মোহনদের বাড়িতে ঢোকার কয়েকটা বাড়ি আগে ধনঞ্জয় পাইকের বাড়ি। দু-কামরা মাটির ঘর। লম্বা দাওয়া। বড় ছেলেটার বিয়ে হয়েছিল পাড়াতেই। সংসার হয়নি। ছোটছেলে ঝন্টু পাইক,মানখন্ডে কালীপূজা দেখতে গিয়ে বিয়ে করে ঘরে বউ এনেছে। ধনঞ্জয় তো পান্তা ভাতে লোক। সাত চড়ে রা নাই। কিন্তু মুস্কিল হয়েছে,এই পাড়ার মেয়েদের মতো সে বাইরে যেতে পারে না। বাড়িতে কারও শৌচাগার নেই। শুকনো দিনে আগানে-বাগানে সবাই চলে যায়, বর্ষাকালে খুব অসুবিধা। শরতকালে চারদিক তো থই থই করে, যাবেটা কোথায়।
ছোট ছেলে নতুন বউ এনেছে, ধনঞ্জয় পাড়ার লোককে বলে বেড়াচ্ছে। ‘ ‘ ভাল ঘরের মেয়ে। ছেলে পচন্দ করে এনেচে। ভাল পরিবেশে বড় হয়েচে। কী সুন্দর কবিতা বলে। ছবি আঁকে। আমাদের বাড়ি যেও, সবাই। বউমা দেকে আসবে। ছেলের বে খাওয়াতে পারিনি। আমাদের পাড়ায় ক’জন আর খাওয়াতে পারে! গরুর বাচুর হয়চে। বোগনা বাচুর। তোমাদের ক্ষীরভাত খাইগে দোবো,ক দিন যেতে দও।একুশ দিনের দিন তোমাদের ডাকব। ঝন্টুকে বলব, যদি পারে একটু মিষ্টি খাইগে দেবে। সকলের তো পারবুনি । জ্ঞাতিগুঁতিদের খাইগে দোবো। ‘
ঝন্টু নতুন বউকে নিয়ে ফতেপুর শীতলা টকিজে সিনেমা দেখতে গেছে। বেলা দুটোর শো। রাজা রাণী বাদশা সিনেমা দেখবে। আলুর দম পরোটা খাবে। একটু মনোহারী দোকান থেকে কটা জিনিস কিনে তবে বাড়ি আসবে। ঝন্টু বাড়ি ফিরে মোহনের সঙ্গে দেখা করবে। বউ লেখালেখি করতে চায়। কবিতা নিয়ে মোহন দা-র সঙ্গে দু-চার কথা বলবে।
ঝন্টুর মা কাঠখড় চেলা করছে,পুকুর পাড়ে। জল নিতে মেয়েরা স্কুলের দিকে যাচ্ছে। ঝন্টুর মাকে ডেকে কথা বলে যাচ্ছে।
– ‘ কিগো বউ কেমন হল। কোতা বলছে তো। ভাত বেড়ে দেচ্চে তো। ‘
– ‘ তুই নে শীতেরাণী। ছেলে পেট থেকে পড়তে না পড়তে দৌড়বে আর কি ! সবে তো অ্যায় চে ক’দিন হল। দু’দিন তোরা যেতে দে। মেটা ভাল রে। একটা কতা বললে শোনে। ক’দিন আর বয়স মেয়েটার। চোদ্দ- পনেরো বছর হবে। ছেলের বয়স তো একটু বেশি হবে। বিশ বছর তো হয়নে। আমাদের ঝন্টু তো মোহনের সঙ্গে পড়তুক। মোহন তো এখনও স্কুলে যাচ্চে। আমাদেরটা বউ নিয়ে সিনেমায় যাচ্চে। যার যা কাজ। ‘
বঙ্কুর মা বলল,’ ঝন্টুর চেয়ে বড় না হোক, ছোট হবেনে গো। সমজুড়ি হবে।কচি বললেই ওমনি কচি হবে।’
ঝন্টুর মা বলল, ‘ হতে পারে। আজকাল ভাব করে সব বে হচ্চে। বয়সের মানামানি আচে। ‘
কথা শেষ করে ঝন্টুর মা একমনে নারকেল পাতার ঘেড়ো, শুকনো ডালপালা কেটে রাশ করেছে,পুকুর পাড়ে।
হালদার পাড়ার সুজাতা মা আসছিল, জল আনতে। ঝন্টুর মাকে বলল, নতুন বউ কি হাওয়া খে থাকে। একলা কাঠখড় কাটতেচো কেন ?
