বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩৬০ কোটি মানুষ সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে। তারা বছরে অন্তত একমাস এই ভোগান্তির সম্মুখিন হচ্ছেন। এই সংকট আগামী কয়েক দশকে আরও খারাপ হতে পারে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষ পানিসংকটে ভুগতে পারে।
মঙ্গলবার (২৯ নভেম্বর) জাতিসংঘের সহযোগী বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) “স্টেট অব গ্লোবাল ওয়াটার রিসোর্সেস ২০২১” প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। চীনভিত্তিক সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে।
এর আগে এ বছরের মার্চে জাতিসংঘের পানি উন্নয়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, আগামী তিন দশক ধরে প্রতিবছর বিশ্বে পানির ব্যবহার ১% বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানি সরবরাহের প্রচলিত উৎস খাল ও বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বেড়ে যাবে ভূগর্ভস্থ পানির চাহিদা। বতর্মানে বিশ্বের ৯৯% সুপেয় পানি আসে ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহব্যবস্থা থেকে। কিন্তু এর গুরুত্ব না বোঝা, প্রতিনিয়ত অবমূল্যায়ন করা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে এই সরবরাহব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ইউনেসকোর করা প্রতিবেদনটির প্রধান সম্পাদক রিচার্ড কনর। তিনি বলেছিলেন, “বৈশ্বিক পানিসংকটের সমাধান যদি আমাদের অজ্ঞাতেই থেকে যায়, তাহলে কেমন হবে? ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে এ থেকে আমরা অনেক সুবিধা পাব।”
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পানির সরবরাহব্যবস্থায়ও চাপ বেড়েছে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি ও এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিষয়টির ওপর আরও গুরুত্ব দিতে হবে।
ভূগর্ভস্থ পানির কেন এত গুরুত্ব, তার ব্যাখ্যাও জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিশ্বের মোট পানির মাত্র ১% সুপেয় পানি, যার বেশির ভাগই পাওয়া যায় বরফের তলে। বাকি পানি লবণাক্ত। সুপেয় পানির মান সাধারণত ভালো হয়ে থাকে। কোনো ধরনের শোধন ছাড়াই এ পানি নিরাপদ ও সহজে ব্যবহার করা যায়।
অপরদিকে পৃথিবীর উপরিভাগের পানি সাধারণত খাল-বিল ও লেকে সংরক্ষিত থাকে। এই পানিসম্পদ সীমিত। দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তীব্র খরা দেখা যাচ্ছে। এতে পরিবেশগত ও সামাজিক ক্ষতি হচ্ছে। সে তুলনায় ভূগর্ভস্থ পানির ভবিষ্যৎ অনেকে ভালো। ১০ থেকে ২০% পানি প্রাকৃতিকভাবে পুনরায় উৎপন্ন হয়। আর এই পানি সহজেই সরু পাইপের মাধ্যমে গভীর থেকে তুলে আনা যায়।
উন্নত প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরিতে ভূগর্ভস্থ পানি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কৃষিকাজে ব্যবহৃত পানির এক–চতুর্থাংশই আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। বিশ্ববাসীর দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত পানির অর্ধেকই সরবরাহ করা হয় ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। গ্রামীণ জনপদের মানুষের বিশুদ্ধ খাবার পানির সবচেয়ে সস্তা মাধ্যম এটি। গ্রামের মানুষ সরকারি কিংবা বেসরকারি পানি সরবরাহব্যবস্থায় সঙ্গে জড়িত নয়। তবে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলা হলে পরিণতি খারাপ হতে পারে। এর ফলে জমি শুকিয়ে পানির সরবরাহ কমে যেতে পারে।
২০১৮ সালে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পানিসংকটের মুখোমুখি হয়েছিল ভারত। দেশটির সরকারি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ভারতের ১৩০ কোটি জনসংখ্যার অন্তত ৪০% মানুষের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে খাওয়ার পানির নির্ভরযোগ্য কোনো উৎসের সুযোগ থাকবে না।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ঘন ঘন খরা হচ্ছে। এ কারণে বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল ভারতের কৃষিকাজে বিঘ্ন ঘটছে। এ ছাড়া দেশটির বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে বাড়ছে বিরোধ। এর ফলে ফসল উৎপাদনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ মানবসভ্যতা টিকে থাকতে হলে সুপেয় পানির কোনো বিকল্প নেই। আমাদের মাটির নিচে এমন কিছু অদৃশ্য সমাধান লুকিয়ে আছে, যার মাধ্যমে মিলবে এই সংকটের সমাধান।
মঙ্গলবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে ডব্লিউএমও”র সেক্রেটারি জেনারেল পেটেরি তালাস বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তীব্র ও ঘন ঘন খরা, চরম বন্যা, অনিয়মিত মৌসুমী বৃষ্টিপাত এবং হিমবাহের দ্রুত গলে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। এসব বিষয়কে বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বসহকারে নেওয়ার বা বোঝাপড়ায় ঘাটতি রয়েছে। ডব্লিউএমও রিপোর্টের লক্ষ্য এসব বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা। আগামী পাঁচ বছরে বন্যা ও খরার মতো বিপদের আগাম সতর্কবার্তার সার্বজনীন অ্যাক্সেস প্রদানে এটি সহায়ক ভূমিকা রাখবে।”