“তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ” কবিতাটা খুব কঠিন কবিতা। বুঝলি মোহন? আমার ভাইপো দারুণ আবৃত্তি করছে। হাসিখুশি-র অনুষ্ঠানে বলবে, তাই রিহার্সাল করছে, চারপাঁচ দিন ধরে।
গৌতমের কথা শুনে মোহন বলল, কবিতাটা তো বেশ বড়। ওইটুকু ছেলে মুখস্থ করল কিভাবে। সবে ক্লাশ টুতে পড়ে।
– আরে ওর স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর। শাসন-তাজপুরের রোদের মতো। সরদার বাড়ির ছেলে। এর আগে এমন কবিতা কখনও বলেনি। হাঁড়ির মাছ কাঁধে নিয়ে ঘুরেছে, বছরের পর বছর। লোকের বাড়ি মুখ রগড়ে মরেচে। না খেয়ে মরেচে। ছেলেটা বড় হয়ে কিছু একটা হবে, দেখিস!
মোহন উত্তর দেয় না। সে তো ঘরপোড়া গরু। কাচারি দা-র ছেলে মানুষ হলে পাড়ার মুখ উজ্জ্বল হবে। গৌতমের ভাইপো, ওর মুখ উজ্জ্বল হবে। শাসন-তাজপুর অজপাড়াগাঁয়ের মাটিতে আগেও রত্ন জন্মেছে। তারা বড় হয়ে বড়দের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। বড়দের সঙ্গে মিশলে আপত্তি নেই, কিন্তু নিজের শেকড়ের কথা ভুলে গেলে চলবে কেন, এরকম কত কথা ভাবতে থাকে, মোহন।
বিকেল তিনটে থেকে সাহিত্য সম্মেলন। গোছগাছ চলছে। আলো থাকতে থাকতে অনুষ্ঠানের বারোয়ানা হয়ে যাবে। তার টেনে আলোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
কিন্তু বৈশাখ মাসের বেলা কখন আকাশ ঘনিয়ে আসে, তার ঠিক নেই।
ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। পাওয়ার চলে গেলে সব অন্ধকার হয়ে যাবে। পারমিতা অনেকগুলো দায়িত্ব নিয়েছে। স্কুলের দেওয়ালে সিমেন্ট বাঁধানো বড় ব্ল্যাকবোর্ড। মোহন, স্কুলের জানলা থেকে ভাঙা চক কুড়িয়ে সুন্দর করে লিখছে, পঁচিশে বৈশাখ, কবি প্রণাম, আয়োজক: অঙ্গীকার সাহিত্য গোষ্ঠী। গর্বিত সহযোগী: হাসিখুশি।
মাইকওলা এসে গেছে। বসন্তর বউ তাদের জন্যে চা-বিস্কুট এনেছে।
আলুর দম, লুচি পারমিতাদের বাড়িতেই হবে। গৌতম চয়ণিকাকে নেমতন্ন করেছে। পাড়ার সবাই আসবে, স্কুলের ভেতরটা ভর্তি হয়ে যাবে।
কচিকাঁচার দল অনুষ্ঠানে এসে একদম চুপ করে না। একে অপরের সঙ্গে কথা বলে যায়। হৈচৈ করে। অনেক বড়রাও এটা করে। তালেগোলে বক্তৃতার পর্ব কেটে গেলে, যখন নাচ শুরু হয়, কেউ কথা বলে না। সবাই তাকিয়ে থাকে। পাইকপল্লীর অনেক বউ ট্যাঙ্কে থেকে কাপড় বের করে পরে আসে। বাচ্চাদের কর্পুরের গন্ধ খুব পছন্দ। বড়দেরও কেমন উৎসব উৎসব মনে হয়,এই কর্পুরের গন্ধে। সনাতন আসতে পারে না, স্কুলের কাছে। তক্তোপোষে শুয়ে-বসে মাইকের শব্দ পায়। চারটে মাইকের মধ্যে তিনটে তো ওদিকে বাঁধা। শাসন গ্রামের দিকে একটা মাইকের মুখ। স্কুল ঘরের মধ্যে দুটো ছোট ছোট বক্স বসানো। বেলা থেকেই রবিঠাকুর বাজতে শুরু করে দেয়, গ্রামের