আবিষ্কারের নেশা মানুষের চিরন্তন। মানুষ পাহড়ের মাথায় উঠেছে, সমুদ্রের অতলে নেমেছে, গভীর বনে ঘুরে বেড়িয়েছে, বিপদসংকুল সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে। সমুদ্রের বিপদ শুধু দূরত্ব আর তরঙ্গ নয়, সঙ্গে ছিল খাদ্যস্বল্পতা এবং রোগব্যাধি। একটি নিত্যকার ভয়াবহ রোগ দেখা দিত সমুদ্রযাত্রায়, যাতে দুর্বল নাবিকের গায়ে ছিট পড়ে যেত, দাঁতের মাড়ি থেকে অনবরত রক্ত বের হতো। মাড়ি পচে গিয়ে এক সময় খুলে যেত দাঁত, এরপর মৃত্যু ছাড়া তাদের আর কোনো পথ থাকতো না।
উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে পর্তুগীজ আবিষ্কারক ভাস্কো-দা-গামা যখন ভারতবর্ষে পৌঁছালেন তখন জাহাজের ১৬০ জন নাবিকের ১০০ জনই নাকি মারা গিয়েছিলেন। এদের মৃত্যু হয়েছিল স্কার্ভি রোগে যা আর কিছু নয়, ভিটামিন সি-র নিদারুণ অভাব। এই তথ্য যতদিন জানা যায়নি ততদিন পর্যন্ত মানুষ কেবল শুকনো রুটি-মাংসজাতীয় খাবার আর পানীয় নিয়েই জাহাজে উঠেছে। তাদের ধারণা ছিল, এই রোগ হয়তো একান্তই সমুদ্রগত, যার শিকার আবিষ্কারক, নাবিক আর লুটেরা জলদস্যু। এই অসহায় মৃত্যুর ঘটনা অধিকাংশ সমুদ্রযাত্রায়, এমন কি সাবধানী কলম্বাসের দ্বিতীয় সফরেও দেখা দিয়েছিল। ভাস্কো-দা-গামার সমুদ্র যাত্রার পর ৩০০ বছর ধরে কমপক্ষে ২০ লক্ষ নাবিক প্রাণ হারিয়েছে এই রোগে।
এই রোগের প্রতিকারের উপায় জানা গিয়েছিল আমেরিকার রেড-ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে, যখন ফরাসী আবিষ্কারক কার্টিয়ারের জাহাজ চলছিল সেন্ট লরেন্স নদীর ওপর দিয়ে, ১৫৩৬ খ্রিষ্টাব্দে। কার্টার লক্ষ করেছিলেন, নদীর ধারের আদিবাসীরা একপ্রকার গাছের পাতা জ্বাল দিয়ে চা তৈরি করে খেতে দিচ্ছে রোগীদের, আর তাতেই খুব দ্রুত আরোগ্য লাভ করছে রোগীরা। এই জীবনদায়িনী গাছটির তখন থেকে নাম হল “আরবর-ভাইটি” (Arborvitae, Tree of Life), বৈজ্ঞানিক নাম থুজা অক্সিডেন্টালিস (Thuja occidentalis) যার জীবিত কয়েকটি গাছ এখন ৮০০ বছরেরও বেশি পুরানো।
এর পর থেকে প্রায় একই রকম গুণাবলীর জন্য ‘থুজা’ গণ-এর বিভিন্ন বৃক্ষকে জীবনবৃক্ষ বা আরবর-ভাইটি নামে ডাকা হয়। এর পাতার রসে থাকে প্রচুর ভিটামিন-সি এবং আরো অনেক জরুরি রসায়ন, কিন্তু সমুদ্রে এই ভিটামিন সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার সুবিধা তখনও ভাল জানা ছিল না মানুষের। তাই এরপরও মারা গেছে নাবিকেরা, যদিও কমে গেছে সংখ্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ার প্রতিটি আর্মি ডিভিশনে একটি করে ১০০ বেড-এর হাসপাতাল রাখা হত, স্কার্ভি থেকে সৈনিকদের জীবন রক্ষার জন্য।
এই জীবনবৃক্ষের ব্যবহারের কোনো শেষ নেই। প্রাচীনকালে মিশরীয়, গ্রীক এবং রোমানরা এর পাতার তেল সুগন্ধি হিশেবে ব্যবহার করত, এখনও করা হয় এরোমা থেরাপিতে, বিখ্যাত ‘ইউগো বস’ (Hugo Boss) পারফিউমে, ভিকস্ ভেপোরাব-এ, উত্তেজনা প্রশমনে, এজমা, ব্রংকাইটিস, খুশকি, চর্মরোগ ও ব্রণ নিরাময়ে। হোমিওপ্যাথিক শাস্ত্রে এর বিশেষ ব্যবহার আছে আঁচিল নির্মূল করাতে। মনোনীত ওষুধটি থুজা-১০০০, যার মাত্র এক ডোজ খেলে নাকি কিছুদিন পর শরীর থেকে ঝরে যায় যাবতীয় আঁচিল। এই ক্রিয়া অনুধাবন করার পর আমরা অনেকেই ভেবেছি, এই থুজা গাছ কি আমাদের রাস্তার আয়ল্যান্ডের নগ্নবীজী উদ্ভিদটি! হ্যাঁ, একই গণের উদ্ভিদ সেটা, তবে ওষুধটি বর্তমানে তৈরি হয় আমেরিকার থুজা অক্সিডেন্টালিস থেকে।