– না রে বোন, ওরা সিনেমা দেকতে গেচে।আজগালকার ছেলে-মে বাবা।
আমাদের মতো হবে। ঘর ছেড়ে কোনদিন কোনও চুলোয় যেতে পেরিচি,বল্ তো।
কাঠখড় কাটা হয়ে যেতে ধনঞ্জয় পাঁজা করে বয়ে নিয়ে যায়। ঝন্টুর মা সমানে হাত লাগিয়ে কেটে রাখা জ্বালানি বইতে থাকে।
বিকেল পাঁচটা বাজার আগেই শো ভেঙে গেলে বউকে নিয়ে ভিড় ঠেলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে। আলুর দম আর পেটাই পরোটা খেতে হবে যে।
নতুন বউ পারমিতা বলল,’ দোকানে খাব না গো। বাড়িতে নিয়ে চলো।সবাই একসঙ্গে খাব। মা,বাবা,তোমার দাদা,সবাই।’
– ‘থালে তো অনেক পরোটা কিনতে হবে।’
– ‘ কি কি অ্যাতো থালে থালে করো বলো তো। কিনতে হয় ,কিনবে।
একা একা খাব না।’
বউয়ের মনটা বড় ভাল। ঝন্টু খুব খুশি হল। ভাবল, পারমিতা তাকে ঠিক মানুষ করে নেবে। বারবার কথাটা তার কানে বাজতে লাগল, ‘একা খাব না।’
ঝন্টু পারমিতাকে রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে রেখে দোকানে ঢুকে সবার জন্যে গরম গরম পেটাই পরোটা নিয়ে নিলো। পরিমাণ মতো ঘুগনি, শশা-লঙ্কা কুঁচোনো, একটা কাগজের মধ্যে বিট লবণগুঁড়ো।
দোকানের বাইরে এসে পারমিতাকে নিয় রাস্তা পেরিয়ে তাপসী বস্ত্রালয়ের দিকে গেল।
পারমিতা বলল, আর দেরি করো না। চলো। খাবারটা ঠান্ডা হয়ে যাবে।
– আরে তোমার জন্যে দুটো ছাপা শাড়ি কিনব। শাড়ি পরলে তোমাকে বেশ মানায়। টুকটুকে রাঙা বউ।
– শাড়ি তো আমার আছে।
– তোলা শাড়ি তো দুটো। আর আটপৌরে শাড়ি দুটো। বারবার জলে ভিজলে কাপড়ের বারোটা বেজে যায়। আমি চাই না,সাত তাড়াতাড়ি তুমি পুরানো বউ হয়ে যাও।
পারমিতার খুব ভাল লাগল, কথাগুলো। আচমকা তাদের বাড়ির বউ হয়ে এলেও মা মরা মেয়ে কষ্ট করে মানুষ হয়েছে। সংসার কি জিনিস সে জানে। বাবা ছাড়া সংসারে তার কষ্ট কেউ বোঝেনি। সৎ মায়ের সংসারে অনেক অবহেলা সহ্য করেছে। সৎ ভাইবোনদের ভালবাসা সে পায়নি। তাকে সবাই অপরাধীর চোখে দেখেছে। সবাই ভাবত, সেই সংসারে আওতা করে আছে। সে একটা মন চেয়েছিল। মানুষ চেয়েছিল,যার একটু দয়ামায়া থাকবে। মুখে লাগাম থাকবে। এমনিতে তার বেশি চাওয়া-পাওয়া নেই। দুবেলা দুমুঠো ভাত আর একটু ভালবাসা,সম্মান,আর কিছু সে চায় না।
পারমিতা বলল, শাড়ি এখন নেব না। তুমি ছাড়া আমার আর কে দেবে ?
