পরাধীন ভারতবর্ষে ১৯৩৩ সালের ২৪ নভেম্বর দেশ পত্রিকার জন্ম। এ পত্রিকার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন সুরেশ চন্দ্র মজুমদার ও প্রফুল্ল কুমার সরকার। তৎকালীন আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার দেশ এর প্রথম সম্পাদক ছিলেন। ১৯৩৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বঙ্কিমচন্দ্র সেন দেশ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। দেশ পত্রিকা যার সুচারু, নিপুন সম্পাদনায় আভিজাত্য মুখর বনেদিয়ানা তথা বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতির খ্যাতি অর্জন করেছে, তিনি প্রবাদপ্রতিম সাগরময় ঘোষ।একটি সাময়িক পত্রিকাকে অফুরন্ত শৈল্পিক দক্ষতা, নিপুণতা, সৃজনশীল চিন্তাভাবনা ও ধারণায় বিভোর হয়ে বাঙালি সংস্কৃতি, সাহিত্য, জাগরণ তথা নান্দনিক মননের সঙ্গীতে পরিচিত করেছিলেন আপামর বাঙালি পাঠক দরবারে। ১৯৫৭ সালের ১৫ জুন সাগরময় ঘোষ দেশে’র অস্থায়ী সম্পাদক হন। সে বছরের ২২ জুন থেকে দেশ এর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন অশোক কুমার সরকার। পত্রিকায় বিশেষত সাহিত্যের বিষয়ে উপন্যাস, গল্প নির্বাচনের ব্যাপারে সমস্ত দায়িত্ব বকলমে সাগরময় ঘোষকে বর্তানো ছিল। ১৯৭৬ সালের২৪ এপ্রিল পর্যন্ত অশোক কুমার সরকার দেশ এর সম্পাদক ছিলেন। তিনি আত্ম কথায় উল্লেখ করেছেন-দেশ এর স্বদেশেই সৌরভ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তার পেছনে অন্যতম কারিগর দেশ-এর অর্জন সাগরময় ঘোষের নিবেদিতপ্রাণ সৌরভ। তারপর সাগরময় ঘোষ দেশের স্থায়ী সম্পাদক হয়ে পত্রিকাকে ফুলে ফলে বিকশিত করে জনপ্রিয়তা ও উৎকর্ষতার শিখরে পৌঁছে গিয়েছেন। সেই নিরিখে সাময়িক পত্রিকা সম্পাদনায় সাগরময় ঘোষের (১৯৩৯-১৯৯৯) সুদীর্ঘকাল নিযুক্ত থাকার ধারাবাহিকতা ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৪৩ সালে প্রথম স্বতন্ত্রভাবে দেশ এর শারদ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এভাবেই সমস্ত রুচিশীলতা, সাহিত্যিক গুণাবলী, পাঠকের ভাবনা চাহিদাকে সর্বতোভাবে মান্যতা দিয়ে উৎকৃষ্ট ও মননশীল লেখনিতে সাহিত্যের সম্ভারে শারদ সংখ্যা ধারাবাহিক অভিযানের সূচনা। দেশ যে সময়ে প্রকাশিত হয় সেই সময়ে কোন সাহিত্য পত্র ছিল না। অন্যদিকে দেশ ও সাহিত্য পত্র নয়। সেখানে সাহিত্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় সীমাবদ্ধতার নিরিখে। প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তাবাদী চিন্তা ধারায় ছিল পত্রিকার অভিমুখ। দেশ তার বহু চলনের মধ্যে সাহিত্যের আবেদনে নিবিড়তাই লাভ করেনি, সমধিক গুরুত্ব লাভ করেছে। দেশের স্বাধীনতা উত্তর পরিসরে পরাধীন দেশের জাতীয়তাবাদী চেতনার অস্তমিত পরিসরে দেশ-এর সাহিত্যের আকাশে বাংলা ছোটগল্পের দিগন্তবিস্তারী আলো ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত ও প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন প্রায় সব গল্পকারই দেশ এর আশ্রয়ে গল্পের শ্রেষ্ঠ ফসল উপহার স্বরূপ উজাড় করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয় রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে উৎকর্ষ মণ্ডিত আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দিতায় সফলতা প্রত্যাশী ছোটগল্পের উত্তরণে দেশ এর ভূমিকা ক্রমশ কালের প্রবাহমানতায় অবিসংবাদিত ও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশ বাণিজ্য পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেসেখানে দৈনিক পত্রিকার পাশেই সাপ্তাহিক পত্রিকার মাধ্যমে যেভাবে বাংলা সাহিত্যের মেলবন্ধনের প্রয়াস ক্রমশ নিবিড়তা লাভ করেছে তি এক কথায় সংস্কৃত মনস্ক বাঙালি পাঠকের কাছে অভূতপূর্ব।