থুজা গাছের কাঠে যে সুগন্ধি থাকে তা অনেকটা ইউক্যালিপ্টাসের মতো, তবে আরো মিষ্টি। প্রাচীনকালে আগুনে পশু উৎসর্গের সময় এই কাঠ জ্বালানো হতো যাতে মাংসপোড়া উৎকট গন্ধটা অসহ্য না লাগে। হালকা অথচ মোটামুটি শক্ত বলে এর কাঠ দিয়ে নানাবিধ আসবাব তৈরি হয়। গিটারের খোল তৈরির জন্যে এটি একটি আদর্শ কাঠ। এর তেল দিয়ে ড্রয়ার মুছে নিলে কাঠে কখনও ঘুণ ধরে না।
বিগত দশকের গবেষণা থেকে জানা যায়, জার্মানিতে এর পাতা থেকে তৈরি হয়েছে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ওষুধ (২০০২)। জাপানে ‘থুজা স্টানডিশিয়াই( (Thuja standishii) ব্যবহার করে টিউমার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে (২০০৩) এবং ‘থুজা ওরিয়েন্টালিস’ (Thuja orientalis, syn Platicladus orientalis) থেকে চীনে তৈরি হয়েছে স্নায়ু এবং নিদ্রাহীনতার ওষুধ। থুজার একটি সক্রিয় রসায়ন ‘থুজোন’, যা চিকিৎসায় পরিমিতভাবে ব্যবহার না করলে স্নায়ু সমস্যা দেখা দিতে পারে। পাশ্চাত্যে এক সময় এবসিন্থ (Absinthe) নামে এক ধরনের নেশাকর পানীয় পাওয়া যেত যাতে মেশানো হতো ওয়ার্ম-উড থেকে সংগ্রহ করা থুজোন। এই এবসিন্থ অতীতে পান করেছেন চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যানগখ, নোবেল বিজয়ী হেমিংওয়ে এবং ফরাসী কবি খ্যাম্বো (Rimbaud), এখন যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
থুজা গণ-এর কয়েকটি অধিক আলোচিত গাছ হচ্ছে, থুজা অক্সিডেন্টালিস (White Ceder), থুজা প্লিকেটা (Red Ceder) এবং থুজা ওরিয়েন্টালিস (Chinese Ceder). এদের ভেতরে আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি হাইব্রিডের নাম ‘গ্রীন জায়েন্ট’ যা তৈরি করা হয়েছে দুটি প্রজাতিকে ক্রস করে, একটি আমেরিকার, Thuja plicata এবং অপরটি জাপানের, Thuja standishiai. আমেরিকার প্লিকেটা বেশ উঁচু গাছ, উচ্চতায় ১০০ ফুটেরও বেশি হতে পারে এবং জাপানের স্টানডিশিয়াই মোটামুটি ৬০-৭০ ফুটের মতো।
ফাঙ্গাস ও অন্যান্য রোগবালাইয়ের বিরূদ্ধে সফলভাবে টিকে থাকে ঘন সবুজ পাতার এই গ্রিন জায়েন্ট। ৬০ ফুটের মতো উঁচু, বছরে ৩ থেকে ৫ ফুট হারে বেড়ে যাওয়া দ্রুত-বর্ধনশীল গাছটি পশ্চিম দেশগুলোতে খুবই সমাদৃত। খুব তাড়াতাড়ি বছর তিনেকের মধ্যেই এই গাছ দিয়ে নিরেট ফেন্স তৈরি হয়ে যায়, যাতে শব্দ, ধুলোবালি আটকে পড়ে। আবহাওয়া শীতল রাখা এবং প্রখর আলো আটকে যাবার কারণে ইলেক্ট্রিক বিল কমে গেছে ঘরের পাশের বাগানে এমন বৃক্ষ রোপনকারীদের। ঘন সবুজের পশ্চাৎপটে বাগানের ফোটা ফুলের সৌন্দর্যও বেড়ে গেছে অনেকাংশে।
গ্রীন জায়েন্টের মতো আরেকটি গাছ খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এক সময়, যার নাম লিল্যান্ড সাইপ্রেস (Leyland Cypress) যা অভূত দুটি গণ-এর সঙ্কর, প্রজাতির নয়। এটি Cupressus এবং Chamaecyparis এই দুটি গণকে ক্রস করে উদ্ভাবন করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই গাছ এখন সহজে কেউ লাগাতে চান না, কারণ এ-গাছে বেশ পোকামাকড় এবং ফাংগাস আক্রমণ (Canker) হয় যা প্রতিহত করার উপায় প্রায় নেই বললেই চলে। তা ছাড়া এত উঁচু গাছে ওষুধ প্রয়োগ করাটাও দুঃসাধ্য।
লিল্যান্ড সাইপ্রেস অবশ্য আমাদের দেশে জন্মানো যেতে পারে কারণ এই গাছটির তাপ সহ্য করার ক্ষমতা খুব বেশি যা গ্রীন জায়েন্টের নেই। অনেক আগে তাজ মহলের চত্বরে সাইপ্রেস গাছ লাগিয়েছে ব্রিটিশরা তাদের দেশীয় ভূদৃশ্যের রূপে যেখানে আগে ফলের বাগান ছিল বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে দিল্লীতে রাষ্ট্রপতির ভবনে থুজা ওরিয়েন্টালিস গাছ লাগানো হয়েছে যেখানে আরো আছে আমাদের পরিচিত বকুল ও পুত্রঞ্জীব।