দেবার সময় তো চলে যাচ্ছে না। পারলে অনেক দিও, সব নেব। বাধা দেব না। বাড়িতে একটা বাথরুম করতে হবে। অনেকগুলো টাকা লাগবে। ওটা না করলে খুব অসুবিধা হবে। তোমাদের পাড়ার সকলের এটা দরকার। দেখছি, পাড়াতে প্রায় কারও এটা নেই। ভাত কাপড়ের মতো এটাও খুব দরকারি।
ঝন্টু পারমিতার কথা বুঝতে পেরে লজ্জিত হয়। সে বুঝতে পারে,পারমিতার সমাজ আর পাইকপাড়ার সমাজ এক নয়। আবার, এটাও সে ভাবে, এই পাইকপাড়ার জীবনের সঙ্গে সে যখন হাত মিলিয়েছে,তখন তো তাকে এইপাড়ার হাওয়া,জল,বাতাসের সঙ্গে মিশে যেতে হবেই। তবুও ঝন্টু মনে মনে প্রতিশ্রুতি দেয়, বেঁচে থাকতে সে কখনও কোনদিন পারমিতাকে অবহেলা করবে না।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। পাখির কলস্বরে তাজপুরের আকাশ-বাতাস মুখর হয়ে আছে।দিনের শেষ আলোটুকু এখনও নিজের অস্তিত্ব জাগিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। পশ্চিমের আকাশ তাজপুরের ঘন বাঁশবাগান আড়াল করে আছে। গ্রামের ইঁট বিছানো পথে পুরো সন্ধ্যা নামার আগেই অন্ধকার খেলা করছে। সারাদিনের ব্যস্ততা মুছে দিয়ে গ্রামটার বুকে দিন ও রাতের সন্ধিক্ষণের প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে। পুকুরের জল কালো হয়ে আসছে। ঝন্টু বউকে সাইকেলের কেরিয়ারে বসিয়ে হনহন করে গ্রামের রাস্তায় ঢুকছে। অন্ধকারে অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। নিজের পাড়া-গাঁর রাস্তা ছবির মতো চেনা। কোথায় উঁচু কোথায় নীচু সবই তার জানা। ক্রিং ক্রিং বেল বাজাচ্ছে, ফাঁকা রাস্তা , দু-একজন সামনে এলেও রাস্তার ধারে সরে হাঁটছে। ঝন্টু বউকে নিয়ে পাড়ায় চলে এসেছে। সবাই সন্ধ্যা দিচ্ছে। তুলসী তলায় আলো দেখাচ্ছে। উঁচু দাওয়া থেকে মাটির প্রদীপ হাতে সনাতনের বড় বউমা লক্ষ্মী মা শীতলার থানে আলো দেখাতে আসছে। বাঁকের মুখে আবছা অন্ধকারে মোহনের সঙ্গে দেখা।
– ‘ঝন্টু কোথায় রে।’
সাইকেল থেকে বাম পা নামিয়ে দিয়ে পিছনের কেরিয়ার থেকে পারমিতা নেমে যায়। ঝন্টুর পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। দাঁড়াতে না দাঁড়াতে মশা ভন ভন করে। পারমিতা খুব ধীরে পা ঝাপটা দেয়।
ঝন্টু উত্তর দেয়, এই তো রে ভাই। দেখা হয়ে ভালোই হল।
মোহন লক্ষ্য করল, বউয়ের সঙ্গে আছে,তাই কত গুছিয়ে সে উচ্চারণ করছে। পাইকপাড়ার লোক অত গুছিয়ে কথা বলে না।
মোহন বলল, ‘বল ভাই। বউকে নিয়ে কোথায় ঘুরে এলি।’
– ‘কোথায় আর যাব, সিনেমা দেখে এলাম। আমাদের বাড়িতে চল্। তোদের বাড়িতে আজ হয়তো যাওয়া হত না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। একটু চা মুড়ি খেয়ে আসবি। চল্ ভাই। ‘
