১৯৯১ সালে কচিকাঁচার পরিচালক থানা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোহিত কামালের (তখনও তিনি কথাসাহিত্যিক হয়ে ওঠেননি) উদ্যোগের সাথে পরিকল্পনা করে টেকনাফে ৮টি প্রকাশনা নিয়ে প্রথমবারের মতো টেকনাফ বইমেলায় অংশগ্রহণ করেছিলাম! সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম, তিনজন প্রকাশক এবং জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন এবং কবি ও কলাম লেখক তসলিমা নাসরিনকে!
যদিও প্রথমবার! কিন্তু আয়োজন ও ব্যবস্থাপনায় কমতি ছিল না! মোহিত কামালের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষিত মানুষজন বই কিনেছে দেদারছে!
দুদিনের সফল মেলা শেষে মোহিত কামাল ট্রলারে করে দুজন লেখকসহ স্থানীয় ইউএনও শফিকুল ইসলাম লস্কর, থানা ইনচার্জ মোহাম্মদ আজিজ, থানা সেকেন্ড অফিসার শামসুদ্দিন, কাস্টমস কর্মকর্তা মোহাম্মদ আমিন, থানা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মাহফুজ আখতার মিলি, কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা, ব্যবসায়ী নুরুল হক, হিসাব রক্ষক মনোয়ার সাগর, উদয়, প্রবল কচিকাঁচার সংগঠক মোহাম্মদ সোহেলসহ আরও কয়েক জনকে নিয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণের আয়োজন করেন!
সকালে বিডিআর পিয়ার থেকে ট্রলারের সামনে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে নাফ নদী দিয়ে স্রোতের টানে ট্রলার ভেসে চললো! টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন সমুদ্র চ্যানেল পাড়ি দিতে সর্বমোট আড়াই ঘন্টার মতো লাগলো! দ্বীপে নেমে সকলে পায়ে হেঁটে পুরোদ্বীপ ঘুরে একমাত্র ইটের তৈরি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনে স্থানীয় কর্মকর্তাদের আয়োজনে দুপুরে বিশাল ভোজ হলো!
বিকেলে ফেরার সময় ট্রলারের উপরে অধিকাংশরা আসন পেতে বসলেন! কেউ কেউ ট্রলারে ভিতরে গিয়ে বসলেন!
মেঘমুক্ত আকাশ! সমুদ্রের ফুরফুরে বাতাস! হালকা ঢেউ! পরস্পর গল্পে মশগুল হলো! তসলিমা নাসরিন ভয় পাচ্ছে! মোহিত কামাল বললেন, আপনি ভিতরে চলে যান! কারো একজনের সহায়তায় সন্তর্পনে ডেকের ভিতর চলে গেল! ডা. মাহফুজা আখতার মিলি, ছোট্ট মাহবুব ময়ূখ রিশাদসহ আরও কয়েকজন ডেকের ভিতরে আগে থেকে বসেছিলেন!
১৫/২০ মিনিট পর বাতাসের গতি বৃদ্ধি পেলো! বড় বড় ঢেউ ট্রলারে আছড়ে পড়তে লাগলো! ট্রলার উঠেছে আর নামছে! ট্রলারের ভিতর থেকে রিশাদের চিৎকার শোনা গেল! মোহিত কামাল নেমে গেলেন! আস্তে আস্তে সবাই ডেকের উপর থেকে নেমে গেল! সর্বশেষ তরুণ পুলিশ অফিসার শামসুদ্দিন নামতে গিয়ে বাতাসের তোড়ে তাঁর হাত থেকে কিছু জরুরি কাগজ যা সেন্ট মার্টিন থেকে দেওয়া হয়েছিল– ডেকের উপর পড়ে গেল! আমি তখনও হালধরা মাঝির বাম পাশে সামনে ট্রলারে হেলান দিয়ে বসে আছি! আমি ইচ্ছা করলে কাগজগুলো ধরতে পারবো! কিন্তু ট্রলারের দুলুনিতে টাল সামলানো কঠিন হতে পারে! এই ভেবে রিস্ক নিলাম না! কারণ পা ফস্কে সমুদ্রে পড়ে গেলে জীবিত কেন! দেহটা খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে! কাগজগুলো আস্তে আস্তে ট্রলারের ছোট্ট উচ্চতার রেলিং গলে সমুদ্রে পতিত হলো ! আমরা দুজনে অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখলাম!
রিশাদ চিৎকার করে বলছে, ‘ঢেউকে থামতে বলো’! তার সাথে তসলিমা নাসরিনের কণ্ঠ– ‘আল্লা বাঁচাও! আল্লা বাঁচাও’!!
ডেকের উপরে আমরা মাত্র তিনজন– মাঝি, তার সহকারী এবং আমি! সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউ! মাঝি কত নৈপুণ্যতার সাথে সেসব ঢেউ সামলাচ্ছেন! মনে হলো, তাঁর সামান্য ভুলে ট্রলারটি অবলীলায় ঢেউয়ের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে! পরিণতিতে টেকনাফ প্রশাসন শূন্য হয়ে পড়বে! চমৎকার শিহরণ জাগানো অভিজ্ঞতা! শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সমুদ্র দেখার সাথে তুলনা করা যায় বৈকি!
নাফ নদীর মোহনায় যাওয়ার আগে পর্যন্ত ছোট্ট রিশাদের চিৎকারের সাথে তসলিমা নাসরিনের ‘আল্লা বাঁচাও’ শোনার অভিজ্ঞতা হলো!
কলমে: মজিবর রহমান খোকা
লেখা ও ছবি সোস্যাল মিডিয়া থেকে সংগৃহীত।