নিজের সঙ্গেই নিজের ঝগড়া
কোনো অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করতে যাওয়া, সংবর্ধনা নেওয়া, পুরস্কার বা স্মারক গ্রহণ করা আমার কাছে ভীষণ হাঙ্গামার ব্যাপার। এসবের যদি ডাক বা আমন্ত্রণ না পাই তাহলে আমার খুব আনন্দ হয়। নিজের সঙ্গে নীরবে নিভৃতে কিছুটা সময় কাটানোই আমার কাছে বড় মূল্যবান। মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন এসে হাজির হয়। কী হবে কবিতা পাঠ করে? কী হবে পুরস্কার নিয়ে? কী হবে সংবর্ধনা? কী হবে মান-সম্মান? কী হবে যশখ্যাতি?
নিজের প্রশ্নে নিজেই জর্জরিত হই। অনেকক্ষণ নিরুত্তর থাকি। তারপর আবার বলি: কী হবে তাহলে লিখে? হ্যাঁ লিখে কিছুই হবে না, না-ও লিখতে পারতাম, কিন্তু নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার একটা মাধ্যম এই লেখা।
নিজের মতো নিজের বন্ধু আর কে হবে? কে শুনবে আমার কথা? কে জানবে আমার ব্যথা? কে বুঝবে আমার শূন্যতা? এই যে দীর্ঘশ্বাস, এই যে হাহাকার, এই যে অন্তহীন না ভালোলাগা, এই যে বিষাদ, এই যে কিসের যন্ত্রণা—এসবের যে সমাধান নেই তা কাকে বোঝাব? তখনই এই লেখাই আমার আয়না হয়ে সামনে দাঁড়ায়। এই লেখাই আমার অনুভূতি হয়ে আমাকে স্পর্শ করে। এই লেখাই আমার মর্মের ভাষা হয়ে প্রতিধ্বনি তোলে। আমি কি যশের জন্য লিখি? আমি কি সংবর্ধনার জন্য লিখি? আমি কি পুরস্কারের জন্য লিখি? আমি কি সাহিত্য অনুষ্ঠানের জন্য লিখি?
না, আমি কিছুর জন্যই লিখি না। আমি শুধু নিজের জন্যই লিখি। যখন পারিপার্শ্বিক পৃথিবী সংকীর্ণ হয়ে আসে। যখন সমাজ আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে কোণঠাসা করে দেয়। যখন রাষ্ট্র আমার ব্যক্তি স্বাধীনতায় বারবার ঘা দিতে থাকে এবং আমার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। তখন তো লেখা আপনিই বেরিয়ে আসে। যা নিজের জন্য লিখি তা সমস্ত মানুষের জন্যই হয়ে যায়।
যা নিজের কষ্ট থেকে উদ্ভূত হয়, তা সমস্ত মানুষের কষ্টেরই প্রকাশ হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং আমার কষ্ট বিক্রি করা, আমার আত্মক্ষরণ বিক্রি করা, আমার মর্মপীড়ন প্রদর্শন করার কি কোনো পুরস্কার হতে পারে? সংবর্ধনা হতে পারে? যশখ্যাতি মান-সম্মান তার বিনিময় হতে পারে? না, পারে না। তাই আমি সেইসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থেকেই আমার এই উদ্বেগ, আমার এই দগ্ধতা, আমার এই পীড়িত আত্মার সদ্গতি কামনা করতে পারি। নিজেকে ভালো রাখতে পারি।
অবশ্য একটা সময় ছিল তারুণ্যের উন্মাদনায় বহুদূর পর্যন্ত চলে যেতাম। বীরভূম থেকে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন প্রান্তে সাহিত্য অনুষ্ঠানগুলিতে হাজির হতাম সাইকেল চালিয়ে। রাস্তার ধারে দোকানগুলিতে চা খেতে খেতে কখনো দুপুর গড়িয়ে গিয়ে হাজির হতাম। মাঝে মাঝে ফিরতেও পারতাম না। কারও না কারও বাড়িতে রাত্রি বাস করতাম। বিশেষ করে ‘পূর্বাভাস’ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালামের সঙ্গেই থাকতাম। একবার কান্দি থেকে আরও বহুদূর এক গ্রামে মানোয়ার হোসেন নামে এক সাহিত্যিক সুজনের বাড়ির উঠোনেই ত্রিপল টাঙিয়ে আমরা রাত্রিবাস করেছিলাম।