মোহন ভাবল, নতুন বউ। অগোছালো ঘরদোর কোথায় বসতে দেব। ওদের বাড়িতেই যায়। যদিও কমবেশি সকলের অবস্থা সমান। তবু ধনঞ্জয় কাকাদের ঘরদোর ঠিকঠাক আছে। মন্টু , ঝন্টু দু-ভাই বিড়লাতে কনট্রাক্টে কাজ করে। ঝন্টু তো সবে কাজে লেগেছে। একমাস কাজ করে সাইকেল কিনেছে। আহামরি কিছু না হলেও চলে যায়। ধনঞ্জয় কাকা মুখ রগড়ে কাজ করে। ঝন্টুর মা আগান-বাগান করে। হাঁস-মুরগি পোষে,গরু আছে। আমাদের তো অভাব আর টানাটানি ছাড়া কিছু নেই।
পারমিতা বলল, মোহন দা তোমার কথা অনেক শুনেছি। আমাদের বাড়িতে চলো।
ঝন্টুর পিছনে পারমিতা, তারপর মোহন সরু একটা দুমিনিটের গলি পথ। বাড়ির ছাঁচ দিয়ে যাতায়াত। কোনও রাস্তা নয়, আবার এটাই রাস্তা।
গোটা পাড়ার ঘরবাড়ি যে যার মতো উঠেছে। গন্ডগোল হয়, মেটে না। নতুন সমস্যা জারি হলে আগেরটা চোখের আড়ালে চলে যায়।
মাটির পইটের ঠিক সোজা ঘরের চালের নীচে বাঁশের আলকাটে সরু তার ধরে বাল্ব ঝুলছে। মাটির একচিলতে উঠোন আর তুলসী তলা আলো হয়ে আছে। দরজা হীন গোয়ালঘরের ভেতর থেকে দুটো গরু বাইরের দিকে মুখ বাড়িয়ে তাকিয়ে আছে। ধনঞ্জয়ের বউ প্রদীপ হাতে দেখতে পেল,ছেলে-বউ বাড়িতে ঢুকছে। পিছনে মোহন। খুব তাড়াতাড়ি
হাত,মুখ ধুয়ে তুলসী তলায় মাথা ঠুকে মোহনকে বাঁশের মোড়ায়
বসতে দেয়, পারমিতা।
ধনঞ্জয়ের বউ বলে, ‘ও মোহন এলি বাবা। আর তো এ বাড়ির পত মাড়াস না। ছোট ছিলিস যখন,কত আসতিস। খেলতিস। তুই মা মোরা ছেলে তোর জন্যে খুব মন খারাপ করে রে বাবা। একন তো বড় হয়ে গিচিস। যকন ছোট ছিলিস, তকন খুপ মায়া হোতুক। চোকে জল আসতুক। ‘
বলতে বলতে কেঁদে ফেলে ঝন্টুর মা।
মোহন বলে, ‘কেঁদো না,কাকি।
তোমরা কেমন আছো বলো ? ‘
– ‘দুবেলা দেকা হচ্চে। এক ঘাটে ঘাট সোরি। কেমন থাকব আর, যেমন দেকিস তেমন আচি। ‘
পারমিতা দুটো রসগোল্লা নিয়ে মোহনকে খেতে দেয়। পারমিতার বাপের বাড়ির মিষ্টি। আগের দিন বাবা এসেছিল। মেয়ের সংসার দেখে গেছে। খাট-গদি সব দেবে বলেছে। জামাই-মেয়েকে সামর্থ্য মতো সোনার জিনিসও দেবে।
ঘরের ভেতর ঘর্ঘর শব্দে টেবিল ফ্যান চলছে। একশো ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে। রাস্তা থেকে বুকিং করা লাইন। এদের মিটার নেই। ধরতে এলে মন্টু ঠিক খুলে দেয়। কেস দিলেও ভয় নেই। ঝন্টুর বাবা নারকেল কাটছে। রেশনের চিনি ,নারকেল কুড়ো মুড়ি দেবে,মোহনকে।
পারমিতা বলল, ‘পরোটা আছে তো। ওতেই সবার হয়ে যাবে। নারকেল থাক। কাল পায়েস হলে মাধব দা-কে একটু দিয়ে আসবে। গরম গরম দুটো ডিমও ভেজে দিই।’
ঝন্টু বলল, ‘তাই করো। মাধব আমার অনেক ছোটবেলার বন্ধু। লেখাপড়া আমাদের হল না। ও এখনও চালিয়ে যাচ্ছে।’
মোহন বলল,’ কতদিন চালিয়ে যেতে পারব,সন্দেহ আছে। আর বোধহয় এগোনোর রাস্তা নেই। ‘
পারমিতা বলল,’ কেন দাদা ? এগোতে তো হবেই। ‘
