উচ্চমাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। মোহন স্কুলে গিয়ে দীপঙ্করকে দেখতে পাচ্ছে না। ভাইফোঁটার দিনে তাদের বাড়িতে নেমতন্ন ছিল। ওদিকে ঝঞ্ঝাটে আসা সম্ভব হয়নি। আসতে পারেনি, খারাপ লেগেছে। দীপঙ্করের মা, বাবা, দিদি সবাই তাকে ভালবাসে। গতবারের শ্যামা কালীপূজা তো দীপঙ্করদের বাড়িতেই কেটেছে। এবছরের পূজাতে একেবারেই আসা হল না। দীপঙ্করের একটু অভিমান হয়েছে। বড়লোকের ছেলে, কোনো অহংকার নেই। মোহনদের বাড়িতে সে অনেক বার ঘুরে যেতে চেয়েছে, মোহন নানা অজুহাতে এড়িয়ে গেছে।
কোথায় আসবে, আর কোথায় বসবে। টেস্ট পরীক্ষার মধ্যে সবাই পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে, তেমন কথা হয়নি। শুধু দেখা হয়েছে। দীপঙ্করকে দেখতে না পেয়ে সে বেশ অবাক হয়। কৌশিকের সঙ্গে দেখা হয়, লাইব্রেরির সামনে। সে বইপত্র জমা দিয়ে নতুন কিছু বই নিচ্ছে। মোহনের কাছেও স্কুলের কিছু বই আছে,জমা দিতে হবে। আজ বইগুলো সে আনেনি। বেমালুম ভুলে গেছে। তাকে দেখে কৌশিক এগিয়ে আসে। কৌশিকের মনটা একটু খারাপ। তার টেস্টের রেজাল্ট ভাল হয়নি।
মোহন বলল, দীপঙ্কর কোথায়?
– সে তো বাড়ি চলে গেছে। পরীক্ষাতে ওই তো ফার্স্ট হয়েছে। তোর তো কেটে গেছে। দুটো মেন সাবজেক্টে। ইংরাজীতে ফেল। তোকে ফাইনালের জন্যে অ্যালাও করেনি। তুই রেজাল্ট দেখিসনি?
মোহনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।
স্কুলে ঢুকতে তার একটু দেরি হয়ে গেছে। সবাই হাতে রেজাল্ট পেয়ে গেছে। ক্লাশ টিচার মার্কশিট দিয়ে গেছেন। এখন হেড মাস্টারমশাইয়ের কাছে গিয়ে রেজাল্ট নিতে হবে। রেজাল্ট নিয়ে কি আর হবে। ফেল তো হয়ে গেছে। সে কিছু ভাবতে পারছে না। কিভাবে সে পাড়ায় গিয়ে মুখ দেখাবে। বাবার সামনে গিয়ে কিভাবে দাঁড়াবে। পারমিতার সামনে গিয়ে কিভাবে দাঁড়াবে, এমন নানা প্রশ্ন তার মাথায় পাক খেতে থাকে। দীপঙ্কর হায়েস্ট পেল। আর সে ফেল করল। পরীক্ষা খারাপ তার হয়েছিল,সে জানে। সে যে অ্যালাউড হতে পারবে না, ভাবতে পারেনি। স্কুলে আর কাউকে মুখ দেখাতে তার যেন সাহস হচ্ছে না। হেড মাস্টারমশাইয়ের ঘরের দিকে পা বাড়ানোর সামর্থ্য তার নেই। কিন্তু দীপঙ্কর নিশ্চয়ই সব শুনেছে। সে একবার দেখা করল না। চলে গেল। দীপঙ্করের সঙ্গে রেগুলার যোগাযোগ থাকলে এমন হত না। সে তো প্রথম দশে ছিল না। পড়াশুনা ভাল করলেও আগে তো কখনও ফার্স্ট হয়নি। নিজেকে ঘষেমেজে ঠিক সময়ে পাঙ্গা নিয়েছে। আর তার এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে নিজের পিছিয়ে যাওয়ার ছায়া তাকে কেমন হন্যে করে তোলে। চোখে ধোঁয়া দেখে। কি করবে, বুঝতে পারে না। কবি হওয়ার সাধ তার কাছে অভিশাপ মনে হয়। নিজের দারিদ্র্যের গল্প বলে এই ব্যর্থতা ঢেকে দেওয়া যাবে না,সে বুঝতে পারে। এই মুহূর্তে তার কি করা উচিত,কার কাছে যাওয়া উচিত, তার স্বপ্নের রথ কি এখানেই থেমে গেল, এমন অজস্র প্রশ্ন তাকে ছেপে ধরে।