ভ্রাম্যমান সাহিত্য আড্ডায় দু-তিন দিন বাড়ি আসাও সম্ভব হতো না। কবিতার টানে পথে-ঘাটে ছোটখাটো সাহিত্য আড্ডাও চলত। সাইড ব্যাগে শুধু কবিতার পাণ্ডুলিপি আর একটি জলের বোতল আর বহুদিনের একটি পুরনো সাইকেল এটাই ছিল সঙ্গী। তখন মোবাইলের যুগ ছিল না। ক্বচিৎ কারও কারও বাড়িতে ল্যান্ড ফোন ছিল। আমাদের যোগাযোগ মাধ্যম ১৫ পয়সার একটা পোস্ট কার্ড মাত্র। সাহিত্য অনুষ্ঠানগুলিতে শালপাতার ঠোঙায় দেওয়া হতো মুড়ি আর তেলেভাজা চপ কিংবা পিঁয়াজি। কখনো কখনো ঘুগনি। সাহিত্যিকদের কেতাদুরস্ত সাজপোশাকও ছিল না।
সকলকেই মনে হতো আটপৌরে হাটুরে লোক। হাওয়াই শার্ট অথবা পাঞ্জাবির সঙ্গে থাকত লুঙ্গি-পাজামা অথবা ধুতি। আজকের দিনে মাঠে-ঘাটে এই সাহিত্যসভার হাল দেখলে মেঠো সাহিত্যিক বলেই এঁদের মনে হতো। তবু যেন এর মাঝেই কোথাও একটা আনন্দ খুঁজে পেতাম। সাহিত্যিকরা বেশিরভাগই সমাজের নিম্নস্তরের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। কেউ কাপড় সেলাই করা দর্জি, কেউ লাঙল ঠেলা কৃষক, কেউ জনমজুর খাটা মানুষ, কেউ কাপড় ফেরি করা হকার, কেউ গ্রামের হাটে সবজি বিক্রেতা, কেউ টিউশন মাস্টার।
সাহিত্য অনুষ্ঠানের সভাপতি বা উদ্যোক্তা যিনি হতেন, তিনি কোনো প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয় এর শিক্ষক। অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হিসেবে তাঁর মতামতই শিরোধার্য হতো। আমরা অপেক্ষায় থাকতাম তিনি কী বলেন আমাদের সাহিত্য নিয়ে সেই দিকেই। যদি ভালো কিছু বলতেন, তাহলে প্রচণ্ড উৎসাহ পেতাম। আর কিছুই না বললে, অথবা মন্দ কিছু বললে আরও জেদ চেপে যেত ভালো কিছু লেখার। এভাবেই আনন্দ অথবা জেদ নিয়ে বাড়ি ফিরতাম।
এখন সে-সব আর নেই। সাহিত্যটা মনে হয় কাউকে খুশি করার জন্য আর লিখি না। কেউ ভালো বা মন্দ বললেও কিছুই যায় আসে না। সব জেদ অথবা অভিমান ফুরিয়ে গেছে। মান-সম্মান, খ্যাতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও আর নেই। এখন চার চাকার গাড়ি দিলেও সাহিত্য অনুষ্ঠানে যেতে মন চায় না। নতুন লেখা কাউকে শোনাতেও ইচ্ছে করে না। এক নিস্তব্ধতার মধ্যে আত্মদর্শনের মুহূর্তগুলি একা একা যাপন করি। কেউ যদি না ডাকে, পুরস্কার বা সম্মান না জানায় তাহলে আরও কিছুটা মুহূর্ত নিজের জন্য খরচ করতে পারি। ইচ্ছেগুলির কত পরিবর্তন হয়ে গেল এবং দিন দিন আরও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে যার জন্য আমি নিজেই আশ্চর্য হচ্ছি।
সাহিত্য রচনা শুধু যে নিজেকে ভালোবাসা তা কিন্তু মনে করি না। এক আত্মতাড়নার অনিবৃত্তি থেকেই সত্যের জাগরণ। যার মধ্যে আমার ঈশ্বরচেতনা, জীবনচেতনা, প্রকৃতিচেতনা এবং মানবচেতনাও ধরা দেয়। এত বীভৎসতা, অমানবিকতা, ধ্বংসময়তা, কদর্যতার মধ্যেও কিছুটা স্বপ্নবোনার প্রয়াস, আশাবাদী প্রজ্ঞার বীজ বপনই আমার কাছে সাহিত্যের উদ্দেশ্য। ব্যক্তিজীবন অথবা সমাজজীবন কী নিয়ে থাকবে, এত হতাশা- এত অন্তরায়ের মধ্যেও একটা খড়কুটোর অবলম্বন, ক্ষীণ দার্শনিক সুতোর ইশারার বাঁধন যা চেতনাজগৎকে কিছুটা আরাম দিতে পারে।
‘একজন তরুণ কবির চিঠি’তে রেনার মারিয়া রিল্কে একটি বিষণ্ন আত্মার জন্য একটি উল্লাস প্রকাশ করেছেন:
অর্থাৎ যদি আপনার দৈনন্দিন জীবন খারাপ বলে মনে হয় তবে দোষ দেবেন না; নিজেকে দোষারোপ করুন, নিজেকে বলুন যে আপনি যথেষ্ট কবি নন এর সম্পদকে ডাকার জন্য; কারণ স্রষ্টার কাছে কোনো দারিদ্র্য নেই এবং কোনো উদাসীনের স্থান নেই।
