শুধুমাত্র কোমলমনের অপাপ আগামীর প্রতিনিধি কান্ডারী শিশুদের নিয়ে পুরোপুরি একটি দিবস উৎসর্গীকৃত, নিবেদিত তাদের সঠিক লালন পালন, পরিচর্যা, অধিকার ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠাতে। দেশের ভাবি প্রজন্ম রূপে ফুলে ফলে বিকশিত পল্লবিত করার নব অঙ্গীকার নিয়ে চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা সবকিছুই জুড়ে গেছে সুকোমল মতি মননের অলিগলিতে। কচিকাঁচা ও শিশুদের নিয়ে উদযাপিত একটি দিবসকে শিশু দিবস বলা হয়। অবশ্য শিশুদের প্রতি সারা বছরই বাবা-মায়ের চলতে থাকে আদর স্নেহ ভালবাসা। শিশুরা যে তাদের কাছে জীবনের পরমপ্রিয় ভালোলাগার -ভালোবাসার সর্বোপরি বেঁচে থাকার চিরায়ত অবলম্বন ও শ্রেষ্ঠ সঙ্গী। প্রত্যেক বছরই ১৪ই নভেম্বর আমাদের দেশের সর্বত্র শিশু দিবস জাঁকজমকপূর্ণ গুরুত্বসহকারে পালিত হয়। বছরের শুরু থেকে -বরণীয় মনীষীদের জন্মদিন স্মরণ ও বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে নানা রকম দিবস উজ্জাপিত ও পালিত হয়। সেই সুবাদে ১৪ই নভেম্বর শিশুদিবস শিশুদের ও কিশোর-কিশোরীদের কাছে একটু ভিন্ন রকম মাত্রা গুরুত্ব পায়। এদিন বড়োরা একটু বেশি করে শিশুদের প্রতি বাড়তি নজর দেয়, নানাবিধ উপহার দেয়, নানান রকম মজার মজার অনুষ্ঠান করে শিশুমনকে আনন্দে, উচ্ছাসে ভরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় ব্যাপৃত থাকে। এবারে শিশু দিবসের প্রেক্ষাপট নিয়ে দু চার কথা।
শিশুদিবস যাকে কেন্দ্র করে পালিত হয় তিনি হলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধান মন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিবিদ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নেতা, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন আদর্শবাদী পন্ডিত এবং কূটনীতিবিদ নেহেরু ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিজীবনে রুচিবান পুরুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন জহরলাল নেহেরু। তাঁর পরিধেয় বহুল ব্যবহৃত প্রিয় কোটটি নেহেরু কোট নামে পরিচিত। নেহেরু ফ্যাশনের সবচেয়ে চমকপ্রদ অধ্যায়টি হচ্ছে যে কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে স্বতন্ত্রধর্মী এই কোটটি তিনি পরতেন। জওহরলাল নেহেরু ব্যক্তিগত জীবনে বাচ্চাদের প্রচন্ড স্নেহ আদর ও ভালোবাসতেন, বাচ্চাদের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটাতেন। তিনি ছোটদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন।তিনি বাচ্চাদের কাছে চাচা নেহেরু রূপে পরিচিতি পান। তাঁর চরিত্রের এই বিশেষ দিকটি কে মনে রেখে তার জন্মদিনকে শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৮৯ সালের ১৪ নভেম্বর উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদে। ১৯৪৭-১৯৬৪ সালের২৭ মে পর্যন্ত তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠা সহকারে। স্বাধীনোত্তর সমস্যায় জর্জরিত ভারতবর্ষকে মজবুত গণতান্ত্রিক ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে এক গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক , সার্বভৌম রাষ্ট্র রূপে ভারতকে সু প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।