পথচলতি লোকজনের বুকের মধ্যে আলাদা আনন্দ জাগে। তাদের পথচলার মধ্যে বিশেষ একটা ভাব জেগে ওঠে। ভাবটা হল, তাদের পাড়ায় ভাল কিছু হচ্ছে। এটা অহংকার নয়, ভাল কিছু হবার তৃপ্তি। ক্রম ঘনীভূত তৃপ্তি। রবিঠাকুরের গান মোহনের আয়োজনে এই প্রথমবার বাজছে। আগেও তাদের কানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রবিঠাকুরের গান এসেছে। কিন্তু স্কুলের দাওয়া থেকে সারাবেলা গানগুলো তারা শুনে শুনে গানের সঙ্গে আত্মার যোগাযোগ তৈরি হয়ে যাচ্ছে। অনুষ্ঠান চলাকালীন সবাই হয়তো আসতে পারবে না, কিন্তু তাদের কান ঠিক এদিকে পড়ে থাকবে। এমনই এই পঁচিশে বৈশাখের মহিমা। অনেকে বলে, ‘শীতলা মার পূজা আর কালীপূজা আমাদের তো ছিল। আর তো কিচু ছিলুনি। মোহন তো নিয়ে এলো আমাদের পাড়ায় এই অনুষ্ঠাম। কবির অনুষ্ঠাম।’
অনেকে দশ টাকা, পাঁচ টাকা করে চাঁদা দেয়, মোহনকে। তার প্রতি বিশ্বাস টলেনি। মোহন টাকা নিয়ে নষ্ট কখনও করবে না। তাজপুর মোহনের কাজের প্রতি ভরসা আছে। পত্র-পত্রিকা না বুঝলেও এটুকু বোঝে, সে ভাল কিছু করবে।
স্কুলের বেঞ্চগুলো গোপাল, তারক, বিধান, চিকু সবাই মিলে হাত লাগিয়ে একপাশে সরিয়ে দেয়। পঁচিশে বৈশাখ লেখা বোর্ডের সামনে দুটো টেবিল পাশাপাশি রাখে। স্কুলে দুটোর বেশি চেয়ার নেই। চেয়ার দুটো ঠিক জায়গায় পেতে দেওয়ার পর, পাশ থেকে দুটো বেঞ্চ পেতে দেয়। অতিথিরা বসবে। পাচঁ সাত জন বসতে পারবে, আরামসে। বাকি যারা আসবে, তাদের জন্যে দেওয়ালের ধার দিয়ে আরও কিছু বেঞ্চ পেতে দেওয়া হয়। সবার জন্যে মেঝে হলুদ পাতনি। প্রচন্ড গরম পড়েছে। হাঁসফাঁস রোদ। তালবাগানের তলায় তবু ঠান্ডা বাতাস খেলে বেড়ায়।
বাবুই পাখির বাসাগুলো নিশ্চিন্তে ঝুলে আছে। তাদের পাড়ায় আজ যেন উৎসব। চারটে জলের মগ এনে রেখে দিয়ে যায়, পালানের বউ দস্যি। লক্ষ্মী ব্যাগভর্তি হাসিখুশি পত্রিকা এনে টেবিলের কাছে রেখে দেয়।
মাইকওলা ভাত খেতে গিয়েছিল, মোহনদের বাড়িতে। তাই লক্ষ্মীর একটু দেরি হয়ে গেল। বিশুর মা স্কুলের দাওয়া, মাঠ একনাগাড়ে ঝাঁট দিয়ে ঝকঝকে করে দেয়। জল ছড়িয়ে দেয়। মোহন, গৌতম, বরুন, ঝন্টু সবাই আজ পাঞ্জাবি পরে এসেছে। নবীন দা এসেছে, তাদের বাড়ি থেকে রবিঠাকুরের ছবি এনে চারটে ইটের ওপর বসিয়েছে। তার আগে মোহন নিজে হাতে লাল নীল কাগজ দিয়ে ইটের খালি গা ঢাকা দিয়েছে।
