গতকাল ৫ অক্টোবর ছিল বিশ্ব শিক্ষক দিবস। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশে এবছর প্রথমবারের মত সরকারিভাবে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী দিবসটি উদযাপনের ২২দিন পর বাংলাদেশে সরকারি নির্দেশনায় গত ২৭ অক্টোবর এবং সেটা আবার প্রাথমিক থেকে কলেজ পর্যন্ত, অর্থাৎ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধমিক পর্যায়ের সাধারণ, কারিগরি এবং মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দিবসটি উদযাপিত হয়েছে। এর বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠানেও হতে পারে কিন্তু সরকারি নির্দেশনা এর মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে মনে হল। কারণ এখানে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন ৯টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক এবং উপ-পরিচালকদেরকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে দিবসটি উদযাপন বিষয়ে সমন্বয় এবং তদারকি করার জন্য। এ বছর শিক্ষক দিবসে সরকারি নির্দেশনায় যে বাংলা স্লোগানের কথা বলা হয়েছে, সেটা হল, ”শিক্ষকদের হাত ধরেই হবে শিক্ষা ব্যবস্থার রূপান্তর।“ বাংলাদেশে ২০২৩ সাল থেকে শুরু হতে যাচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম। এদেশে পাঠ্যসুচি, সিলেবাস, পরীক্ষা পদ্ধতি এত ঘন ঘন পরিবর্তিত হয় যে সেগুলি নিয়ে ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক এবং শিক্ষা নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করা মানুষ ছাড়া তেমন কারো আগ্রহ আছে বলে আমার মনে হয় না। যাদের কথা বললাম, তাদেরও ঠিক আগ্রহ থাকে না বরং শংকা থাকে, হতাশা থাকে। তবে আগামী বছর থেকে ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত হতে যাওয়া নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আমাদের গণমাধ্যমে এবার অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে একটু বেশি আলোচনা হচ্ছে। যেসব প্রতিবেদন আমরা প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়াতে দেখি, সেখানে গুরুত্বের সাথে যে বিষয়গুলিকে সামনে আনা হয়, সেগুলি হল, প্রাথমিকে পড়তে হবে ৮ টি বই, মাধ্যমিকে ১০ টি। তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না; মুল্যায়ন হবে শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। এসএসসি পর্যায়ে কোনো গ্রুপ বা বিভাগ থাকবে না। শুধুমাত্র পরীক্ষার নম্বর নয়; ছাত্রছাত্রীদের মুল্যায়ন হবে বছরব্যাপী তাদের অগ্রগতি পর্যালোচনার মাধ্যমে। অর্থাৎ ফলাফল নির্ভর করবে, ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার খাতায় যা লিখেছে তার বিপরীতে প্রাপ্ত নম্বর এবং শিক্ষকরা তাঁদের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে যে নম্বর প্রদান করবেন দুইয়ের যোগফলের ভিত্তিতে। কথা হল, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঠিক কি কারণে শিক্ষাক্রমে এই পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন, সে বিষয়ে আমাদের যথাযথ ধারণা না থাকলেও এটুকু অন্তত আমরা বুঝতে পারি, নিশ্চয় এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তারা একটা রূপান্তর ঘটাতে চান। আর সে কারণেই বোধহয় এ বছর সরকারিভাবে এই স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন কথা হল, যাঁদের হাত ধরে রূপান্তর ঘটানোর কথা বলা হয়েছে, তাঁদের রূপান্তর কে ঘটাবে?
