ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গুজরাটের আনন্দ ও মেহসেনায় আফগানিস্থান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। আর এই ঘোষণার পরেই পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন এবার রাজ্যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) লাগু হতে চলেছে। যদিও এখন পর্যন্ত সিএএ আইন তৈরি করতে পারেনি মোদি সরকার। তাই ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী গুজরাটে বসবাসরত শরনার্থীদের নাগরিকত্ব দিতে চলেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
আর এই ইস্যুতে সরব হয়েছে তৃণমূল, বাম, কংগ্রেসের মতো বিরোধীরা। এতে মতুয়া, নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের সুবিধা হবে বলে দাবি রাজ্যের গেরুয়া শিবিরের। মঙ্গলবার শুভেন্দু অধিকারী বিরোধীদের নিশানা করে বলেন, ‘এটা তো সিএএ-র পার্ট। সিএএ তো প্রণয়ন শুরু হয়ে গেলো। একই আইনে মতুয়ারাও নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। ভারতের অঙ্গ পশ্চিমবঙ্গও। পশ্চিমবঙ্গেও হয়ে যাবে। সিএএ আইন তো লোকসভা রাজ্যসভার দুটি সদনেই পাস হয়ে গিয়েছে। এটা আমরা অপেক্ষা করছিলাম। নিশ্চয়ই রুল তাহলে হয়ে গেছে। এই একই রুলে মতুয়া সমাজ, নমঃশুদ্র সমাজ যাদের ভিসা করতে গেলে, পারমিট করতে গেলে, চাকরির ক্লিয়ারেন্স আনতে গেলে বলা হয়, একাত্তরের আগের দলিল নিয়ে আসেন। এখন আর সেই সমস্যা থাকলো না। এক যাত্রায় তো পৃথক ফল হয় না।’
এ বিষয়ে বনগাঁর বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর বলেন, ‘ভারতীয় জনতা পার্টি সিএএ কার্যকর করার জন্য দায়বদ্ধ। সুপ্রিম কোর্টে একাধিক মামলা ও করোনা কালের জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে রাজ্য সরকারের মতামত গুরুত্বপূর্ণ, তাই আমাদের রাজ্যে তা চালু করার ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। যেটা পশ্চিমবঙ্গের জন্য নেতিবাচক। কারণ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও মুখ্যমন্ত্রী এটিকে সমর্থন করেননি বলে রাজ্যে এটি লাঘু করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু এখানেই আমাদের বড় সমস্যা। আমি মনে করি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ডিক্লারেশন দিয়েছেন, সেটি একদম ঠিক। আমাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমাদের প্রক্রিয়া চলছে। আমি মতুয়াদের কাছে যে প্রতিশ্রুতি করেছিলাম, সেটি যদি সম্পূর্ণভাবে গুজরাটে শুরু হয় আমি মনে করি তার প্রথম ধাপ শুরু হলো। যেহেতু গুজরাটের রাজ্য সরকার বিজেপি দ্বারা পরিচালিত এবং কেন্দ্রীয় সরকারও আমাদের, সেই কারণে এই নির্দেশ কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে। আগামীতে উত্তরপ্রদেশসহ যেখানে যেখানে আমাদের সরকার রয়েছে, সেখানে সেখানে কার্যকর হবে। আমরা আনন্দিত এবং আমরা আশাবাদী আগামীতে পুরো দেশের পাশাপাশি এ রাজ্যেও সিএএ কার্যকর হবে।’