আমন্ত্রিত কবি হিসেবে কবি ভীম ঘোষ, কবি অরুণ পাঠক, কবি সুমিত মোদক, কবি স্বপনকুমার মান্না, গল্পকার সুব্রত হালদার প্রমুখ এসে গেছেন। নবীন দা-র স্ত্রী সবার আগে রবিঠাকুরের প্রতিকৃতিতে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দিয়েছেন। আসছেন, আরও অনেকেই। তাজপুর ঝেঁটিয়ে লোক আসছে, শাসনগ্রামের লোকজন আসছে। সবার মনে আজ আনন্দ যেন থই থই করছে। পাতনিতে সবাই বসে পড়েছে। অনেকেই জায়গা পাচ্ছে না। বেশিরভাগ দাঁড়িয়ে আছে। বেনাপুর থেকে সমাজসেবী ভবানন্দ ভট্টাচার্য এসেছেন। সবার আগে আসর গরম করে তুলেছেন। ব্যাগভর্তি লজেন্স, কেক, খেলনা নিয়ে এসেছেন। সেগুলো এখন ছোটদের হাতে হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নানান গল্প তিনি বলছেন। রগড় করছেন। তিনি আসলে অনুষ্ঠানের আগে অনুষ্ঠান করে নেবার মানুষ। মাটির মানুষ। ছোটদের আপনজন। ফলতার সান্তাক্লজ। তাকে ঘিরে খুব হইহই চলছে। বসন্তর বউ আর দুলালি অতিথিদের চা-বিস্কুট দিচ্ছে। নমস্কার জানাচ্ছে। এর মধ্যেই ভবানন্দ বাবু ঘোষণা করলেন, ‘আজ ছোটদের জন্যে শুধু নয়,বড়দের জন্যেও একটি বিশেষ উপহার আছে। যাকে নিয়ে অনুষ্ঠান, তার ছবি লাগানো পকেট ক্যালেন্ডার।তিনি কবিদের হাত দিয়ে সবাইকে উপহার দিতে চান। হারালে চলবে না, পরের বছর পর্যন্ত রাখতে হবে।চোখ বন্ধ করে এই ছবিটা মনে মনে আঁকতে হবে। এই মানুষটির জন্য সারা পৃথিবী জানে, ভারতবর্ষের কথা। আমাদের পাড়াগাঁয়ের কথা। আগামী বছর এসে তিনি দেখতে চান, এই ক্যালেন্ডারটি। যারা দেখাতে পারবে, তাদের জন্যে আগামী বছর আকর্ষণীয় পুরস্কার। ছবি হারালে পুরস্কার নেই। তবে তিরস্কার নেই। আর আজ যারা যারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামটা কারও খাতার দিকে না তাকিয়ে নিজে লিখতে পারবে, তাদের জন্যে থাকবে, খাতা-পেন আর রাবার। সবাইকে একটা একটা কাগজ দেওয়া হবে। সময় পাঁচ মিনিট।
আর যারা এই চেষ্টাটুকু করবে,তাদের জন্যে একটা করে চকোলেট।’
বলতে বলতে হাতে হাতে তিনি কাগজ-পেন্সিল দিয়ে দিলেন। একশোরও বেশি কচিকাঁচা। অনেকেই লিখে ফেলল। বেশির ভাগ ছোটরা লিখতেই পারল না। পেন্সিল নিয়ে হাবিজাবি করতে লাগল।
ভবানন্দ বাবু মিনিট পাঁচেক পরেই বললেন, ‘হাতে সময় কম। তাড়াতাড়ি লিখে ফেলতে হবে। আর যারা লিখতে পারলে না,অন্তত নিজের নামটা লিখে দাও। তাতেই পুরস্কার।’
গৌতমের ভাইপো রাকেশ সবার আগে কাগজটা জমা দেয়, ভবানন্দ বাবুর হাতে। গোপাল ছোটদের হাত থেকে কাগজগুলো একে একে জমা নিয়ে নেয়। সব জমা হয়, ভবানন্দ ভট্টাচার্যের হাতে। সব মা-বোনের উদ্দেশ্য তিনি বললেন, ‘তাজপুর গ্রামকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। মোহন, গৌতম, নবীন ভাইদের হাত ধরে। আজ কত কবি এসেছেন। তাদের লেখা পড়তে হলে সবাইকে লেখাপড়া শিখতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা পড়তে হলে লেখাপড়া শিখতে হবে। ছোটরা তো বোঝে না। তোমাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা দিয়ে ছোটদের মানুষ করতে হবে। আমাদের সেটা পারতেই হবে। পারবে তো? বলুন, মায়েরা পারবেন তো?’