কতই বা তার বয়স,১৯৮৩ সালে জন্ম। ১৯৯৮ সালে মাধ্যমিক,তারপর দু’হাজার সালে এসে এইভাবে হোঁচট খেয়ে ঠিকরে যেতে হবে,সে বুঝে উঠতে পারেনি। সবকিছু যখন তার চোখে ঝাপসা, কোনও কিছু ভাবতে যখন সে অপারগ, তখন-ই দেবদূতের মতো তার পাশে এসে মণি মাস্টার দাঁড়ালেন।
-‘মোহন, কতবার বলেছিলাম, কথা শুনলে না। তুমি টেস্ট পরীক্ষায় পাশ করতে পারলে না।
মোহন হাউহাউ করে কাঁদছে। মা মারা যাওয়ার পর সাতবছর বয়সে সে এমন ছেলেমানুষের মতো কেঁদেছিল। আর কখনও সে এত কাঁদেনি।
মণি মাস্টার আর শক্ত থাকতে পারলেন না। তিনি বললেন, কাউকে আটকানো হবে না। সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তবে গার্জিয়ান আনতে হবে। তোমার মা – বাবা যে কেউ এলে হবে। তোদের পড়াশুনার কী অবস্থা সেটা তো তাদের জানতে হবে। সেইভাবে শেষ কটাদিন নিজেদের তৈরি করতে হবে। এবার উড়লে সারাজীবনের শিক্ষা নিতে হবে। তুই লেখালেখি করিস, ভাল লাগে। পরীক্ষায় ফেল করে লেখালেখি করতে হবে না। সবাই বলছে, তোর হাল একদম খারাপ। পড়াশুনা একদম করিস না। প্র্যাকটিক্যালের কাজ ঠিকঠাক করিসনি। যা তা। যাইহোক ,বাবা। এবারে লাস্ট চান্স। তানাহলে কপালে কষ্ট মেনে নিতে হবে।’
কপালে কষ্ট কথাটা তার অন্তরে ঘড়ির মতো বেজে উঠল। বলল, ‘এখন কি করব, স্যার।’
– বাড়ি যা। হেড মাস্টারমশাই ব্যস্ত আছেন। বাবাকে নিয়ে চলে আসবি।
– ঠিক আছে,স্যার। বাবা তেমন বাইরে বের হতে পারেন না। বাড়িতেই থাকে। আমার তো মা নেই। ছোটবেলা থেকে।
– ও মা জানতাম না তো। বলিসনি তো কখনও। ঠিক আছে, কথা বলে রাখছি, হেড মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে। বাবাকে কষ্ট করে নিয়ে আয়। আর যদি উনি আসতে না পারেন তো একটা চিঠি বাবার থেকে লিখে আনিস।
উনি লিখতে পড়তে পারেন তো।
– হ্যাঁ স্যার, পারেন। তবে এখন আর পারেন না। অনেকদিন তো লেখেননি। নাম সই করে দিতে পারবে।
– তাহলে মোহন, বক্তব্যটা তুই গুছিয়ে লিখে দিস। আর বাবাকে দিয়ে সই করে নিস। চিঠিটা দেখিয়ে সই করিস। বাবার সাইন, বাবাকে দিয়ে করাস। নিজে করে দিস না,আবার।
– আজ্ঞে না, স্যার।
– ঠিক আছে। তুই বেরিয়ে যা। সামনের দিনে দেখা হবে। পরের দিন, শনিবার। একেবারে ছুটির দু’দিন বাদ দিয়ে সোমবার চলে আয়। চিন্তা করিস না। এই কটা দিন টেনে পড়াশুনা করে যা। উতরে যাবি। নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারলে সংসারে কে তোকে দেখবে,বলতো।
