জমানো সব যদি শেষ করে দাও… তোমার চলবে কি করে?
-মোর এমোন সোমত্ত ব্যাটা থাকতি মোর চিনতে কত্তি… চুপ মার, ঐ ছোঁরা এষে পোড়েচে, তুই এবেরে ফটোক তুলে নে বারি পানে হাঁটা দে, আত্তির হচচে না…
তের
একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা বাড়ি… গুনগুন করতে-করতে ওপরে উঠেই দেখি, একগাল হাসি নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আমার হোম মিনিষ্টার… কিগো আজ একেবারে ট্যাক্সি থেকে নেমে সুর ভাঁজতে-ভাঁজতে হাজির। নিশ্চয় কোন খুশ খবর…
ভিতরে ঢুকে পেছনদিক দিয়ে দরজাটা লক করে জাপটে ধরে স্নিগ্ধার ঠোঁটটা চেপে ধরলাম… ও ঈশারায় ভিতর দিকে মেয়ের ঘরটা ইঙ্গিত করল। এবার…. কইরে মা আমার জান…
এই তো বাবি… আয় মা, বলে ওকে খুব আদর করে দুজনকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বললাম… এই আমাদের সুখি পরিবার…
স্নিগ্ধা বলল, ওসব ছেড়ে এত আনন্দের কারণটা এবার বল?
নাহ, ডিটেইলস বলতে পারছিনা, পরে সংকল্পকে যখন বলব শুনে নিও, এখন আসল খবরটাই বলি… অপুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, নেক্সট উইকেই। সংকল্প ল্যাণ্ড করার দু’দিন পরই, কালই অফিসে গিয়ে, জরুরি প্রয়োজন বলে পনেরো দিনের ছুটির এ্যাপ্লিকেশন করতে হবে। ঐ দিনই অপুদের পাসপোর্টের ফর্ম জমা দিয়ে কাজের শুরুয়াৎ…
জান তো হাততালি দিয়ে লাফাতে লাগল… কি মজা, পিসির বিয়ে, বাবি আমাকে ভাল নতুন জামা দিতে হবে…
এবার সে সব তোর কাকুর ব্যাপার…
তাহলে তো আরো মজা…. নাচতে-নাচতে ঘরে চলল জান।
খাওয়া দাওয়া মিটতে গুডনাইট করে জান চলল নিজের ঘরে, খুব সিনসিয়ার হয়েছে এখন থেকেই। এবার সিক্স হ’ল ওর, সেন্ট্রাল মর্ডানে পড়ে , প্রিন্সিপালও খুব প্রশংসা করেন ওর… সি ইজ নট ওনলি সিনসিয়ার, সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট অলসো। সত্যিই বাড়িতে ও নিজের কাজগুলো নিজেই করে, ওর ঘরটা নিজেই গুছিয়ে রাখে, বই-খাতা সব, নিয়মিত হোমটাস্ক করে রাখে। আপন মনে সিগারেট খেতে-খেতে ভাবছ, স্নিগ্ধা রান্নাঘরের কাজ সেরে এসে বসল আমার গা ঘেঁসে। বেশিরভাগ দিনই শুয়ে পড়ে, জানের স্কুলবাসে তুলতে যেতে হয় মোড়ের সামনে, সাতটায় বাসটা ওখানে থামে, ওরা সাড়ে ছটায় বাড়ির থেকে বেরোয়। তার আগে মেয়ের টিফিনটা রেডি করে দেয়, জান শুধু এক কাপ কমপ্ল্যান খেয়ে বেরোয়…
ঐ ব্যাটা সংকল্পর কল এসে গেল… কবিদা, আজ কা সমাচার?
প্রথমে একটু নেচে নে, তারপর শুনিস…
হাসতে হাসতে… কবিদা, আজ কি সত্যিই আনন্দে নাচার মত খবর আছে নাকি? ওঃ কবিদা বলনা… আমি যে আর ধৈর্য্য ধরতে পারছি না…
তুই সেই একই রকম রয়ে গেলি, কলেজে থাকতেও কোন কথা শোনার জন্য একেবারে অস্থির হয়ে পড়তিস, তাই শুধু না, নিজের ও সব খবর সবাইকে জানিয়ে দিতিস। কিন্তু অপুর ব্যাপারটা কি করে হজম করে ছিলি বলত?
আরে কবিদা তুমি ভুলে যাচ্ছ… অপুর সঙ্গে কোর্টশিপ চলাকালিন আর তোমাদের সঙ্গে আমার কোন যোগাযোগ ছিল নাকি?