সৃজনশীলতা এবং শিল্পের ক্ষেত্রে একটা প্রচলিত কথা আছে, নতুন কিছুর জন্ম দিতে চাইলে শিল্পীকে নিজে আগে নবরূপে জন্মলাভ করতে হয়। নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে উদ্দ্যেশ্য হয় সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থীদের রূপান্তর ঘটানো, তাহলে যারা রূপান্তর ঘটাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন, তাঁদের রূপান্তর আগে দরকার। একথা বলছি, কারণ আমাদের শিক্ষক সম্প্রদায় আসলে কতটা সংবেদনশীলতার সাথে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে পারবেন, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। সংশয়ের কারণ হিসাবে অনেক কারণ আলোচনা করা যায়। আমি এখানে দু-একটা উল্লেখ করছি মাত্র। সরকারিভাবে বিদ্যালয়ে প্রাতঃকালীন সমাবেশে সকল শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া বাধ্যতামুলক। খোদ ঢাকা শহরেই শিক্ষকদের একাংশ সমাবেশে মিলিত হন, কিন্তু জাতীয় সঙ্গীতের সাথে গলা মেলান না। তাঁরা মনে করেন এই কাজটা ইসলাম বিরুদ্ধ। এখন যিনি মনে-প্রাণে এই কথা বিশ্বাস করেন এবং সরকারি নির্দেশনা অমান্য করেন, তার পক্ষে নিরপেক্ষভাবে গান-বাজনা করে এমন শিক্ষার্থীকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা কিভাবে সম্ভব? আমি যে কথা বললাম, এইটা আমার পক্ষে প্রমাণ করা কস্টসাধ্য। কারণ প্রত্যেক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকেরই দায়িত্ব হল, সেই শিক্ষককে বলা। তিনি যদি তারপরও তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, তাহলে সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যথযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কিন্তু দীর্ঘদিন একসাথে চাকুরীর সুবাদে কিংবা প্রধান শিক্ষকেরা চেয়ে তিনি বয়সে বড় হওয়ার সুবাদে প্রধান শিক্ষক নীরব থাকেন।
একই কথা প্রযোজ্য একুশে ফেব্রুয়ায়ির প্রভাবফেরী কিংবা শহীদ মিনার ফুল দেবার ক্ষেত্রে। এই ঘরানার শিক্ষকেরা শহীদ মিনারে ফুল দেওয়াকে ইসলাম সম্মত মনে করেন না, এমনকি প্রভাতফেরীতে খালি পায়ে শহীদ মিনারে যাওয়াকেও তাঁরাও সমর্থন করেন না। তাঁর মানে কি তাঁরা চান একটা বিদ্যালয় ইসলাম সম্মত উপায়ে চলবে। সেটা তো এই মুহুর্তে পূর্ণমাত্রায় সম্ভব হচ্ছে না, তাই যারা এগুলিকে সমর্থন করেন, সেই ছাত্রছাত্রীদের প্রতি এই শিক্ষকদের আনুকুল্য বেশি থাকাই স্বাভাবিক। এখন বিদ্যালয় পর্যায়ে এত খোলামেলাভাবে মতামত প্রকাশের সুযোগ ছেলেমেয়েদের কম। কিন্তু কিছু বিষয় তো আছেই, যেগুলি থেকে শিক্ষকরা ওই শিক্ষকেরা অনুমান করে নিবেন, না, ছেলেটা কিংবা মেয়েটা আল্লাহর রাস্তায় আছে। তার মধ্যে পোশাক অন্যতম। আবার অন্য ধর্মেরও কিছু শিক্ষক আছেন, যাঁদের মনোজগতে এই পোশাকের কারণে ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বিরূপ ধারণা রয়েছে। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় সেটা প্রকাশের সুযোগ কম।
এতক্ষণ যাঁদের কথা বললাম, তারা তো চিহ্নিত। এর বাইরে ছদ্ম মৌলবাদী শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যাও অনেক। আমি গ্রামের একাধিক স্কুলের কথা জানি, যেখানে শিক্ষিকারা শিক্ষক রুমে বসে আজাহারীর ওয়াজ শোনেন এবং নিবিষ্টতা দেখে বোঝা যায়, এঁরা কি পরিমাণ আজাহারী ভক্ত। এই শিক্ষকদের পক্ষে কি সম্ভব জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীর প্রতি ন্যায় দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করা?