সবাই তারস্বরে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ পারব। নিশ্চয়ই পারব।’
ভবানন্দ বাবু একজন সফল রোটারিয়ান। তিনি যেখানেই যান, সবাইকে আনন্দ দিয়ে আসেন। ছোটদের ভালবাসা দেন। কত উপহার দেন। এটাই তিনি করে বেড়ান। অজস্র মানুষের উপকার করেন। শিক্ষা-সংস্কৃতি, খেলাধূলা, নাচ-গান, উৎসব সবকিছুতেই তিনি উৎসাহ দেন। বিস্তৃর্ণ জনপদ জুড়ে তিনি কাজ করেন। পানীয় জল, শৌচাগার জীবনদায়ী ওষুধ সবই আছে, তার সমাজসেবার ঝুলিতে। চিকিৎসার ব্যবস্থা তো আছেই। ঘরদোর করে দেন। শিশু ও মায়েদের পুষ্টির জন্যেও তিনি সান্তাক্লজ। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘এখন তো সময় হাতে তেমন নেই। ছোটদের জন্যে সমস্ত পুরস্কার তিনি মোহনের কাছে দিয়ে যাবেন, সবাইকে দেওয়া হবে, এই পুরস্কার। কেউ বাদ যাবে না। যারা লিখতে পারেনি, তারাও পাবে। তবে আগামী বছর সবাইকে পারতেই হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে দশ লাইন লিখতে হবে। থাকবে, আকর্ষণীয় পুরস্কার। বস্তা ভর্তি নানান উপহার, ভবানন্দ বাবুর সহকারী সবকিছু মোহনের হাতে তুলে দেয়। ছেলেরা গুছিয়ে রাখে। মোহন মূল অনুষ্ঠান শুরু করে।
মাটির প্রদীপে আলো জ্বলে ওঠে। সমবেত গানের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়, কবি প্রণাম। কবিতা পাঠ, বক্তব্য কবি প্রণামের অঞ্জলি। পারমিতা আগত কবিদের কপালে চন্দনের ফোঁটা ছুঁইয়ে দেয়। তার হাতের তৈরি ঘরোয়া পুষ্পস্তবক কবিদের হাতে হাতে পৌঁছে যায়। বিভিন্নজনের আন্তরিক হাতের মুঠো ধরে। দক্ষিণের আকাশ ধরে সূর্য পশ্চিমের পথে তখন মনোযোগ দিয়েছে। বিশ্বকবির চরণে একে একে অঞ্জলি অর্পণ চলছে। কবিতা পাঠ, বক্তব্য, সমবেত গানের মধ্যে দিয়ে। অভাব-অনটনের মাটিতে আজ সাহিত্য-সংস্কৃতি জাঁকিয়ে যেন দোকান দিয়েছে। ভাত-মুড়ি,পান্তা-আলুভাতের দাবি সরিয়ে শাসন-তাজপুর দুটি গ্রাম, পাইকপল্লী সাহিত্য-সংস্কৃতিকে আজ কোলে তুলছে। যেমন করে এরা খালে নেমে শাক তোলে, পাতানাতা তোলে। সবাই রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করছে। মোহন দেখতে পাচ্ছে, নতুন মোহনা। সে হাত বাড়িয়ে আরও কটা মোহন খুঁজছে। হাসিখুশি পত্রিকার মোড়ক উন্মোচন করলেন, কবি ভীম ঘোষ। একে একে সবার হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, হাসিখুশি পত্রিকা। নতুন বইয়ের নতুন পাতার গন্ধ সবার নাকে। মায়ের মমতার মতো গভীর, শান্ত সে ঘ্রাণ। জুমলার বউ বসেছে,সবার মাঝখানে। বই সে পড়তে পারে না। তার বড় বড় ছেলে তারাও পড়তে পারে না। তার ছোট নাতি দুটো বইয়ের পাতা ছিঁড়তে শিখেছে। বই পড়তে এখনও শেখেনি। তার হাতেও বই। জীবনে প্রথমবার সে বইয়ের পাতা খুলে দেখছে। এমন অনেকেরই হাতে বই। তারা কেউই পড়তে পারে না। যারা পড়তে পারে,তারা তো আঁতকে ওঠে, ওদের হাতে বই দেখে। তারা এমনকিছু শিক্ষিত তা নয়, একটু পড়তে পারে যা। তাতেই তারা আঁতকে ওঠে। একজন তো মোহনের কানে কানে বলল, ‘ওরা বই নিয়ে করবে কি?’