ঠিক ঠিক, তাই ত, যাক শোন… বুড়ির সঙ্গে আদ্যোপান্ত আলোচনা সবই হুবহু বলে নিজের প্ল্যান করে মিথ্যে বলাটাও বললাম। কিন্তু আসার সময় একদম বিয়েবাড়ি বুক করেই এসেছি, এখন তো অফ সিজন তাই বাড়ি আ্যভেলেবেল আর রেটটা ও কিছুটা কমই। ঐ হাডকোর কাছাকাছিই বাড়িটা, আমাদের ও যাতায়াতের সুবিধা… ওদের জন্যে একটা গাড়ি সারা দিনের জন্য থাকবে।, সকাল থেকেই ঐ বাড়িতেই খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে।
তাহলে কবিদা, আমি তো থার্ড ডিসেম্বর নামছি, বিয়েটা সেভেন্থে… খুব হেকটিক হয়ে যাবে। আমি তো ফিফথে, জান আর বৌদিকে নিয়ে বিকেলটা পুরো শপিং নিয়ে ব্যস্ত থাকব, তুমি ওদের বাড়ির সবাইয়ের জন্য দামি শাড়িটাড়ি কিনে এরমধ্যে বুড়ির হাতে তুলে দিও, উনি নিজের ইচ্ছামত যাকে যা দেওয়ার দেবেন। তোমাকে কিন্তু ঐদিন ঠিক আমার মতই সাজতে হবে…
-আরে তোর যা লাগবে, সে তো বুড়িই দেবে…
-ঠিক আছে তোমারটা আমিই কিনব, তুমি হলে বরকর্তা…
-দুর ব্যাটা, আমি তো মেয়ের দাদা, মানে কন্যাকর্তা। তুই তোর বন্ধুদের বরযাত্রি বানিয়ে নিয়ে আসবি…
-ঠিক আছে, তুমি কন্যাকর্তা হলেও আমার মতই সাজবে, ব্যাস দিস ইজ ফাইনাল…
-আচ্ছা, তোর জ্বালায় এই বুড়ো বয়সে না হয় আবার বর সাজব…
-ষ্টপ ইট ননসেন্স, কিসের বুড়ো, চেহারা তোমার বরাবরই ভারি, একসঙ্গেই তো পড়েছি আমরা। হার্ডলি তুমি হয় তো বছর দুয়েকের বড়ই হবে…
-আচ্ছা, ওদিকে তো অনেকদূর এগিয়ে গেলি, ফটোটা পাঠা… বুড়ি তো ওদিকে জামাই দেখার জন্য অস্থির হয়ে।।, তারপর পাসপোর্ট-ভিসা, সেগুলো তো আগে লাগবে, নাকি?
-স্যরি, স্যরি, আমি অফিস গিয়েই তোমাকে এ্যাডজাস্টেড ফটোটা পাঠিয়ে দিচ্ছি আর ফেরার পথে পজেটিভ গুলো করিয়ে, কালই রেজিষ্টার্ড পোষ্টে পাঠিয়ে দেব। ওকে গুডনাইট কবিদা…
চৌদ্দো
মোবাইলে এ্যাডজাষ্টেড ফ্যামিলি ফটোটা দেখে বুড়ি তো একেবারে হতভম্ব, হ্যারা খোকা তুই ঝা বলিলি, সেডা ঝে এইরম সততিকারের হোতি পারে মোর বিস্যেশই হইনি কো…
মিতুল টিউশন থেকে ফিরে মোবাইলটা হাতে নিয়ে খুশিতে ডগমগ হয়ে, মামু আমার পাপা এত হ্যাণ্ডসাম? মা, ও ঘরে কি করছ এসনা প্লিজ দেখ, মাই পাপা ইজ সো হ্যণ্ডসাম…
নীলু চোখ মছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে দাদার জন্য চা-টা নিয়ে এসে দাদার সামনে দিয়ে মিতুলের চুলটা ঘেঁটে দিয়ে বলল, হ্যাঁ সোনা তোমার পাপা ইজ রিয়্যালি এ হ্যাণ্ডসাম গাই।
-হ্যারা খোকা, ছোঁরাডা ইংজিরিতে কি বোলতেছ রে….
-ও কিছু না মা, ওর বাবা কত্ত সুন্দর দেখতে, তাই…
-ওদিকি খুকির চোকে পানি এসতেচে তা দেকিচিস?
-হবে না, সংকল্পর ফটোও তো এতো বছর দেখেনি… মা ওসব ছেড়ে আমার একটা কথা তোমাকে শুনতে হবে, সংকল্প আসার আগে তোমার ভাষাটা একটু পাল্টাতে হবে।
-মুইও ভাবতি চিলাম, সত্যি কতা বলতি মুই দুদিন তে চেসটাও করতিচি পানি না বোলে জল বোলতি, মোনে থাকে না। এইবেরে ঐ ছোঁরার কাচ দে সিকতি হবে।
-সোন খোকা তুরির সোনগে এট্টা গোপন কতা আচে, এই বারিডা নে এট্টা কতা ভাবচিলাম, নিজির মোনেই ঘেন্না ধোরে গেচে এই বেওসা আর করবই নাকো।
-সোন বাপ, মোর এই পুরনো বারিখান ঝদি পোমোটারির হাতে দিতি চাই ওরা নেবেনে?