এবার আসি সরকারিভাবে শিক্ষক দিবস পালনের জন্য যে সাধারণ কর্মসুচি ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে কোথাও কোরান তেলওয়াত, গীতা পাঠ কিংবা অন্য ধর্মের কোনো গ্রন্থ থেকে পাঠের কোনো বিষয় নাই। আমি কর্মসূচীটা যতদূর দেখেছি, সেখানে যে বিষয়গুলির কথা বলা হয়েছে সেগুলির সাথে সরাসরি ধর্মীয় চর্চার কোনো বিষয় নাই। এখন আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, একটা কর্মসুচির শুরুতে কোনো ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হবে, সেটা কর্মসুচিতে থাকতেই হবে? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, জাতীয়ভাবে যখন কোনো কর্মসুচি পালন হয় তখন একটা সাধারণ নির্দেশনা অনুসরণ করায় শ্রেয়। আর যদি ব্যতিক্রম ঘটানো হয়, সেটা যাতে একটা ধর্মের মানুষের চর্চাকে প্রাধান্য দেওয়া না হয়। আমার জানামতে, এই কর্মসুচিতে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র কোরান তেলওয়াত করা হয়েছে, সেখানে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ধর্মের কোনো গ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয় নাই। সবচেয়ে বড় কথা হল, ”শিক্ষকের হাত ধরেই হবে শিক্ষা ব্যবস্থার রূপান্তর” এই শিরোনামে আলোচনার কথা সরকারি নির্দেশনায় ছিল। কিন্তু কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সেই আলোচনাকে কোরান-হাদিসের আলোকে শিক্ষা এবং শিক্ষককে রূপান্তর করে ফেলেছেন। এখন কথা হল, এই যে এক রৈখিক চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি যা দ্বারা তারা প্রতিষ্ঠানকে তো প্রভাবিত করছেনই, সরকারি নির্দেশনাকে অমান্য করছেন, তাদের পক্ষে, সেই শিক্ষকদের পক্ষে কি শিক্ষার্থীদের রূপান্তর ঘটানো সম্ভব? আমি মনে করি না, কারণ হতে পারে সেই প্রতিষ্ঠানে অনেক মুক্তমনা শিক্ষক আছেন, কিন্তু তাদের যদি এইটুকু বলার মত সৎ সাহস না থাকে যে, আমরা একটা সাধারণ নির্দেশনা অনুসরণ করি কিংবা কোনো গ্রন্থ থেকে পাঠ করলে সেটা সব ধর্মের গ্রন্থ থেকে পাঠ হতে হবে কিংবা আলোচনা কেন শুধু কোরান-হাদীসের আলোকে হতে হবে? অন্য ধর্মেও তো শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। তাহলে সেই কথিত মুক্তমনা শিক্ষকেরা পালে হাওয়া দিচ্ছেন নিজে জেনে, বুঝেও। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানো সত্যিই কঠিন। যদি এই বাংলাদেশেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস দেখতে যাই সেটার শুরু, হিন্দু কিংবা মুসলিমদের হাতে হয় নাই। তাহলে কেন আমরা একটা বিশেষ ধর্মের আলোকে এই আলোচনা করব?
এরকম অনেক কথায় বলা যাবে, এটাই এখন বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলাফল, যা হবার তাই হচ্ছে। যতই আমরা রূপান্তর ঘটাতে চাই না কেন, সেটা অলীক স্বপ্নই থেকে যাবে, যদি আমরা নাগরিক হিসাবে এগুলি আমলে না নেয়। তবে মূল দায়িত্ব রাস্ট্রেরই। আমরা শুধু রাষ্ট্রকে দেখিয়ে দিতে পারি গলদটা কোথায়। হতাশার মাঝেও আমরা স্বপন দেখতে চাই, এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সত্যিকারের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করবে এক নতুন মনুষ্য সমাজ।