ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রাতের হাওয়া-ই-হিন্দ এর নরম গদিওয়ালা সিটে আরাম করে বসেছি জানালার ধারে, কলকাতা ফিরব। আমার পাশের সিটে সহযাত্রী নেই। আমি একা ডানদিকে। বসার সঙ্গে সঙ্গেই ছোট্ট কাচের গ্লাসে লাইম জ্যুস, অরেঞ্জ জ্যুস দিয়ে গেলেন কমবয়সী তন্বী বিমানসেবিকা। তার পরেই ট্রেতে সাজিয়ে একগুচ্ছ নতুন ম্যাগাজিন- ‘ইন্ডিয়া টুডে’, ‘উওম্যান’স ইয়েরা’, ‘ফ্রন্টলাইন’ ইত্যাদি। যাওয়ার সময় যেহেতু ‘ইন্ডিয়া টুডে’ নিয়েছিলাম, মনে হল ‘উওম্যান’স ইয়েরা’টা নেই। কী হচ্ছে মেয়েদের অন্দরমহলে একটু ঢুঁ মারি। মেয়েদের পত্রিকার গতিপ্রকৃতি কেমন সেগুলোও জেনে রাখা ভালো। সিদ্ধান্ত নিতে তো বেশিক্ষণ সময় নিতে পারি না। তন্বী ললনা হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তুলে নিলেই সামনের জনের কাছে যাবেন। শেষ মুহূর্তে মত পাল্টে তুলে নিলাম ‘ফ্রন্টলাইন’। তখনও বোর্ডিং চলছে পুরোদমে। মাস্ক না পরে ওঠার জন্য বিমানসেবিকারা গেটের কাছে ধরে ধরে মাস্ক পরিয়ে ওঠাচ্ছে। ওদিকে না দেখে আরাম করে লাইম জ্যুসে চুমুক দিতে দিতে পেছন থেকে পাতা ওল্টাতে লাগলাম। চোখ আটকে গেল একটা বুক রিভিউতে। বইয়ের নামটি অদ্ভুত। ‘Why Do You Fear My Way So Much? Poems and Letters from Prison’.(Speaking Tiger, ₹450/-)
লেখক গোকরকোন্ডা নাগা সাইবাবা, যিনি জি এন সাইবাবা নামেই পরিচিত।
ছোট থেকে পোলিওতে নব্বই শতাংশ পঙ্গু অন্ধ্রপ্রদেশের অমলাপুরমের ড. সাইবাবা ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন দিল্লির রামলাল আনন্দ কলেজের। ছিলেন কারণ তাঁর চাকরিটি গত বছর এপ্রিল মাসে চলে গেছে কারণ সাইবাবা জেলবন্দি ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। নব্বই শতাংশ পঙ্গু মানুষটি ২০১৪ থেকে নাগপুরের আন্ডাকক্ষে জেল খাটছেন রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য।
কিছু কিছু ক্ষণিকের সিদ্ধান্ত আশীর্বাদ না অভিশাপ হয়ে আসে বুঝতে পারি না। রিভিউটি পড়ার পর স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। মনে হচ্ছে মূল বইটা কতক্ষণে কিনে পড়ব? নীচে বিন্দু বিন্দু আলোর রেখা উপেক্ষা করে দ্রুতগতিতে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো আমাদের উড়ান।
কী জানি, নাগপুরের ছোট্ট কুখ্যাত আন্ডা সেলে হামাগুড়ি দিয়ে কি অশক্ত হাতে লিখতে চেষ্টা করছেন অধ্যাপক?
তাঁর দুই হাত, যা ছিল একমাত্র অবলম্বন, সেই হাতের ক্ষমতাও কেড়ে নিয়েছে রাষ্ট্র। তাঁর স্ত্রী কি সন্তান নিয়ে নিদ্রাহীন? কী অসহায় আমরা যড়যন্ত্রের কাছে, আইনের কাছে। আমার মনে তখন তোলপাড় করছে কয়েকটা লাইন।
“I still stubbornly refuse to die.
The sad thing is that
they don’t know how to kill me,
because I love so much
the sound of growing grass.”
