রাঁড়, ভাঁড়, মিথ্যে কথা
এই তিনে কলিকাতা
– শরাফতের সদম্ভ ঘোষণা।
ঐ কোইলকেতে মাগীর গুষ্টির মদ্যি তুই ক্যা ফাল দে পড়ে বৌ সাজাতি বসলি?
হিরণের মুখে কথা যোগায় না। তার মুখে এ কথা ঠেলাঠেলি করে বেরুতে চাইলেও সে বলার অবকাশ পায় না যে ইচ্ছে করে নিজ গরজে সে বৌ সাজাতে বসেনি। নানাজনের উপরোধ এড়াতে না পেরে নিতান্ত বাধ্য হয়েই সে…। মধুমতি তীরের বিখ্যাত উজানগাঁওয়ের মেয়ে হিরণ।
এককালে উজানগাঁও তো বড় গঞ্জই ছিল, নাকি? নদীর ভাঙ্গনে ভাঙ্গনে সেই গাঁ আজ বিলীন হয়ে গেলেও, গাঁয়ের অধিবাসীদের অধিকাংশ এখন চরুয়া হলেও, আগেরকালের ঠাঁটবাট কি তারা সবই ভুলেছে? এই হিরণের বিয়েতেই তার চরবাসী চাচা দামান আর ইয়ারদের জন্য যে বিশাল তশতরি ভরা কোর্মা-পোলাওয়ের আনজাম করেছিল তেমন কি এই হাভাতে গিজগিজ করা ভাতুরে গ্রামের কেউ দেখেছে? কাজেই মিদ্যা বাড়ির মেয়েরা যদি হিরণকে কনে সাজায়ে দেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে, আর হিরণ বহু না না করেও শেষে ময়-মুরুব্বীর মুখের কথার মান রাখতে রাজী হয়, তবে তাতে তার দোষটা কোথায়?
কিন্তু এসব কথা বলবার মত অবস্থা কিনা এখন হিরণের! এই সাতসকালে বিয়েবাড়ির শত শত জোড়া চোখের সমুখ দিয়ে বৌয়েরে প্রায় উঠায়ে এনে বাড়ি ফিরে শরাফত মিঞা ফাঁকা ঘরে খিল এঁটেছে। মিদ্দাবাড়ির বিয়ের দাওয়াতে আর কাজের হাঙ্গামায় হাত লাগাতে কাল বিকেল থেকেই এ বাড়ির সবাই সেখানে পড়ে আছে। ফাঁকা বাড়ি পাহারা আর গরু-বাছুরের তত্ব-তালাশের নাম করে বাড়ি জুড়ে ছিল এক লোকমান। তা বৌয়ের হাত ধরে শরাফতরে বাড়ি ঢুকতে দেখে সে এখন মূল বাড়ি ছেড়ে কাছারি ঘরের ওপারে খ্যাড়ের পালার কোলে ঠাঁই পেতেছে। সেখানে সে বিচালী কেটে গরুর জাবনা তৈরিতে যেন ঘোর মনোযোগী। বুক শিরশির করে বেয়ে ওঠা এক দীর্ঘশ্বাস লোকমানের মুখ দিয়ে সশব্দে বেরিয়ে অদূরে ভাতুরিয়া বিলের বুক ছুঁয়ে কোন এক অজানা শূন্যতায় মিলিয়ে যায় কি?
আর হিরণ? তার মুদিত বিবশ চোখে তখন কোন ঘোর নেচে ফেরে? ইশ্কুল, ইশ্কুল…না জানি কেমন তা। সেখানে মেয়েরা পড়তে যায়। কারা পড়ায়? কী পড়ে? পুঁথি? কী পুঁথি? কী কাহিনী লেখা থাকে তাতে? ইস্! তার যদি একটা মেয়ে হয় তবে সে ইশ্কুলে পড়তে পাঠাবে। কোন ইশ্কুলে? এ গাঁয়ে তো ইশ্কুল নেই। কাছাকাছির ভেতরে তিন গ্রাম পরে নহাটায় আছে এক ইশ্কুল। সে ইশ্কুলে নাকি ছেলেরা পড়ে। কই, কোন মেয়ের ইশ্কুলে পড়ার কথা তো শোনা যায় না। মেয়েমানুষ ইশ্কুলে পড়ে এ কথাটাই তো এ তল্লাটের কেউ কখনো আগে শোনেনি। ইদানীং শোনা যাচ্ছিল কোলকাতায় মেয়েরা নাকি ইশ্কুলে পড়তে যায়।
মেয়েদের জন্য আলাদা ইশ্কুল নাকি আছে সেখানে। কিন্তু আজকের আগে হিরণ সেই মেয়েদের কাউরে চোখের দেখাও দেখেনি। সেই মেয়েরা কি সব এমনই সুন্দর দেখতে? আহা! কী রূপ! কী শাড়ি পরার কায়দা! আর কী মিঠে মিঠে কথা! নামও তার তেমনি মিষ্টি – মোসাম্মৎ শারাবান তহুরা। কত মোলাম করে হিরণের হাত দুটো ধরে সে বললো, রাগ কোরো না ভাই, আমার নানীটা অমন…. তোমার কনে সাজানো কিন্তু আমার ভারি পছন্দ হয়েছে ভাই। বললে বিশ্বাস করবে কি – তোমার বাড়ি কোলকাতায় হলে আমার বিয়ের সাজের জন্য তোমাকেই নেমন্তন্ন করতুম। এটুকু বলেই মোসাম্মৎ শারাবান তহুরা লাজে লাল হয়ে গেছিল। কিন্তু হিরণের মুখ লাল হয়ে উঠেছিল স্বীকৃতির গর্বে আর ভালো লাগার উচ্ছাসে।
এখন হিরণের চোখে যে অন্য এক স্বপ্নঘোর! স্বামীর বুকের তলায় পিষ্ট হতে হতে তার মনশ্চক্ষু দেখতে থাকে এক ঝাঁক মেয়ে…. তারা ছুটে ছুটে খেলাধুলা করে, দল বেঁধে ইশ্কুলে যায়, দলের মাঝখানে থাকে শরাবান তহুরার মতন দেখতে একটা মেয়ে। কিন্তু কেমন ছোট্ট আর তুলতুলে…. মেয়ে, মেয়ে, হিরণের পেটে ধরা মেয়ে, হিরণের কোলে বেড়ে ওঠা মেয়ে, হিরণের লহু বয়ে নেয়া মেয়ে…. সেই মেয়ে ইশ্কুলে যায়, পড়ে, লেখে, হিরণ চেয়ে চেয়ে দেখে…. আহা! হিরণের কপালে কি তা আছে!! অমন সুখের দিনে হিরণ কি বেঁচে থাকবে!!
চলবে …