পূবিতে সূয্যি ওঠে পশ্চিমিতে চান
ঘরে আমার মানিক জ্বলে আসেন দেহে যান।
সুনার তৈয়ার পুত্তুল আমার হীরের ঝলক রূপ
সুনায়-হীরেই রাখব মুড়ে কে বা দিবি দুখ!!
নাতিনের গায়ে ঘানিভাঙ্গা সর্ষের তেল ডলতে ডলতে আকিমন গান গায়। রওজান বিবি চেয়ে চেয়ে দেখে আর হাসে। মনে তার বড় আনন্দ। আজ কত কত বছর পর এ বাড়িতে একটা ছোট্ট শিশু হাত-পা ছুঁড়ে খেলে, খলখলায়ে হাসে, আর ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদে!
হিরণবালা মেয়েরে মাই দিতে চেষ্টা করে। পয়লা পোয়াতি সে। সময়মত মাই টানাতে না পারায় বুকে দুধ ঠিকমত আসেনি। মেয়ে তাই মায়ের বুকে অস্বস্তিতে কাঁদে। আকিমন এসে নাতিনেরে কোলে তুলে নেয়। ‘ও আমার সুনা বুবু, মানিক বুবু রে, ও আমার ঘরের আলো আলতা বুবু রে’ বলে দোল দিয়ে দিয়ে কান্না থামাতে চেষ্টা করে। বাচ্চাটা একটু থামে, আবার কাঁদে। আকিমন এবার কাপড় সরায়ে নাতিনের পেট টিপে-টুপে দেখে হিরণবালার উদ্দেশ্যে বলে, তুমার দুধি আমার নাতিনির প্যাটের কুনাও ভরে না। এত যে কালিজিরে খাও, ভালোমন্দ খাও, তার পরও মাইয়ে দুধ আসে না। তারপর বিড়বিড় করে রাগতস্বরে বলে, দুধ কী অরে আসপি! সোয়ামি যদি আঁতুড় ঘরে মাইয়েলোকের কাছে যায়, তালি কি আর সেই পুয়াতির বুহি দুধ থাহে! পুয়াতির দুধ সুয়ামীর পার তলায় পড়লি তিন দিনিই শুহোয় যায়।
মেয়ের দুধ না পাওয়ার কষ্টে নাকি এই খোঁটায় হিরণবালার চোখে পানি চলে আসে। সে কি আঁতুড় ঘরে শুয়ে সোয়ামীর সোহাগ চাইছিল? সে কি খবর দিয়ে শরাফতরে তার চাচার বাড়ি আনছিল? একুশটা দিনও পার হতি দেয়নি, লোকটা একদিন যাইয়ে হাজির। বলে কিনা ঝামার আড়ং দেখতি আইছি। তা ঝামার আড়ংয়ের নৌকাবাইচ তো এ তল্লাটে বিখ্যাত। কত কত দূর গাঁও থেকে মেয়েরা এসময় নাইওর আসে! জামাইরাও আসে শ^শুরবাড়ি বেড়াতে আর আড়ং দেখতে। নতুন জামাইগেরে দাওয়াত দিয়ে আনা হয়। আর পুরনো জামাইয়েরা আপনি আসে। তা জামাই নতুন-পুরনো যাই হোক, আড়ংয়ে যেয়ে ঠিকই কেনে শালার জন্যি বাঁশি, শালীর জন্যি পুতুল আর শাশুড়ির হাতে তুলে দেয়ার উদ্দেশ্যে এক হাঁড়ি মিঠেই। সেই আড়ংয়ে শরাফত এবার গেছিল দাওয়াত ছাড়াই। মাত্র কয়দিন আগে মনির শাঠুরের আয়োজনে যা খরচ হইছিল তা সামলাতেই চাচার অবস্থা কাহিল, এর মাঝে আবার জামাইরে দাওয়াত করে ভালোমন্দ কী খাওয়াবে! অবশ্য গেল দুই সাল চাচা এমনিতেও জামাইয়েরে আড়ংয়ের দাওয়াত দেয়নি। দশ বচ্ছর হয় বিয়ে হয়েছে হিরণের। এখন তো তার সুয়ামী পুরনো জামোই, নাকি?
রমিজ মিঞা এত্তেলা পায়। আকিমন তারে ভেতর বাড়ি ডাকে। ও পাড়ার খয়বরের সাথে খলাটে দাঁড়ায়ে রমিজ মিঞা হাটে গরুর দরদাম বিষয়ে আলাপ করছিল। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর গরু-বাছুরের দাম ফের উঠতে শুরু করছিল। এখন নাকি বন্যার আগের চেয়েও বেশি দাম চড়ছে। আর চড়বে নাই বা কেন? বন্যার সময় অনেক গিরস্থই গরু পালতে না পেরে নাওয়ে গরু চড়ায়ে নিয়ে গঞ্জের হাটে বেচে দিছিল। অনেকে বেচছিল পেটের জ¦ালায়। তা রমিজ মিঞা কষ্টে-সৃষ্টে হলেও গরুগুলোরে ঠিক পেলে-পুষে রাখছে। এখন বাজারে দাম চড়ায় সে দুয়েকটা গরু বেচতে চায়।
রমিজ মিঞা ঘরে এলে আকিমন বলে, আধসের-তিন পোয়া দুধ দেয় এমন এট্টা ধাড়ি ছাগলের খোঁজ করেন, মনির জন্যি দুধির ব্যবস্থা অরা দরকার।
রমিজ মিঞা অবাক স্বরে বলে, ক্যা, মনি দুধ পায় না?
