পিরিয়ড নারীদের একটি স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া। এটি সাধারণত প্রতি মাসে ২৮ দিন অন্তর (সবার ঋতুচক্র সমান নয়) একবার করে হয়ে থাকে। যার স্থায়িত্ব প্রায় ৪-৫ দিন। এই পিরিয়ড ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন – ‛মাসিক’, ‛ঋতুস্রাব’, ‛রজঃস্রাব’ প্রভৃতি। সাধারণত ৯-১৩ বছর বয়সের মেয়েদের প্রথম মাসিক/ পিরিয়ড শুরু হয়। পিরিয়ডের চক্রকাল ২৮ দিনের চেয়ে কম বা বেশি হতে পারে। তবে খুব বেশি বা কম দিনের ঋতুচক্র কাল হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অতি অবশ্যই প্রয়োজন। যাইহোক, প্রতি চন্দ্রমাস পর পর হরমোনের প্রভাবে জরায়ুর কিছু স্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে রক্ত ও জরায়ু নিঃসৃত অপ্রয়োজনীয় অংশ শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একটি জৈবিক প্রক্রিয়াই হল পিরিয়ড।
পিরিয়ড হল নারীর অহংকার। নারীর মাতৃত্বের ক্ষেত্রে পিরিয়ড হল এক অমূল্য সম্পদ। সূর্য- চন্দ্র ব্যতীত পৃথিবী যেমন অসম্পূর্ণ ঠিক তেমনি ‛পিরিয়ড’ ছাড়া একজন নারীও অসম্পূর্ণ। পিরিয়ড নারীর কাছে এক অলংকার। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই পিরিয়ড নিয়ে সমাজে নানান রকমের অবৈজ্ঞানিক ও ভিত্তিহীন কুসংস্কার গুলো লক্ষণীয়। নারীদেরকে তাদের পিরিয়ড নিয়ে ইভটিজিং, লাঞ্ছনা-বঞ্চনার শিকার হতে হয়। কিন্তু পুরুষদের পাশাপাশি কিছু নারীরাও এই বিষয়টিকে নিয়ে মজা ও হাসি-ঠাট্টায় মেতে থাকে। বিশ্বায়নের যুগে এসেও আজও একজন মেয়েকে ‛স্যানিটারি প্যাড’ কিনতে গেলে গোপনীয়তা অবলম্বন করতে হয় এবং পদে পদে অপদস্থ ও ইভটিজিং এর শিকার হতে হয়।
আমাদের সমাজে মেয়েদের পিরিয়ড/মাসিক নিয়ে বিভিন্ন কুসংস্কার রয়েছে। যেমন – পিরিয়ড হলে মেয়েরা অপবিত্র হয়ে যায়, ধর্মীয় কার্যে অংশ নিতে পারবে না, মাথা পরিষ্কার করতে পারবে না, ভালো বিছানায় ঘুমাতেও পারবে না, বাড়ির বাইরে যাওয়া যাবে না, ভালো পোশাক পরিধান করতে পারবে না, রান্না করতে পারবে না, ঐ নারীকে ছোঁয়া যাবে না, এমনকি অনেক সময় ভিন্ন ঘরেও থাকতে দেওয়া হতো প্রভৃতি। এককথায়, পিরিয়ড বিষয়টি একটি ‛সোশ্যাল ট্যাবু’ তে পরিণত হয়ে গেছে। আমি এথনোগ্রাফি গবেষণায় দেখেছিলাম যে, পিরিয়ড চক্রের পর নারীকে নখ কেটে স্নান করে শুদ্ধ হতে হয়। এবং তারা অনেকেই ‛স্যানিটারি প্যাড’ সম্পর্কেও সচেতন নয়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পিরিয়ড এর যন্ত্রনা হার্ট অ্যাটাকের মতো বেদনাদায়ক হয়ে থাকে। এই সময় নারীদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যও ভালো থাকে না। মেয়েদের শরীর দুর্বল থাকে, মুড সুইং, দুশ্চিন্তা, তলপেটে ব্যথা প্রভৃতি হয়ে থাকে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে আমাদের সমাজ তথা আমরা তাদের পাশে না থেকে, তাদেরকে পুষ্টিকর খাদ্য না দিয়ে কুসংস্কারের জালে বন্দি করে রাখি। কুসংস্কারের জন্যই নারীকে এই সময় ‛স্যানিটারি প্যাড’ কিনে না দিয়ে বাড়ির পুরোনো মহিলারা কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করতে বলে। যার ফলে প্রতিবছর অসংখ্য মহিলাকে জরায়ু সংক্রান্ত রোগে প্রাণ দিতে হয়।
যাইহোক উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এই পিরিয়ড বিষয়টিকে সর্বপ্রথমে ‘সোশ্যাল ট্যাবু’ বা ‘কুসংস্কার’ থেকে মুক্ত করতে হবে। আমাদের সবাইকে এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে। তার জন্য যে পদক্ষেপ গুলি গ্রহণ করা দরকার সেগুলি হলো – সরকারি/বেসরকারি ভাবে অঞ্চলে অঞ্চলে পিরিয়ড সংক্রান্ত সচেতন মূলক ক্যাম্প করতে হবে, প্যাড ব্যাংক তৈরি করতে হবে,গণমাধ্যমে এই নিয়ে সচেতন মূলক বার্তা দেখাতে হবে, স্কুল পাঠ্যে পিরিয়ড সচেতন শিক্ষাকে স্থান দিতে হবে, স্কুল-কলেজে এই নিয়ে বিভিন্ন সেমিনার এর আয়োজন করতে হবে, বিশেষকরে চিকিৎসা বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব ও সমাজকর্মের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে NSS এর মত ‘পিরিয়ড ক্যাম্প’ সংগঠিত করার দায়িত্ব নিতে হবে, সরকারি ভাবে পিরিয়ড নিয়ে বিভিন্ন স্বাস্থ্য মূলক পদক্ষেপ ও ইভটিজিং প্রতিরোধ এর জন্য বিভিন্ন আইন চালু করতে হবে, NGO দেরকেও বেশি করে এই নিয়ে সচেতন মূলক ক্যাম্প করার দায়িত্ব নিতে হবে,স্যানিটারি প্যাড বিনামূল্যে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রদান করতে হবে প্রভৃতি। সবশেষে এটাই বলবো, একজন নারীর পাশাপাশি একজন পুরুষকেও এই পিরিয়ড সচেতনতার দায়িত্ব নিতে হবে,তাদের পাশে থাকতে হবে। তাহলেই এই পিরিয়ড সম্পর্কিত কুসংস্কার গুলোকে এই সমাজ থেকে দূরীভূত করা যেতে পারে। তখনই এর ফল স্বরূপ হিসেবে এক কুসংস্কার মুক্ত নতুন সমাজের সূত্রপাত হতে পারে।