বাল্বের আলোতে মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে পারমিতা মোহনের কোনও উত্তর পাবার আগেই আবার বলল, তোমাকে কিন্তু খুব চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছি বলো তো।
ঝন্টু বলল, তোমাদের বাড়ির দিকে একটা ইস্কুলে ও পড়ে। চাষবাস নিয়ে তো পড়ছে।
পারমিতা বলল, গোবিন্দপুরের স্কুলে।
মোহন বলল, হ্যাঁ। ওখানেই পড়ি। এবছর উচ্চমাধ্যমিক দেব।
– আচ্ছা। তাহলে হয়তো কখনও রাস্তাঘাটে দেখেছি।
– হতে পারে।
পারমিতা ঘর থেকে বেরিয়ে খোলা উঠোনে মাটির উনুনে ভেজে দেওয়া ডিম ভাজা নিয়ে একটা থালাতে সবকিছু সাজিয়ে দেয়। সবাইকে দেয়।
শাশুড়ি আর নিজের জন্যে আলাদা রেখে দেয়।
ঝন্টু বলল, তুমি খাবে না।
পারমিতা বলল, আশ্চর্য,তুমি ,মাধব দা,বাবা খেয়ে নাও। দাদা তো এসে গেছে। দাদাকেও খেতে দিয়েছি। তোমাদের হয়ে গেলে মায়ের সঙ্গে খাব।
– না। মানে। তুমি তো সেই দুপুরবেলা খেয়েছ, খিদে পেয়ে গেছে তো।
মোহন জানে খিদে কি জিনিস,গোটা পাড়া জানে। মন্টু-ঝন্টু সবাই জানে।
বাইরে থেকে এদের সব কথা শুনতে পাচ্ছে, ঝন্টুর মা। ছেলের কথায় সায় দিয়ে বলছে, ‘সেই দুকুর বেলা খ্যাইচো তো, দেরি করুনি, খে নও।শরীর খারাব কোরবে তো । ‘
পারমিতা বলল, তোমার সঙ্গে খাব,মা। রাতে তো ভাত হবে। তাড়াতাড়ি না খেলে খাব কি করে ?
বউমার কথা শুনে ঝন্টুর মায়ের কান শীতল হয়ে যায়। মোহন,ঝন্টু খেতে শুরু করে। পরোটার থালা নিয়ে মন্টু মায়ের কাছে উঠোনে এসে বসে। খেতে খেতে কথা হয়।
পারমিতা চটপট বাইরে এসে একটু একটু করে খাবার মুখে তোলে। শাশুড়ি মাকে গালে তুলে খাইয়ে দেয়। উনুন আর নেভাবে না। এই উনুনেই রাতের রান্না সেরে নেবে। ওদের জন্যে ডিম ভাজলেও নিজেদের জন্যে ভাজেনি। ঝন্টুর,মোহন ছাড়াও ধনঞ্জয়,মন্টুর জন্যেও ডিম ভাজা হয়েছে। মন্টু ডিমে মুখ দিয়ে মাকে বলল, ভাগ্যিস মোহন আচমকা এ বাড়িতে এলো। তাকে যত্ন করতে গিয়ে আমাদেরও সন্ধেবেলা ডিম ভাজা খাওয়া হল। তোমরাও একটা করে খাও না,মা। তুমি না গেলে বউমা খাবে না তো।
পারমিতা বলল, দাদা, তোমরা খাও। চিন্তা করো না। দুটো ডিম ঘরে থাক। হাঁস-মুরগি আজও হয়তো ডিম দেবে। কিন্তু কখন কে এসে পড়ে। না হয় কাল আমরা খাব।
মন্টু দেখল, ঠিক কথা। সে আর কথা বাড়াল না। ততক্ষণে পারমিতা শাশুড়ি মাকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিয়েছে। মাঝখানে সে একবার দুজনের জল দিয়ে গেছে। দুই বন্ধু খেতে খেতে নানান গল্প করছে। বাইরে থেকে হাতমুখ ধুয়ে চকচকে নতুন কাপ-প্লেটে ওদের জন্যে লাল চা নিয়ে আসে। মোহনের খুব লজ্জা লাগে। সে যেন বাইরের লোক। নতুন বউয়ের কাছে সত্যিই সে বাইরের লোক। ঝন্টুদের আর তাদের হাঁড়ি আলাদা। কিন্তু সমাজ আলাদা নয়। হিসেব মতো এক ঘরেই তো তারা বড় হয়েছে। ওরা নিজেরাই বলছে,পাইকপাড়াতে