বাংলা ভাষায় একটি সাময়িক পত্রিকা নিরবচ্ছিন্নভাবে ৯০ বছর যাবৎ প্রকাশিত হতে থাকা অত্যন্ত গর্বের ও সম্মানের। জন্ম লগ্ন থেকেই শাসকের অন্যায় অবিচার এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে এই পত্রিকা অকপটে শাণিত প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে। সাহিত্য নির্ভর এই পত্রিকা হলেও সমাজের সর্বত্রগামিতায় তার অবাধ বিচরণে সামাজিক দায়বদ্ধতার আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে কোনভাবেই বিচ্যুত হয়নি। রাজ রোষের তোয়াক্কা না করে ধারাবাহিক সৃষ্টিশীল রচনা সম্ভার প্রকাশ করেছে। পরাধীন ভারতবর্ষের ব্রিটিশ শাসক কিংবা স্বাধীন ভারতে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত কোন রাজনৈতিক মতাদর্শ বিশ্বাসী দলের সরকারের কাছে তার অবিচলিত নীতি ও লক্ষ্যের সাথে কখনোই আপোষ করেনি। দেশমাতৃকা ও জাতীয়তাবাদের প্রতি নিবেদিত প্রাণ সংবিধান ও গনতন্ত্রের অনুসরণকারী দেশ পত্রিকা বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে তার স্থান বিশেষভাবে মহিমান্বিত। বাংলা সাহিত্যের প্রচার ও প্রসারে এই পত্রিকার ভূমিকা অবিসংবাদিত। সাহিত্যের এমন কোনও শাখা নেই, দেশ পত্রিকায় যার স্থান হয়নি। জীবনের এমন কোনও অঙ্গন নেই ,এই পত্রিকা যেখানে নিজেকে দাঁড় করায়নি। সংস্কৃতির এমন কোনও দিক নেই পত্রিকা যাকে ছুঁয়ে যায়নি। সাহিত্য ছাড়াও যেসব বিচিত্র বিষয় নিয়ে জীবন আবর্তিত হয় সেগুলির কোনওটিকেই দেশ উপেক্ষা করেনি। পাঠকের মননের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ব্রত থেকে দেশ আজও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। স্থবিরত্বকে এই পত্রিকা কখনোই প্রশ্রয় দেয়নি বরং জগৎ ও জীবনে প্রতিমুহূর্তে যে পরিবর্তন ঘটছে জন্ম কাল থেকে আজ পর্যন্ত তাকে দেশ সুচারু ও অনুপুঙ্খভাবে আত্মস্থ করেছে। এ পত্রিকা একথা বিশ্বাস করে পরিবর্তনই প্রকৃতির সবচেয়ে স্থায়ী নিয়ম। তাই চারপাশের পরিবর্তনধর্মী জীবনের নানা রূপান্তরের চিহ্ন এ পত্রিকার পাতায় পাতায় পূর্বাপর সুষমভাবে ধরা আছে।বিগত নদশক ব্যাপী এই পত্রিকায় যা প্রকাশিত হয়েছে তন্মধ্যে কালজয়ী ও মনোগ্রাহী সৃষ্টির সংখ্যা অগণিত। যা পরবর্তীতে পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। পাঠকেরা সাদরে গ্রহণ ও আপন করেছে সেইসব কবি গল্পকার প্রাবন্ধিক ও চিত্রশিল্পীদের মনন শীল সৃজনধারা। কোন চলচ্চিত্রের সাফল্যের ক্ষেত্রে যে ভাষা ব্যবহার করা হতো একসময় চলিতেছে বাঙালির চিরকালীন মরনসঙ্গী দেশ পত্রিকার ক্ষেত্রেও সেই বহুল প্রচলিত শব্দ দুটি সুপ প্রযোজ্য। অবিরাম নয় দশক ধরে বাঙালির মনন চেতন প্রাত্যহিক জীবন যতটা প্রতিফলিত ও প্রতিবিম্বিত হয়েছে দেশের পাতায় পাতায় ঠিক ততটাই হয়েছে সমানভাবে ঋদ্ধ ও পরিপুষ্ট। আজ দেশ শুধুমাত্র একটি পত্রিকা নয় দেশ এক বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিশীলতার প্রতীক যার পরতে পরতে বাঙালির স্বতন্ত্র, সংস্কৃতির, বাঙালির আন্তর্জাতিকতা একাত্ম হয়ে গেছে। কলেজ জীবন থেকে পড়তে শুরু করে দেশের সঙ্গে এক নিবিড় ভালোলাগার পরিমণ্ডলে জড়িয়ে গেছে প্রাত্যহিক জীবনের গতিপথ। সত্যি কথা বলতে সাপ্তাহিক থেকে পাক্ষিক হয়ে যাওয়ার পরেও এখনো অধির আগ্রহে চেয়ে থাকি কখন নতুন সংখ্যাটা হাতে পেয়ে শুরু করব পাতা উল্টিয়ে নবীন প্রবীণ কলচিদের শ্রেষ্ঠ সৃজন সম্ভার। পরিবর্তনশীলতাকে গ্রহণ করে এখনো দেশ পত্রিকা বজায় রেখেছে তার নিজস্বতা। সেজন্যই অনেক পত্রিকার ভেড়ার মাঝেও বাঙালিরা সানন্দে বরণ করে নিয়েছে দেশকে। কাঁটাতারের গণ্ডি ছাড়িয়ে ওপার বাংলাতেও বাঙ্গালীদের কাছে দেশ পত্রিকা যথেষ্ট প্রশংসিত ও পঠিত। দেশ পত্রিকা যেন আজ দুই বাংলাকে বাঙালি সত্তাকে সংস্কৃতিকে চেতনাকে অনুভূতিকে সৃষ্টিশীলতার জগতে মিলেমিশে একাকার করে দিয়েছে। দেশ পত্রিকা যেন এক জ্ঞানের ভান্ডার, ব্যক্তি সত্তাকে জাগ্রত ও সমৃদ্ধ করার অন্যতম চিরকালীন রসদ। এভাবেই ৯০ বছরের মধ্যে দেশ পত্রিকা তার উচ্চমার্গীয় সৃষ্টি সম্ভারে অবলীলায় বাঙালি পাঠকের মনন সঙ্গীতে পরিণত হয়েছে। এখনো বাংলা সাহিত্য ও বাঙ্গালীমানসে বিরাট স্থান জুড়ে এখনো বিরাজিত।