রেনার মারিয়া রিল্কের কথাটি আমার কাছে সত্য বলে মনে হয়। সেই আনন্দ আহরণ করার অঢেল বস্তু জগৎময় ছড়ানো আছে, তাকে প্রাণসঞ্চার করার মধ্য দিয়েই আনন্দের উদ্ভব হয়। নিজেকে কিছুটা সমৃদ্ধ করা যায়। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার এই পথ ধরেই কবিতার সূক্ষ্ম বুননে শব্দ ফোঁড় তুলতে পারে। সেলাই করতে পারে ভাঙা হৃদয়কে। সুতরাং সৎ কবিতার নিভৃতি বা মগ্নতা বা একান্ত অভিনিবেশ যাপনের অন্তরায় সহ্য করা মুশকিল। যখন আমরা বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলি তখন তো আস্ফালন, বিবৃতি বা বক্তব্য। তাতে কলরব থাকে বেশি। কিন্তু যখন নিজের সঙ্গে কথা বলি, তাতে স্তব্ধতা থাকে বেশি। এই কারণেই উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস্ বলেছিলেন:
অর্থাৎ আমরা অন্যের সাথে ঝগড়া করি তাতে বাগ্মিতা প্রকাশ পায়, কিন্তু নিজের সাথে ঝগড়া করি তাতে কবিতা তৈরি হয়।
ব্যক্তিজীবনে নিজের সঙ্গে ঝগড়া করাটাই তো দার্শনিক ঝগড়া। এখানে প্রজ্ঞার প্রয়োজন। বোধের প্রয়োজন। একজন কবিরই সেটা থাকে। আর এই কারণেই তাকে কবিতা লিখতে হয়, কারণ তাঁর অন্য কিছু করার ক্ষমতা থাকে না। শব্দ ও উপলব্ধি, হৃদয় ও প্রজ্ঞা নিয়েই তাঁর মূলধন। আর তা থেকেই তাঁর নির্মাণ চলতে থাকে। অন্য কিছু করা বলতে সমাজের বিভিন্ন বস্তুর নির্মাণকারীর মতো তিনি হতে পারেন না। তিনি ফেরিওয়ালাও নন। সুতরাং তার নির্মাণকে বিক্রি করার জন্য বা বিজ্ঞাপিত করার জন্য তার হাঁকডাকের প্রয়োজন হয় না। তাঁর সৃষ্টির মাল বিক্রিও করা যায় না। এই কারণে কবির একটি শর্তের কথাই রবার্ট গ্রেভস্ বলেছিলেন:
অর্থাৎ কবির একটাই শর্ত, তা পেশা নয়। কখনো কখনো কবিতা লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে বটে, কিন্তু প্রকৃত কবির কাছে পেশা হিসেবে কবিতা লেখা হয়নি। কবিতা এসেছে হৃদয়ের তাগিদ হিসেবে। আত্মস্ফুরণের অবলম্বন হিসেবে। সুতরাং কবিতা লিখি বলে মঞ্চ আলো করে বসে নিজেকে ঘোষণা করা আমার কাছে কখনোই শোভা পায় না। এই বিষয়টা নিজেও মানিয়ে নিতে পারি না।
দুর্ভাগ্যবশত মাঝে মাঝে তবুও যেতে হয় নিজের সঙ্গে অনেক ঝগড়া করে। অনেক স্ববিরোধিতার মধ্য দিয়ে। তখন অনেক কষ্ট চেপে রাখি। কাউকে জানতে দিই না। কবিতা পাঠের ছবি টাঙানো, কিংবা প্রকাশিত কবিতার বহুল প্রচারও আমার একটা স্ববিরোধী কাজ। অনেক ক্ষেত্রেই এড়িয়ে যাই। এইসব দেখেও আমার অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। কেননা তা অনেকটাই পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনের মতো। কেউ না জানবে তো না জানুক, অথবা আমাকে কবি বলুক এটাও আমি চাই না।
কারণ কবিতা লেখাকেও কোনো যোগ্যতা বলে আমি মনে করি না। একটা আত্মযাপনের ব্যক্তিগত চর্চা একান্ত নিজস্ব। অনেক সময়ই শিল্পসম্মত কিনা অথবা তার সিদ্ধি এসেছে কিনা সে বিষয়টিও মনে থাকে না। যেমনভাবে অন্তরের সাড়া পাই, যেমনভাবে শব্দে তার প্রতিফলন ঘটে তাকেই লিপিবদ্ধ করি। আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এসব বেঁচে থাকল কিনা, অথবা কেউ পড়ল কিনা—সেসব বিষয়ও আদৌ ভাবনার মধ্যে আসে না। এই আমি কথা বলছি তাই আমি আছি। এই আমি কথা বলব না তখন আমি থাকবও না। প্রবহমান জীবনস্রোত বয়ে যাবে। আমার পুরনো সাইকেলটির মতো একদিন আমিও হারিয়ে যাব। তার মতো বেল্-ও আর বাজবে না।