কাপ-প্লেটের বালাই ছিল না। চিনি না থাকলে ভেলেগুড় দিয়ে চা খাওয়া হয়। বাটিতে,গ্লাসে চা খাওয়া হয়। নতুন নতুন বউ আসছে,পাড়ার ভোল বদলাচ্ছে। বেশ আভিজাত্য অনুভব হয়। মোহন, ঝন্টু তাদের সেই শাপলা-শালুকের পাড়ায় নতুন দিনের গন্ধ পায়।
ঝন্টু বিছানায় বসে কথা বলছিল। তক্তোপোষের ওপর নতুন চাদর পাতা। ঘরের ভেতরের দেওয়ালে একটা মোটা বড় পেরেকে পোঁতা আছে।ওদের বিয়ের মালা দুটো ঝুলছে। অনেকটা শুকিয়ে গেছে। পরোটা আলুর দম,গরম ডিম ভাজার গন্ধে মোহন এতক্ষণ খেয়ালই করেনি। আধ শুকনো হলে কি হবে,ফুলটা তো রজনীগন্ধা। ছোট্ট মাটির ঘরের মধ্যে কি একটা মায়া তৈরি করে দিয়েছে। রূপকথার মায়া। সেই রূপকথার নায়ক-নায়িকা ঝন্টু আর পারমিতা।মোহন অনুভব করতে পারছে, কিন্তু বোঝাতে পারবে না।
সে শুধু বলল, তোমাদের ঘর মনে হচ্ছে,একটা ভালবাসার কবিতা।
বাল্বের হলুদ আলোতে ঘরটা খুব মায়াবী মনে হচ্ছে। ঘোর লাগা মায়া। তোরা সুখী হ ভাই। পারমিতাকে আমি নাম ধরেই ডাকব। তোর আপত্তি নেই তো ঝন্টু।
– কি যে বলিস ভাই। তুই কবি মানুষ। তোর কত কবিতা। কত পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। কাউকে বলিস না। তাই বলে আমরা কি খবর রাখি না।
বন্ধুর বউকে নাম ধরে ডাকবি না তো কি বলে ডাকবি।
পারমিতা বলল, ‘মোহন দা, ছোটবোনের নাম তো ধরতেই হয়। তুমি আমাকে নাম ধরেই ডাকবে।’
মোহন বলল,’ হ্যাঁ বোন। তাই হবে।’
ঝন্টু বলল, ‘পারমিতা কবিতা ভীষণ ভালবাসে। ওকে আগেই বলেচি,আমার এক কবি বন্ধু আচে, মোহন।
শুনেই বলল, আমাকে আলাপ করে দিও। আজ তো যেতুম তোদের বাড়ি।’
পারমিতা মোহনের সামনেই বলল, ‘আচে নয়,বলো আছে। যেতুম নয়,বলো যেতাম।’
– ‘আরে বাবা ওই হল। সব ঠিক আচে।’
– ‘আবার,চ বলে। ছ বলো। আছে বলো।’
সবাই হো হো করে হাসছে। ধনঞ্জয়ের বউ এসে বলল, ‘মাগো আমরা তো সপ ভুল বলি। থালে কি কোতা বোলবুনি। ‘
পারমিতা বলল, ‘তোমাদের শেখানোটা কঠিন। শিখতে পারলে তো ভাল। না পারলে কিছু এসে যায় না। তুমি যেমন পারবে, তেমন বলবে। তোমার তো ঠিক আছে,মা। ও চাইলে একটু সচেতন ভাবে বলতে পারবে। ও সঠিক উচ্চারণে কথা বললে আমার যে গর্ব হবে। ওকে শিখতেই হবে। এলাকার ভাষা ভাল তো বাসতেই হবে। কিন্তু ভদ্রসমাজের ভাষা সকলের শেখা উচিত।
ঝন্টু বলল, ঠিক আছে।তাই হবে শালুক সুন্দরী। হা হা হা হা।
মোহন বলল, ‘তুমি কবিতা লেখো।’
– ‘লিখি তো। ‘ পারমিতা উত্তর দেয়।
– ‘ঠিক আছে। একদিন শোনাবে। শুনব। আজ তবে উঠি।
আর তোমরা জমিয়ে গল্প করো।’
– ‘তোমার স্কুলের কি খবর। কেমন চলছে।’