মোহন বাড়ির পথে রওনা হয়।
প্রতি
মাননীয় প্রধান শিক্ষক,
গোবিন্দপুর হাইস্কুল,
রামনগর থানা,
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা
বিষয়: চূড়ান্ত পর্যায়ের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার জন্যে আবেদন
মহাশয়,
আমি শ্রী সনাতন পাইক, সাং তাজপুর,পাইকপল্লী, হরতাল,দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা। আমার ছোটছেলে শ্রীমান মোহন পাইক, আপনার অধীনস্থ বিদ্যালয়ে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। মোহন এগ্রিকালচার নিয়ে পড়াশুনা করছে, আপনার অভিভাবকত্বে। কিন্তু নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ পাওয়াতে আমি অত্যন্ত হতাশ হয়েছি। মোহন সফল হতে পারেনি। আমরা গরীব, হতদরিদ্র,নানা সমস্যায় জর্জরিত। ওকে ঠিক মতো নজর দিতে পারিনি। এই ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে আপনার কাছে সশ্রদ্ধ অনুরোধ রাখি, ওর সাম্প্রতিক ব্যর্থতা মার্জনা করে দিয়ে একটিবার সুযোগ দিন,যাতে মোহন চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষায় বসতে পারে। আশাকরি, আপনার ছাত্রটি নিরাশ করবে না। আমাদের মুখ রাখবে। ওর এই ফলাফল একটা দুর্ঘটনা মাত্র।
অতএব মহাশয়, আমার এই মানবিক আবেদন আপনি যদি মঞ্জুর করেন পিছিয়ে পড়া সমাজের ছেলে হিসেবে ওর চলবার পথ যেমন আলোকিত হবে,তেমন বাবা হিসেবে আমি নিশ্চিন্ত হবার অবকাশ পাব। পাশাপাশি আপনার নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
বিনীত
শ্রী সনাতন পাইক
তাজপুর, পাইকপল্লী
১৪/১/২০০০
মোহন বাবাকে কখনও মিথ্যে কথা বলেনি। আজও বলবে না। চিঠিটা হাতে নিয়ে সংকোচে সে রাঙা হয়ে গেল। নিজেই তো লিখেছে। যেভাবে লিখতে হয়। এর আগে অভিভাবকের চিঠি অনেকের সে লিখে দিয়েছে।
এবার নিজের প্রয়োজনে লিখেছে। সনাতন আবছা অন্ধকারে দাওয়ার তক্তোপোষে শুয়ে ছিল। ময়লা লেপ গায়ে। মোহনের একটা শোয়েটারও সনাতন চাপিয়ে নিয়েছে। শীত যত জাঁকিয়ে নামছে, সনাতনের সাড়া তত কমে যাচ্ছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না। মশারী টাঙানো। দড়ি দিয়ে চার জায়গায় বাঁধা।ছেঁড়া মশারী,মশারীর ভেতরেই মশা বেশি। এখন শীত বলে মশা কম। সন্ধ্যের পর থেকে সে মশারীর ভেতরে ঢুকে যায়। বাবার কাছে এসে খুব ধীর গলায় সে ডাকল।
– বাবা, ঘুমালে। একটু দরকার ছিল।
– না ঘুমোই নি। একটু ঝিমোচ্ছি। শরীরটা ঠিক নি রে বাবা। চোখ ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে। চোখে পিচুটি কাটছে। দাঁড়াতে পারছি না।
– জানি বাবা। একটা কাগজে সই করতে হবে।
– কিসের সই। চশমা নি তো। অন্ধকারে দেকতে পাবুনি। কি হবে, আমার সই?