পরবর্তীকালে ভারত সরকার পণ্ডিত নেহেরুর জন্মদিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ঐ দিনটিকে শিশুদিবস বলে ঘোষণা করেন ।সেদিন থেকেই ১৪ই নভেম্বর শিশুদিবস পালিত হয়ে আসছে। শিশু দিবস টি প্রথমবার তুরস্কে পালিত হয়েছিল ১৯২০ সালের ২৩এপ্রিল। বিশ্ব শিশু দিবস ২০ নভেম্বর উদযাপন করা হয় এবং আন্তর্জাতিক শিশু দিবস ১জুন তারিখে উদযাপন করা হয়। তবে বিভিন্ন দেশের নিজস্ব নির্দিষ্ট দিন আছি শিশু দিবস উদযাপন করার।
প্রতিটি শিশুর মধ্যেই নিহিত থাকে বিরাট সম্ভাবনার জগত। আজকের শিশুরাই আগামীদিনে সমাজ রাষ্ট্র ও দেশের কর্ণধার কথা কান্ডারী রূপে পরিগণিত হবে। দেশকে, জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে । বিশ্বের অঙ্গনে পরিচয় করিয়ে দেবে যে আমরা ভারতবাসী। শিশুদিবস পালনের মধ্যে দিয়ে প্রতিটি নাগরিককে মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে ছোটরা কোনো তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা, হেলাফেলা বা অবহেলার পাত্র নয়। তাদের যত্ন, পুষ্টি স্বাস্থ্য, শিক্ষার দিকে আমাদের বেশি করে দৃষ্টি দিতে হব। প্রতিটা সুতকোমলমতি শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য মননশীল,অনুকুল বাতাবরণ সৃষ্টি করতে হবে। শিশু দিবস পালন মানেই শুধু রকমারি অনুষ্ঠান, ঘোরাঘুরি, তাদের উদ্দেশ্যে বড় বড়গালভরা কথা, আশ্বাসবাণী নয়, তাদের মজার গিফট ও উপহার দেওয়া নয় শিশু দিবস পালন মানে শিশুদের লালন পালনে আরো বেশি কর্তব্যনিষ্ঠ, দায়িত্ববান ও সচেতনতার পরিচয় দেওয়া। শিশুদের জন্য জহরলাল নেহেরুর অপার স্নেহ ও ভালোবাসা ছিল সর্বজনবিদিত। শিক্ষার মূল ভিত্তি হিসেবের বিজ্ঞানচেতনা এবং যুক্তির উপর জোর দেওয়ার কথা বলতেন তিনি। নেহেরুর কথায়-“শিশুরা বাগানের কুঁড়ির মত। খুব যত্ন সহকারে ওদের দেখভাল করতে হয়। ওরা দেশের ভবিষ্যৎ আগামীকালের নাগরিক। একমাত্র সঠিক শিক্ষাই পারে একটা সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে। “ভাবতে অবাক লাগে চারিদিকে এখন বেড়ে চলেছে শিশুদের প্রতি বঞ্চনা নিপীড়ন, শোষণ, হিংসা।নিদারুণ দারিদ্রতার বকখালি হারিয়ে যাচ্ছে অনেক শিশুর সুন্দর সাজানো শৈশবকাল। শিশুর বিচরণ ক্ষেত্র মাতৃক্রোড়, উন্মুক্ত প্রান্তর, শিক্ষাঙ্গন অথচ বাস্তবতায় পেক্ষাপটে অনেক শিশুই উপযুক্ত পরিচর্যার অভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে বিপথে পরিচালিত। এক্ষেত্রে অর্থ সামাজিক কাঠামোর ভারসাম্যহীনতা তাদের ক্রমশ বিপন্নতার আঁধারে নিমজ্জিত করছে।কিন্তু দুর্ভাগ্যে ও পরিতাপের বিষয় একবিংশ শতাব্দীতেও সমস্যার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বহু শিশুর শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে । প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার জীবনযুদ্ধে তারা ক্ষতবিক্ষত, জর্জরিত, বিধ্বস্ত হচ্ছে। সংসার চালাতে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে দুমুটো অন্ন জোগাড় করতে হয়। কখনো দুষ্ট চক্রের হাতে পড়ে অনেক শিশু চক্ষু নিমেষেই পাচার হয়েও যায়। অনেক শিশু স্কুলছুট হয়ে যাচ্ছে, অনেক শিশু অপুষ্টিতে রোগ-ব্যাধিতে ভুগছে, অনেক শিশু