দুধ পালি কি আর আপনেরে ছাগলের কতা কই? আকিমন ঝাঁঝিয়ে ওঠে। রমিজ মিঞার মুখে আন্ধার ঘনায়।
নাহ্! টাকা হাতে এলে তা ধরে রাখার কপাল রমিজ মিঞার নয়। এই কেবল গরু বেচে কিছু নগদ টাকা পাওয়ার স্বপ্নে তার মনটা একটু খুশি খুশি বোধ করছিল, এমন সময় আরেক খরচের পরস্তাব। তয় ছাগলের দাম এই বাজারে এমন কিছু বেশি নয়। বন্যার পরে গরুর দাম যেমন চড়ে ছাগলের তেমন নাÑ এই যা ভরসা।
ছাগীর দুধ শিশুর পেটে সহনীয়, মায়ের দুধ না পেলে শিশু ছাগীর দুধ খেয়েই বড় হয়। এ দুধ খেয়েই হিরণবালার কইন্যা চান্দের কলার মতন বাড়তে থাকে। এখন সে এক পা-দু’ পা করে হাটে। তার পায়ে রুপোর মল ঝমঝমায়ে বাজে।
দুধে-আলতা গায়ের রঙ শরাফতের মেয়ের। নামও তার আলতা। নাকটা তার একটু চ্যাপ্টা। তাই নিয়ে আকিমনের শরিকী জায়েরা রঙ্গ করে কত কথা কয়! এ বংশে সবার নাকই বেশ খাড়া আর লম্বা। হিরণবালার নাকও তো বাঁশির নাহাল। সে তুলনায় বোঁচা নাকী আলতা সবার মনেই কৌতুকরসের জন্ম দেয়। রওজান বিবি সেসব কৌতুকের জবাব এভাবে দেয়ঃ
উঁচা কপাল, বুঁচা নাক
আলাই-বালাই দূরে যাক।
উঁচা কপাল, বুঁচা নাক
গোলা ভরা ধান থাক।
উঁচা কপাল, বুঁচা নাক
মানিক আমার বাঁইচে থাক।
বোঁচা নাকী আলতা সবার দোয়ায় বেঁচে থাকে।
বোঁচা নাকী আলতা বড় হতে থাকে।
পুতুলের বিয়ে দেয় আলতা। পাশের বাড়ির নওয়াব মিনের সাইজে মাইয়্যের কুচকুচে কালা ছাওয়াল পুতুলটার সাথে তার সোনার বরণ কইন্যার বিয়ে। বিয়ে হয়, ভোজ হয়। বর-বৌ কোলে চড়ে নওয়াব মিনের গোয়ালঘরে গিয়ে ওঠে। ঐ গোয়ালের এক কোনায় সাইজে মাইয়্যের পুতুল খেলার ঘর। কইন্যার বিয়ে দিয়ে আলতা কাঁদে। একদম সত্যিকার মায়ের মতই যেন সে কাঁদে। এমন সময় মা তারে ডাক দেয়। চোখ মুছে ধীর পায়ে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সে অবাক। মায়ের হাতে লাল মলাটঅলা কী একটা বই!
মুখ্যুর বংশ তো নয় – এ বংশে পড়ার চল আছে। পুরুষরা অনেকেই মক্তব-মাদ্রাসায় পড়েছে, কেউ কেউ গেছে নহাটা ইশ্কুলে। তবে মেয়েদের মধ্যে আলতাই প্রথম ইশ্কুলে যায়। বাড়ির পাশেই ইশ্কুল বসছে। ছাত্রদের সাথে দুয়েকটা ছাত্রীও যুক্ত হয়েছে। আলতা তাদের সাথে সুর করে পড়ে….
স্বরে অ, স্বরে আ, হ্রস্বই, দীর্ঘঈ….
কর খল ঘট
জল ধন নখ
পথ ফল ভয়….
ঐক্য বাক্য মাণিক্য
মুখ্য অখ্যাতি উপাখ্যান
ভাগ্য যোগ্য আরোগ্য….
সদা সত্য কথা বলিবে।
মিথ্যা বলা মহাপাপ।
চুরি করা অপরাধ।
গুরুজনে মান্য কর।
লেখাপড়া করে যেই
গাড়ি ঘোড়া চড়ে সেই।
গোপাল বড় ভাল ছেলে। তাহাকে যাহা দেয়া হয়, তাহাই খায়।
আলতা পড়ে। হিরণবালা শোনে। পড়া শুনতে তার কী যে ভাল লাগে! আলতার পরিত্যক্ত বর্ণ পরিচয় প্রথমভাগ বইটা সে উল্টেপাল্টে দেখে। আলতার শিশু হাতের অযত্ন আর বছরখানেক ব্যবহারের দরুণ মলাট ছেঁড়া ন্যাতানো দশার বইটা সে বড় যত্নে খুলে চোখের সামনে মেলে ধরে কতক্ষণ চুপ করে বসে থাকেÑ আশ্চর্য! এমন বই আলতা কত অনায়াসে গড়গড় করে পড়ে যায়! অথচ তার চোখে সব লেখা কথা হয়ে ধরা দেয় না। আলতার পড়া দেখে দেখে তার বর্ণ পরিচয় কতকটা হয়েছে কিন্তু সেই পরিচয় কাজে লাগিয়ে বই পড়া আর হয়ে ওঠে না। সংসারে কত কাজ! এর মাঝে আলতার পড়া কানেই শোনা হয়, চোখ দিয়ে মিলিয়ে নেয়ার ফুরসৎ মেলে কই?
চলবে …