– একটু দরকার।
মোহনের সেজো বউদি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল,অন্ধকারে। ছেলেটা উঠোনে কাগজের ওপর পায়খানা করছে। তার হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল। সে সইয়ের কথা শুনে ভাবল, কিনা কি সই। ঘরের ভেতর গিয়ে বিছানা থেকে মোহনের সেজদাকে ডেকে তোলে। সে তো লেখাপড়া জানে না।
সে আবার, মেজদাকে ডেকে তোলে। রাত বেশি হয়নি,দশটার মতো।
মোহনের মেজদা বীরেন, উঠোন থেকে হাঁক দেয়, মোহন কিসের সই বাবা করবে,এই অন্ধকারে। মোহন তো খুব লজ্জায় পড়ে যায়।কথা বলে না। একটা সামান্য জিনিস নিয়ে এরকম হট্টগোল হতে পারে, সে বোঝেনি। বাড়ির সবাই জেগে যায়। পাশের বাড়ির লোক উঠে পড়ে।
বাড়িতে কখনও মোহনকে এমন ফাঁপড়ে পড়তে হয়নি’। যুগলকিশোর কোনও কথা না বলে মোহনের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে ঘরের আলোতে গিয়ে পড়ে। সে তো ম্যাটিকুলেশন পাশ। চাকরিবাকরি না পেলেও তার পড়াশুনার যে দাম আছে,তা এতদিনে কেউ না বুঝলেও বাড়ির সেজো বউ বুঝেছে।
যুগলকিশোর বলল, ছিঃ ছিঃ ছিঃ। তুই পাশ করতে পারিস নি। রাতের অন্ধকারে বাবার দে সই কোরাচ্চিস? তুই নিজেই সনাতন পাইক।
মোহন একটাও কথা বলল না।
লক্ষ্মী বলল,’ ছেলেটা বড় হয়চে। কি বলতেচো কি?
ও চুরি করেচে,না ডাকাতি করেচে। ইস্কুলের একটা চিটি সই কোরাচ্চে। ‘ বলতে বলতে কেঁদে ফেললো। কথা আর বাড়ে না। সবাই যে যার ঘরে চলে যায়। কয়েক মুহূর্ত পর মোহন বাবাকে বলল, ‘বাবা চিন্তা করো না। তোমাকে কাল সব কথা বলব।’
সনাতনের ছাপান্ন সাতান্ন বছর বয়স। এই বয়সে কেউ বুড়ো হয় না। অভাব সনাতনকে বুড়ো করে দিয়েছে।
সনাতন বলল, সব বুজতে পেরিচি। আমার সব্বোনাশ হয় চে। মোহন, কত কোরে বোজালুম। ওরা তোর পরীক্ষায় বসতে দেবে তো।
– দেবে বাবা। একটা চিঠি দিতে বলেচে। তোমাকে সই করে।
– ঠিক আচে। কাল দে দোবো। তুই পড়তে বসে যা। পড় বাবা পড়। সারারাত পড়। তোর মুকের দিকে তাক্কে বেঁচে আচি।
মোহন ঘরের দরজায় খিল দেয় না। দাওয়ায় বাবা থাকে। দাদা-বউদি থাকে। দরজাটা ভেজিয়ে দেয়। রাত বাড়তে থাকে। মোহনের দুশ্চিন্তা, দুঃস্বপ্ন বাড়তে থাকে। আকাশে চাঁদ উঠেছে। শীতের রাত। কনকনে ঠাণ্ডা। ফাঁকা দাওয়ায় ওরা শুয়ে থাকে। চট, ঝ্যাঁতলা, ছেঁড়া লেপ গায়ে ওদের রাত কাটে। মোহনের লেপ নেই। মোটা কাঁথা। ওর মা আরতি বুঝেছিল, খুব ময়লা হয়ে গেছে। ঠাণ্ডা আটকায়। দাওয়ার বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না, কুয়াশা নামছে। গোটা পাইকপল্লী জুড়ে। সবাই ঘুমোচ্ছে, মোহন একলা জেগে আছে, সে যেন দেখতে পাচ্ছে, সামনের দিনগুলো বড় ধোঁয়াশায় ভরা। সবকিছু যেন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। স্বপ্ন- দুঃস্বপ্ন দুটোই তার বুকে পায়চারি করছে।
চলবে…