(I Refuse to Die, 26 October 2017)
লাইনগুলো সাইবাবা জেল থেকে তাঁর বহু বছরের সঙ্গিনী, স্ত্রী বসন্ত কুমারীকে লিখেছিলেন চিঠিতে।
মূল বইটি যখন হাতে পেলাম কয়েক ঘন্টা ঘোরের মধ্যে কেটে গেল। হুইল চেয়ারে আবদ্ধ এক ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক তাঁর সমস্ত চিন্তাভাবনা, বেদনা, ভালোবাসা, ভয়, সাহস উজাড় করে দিয়েছেন তাঁর স্ত্রীকে এবং কিছু বন্ধুকে লেখা চিঠি, কবিতার ছত্রে ছত্রে। প্রথম দিকের কিছু লেখা মাতৃভাষা তেলেগুতে। পরে ইংরেজিতে কারণ মাতৃভাষায় চিঠি লেখার অনুমতি হারিয়েছেন সাইবাবা। তাঁকে লিখতে হয় ইংরেজি ভাষায় যে ভাষায় বসন্ত একেবারেই স্বচ্ছন্দ নয়। এটাও সাইবাবার রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি। কিন্তু অন্যায়টা যে ঠিক কী তা এখনো জানেন না তাঁরা। শুধু এটুকু তাঁর পরিবার জানে ২০১৪ সালে নব্বই শতাংশ পঙ্গু সাইবাবাকে হুইলচেয়ার থেকে তুলে বালির বস্তার মত ছুঁড়ে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয় সশস্ত্র কমাণ্ডোদের তত্ত্বাবধানে। পঙ্গু অধ্যাপকের বাম হাতটিও ধাক্কায় নষ্ট হয়ে যায় (২০০৮ এর আগে পর্যন্ত তিনি দু তালুতে চপ্পল গলিয়ে সরীসৃপের মত হেঁটে কলেজ করতেন যেহেতু তাঁর কোন হুইলচেয়ার ছিল না)। তাঁকে বাহাত্তর ঘন্টা প্রস্রাব করতে দেওয়া হয়নি এবং দেওয়া হয়নি তাঁর উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ। যে অধ্যাপক একদিনের জন্য ক্লাস মিস করেননি, এক মুহূর্তের জন্য দেরি করে ক্লাসে যাননি, যিনি প্রচুর দুঃস্থ ছাত্র-ছাত্রীকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেছেন, যাঁর ইংরেজি সাহিত্য পড়ানোই ছিল ধ্যানজ্ঞান সেই নব্বই শতাংশ পঙ্গু মানুষটি কিন্তু মায়ের মৃত্যুতেও মাকে শেষ দেখার অনুমতি পাননি। যে বৃদ্ধা মা যখন কয়েকশো কিলোমিটার উজিয়ে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন জেলে, ছেলের মুখ ভালো করে দেখতে পাননি কারণ তাঁদের দুজনের মাঝে রেখে দেওয়া হয়েছিল একটি ঘষা ফাইবার গ্লাস। তাই জেলবন্দি ছেলের আকুতি ঝরে পড়ে কয়েকটা লাইনে। মাকেও তেলেগুতে লেখার অনুমতি পাননি ছেলে।
তাই ইংরেজিতে লেখেন —
“When you came to see me,
I couldn’t see your face
from the fibreglass window….
When you couldn’t afford a glass of milk
in my childhood,
you fed me with your words
of strength and courage….
Mother, lose not your hope.
I realised that jail is not death,
it is my rebirth,
and I will soon return home
to your lap that nurtured me
with hope and courage.
Mother, fear not for my freedom.