-কি বলছ মা, ওরাতো হাঁ করে আছে, বাড়ির তো কোন দাম দেয়না, সে পুরনো নতুন যাই হক, তোমার এইরকম জায়গায় রাস্তার ওপরে এতটা জমি… ওরা একেবারে লুফে নেবে আর ভালই দামও পাবে তুমি।
কতা হচচে ঐঝে একোনো ষাতডা মেয়ে, ওরা আর একেনের তে কমনেই বা জাবে, তাই ওরগা জননি দুতোলায় এটটা কোরে ছোটোপানা, একঘরের ফেলাট দোবো আর মোর একখান ফেলাট তারির নাগোয়া এটটা তিন ঘরের বরো ফেলাট নাগপে। এইসব ছেরেদে ঝা দর হবানি তারতে ঐ ছুঁরিগুনোরে লাখট্যাকা কোরে হাতে দে বলবো এই কায এবেরে ছারতি হবে, ঐ ট্যাকার ঝা ষুদ ওঠপে তাইদে চালাতি হবানি। ঝে দুযোনের খাটার মতন রুপ জৈবন নিইকো, গতোরেও খ্যামতা নিইকো, ওনাদের দুমুঠো খাতি দিলি ওনাদের ট্যাকার ষুদডাও জেইতি খাতি দেবে ষেইতিই পাবানি।
-মাগো তোমার মনটা এত বড়, আগে জানতেই পারিনি মা। তোমার পায়ের ধুলো নিতে ইচ্ছে হচ্ছে মা…
একলাফে সরে গিয়ে, খপোরদার ঐরোম কতা আর ককখনো কোবিনে, মোরে পাপের ভাগি কোরতি চাষ…
পনেরো
বাড়ি ফেরার পথে আবেগের তাড়নায় চোখে জল এসে যেতে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম আর দরজা খুলে স্নিগ্ধাও অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভিতরে চলে গেল। আমি ঘরে ঢুকে নিঃশব্দে ল্যাপটপ খুলে প্রোমোটারদের কয়েকজনের নাম্বার নোট করে নিয়ে গোটা চারেককে কল করে কথা বলতে গিয়ে একজনকে মোটামুটি পরিচিত মনে হতে, মানে ও আমাদের কলেজেরই ষ্টুডেন্ট, অপুদের ব্যাচ মেট। ওর সঙ্গে দুপুর তিনটেয় এ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্স করে রাখলাম, অপুকে জানিয়েও দিলাম।
রাতে সংকল্পর সঙ্গে পুরো ঘটনাটা বলার সময়, স্নিগ্ধাকে পাশে ডেকে নিয়েছিলাম। দেখ সংকল্প একজন অশিক্ষিত বৃদ্ধার মনটা যে কতটা বড়, আজ তাঁর প্রস্তাব শুনে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। ঝপ করে তাঁকে মা বলে ডেকে পা জড়িয়ে ধরেছিলাম, তিনি তো ছিটকে সরে গিয়ে… ওরে খোকা এরম কোরে আমারে পাপের ভাগি কোরে ফেলালি, আল্লা ঝে আমারে কোন ভাগারে ফ্যালবানি তার নিকেস নিইকো…
মাগো এতদিনে সত্যি সত্যি তোমাকে চিনলাম, ভাগ্য করে তোমার মত মা পেয়েছি আমি…
ও এই জন্য বাড়ি এসে অবধি থমথমে মুখ নিয়ে কেবল ল্যাপটপে কাজ করছিলে?
হ্যাঁ গো স্নিগ্ধা, আমার এই মা নিজে হাতে করে ঐ বেশ্যাবৃত্তি করা মেয়েদের ঐ অন্ধ গলি থেকে রাজথে নিয়ে চলেছে। আজ এটা সত্য বলে প্রমাণিত… পাঁকেই পদ্ম জন্মায়… আজ আর কথা বলার মুড নেই, চলি ভাই… গুড নাইট…
বাস্তবেও এমন ঘটনা ঘটে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, ছেলেটি তার দায়িত্ব অস্বীকার করে সরে পড়ে। এমন উদ্ধারকারী আর দেহ পসারিনী ব্যাবসায়ী মাসিও কদাচিৎ পাওয়া যায়। সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ হেতু গল্পাকারে সমাজ শিক্ষাই মূল উদ্দেশ্য।