আঁধার রাতে তারাভরা নীল আকাশ আর
নিঃসঙ্গ চাঁদের উপচে পড়া হাসি,
গোধুলির শেষ রঙ, লাল মেঘ
তাকে আমি সৌন্দর্য বলি না, আমার
অনুভূতি শুন্য হাত দিয়ে তা ছুঁয়ে দেখিনা।
শান্ত সমুদ্রে সোনালি পাখির ওড়াওড়ি, অথবা
তরুণ ওক গাছের লতার ঝুলন্ত ফুল থেকে
হামিংবার্ডের চমৎকার কৌশলে মধু পানের
দৃশ্য আমার কাছে মুগ্ধতার আবেশ ছড়ায় না।
স্নিগ্ধ গ্রামীণ নদীর উভয় পাশে ঢেউ খেলানো
ধানের ক্ষেতে মুগ্ধতায় আমি হাবুডুবু খাই না।
দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠে আর আমার
চোখ জুড়ায় না। পাথরের ওপর দিয়ে
নিরিবিলি বয়ে যাওয়া নায়াগ্রার ঝর্ণা জলের
গোলক ধাঁধায় আমি আত্মহারা হই না।
ভ্যান গগের পেইন্টিং, দা ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’
মেলে ধরে না আমার কাছে সৌন্দর্যের ডালা।
অজ গাঁয়ের অচেনা যুদ্ধ ক্ষেত্রের
যে গণকবরে শুয়ে আছে নাম না
জানা বীর সন্তানরা চিহ্নহীন স্মৃতিফলক নিয়ে,
সেটি আমার চোখে আইফেল টাওয়ার অথবা
বুর্জ খলিফার চেয়ে নজরকাড়া ভাস্কর্য।
টাকার অভাবে কিনতে না পেরে
গরুর সঙ্গে ভাগাভাগি করে
লাঙ্গল টানা নাগেশ্বরীর শরীর
নুয়ে-পড়া কৃষক সলিম আলি,
যার কপালের ঘামের নোনাজলে
বৃষ্টিহীন শষ্য ক্ষেতের তৃষ্ণা মেটে,
তার মুখ সবচেয়ে সুন্দর আমার কাছে।
আধা অন্ধ বৃদ্ধার লাঠি ধরে ট্রাফিক পুলিশের
ব্যস্ত সড়ক পার করার ছবিটি অতি মনোহর।
মৃত্যু পথযাত্রী যে বৃদ্ধ তার নাক-মুখ
থেকে ভেন্টিলেটর খুলে এগিয়ে দেয়
বাঁচার আশা প্রত্যাশী কোন তরুণের
দিকে, তার জন্যই আমার জনমের শ্রদ্ধা।
পর্যাপ্ত সুরক্ষা পোষাক ছাড়াই যে স্বাস্থ্যকর্মী
জীবনের ঝুকি নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য
সকালবেলা হাসিমুখে ঘর থেকে বের হলো,
এ অবাস্তব সময়ে সে-ই সবচেয়ে বড় মুক্তিযোদ্ধা।
আমি অপলক চেয়ে থাকি, ঢেঁকির ওঠানামার দিকে,
কামারশালার হাপরের দিকে, আমি চেয়ে
চেয়ে থাকি মাছধরা জালের দিকে, কাদা জলে
ধান রোয়া সেই সাঁওতাল রমণীর দিকে,
শষ্য বোঝাই গরুর গাড়ির চাকায়,
রাতের জোনাকির আলো, ঝিঁঝি পোকার ডাক
আর মাঠ ভারি হয়ে নামা নীল কুয়াশায়
দিগন্তের ভেঙে যাওয়া প্রাচীরের দিকে।
স্কুলে পড়তে পড়তে যে বালক চায়ের
দোকানে কাজ নিয়েছে, যে যুবক মাথা
কুটেও একটা চাকরি জোটাতে পারেনি,
সে-ই আমার কাছে সৌন্দর্যের উপমা,
অজানা সুর আমার না গাওয়া গানের।
আমার সঙ্গে কীভাবে যেন আত্মীয়তা
গড়ে ওঠে ওদের। দু হাত প্রসারিত করে
এদের আলিঙ্গনের চেয়ে বড় কোন
আনন্দ নেই আমার।
বারবার বিয়ে ভাঙ্গা কালো মেয়েটি
যেমন তার বাবার কাছে সবচেয়ে সুন্দর,
ওরাও আমার কাছে তেমনি
আমার চোখের মণি।
এদের জন্যই বিশ্ব
আজও অসুন্দর হয়ে যায়নি।
সৌন্দর্য
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
কবি ও গল্পকার। জন্ম ১৫ জুলাই, রংপুরে। বর্তমানে বসবাস করছেন কানাডার টরন্টো শহরে। ১৯৯১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। সাংবাদিকতা ও পরে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন। ছোটগল্প ও কবিতা লিখছেন দীর্ঘদিন ধরে। গল্পগ্রন্থ “যাপিত জীবন” বিভাস থেকে বেরিয়েছিল ২০১৫ সালে।
একটি মন্তব্য করুন
একটি মন্তব্য করুন