Tell the world,
my freedom lost
is freedom gained for multitudes…”
(Mother, Weep not for Me,2014)
ছেলের বড়ো আশা ছিল এ কবিতা কেউ তাঁর মাকে তেলেগুতে অনুবাদ করে দেবেন। জানি না সে আশা পূরিত হয়েছিল কিনা, তবে ছেলে তাঁর মাকে শেষ দেখার অনুমতি পাননি মায়ের নব্বই শতাংশ পঙ্গু ছেলে দেশের পক্ষে বিপদ বলে। অথচ দেশের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর।
সাইবাবা জেলের নির্জন কক্ষে লেখেন একের পর কবিতা। বেশিরভাগই তাঁর বন্ধু, প্রিয়া, স্ত্রীকে যিনি একা বৃদ্ধা শাশুড়ি ও সন্তান নিয়ে অসহায়ের মত লড়াই করছেন, স্বামীর সঙ্গে যিনি জেলে প্রথম দিন দেখা করতে পারেননি কারণ তিনি সাইবাবার পদবি ব্যবহার করেন না, তাই স্ত্রী বলে মেনে নিতে বসন্তকে অস্বীকার করে রাষ্ট্র। তাঁকেও দেখা করতে হয় ফাইবার গ্লাসের ব্যবধান রেখে।
“Fear not to stand in the dock,
if need be.
Never feel small
or allow despondency,
the squeamish helplessness.
Cross the bar,
move on
with the same evergreen smile
on your red wet lips.
What we have dreamt together
must move on….
(My Love, Are You Tired?2016)
এ এক অসম লড়াই বসন্তর। যোগাযোগ বলতে মাঝে মাঝে ফোন কল (তাও সেই ফোনে আড়িপাতা হয়, অথবা চিঠি- যে চিঠি পড়ে দেখা হয়)।
স্বামীর দুবছরের কোন মেডিকেল রিপোর্ট তাঁর হাতে আসেনি। হাসপাতালে অসুস্থ স্বামীকে দেখার অনুমতি না পেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে চেয়েছেন কিন্তু কাঁদেননি। সামলে নিয়েছেন নিজেকে কারণ তাঁর দুর্বলতা ও অসহায়তা হৃদয়হীন অফিসারদের সামনে প্রকাশ করতে চাননি। তাই স্বামীকে চিঠিতে লেখেন –“I will never allow sadists to feel happy.” তবুও বেদনার ভাষা কেঁদে ওঠে কবিতায় যদিও রাষ্ট্র কেড়ে নেয় ভাষা তাঁদের কাছ থেকে।
“We are made helpless,
our emotions shackled,
love imprisoned, thoughts fettered,
and our words chained;
our language is stolen away from us….
My love, my freedom,
raise the burning torch
in your hand a little higher.”
( My Love, My Freedom)
কোভিডকালে সুপ্রিম কোর্ট অর্ডার দিলেও সাইবাবার প্যারোলে ছাড়া পাননি বা জামিন তো পাননি উল্টে অতিমারীর দোহাই দিয়ে সব বাতিল করেছে জেল কর্তৃপক্ষ। ভাইরাসতো জেল বা রাজপ্রাসাদ মানে না। তাই দু দুবার ভাইরাস আক্রমণ করে সাইবাবাকে। বাড়ি থেকে মাসে পঁয়ত্রিশশো টাকার বেশি পাঠানোর অনুমতি নেই। তাই দেশদ্রোহী অধ্যাপকের ফল জোটে না, জোটে না ভালো পুষ্টিকর খাবার। ওষুধের তালিকা দীর্ঘ। ছোট থেকে পোলিওর জন্য যাঁর দেহের নব্বই শতাংশ পঙ্গু, তাঁর এখন শিরদাঁড়া বাঁক নিচ্ছে, কোমরে এত যন্ত্রণা ঘুম হয় না, পিত্তথলিতে ও কিডনিতে পাথর, ব্রেনে সিস্ট। চার বছর সুচিকিৎসা পাননি তিনি। তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী। কী তাঁর দোষ তিনি এখনো ঠিক জানেন না। ছোট থেকে লড়াই করে পাওয়া চাকরিটি চলে গেছে। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে।
না মানসিক শক্তিটা হারিয়ে ফেলেননি তিনি এখনো। স্ত্রীকে নিরন্তর সাহস যুগিয়ে চলেছেন —
“তুমি দুঃখ পেয়ো না, বরং মাথা উঁচু করে চল। তোমাকে হেয় করতে চায় করুক, তুমি সামনের দিকে তাকিয়ে সঠিক পথে চলবে।”
কলম গর্জে ওঠে —
“For us, despair has no space,
hope alone creates a new history.
Mistakes or no mistakes
when revilers are thrown about,
hold them in your cupped palms
with grace and dignity.”