মোহন বলল, ‘দেখবে। ভাতের গন্ধ পেলে যেমন খিদে পায়। তেমন বইয়ের গন্ধ পেয়ে ওদের যদি বইয়ের খিদে পায়। পড়াশুনার খিদে পায়।’
মাইকে বক্তব্য রাখছিলেন, কবি সুমিত মোদক। তার মধ্যেও মোহনের কথাগুলো সে স্পষ্ট শুনতে পায়। উত্তর শুনে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।
সুমিত মোদকের বক্তব্য শেষ হতেই করতালির ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি।
কবি অবিনাশ চৌধুরী বক্তব্য রাখতে গিয়ে বললেন, ‘শাসন-তাজপুর গ্রাম দুটি আমার মায়ের মতো। মাঝে মাঝে খুব বিষন্ন লাগে। হাঁড়িতে যখন ভাত থাকে না। কিন্তু ভাতের লড়াই শেষ করার দিন এসেছে। সামনে আলোর দিন আসছে। বিংশ শতাব্দী শেষ হয়ে একবিংশ শতাব্দীর সূর্য মুখ দেখাবার প্রতীক্ষা করছে। এখন দু’হাজার সালের মে মাস। আর কটা মাস গেলেই নতুন শতাব্দীর পায়ের শব্দ শোনা যাবে। সে তো নূপুর পরে আসছে। শাসন-তাজপুর গ্রাম আর মুখঝামটা খাবে না। সময়ের ঘাড় ধাক্কা খাবে না। মোহনের মতো ছেলেদের হাত ধরে নতুন দিন আসছে। ভাতের গন্ধে আমরা নতজানু, চিরকাল থাকব। আমরা তো ভেতো বাঙালি। কিন্তু ভাতের কাঙাল হয়ে থাকব না। আমরা যে ভারতবাসী। কত ধর্মের মানুষ এদেশে।কত ধরণের সংস্কৃতি। কিন্তু সবাই একটা ঠাকুরের পূজা করেন। তিনি ধর্মের ঠাকুর নন। তিনি মরমের ঠাকুর, তিনি মানুষের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ সবার হাতে হাসিখুশি দেখতে পাচ্ছি। হাতে ধরে থাকা হাসিখুশি সকলের মুখে খেলে বেড়াতে দেখতে চাই। সকলের জীবন হাসিখুশিতে ভরে উঠুক। সবাইকে স্বনির্ভর হতে হবে। শিক্ষিত হতে হবে। ভাতের লড়াইয়ের দিন, লাউ মাথায় তুলে দিয়ে মান-মর্যাদার লড়াই করতে হবে। পিছিয়ে থেকে হাত কামড়ানোর দিন আর নেই। শূন্য দশক পেরিয়ে আমাদের পূর্ণ হয়ে ওঠার দিন এসেছে। পুরানো মানসিকতা ভেঙে দিয়ে নতুন সমাজ ব্যবস্থার সামনে আমাদের দাড়াতে হবে। শোষণের শিকার আমরা আর হব না। আমরাই নতুন দিনের ধারক বাহক হব। তাজপুর পাইকপল্লী সেই নতুন দিনের নায়ক হবে। নতুন দিনের নায়ক হবে, এই ধুলোমাখা শাসনগ্রাম। সবাইকে পথ চিনতে হবে। ঠিক জায়গায় পা ফেলতে হবে। নতুন দিনের প্রতিনিধি তোমরাই। আপনারাই। সবাইকে ধন্যবাদ। শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা। ‘আবার, করতালির বৃষ্টি।
জুমলার বউ অবিনাশের সব কথা বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু তার খুব ভাল লাগছে। সবার কথা। আলাপচারিতা। আকাশের আলো কমে আসার আগে টেনে আনা ইলেকট্রিক তারে আলো জ্বলে উঠেছে, জুমলার বউ বইয়ের পাতা খুলে ছবিগুলো দেখতে। খুব ভাল লাগছে, সেই ছবি। মোহনের জন্যে তার অন্তঃকরণ কেমন বিগলিত হয়ে যায়। সে মুখরা বলে মনে মনে কেমন লজ্জাবোধ করে।সে ভাবে, ভাল করে কথা বললে কত ভাল শুনতে লাগে।