পড়াশোনার অধিকার থেকে বঞ্চিত, অনেক শিশু বেঁচে থাকার স্বাভাবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, অনেক শিশুর বাল্যবিবাহের শিকার। বিশেষত আমরা লক্ষ্য করেছি করোনা অতিমারিতে আর্থসামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া, অনুন্নত, প্রান্তিক, দরিদ্র শ্রেণীর পরিবারের শিশুদের অবস্থা খুবই দুর্বিষহ ও শোচনীয়। করোনা অতিমারিতে এই সমস্ত শিশুদের শৈশব বড়ই বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। প্রতিকূল পরিবেশে চার দেওয়ালের মধ্যে তাদের সুন্দর, প্রাণবন্ত, ছটফটে শৈশব হাবুডুবু খাচ্ছে।এইভাবে আমাদের দেশে সমাজ ও রাষ্ট্রে অকালে কত শিশু হারিয়ে গেল। তাই শিশুকে শিশুর বাসযোগ্য পরিবেশ গড়ের তোলার জন্য সরকারের পাশাপাশি সবাইকেই যৌথভাবে প্রচেষ্টা করে যেতে হবে। প্রতিটি শিশুকে সুস্থভাবে বাঁচার আশ্বাস দিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রতিটি শিশু ফুলের মত সুন্দর নিষ্পাপ ও পবিত্র। তাদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার জন্য আমাদের সর্বতোভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। শিশুদিবস মানে শুধু উপহার দেওয়া নয় বা বিনোদনের ব্যবস্থা করা নয়, শিশুর সহজাত অধিকারকে মর্যাদা দেওয়া ও সম্মান জানানো এবং প্রতিটি শিশু যাতে কোনদিক থেকে বঞ্চিত, নিপীড়িত, শোষিত না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দেওয়া। এগুলোর যথাযথ পালনেই শিশু দিবসের প্রাসঙ্গিকতা ও যথার্থতা। আসুন আমরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটা শিশুর মধ্যেই পিতৃত্বের স্নেহ ভালোবাসাকে উপলব্ধি করে তাদের প্রতি আরো যত্নশীল কর্তব্যনিষ্ঠা ও দায়িত্ববান হয়ে উঠি। তাদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশেই আমাদের আগামীর স্বপ্নের পূর্ণতা। এর পাশাপাশি প্রতিনিয়ত আমরা মন প্রাণে অকুণ্ঠচিত্তে শ্রদ্ধা ,ভক্তিতে অবশ্যই স্মরণ করব দূরদর্শী প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব ও ভারত বর্ডার কারিগর জহরলাল নেহেরুর আদর্শ, চিন্তাভাবনা। বর্তমান অসহিষ্ণুতা ও অস্থিরতার মুহূর্তে চারিদিকে যখন উগ্র দেশাত্মবোধের মোড়কে সুকৌশলে, মেরুকরণের ফায়দা লাভে চারিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা বিষবৃক্ষ । কেন্দ্র সরকার জনমানসে ভুলিয়ে দিচ্ছে বহুত্বের সম্প্রীতির সৌহার্দের স্থিতিশীল ভারতবর্ষ নির্মাণে মুক্ত মনের গণতন্ত্র কামি আধুনিক মনষ্ক জহরলাল নেহেরুর অবিস্মরণীয় অবদান। সেই প্রেক্ষাপটে ভ্রান্ত ধারণা নিরসনে দেশ গঠনের প্রতি নিবেদিত প্রাণ স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর প্রদর্শিত পথ আমাদের এই সঙ্কট মোচনের আসু মন্ত্র হয়ে উঠতে পারে। যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মিলেমিশে সবাই একাকার হয়ে ভারতীয় হয়ে ওঠার নবজাগরণের চিরায়ত স্বপ্ন দেখি। পরিশেষে শিশু দিবস পালনের মধ্য দিয়ে শিশুদের সুপ্ত চেতন মননকে জাগ্রত করার পাশাপাশি আমরা অবশ্যই জহরলাল নেহেরুর জীবন দর্শনকেও পাথেয় করে সম্মুখে এগিয়ে যাবো নতুন ভারত নির্মাণের ক্ষেত্রে। সেটাই হবে শিশু দিবস পালনের যথাযোগ্য প্রাসঙ্গিকতা আপামর ভারতবাসীর মধ্যে।