সাইবাবা সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করছেন যেদিন পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলিতে চুঁইয়ে পড়বে বিন্দু বিন্দু শিশির আর পাহাড়ের তলদেশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন তাঁর স্ত্রী।
তাঁর মুক্তির জন্য অনেক আন্দোলন করেছে তাঁর ছাত্র, সহকর্মী, অসংখ্য শুভানুধ্যায়ী, রাজনৈতিক দল, প্রতিবন্ধীদের সংস্থা। কিন্তু জগদ্দল পাথর নড়েনি। রাষ্ট্র অনড়। মেয়ে মঞ্জীরাকে ক্ষোভের সঙ্গে লেখেন —
“The Mahatma
at the main gates
stuck on the wall
with a cane in hand
cries out in silence:
‘Repent the sin of your crime…
Silence rustles
like fallen leaves
tossing on the dusky back
of the deadened leviathan.
After lock up,
walking up and down
behind the cage’s rusty bars
every prisoner
appears to be a wild beast…
The hard-earned books
in my cell
stare at me.
I am frightened to read them
by opening my eyes.”
(Images of My Cage,2017)
মনের সরসতা, ভালোবাসা, মানবিকতা হারিয়ে ফেলেননি তিনি। তাই প্রতিদিন সকালে সেই জেল রক্ষীকে নিয়ে কবিতা লেখেন যে রক্ষী প্রত্যেকদিন সকালে পরীক্ষা করেন তাঁরা জীবিত নাকি মৃত। অসাধারণ সে কবিতা।
“He smiles
he laughs
through the bars
to shake me up
from my early morning dreams
with a hug
of a good morning…
He comes from
the deepest well
of our social misery.
He has no time for his beloved ones
languishing outside the gates.
Imprisoned by his duties
day and night
behind high four walls
and closed gates,
he spans away
a lifetime in prison
for a pittance.
The cursed souls come and go,
but he is a permanent prisoner,…”
(Ode to a Prison Guard, 2017)
দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান কবে সে সদুত্তর কারুর কাছেই নেই। নির্জন কক্ষে সময় থমকে যায় মাঝে মাঝে। ভবিষ্যত তাঁর কাছে যেন দূর নক্ষত্রমণ্ডলীর কোন মৃত তারা থেকে উজিয়ে আসা ক্ষীণ আলো। তাঁর কাছে মৃত্যুদণ্ড যাবজ্জীবনের থেকে সহজতর কারণ “Nations are prison-houses/ encompassing death’s desire.” তবুও তিনি লেখেন —
“Living in the prison- house,
I’ve learnt to set myself free,
I’ve broken all walls of narrowness.
I’ve ploughed the land of my mind
now my heart shines with
the rays of a zillion green trees.”
(My Heart is Coloured with the Colour of Love, 2019)
হয়তো পরিস্থিতি তাঁকে করেছে আরও মানসিকভাবে শক্তিশালী। স্ত্রীকে লিখছেন-
“But death my love,
I find it poor or rich
disgraceful or with dignity–
it all depends on who one is in life….”
রাষ্ট্র তাঁকে বন্দি করলেও তাঁর ভাবনা চিন্তাকে বন্দি করতে পারেনি। তিনি স্বাধীন, তিনি মুক্ত। তাঁর কবিতা, চিঠিগুলি বারবার সেই কথা বলে। যিনি একা বাথরুম যেতে পারেন না, এক পা হাঁটতে পারেন না, যাঁর হুইলচেয়ার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, যার হাতের জোর নেই আজ তবে রাষ্ট্রের ভয় কীসে? হয়তো তাঁর জোরালো শব্দবন্ধকে, তাঁর কবিসত্ত্বাকে। কারণ তিনি সমাজের সমস্ত ধর্ম, গোঁড়ামিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে সোচ্চারে প্রতিবাদ করেন।
কবীরের কথায় —
“He’s a messenger of love for people.”
তাহলে রাষ্ট্রের এত ভয় কেন? রাষ্ট্রই এখানে বেশি অসহায়। তাই জেল থেকে লেখা দু’শ ষোল পাতার বইটিতে তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন –
“Why do you fear my way so much?”
লেখক: মণিমেখলা মাইতি