বছর পাঁচেক আগে রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছি সিনেট নির্বাচনে ভোট দিতে। আমাদের এক ব্যাচমেটও প্রার্থী। সেই প্রার্থীর টেন্টে বন্ধুদের আড্ডা। নির্বাচনের বন্ধুর হার-জিতের চেয়ে বরং সেটাই বড় পাওনা। সেদিন পরিচয় হল আমাদের ব্যাচমেট একটা মেয়ের সাথে। সে এখন থাকে বগুড়াতে। বিস্তারিত আলাপে গিয়ে জানতে পারলাম, আমাদের সেই ব্যাচমেট মেয়েটি একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। আমি সেটাকে এপ্রিশিয়েট করার আগেই, সে বলতে শুরু করল, আরে বোলো না। আছি মহাজ্বালায়, এলাকার লোকজন তো বলেনই, কোনো প্রশিক্ষণে গেলে খোদ শিক্ষা বিভাগের লোকজনও বলেন, আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে এখানে পড়ে আছেন কেন? আমাদেরই ব্যাচের আরেকজন কে চিনতাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ছিল। আমার সাথে তার কখনো আলাপ হয় নাই। এখন ফেসবুকে যুক্ত আছি। একদিন তার একটা ছবি দেখে ইনবক্সে জানতে চাইলাম, তুমি কি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ কর? উত্তরে সে জানালো, নারে ভাই, আমি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। মেসেজ এ তো আর উচ্ছ্বাস প্রকাশটাকে দৃশ্যমান করা যায় না। কিন্তু আমি লিখেই তাকে দারুণভাবে এপ্রিশিয়েট করলাম। বললাম, তোমরা মত মেয়েকে যে স্কুল এবং বাচ্চারা শিক্ষক হিসাবে পেয়েছে, তারা সত্যিই ধন্য। কারণ, ওকে আমি দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশুশ্রমে যুক্ত হতে বাধ্য শিশুদের সাথে নিবিড়ভাবে মিশতে। ওকে এপ্রিশিয়েট করার সময় আমি যেন মানসলোকে সেই সময়ের ছবিগুলি দেখতে পেলাম। আমাদের সেই ব্যাচমেট বন্ধুর সাথে আমি ফেসবুকে যুক্ত আছি, কিন্তু সে আর আমার কোনো মেসেজের রিপ্লাই করে না। আমার ধারণা, সে প্রাইমারিতে শিক্ষকতা করে, এটা নিয়ে তার মধ্যে এক ধরনের জড়তা কাজ করে। কয়েকদিন আগে, ময়মনসিংহ সদর উপজেলার একটা প্রত্যন্ত প্রাইমারি স্কুলে গিয়েছি একটা কাজে। কাজ শেষে সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলাম। যিনি আমাদেরকে গাইড করছিলেন, তিনি জানলেন, স্যার কিন্তু এগ্রি ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলেন। এই কথা বলবার সময় প্রধান শিক্ষক ফোন কলে ব্যস্ত ছিলেন। তাই আমি একটু আগ্রহ নিয়েই আবার জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আপনি এগ্রি ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন? তিনি একটূ সংকোচের সাথে হ্যাঁ বললেন এবং সাথে যোগ করলেন, সরাসরি প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেছি। পাশ করার পর একটা সার্কুলার ছিল, এপ্লাই করেছিলাম, হয়ে গেছে। তাই আছি, বলি না কাউকে এগ্রিতে পড়তাম।
এই যে তিনটি ঘটনার উল্লেখ করলাম, এগুলি থেকে শিক্ষার প্রতি আমাদের নিজের, পরিবারের, সমাজের এবং রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্কারভাবে বোঝা যায়। আমরা নিজেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে কখনো প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতে চাই না, আমাদের পরিবারও চায় না, আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রও চায় না। কেন চায় না? চায় না নানা কারণে কিন্তু প্রত্যেকটা কারণ আসলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত। নরওয়ে থেকে প্রকাশিত একটি অনলাইন বাংলা পত্রিকার সম্পাদকের সাথে কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, আমাদের এখানে টিচিং এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ এবং কঠিন স্টেজ হল, ১ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে। এই পর্যায়ের ছেলেমেয়েদেরকে যারা শেখান, তাঁদেরকে শুধুমাত্র কারিকুলাম জানলে তো হবে না, কিভাবে তাঁদেরকে সামলাতে হয়, তাঁদের সেফটি, সিকিউরিটি, পুষ্টি নিশ্চিত করা এবং দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির ক্ষেত্রে অবদান রাখার মত যোগ্যতা নিয়েই এই পর্যায়ে এই শিক্ষকতার জন্য আসতে হয় কিংবা আসবার পর এই সব যোগ্যতাগুলি অর্জন করতে হয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গোঁড়ায় গলদ বোধহয় এখানেই চরম মাত্রায়। আমাদের পরিবার তো বটেই, শিশুকাল থেকেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন, কিংবা লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে এই স্বপ্ন দেখাতে আমাদের শিক্ষককুলও কম যান না। আর শিক্ষক সমাজের প্রতি, বিশেষ করে প্রাইমারি শিক্ষকদের প্রতি সমাজের এই অনীহার কারণে এখানে না এসেছেন মেধাবীরা, না হয়েছে এখানে যুক্ত শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন। ফলত যা হবার তাই হচ্ছে। প্রাইমারি পাশ করে, হাই স্কুল, হাই স্কুল পাশ করে কলেজ, কলেজের পর বিশ্ববিদ্যালয় একের পর এক সার্টিফিকেট যুক্ত হচ্ছে থলিতে, কিন্তু মাথা খুলছে না, হিসাব মিলছে না। স্বপ্ন দেখেছিলাম কি, আর হতে যাচ্ছি কি কিংবা হয়েছি কি? ওই যে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে, পরিবর্তনে আমাদের এই শিক্ষা ব্যবস্থা শুরু থেকেই কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। কারণ শতকারা ৯০ শতাংশ শিক্ষকেরই তো কোনো নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নাই। সে হোক প্রাইমারি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ প্রাথমিক বিদ্যালগয়গুলি হতে পারত আমাদের শিক্ষার, দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির ভিত্তিমূল। বলা হয়ে থাকে, এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একই সাথে একাধিক ভাষা রপ্ত করার যোগ্যতা রাখে। আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শুদ্ধভাবে নিজের মাতৃভাষাটিও লিখতে যদিও বা শেখে, বলতে শেখে না। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত প্রতিদিন প্রাতকালীন সমাবেশে আমরা জাতীয় সঙ্গীত গাই। কিন্তু জাতীয় সঙ্গীতের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আমরা বলতে পারি না। দৃষ্টিভঙ্গি সে তো অনেক দুরের ব্যাপার।
এখন কথা হল, কেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা ছেলে-মেয়েরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চান না? কিংবা হলে পরেও নিজের পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত থাকেন? এর নানা কারণ আছে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কারণই এখানে মুখ্য। অর্থনৈতিক কারণের বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে শুধু এটুকু বলতে পারি, বর্তমান বেতনকাঠামোর আগে যে বেতন কাঠামো ছিল, সেখানে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষকের বেতন দিয়ে তাঁর গোটা পরিবারের ব্যয় নির্বাহ নিতান্তই কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। দুর্মূল্যের বাজারে আজকের বেতন দিয়েও যে তাঁরা খুব স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারেন এমন নয়। আমাদের সমাজে মর্যাদার একটা মাফকাঠিও এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থ। তাই এই পেশায় আসবার প্রতি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করা ছেলে মেয়েদের যোগদানের আগ্রহ কম। এখন যদি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিদের গ্রেড অনুসারের পদমর্যাদা দেখি, তাহলে সহকারি শিক্ষকেরা আছেন ১৩ তম গ্রেডে। যেটাকে তৃতীয় শ্রেণিভুক্তও বলা হয়। আগে তো আরো মজা করে মানুষ বলতেন, সরকারি অফিসের গাড়ি চালক এবং প্রাইমারি স্কুলের সহকারি শিক্ষকের গ্রেড এক, বেতনও এক। বরং ওভারটাইম করে চালক শিক্ষকের চেয়ে অনেক বেশি টাকা পান। এই সব স্থুল তুলনা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হল, সমাজের, রাষ্ট্রের শিক্ষকদের প্রতি, শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, এগুলি সম্পর্কে তারা কতটা সচেতন, যত্নশীল সেগুলি বুঝতে চেষ্টা করা। কেউ কেউ মজা করে বলেন, একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক আজীবনই সহকারি শিক্ষক থেকে যান, পরিপূর্ণ শিক্ষক হয়ে উঠতে পারেন না।
১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং শিক্ষকদের মধ্যে একটা ঘটনায়, একজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, স্যার আমাদের ছেলেমেয়েদের কেমন মানুষ করছেন? উত্তরে আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তো আপনাদের কাছেই থাকে, তারপর আসে আমাদের কাছে। এই পর্যন্ত আপনারা যা শেখান, তার আসর যাবে কোথায়? এই যে আপনাদের কাছে মানে কি শুধু অভিভাবক? না বরং প্রাইমারি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত যে ধাপগুলি তারা পেরিয়ে আসেন, সেই প্রতিষ্ঠানগুলির শিক্ষকেরা, তাঁদের চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি ভর করে থাকে ছাত্রদের মেধা এবং মননে। যেখানে প্রাইমারি স্কুলের ভূমিকা রয়েছে দারুণভাবে।
স্বাধীনতার পর জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক একটা স্কুল প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেছিলেন বুড়িগঙ্গার উপারে। যেখানে তিনি শিক্ষক হিসাবে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন সরদার ফজলুল করিম, বদরুদ্দিন ওমর এবং প্রফেসর আনুসুজ্জামানকে। তাঁর এই চিন্তার মুল কারণ ছিল ছেলেমেয়েদের একটা বেইজ তৈরি করা, দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা। যেটা প্রাইমারি পর্যায় থেকেই জরুরি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করলাম আমরা, কিন্তু আমাদের শিক্ষার ভিত্তিমূল একই রকম রয়ে গেছে। এই অবস্থার মধ্যেও প্রাইমারি স্কুলে মেধাবী এনং মননশীল শিক্ষক রয়েছেন, তাঁরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁরাও আজ বিরক্ত পরিপত্র আর অফিস আদেশ নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি। তারা আজ দাবী তুলেছেন শিক্ষামনোবিজ্ঞান ভিত্তিক কারিকুলামের। যেটা আমালা-মন্ত্রীদের মস্তিস্কপ্রসুত নয়; নিবিড় গবেষণার ভিত্তিতে প্রণীত হতে হবে। আর সেটা হলেই সম্ভব আমাদের আগামী প্রজন্মের ভিত্তি তৈরি করা, যুক্তিশীল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দেশপ্রেমিক জাতি তৈরি করা, নইলে আমরা যে তিমিরে আছি, সেখানেই পড়ে থাকব।