রাত আটটা নাগাদ সমাপ্তি সঙ্গীত দিয়ে রবি প্রণাম শেষ হয়। গোছগাছ করতে করতে আরও ঘন্টা দুয়েক চলে যায়। গৌতমের ভাইপোর কবিতা সবাই বলেছে অসাধারণ, পারমিতার সবকিছু অসাধারণ। আজ সে নিজের লেখা একটা কবিতাও বলেছে। জুমলার বউ কবিদের বলেছে, ‘তোমরা চলো না আমাদের বাড়ি। আমরা গরীব মানুষ।একটু চা খে যাবে। সবাই বলেছে,’পরের বারে যাব, দিদি। বেলা থাকতে যাব।’
দস্যি, পম্পা সবাই শেষপর্যন্ত থেকেছে। সব কাজের ফাঁকে কবিদের হাতে পারমিতা লুচি-আলুর দমের প্যাকেট ঠিক তুলে দিয়েছে। দুলালি বাপের বাড়ি গেলেও মাধব প্রথম থেকেই ছিল। অভাবের সংসার হলেও সে পঞ্চাশ টাকা চাঁদা দিয়েছে। সবাই একে একে চলে গেলে, পারমিতা বলল, মোহন দা তোমাদের কজনের জন্যে একটু ডিমের ঝোল ভাত করে রেখেছি। তোমরা আমাদের বাড়ি খেয়ে যাবে। কয়েকজন বেশি গেলেও অসুবিধা নেই। একমুঠো ভাত তোমরা যেতে যেতেই হয়ে যাবে।
পারমিতার আন্তরিকতা আর সহবত শিক্ষা দেখে মোহন বরাবর অবাক হয়েছে,আজ সেই সীমানা পেরিয়ে সে বিস্মিত হয়েছে। সারাদিন যা ডিউটি করল, ভাবা যাবে না। খোর্দশাসন- তাজপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আলো নিভে যাওয়ার পরেও সবার মনে হয়, একটু আগে কত মানুষের আনাগোনা ছিল। কি সুন্দর একটা দিন কেটে গেল। ছবির মতো সবার চোখে আঁকা হয়ে গেল। ঝন্টু সবাইকে নিয়ে তাদের বাড়ির দিকে রওনা হল। মোহন বাড়ির দাওয়ায় যখন পা দিল,রাত বারোটা হয়ে গেছে। গোটা বাড়ি অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে। তার ঘরে আলো জ্বলছে। দরজা ভেজানো। সনাতন প্রতিদিনের মতো দাওয়ার তক্তোপোষে। লক্ষ্মী-যুগলকিশোর ঝ্যাঁতলা পেতে দাওয়ার একধারে। সবাই ঘুমিয়ে আছে। দরজা ঠেলে ভেতরে সে ঢুকতে যাবে, এমন সময় সনাতন ডাকল, ‘মোহন ফিরলি বাবা। আজ তো খুব ভাল অনুষ্ঠান হল। লক্ষ্মীর হাত থেকে হাসিখুশি পেলুম। চমৎকার সাজানো। চশমাটা নি। ভাল করে পড়তে পারলুম না। একটা চশমা করে দে বাবা। বইটা পড়ব। তোর নামটা খুঁজে দেখছিলুম। তারপর দেখলুম, মোটা অক্ষরে লেখা তোর নাম।মোহন পাইক। সম্পাদক। হাত বুলিয়ে নিলুম। ছাপা অক্ষরে লেখা তোর নামের ওপর।
মোহন বলল, ভাল হয়েছে, বাবা ?
– খুব ভাল। খুব ভাল।
মোহনের চোখে জল এসে গেল। সে ভাবল, আমার দেবতার কথা তো রাখতে পারলাম। তাঁর এই ভাল লাগাটুকু আমার অপরাধ বোধের সান্ত্বনা।
সনাতন বলল, স্কুলের পরীক্ষাটা আবার দিস বাবা। ছেড়ে দিসনি। তোর মুকের দিকে তাকিয়ে বেঁচে আচি বাবা।
– হ্যাঁ বাবা। তোমার কথা মতো সব করব। তোমার চশমাটা তাড়াতাড়ি এনে দেব।
বলতে বলতে মোহন, সনাতনের গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। তার চোখের জল টপ টপ করে সনাতনের বুকে ঝরে পড়ে।
সনাতন বলে, কাঁদিস নি বাবা। কাঁদিস নি। আজ তো তোর বিজয়ের দিন।
চলবে…