কেন্দ্রীয় সরকার ও গুজরাট সরকারকে সাধুবাদ জানিয়ে শরণার্থী আন্দোলনের সর্বভারতীয় নেতা কল্যানীর বিজেপি বিধায়ক আইনজীবী অম্বিকা রায় বলেন, ‘এই নাগরিকত্বের দাবিতে আমায় জেলে যেতে হয়েছিল। ১৩ বছর ধরে এর দাবিতে আন্দোলন করেছি। আজ গুজরাট সরকার তার সার্থক প্রয়োগ শুরু করলো। ধর্মীয় কারণে যারা এদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদের জন্য এই আইন পাস করতে গিয়ে রাজনৈতিকদলগুলো বাধা দিয়েছিল। কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করে আইন পাস করে মোদি সরকার। এবার গুজরাট করেছে, আমরা আশাবাদী অন্য রাজ্যও করবে। আজ মতুয়াসহ সব শরণার্থীদের কাছে অত্যন্ত আনন্দের দিন। আমাদের পরিশ্রম, ত্যাগের ফসল আসা শুরু হয়েছে। গুজরাট সরকারকে ধন্যবাদ। কেন্দ্রীয় সরকার তাদের কথা রাখার চেষ্টা শুরু করেছে, আজ তা প্রমাণ হয়ে গেলো।’
এদিকে, রাজ্য সরকারের মতুয়া উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান তথা সাবেক তৃণমূল সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর বলেন, ‘গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমাদের দাবি, নিঃশর্ত নাগরিকত্ব। কী প্রমাণপত্রের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে আমরা ঠিক স্পষ্ট নই। সেটা জানার পরেই আমরা সঠিকভাবে বলতে পারব।’
তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ শান্তনু সেন এ বিষয়ে কটাক্ষ করে বলেন, ‘রাজনীতি ও ভোট বড় বালাই। দেশের মানুষ দেখছে রাজনীতি করতে গিয়ে আর কত নাটক করবে বিজেপি। মারবিতে ব্রিজ ভেঙে একশ মানুষের মৃত্যু হলো। সেসব চাপা দেওয়ার জন্য ও ধর্মের নামে মানুষকে বিভাজন করতে গিয়ে এই ঘোষণা করা হলো। এভাবেই এক শ্রেণির মানুষকে অন্য এক শ্রেণির বিরুদ্ধে উৎসাহ দেওয়া হলো।’
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী এই বিষয়ে বলেন, ‘শুভেন্দু অধিকারী যে কথা বলেছেন, তাতে যদি মান্যতা দিতে হয়, তাহলে শুভেন্দু অধিকারীকেও স্বীকার করতে হয় দিল্লিতে সরকারি ব্যবস্থায় কোনও স্বচ্ছ্বতা নেই। কোনও বিজ্ঞপ্তি নেই সিএএ চালু করার, কোনও ঘোষণা নেই। অথচ শুভেন্দু অধিকারী জানিয়ে দিলেন। তাহলে কি ঘুরপথে পিছনের দরজা দিয়ে চালু করছে? এটাই কি উনি বলতে চাইছেন? আমি নির্দিষ্ট করে বলতে চাই, সংবিধান সম্মত মনোভাবের বাইরে চলার ঝোঁক বিজেপির থাকলেও, সেটা করতে পারবে না। ওখানে এটা কোনও নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রজেক্ট নয়। তাহলে আগেও বন্দোবস্ত করতে পারত। এটা ভোটের প্রজেক্ট।’
কংগ্রেস নেতা সাংসদ অধীর চৌধুরীর বলেন, ‘সেতু দুর্ঘটনার পর গুজরাটের মানুষ প্রতিবাদে নিন্দায় গুজরাট সরকারকে ভরিয়ে দিচ্ছেন। তখন সেই একই কায়দা। ভোটে সব বিষয় ভুলিয়ে দাও। সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে সামনে নিয়ে আসো। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে এমনটিই হয়েছিল। মোদি, দিদি লাভবান হয়ে গেলেন। এখন সিএএ, এনআরসি ঘুমাচ্ছে। এর পরের নির্বাচনে তা ফের উঠবে। গুজরাটে ভোট হচ্ছে বলেই সিএএ জেগেছে। সিএএ আইন তৈরি হয়ে গেছে। এখনও তা কার্যকর হয়নি।’