– ‘সেটাও তুমি জানো নাকি। চলছে আর কি। ভারত সেবাশ্রম থেকে সামান্য কিছু করে টাকা দেয়। ওদের কিছু ন্যায়-নীতি,উপদেশ মেনে পড়াতে হয়। দুবেলা পড়াই। যেদিন পারি না,বন্ধ থাকে।পাড়ার ছেলেদের নিয়ে ওই চলছে,সময় কেটে যাচ্ছে। কতটুকুইবা জানি।নিজেই তো মহাপন্ডিত। ‘
– ‘না দাদা, তোমার মধ্যে অনেক আলোছায়, ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে।’ সবকিছু সামলে টিকে আছো,এটাই যথেষ্ট।
মোহন উঠে পড়ে। উঠোন পর্যন্ত নেমে আসে, পারমিতা। ঝন্টু একটু আলো দেখায়।
মোহন হেঁকে বলে,’ও কাকি আসি গো।’
-‘ মাজে মাজে আসিস বাবা। তোরা এলে ভাল লাগে। ‘
মোহন চলে যাবার পর পারমিতা গুনগুন করে গান গাইতে থাকে। ঝন্টু নতুন বউয়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। গানটা পারমিতা গাইতেই থাকে।
‘ দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।
‘কে মোহন ?’
– ‘হ্যাঁ বাবা।’
-‘ কোতায় ছিলি রে ?’
– ‘ঝন্টুদের বাড়ি একটু গিয়েছিলাম।’
– ‘সামনে তোর পরীক্ষা। পড়তে বসতে হবে তো। চিন্তা হয় রে।
কোতায় কি করবি বল তো। তোর মা বেঁচে থাকলে দেকে যেতুক।
কেউ কিচু কোরতে পারলুনি। বড় ছেলেটা যদি একটা কাজ জোটাতে পারতুক। আমার আত্মার শান্তি হতুক। তোর মা তো চাইতুক সবাই লেকাপড়া করুক। পারলুম নি, আরতির কতা রাকতে পারলুম নি।একন দেকচি তোর আশাও ছাড়তে হবে। আশা আমি ছাড়িনি। কতা শোন্ বাবা। মাস্টারদের কাচে একটু পড়তে যা।’
মোহন একটাও কথা বলেনি। চুপচাপ শুনে মাথা নিচু করে বাবার কথা শোনে। ঝন্টুদের বাড়ি গিয়ে সময়টা বেশ ভাল কাটলেও বাবার কথাগুলো তাকে দমিয়ে দেয়। সে বুঝতে পারে, সত্যিই তো পরীক্ষা চলে এসেছে। বাবা তো বলবেই। সে তো রোজ ভাবে, কাল থেকে সব ছেড়ে ছুড়ে বই নিয়ে থাকবে। কত কাল এইভাবে কেটে গেছে, পূজার পরেই তো টেস্ট পরীক্ষা। তারপর ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষার কথা মাথায় এলে মাধবের বুক ধড়ফড় করে। তাকে তো পারতেই হবে। বাংলার মাস্টারমশাই মণি বাবু বলেছেন, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার চান্স হয়ে গেলে পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। বিদেশ যেতে পারবে। তাজপুরের পাইকপল্লীতে নতুন সূর্যোদয় হবে। সবাই ধন্য ধন্য করবে।
মোহনের নীরবতা ভাঙেনি, সনাতন বলল, ‘যা কষ্ট করে আর কটা বচরের বেপার, মানুষ হয়ে নে বাবা। তোর মা শান্তি পাবে।
তোর ছোটবোন বিনা চিক্কিসায় মরে গেল। আরতি কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে গেল। তাকে আর ফেরাতে পারলুম নি। তোরা মাতৃহারা হোলি। ‘
মোহন বলল, চিন্তা করো না ,বাবা। চেষ্টা তো করছি। তুমি আমার দেবতা,বাবা। তোমার আশায় জল ঢালব না।
প্রায় অন্ধকারে বসে আছে, সনাতন। ঘরের দাওয়ায় আলো নেই। ঘরের ভেতরের আলকাটে তার ধরে বাল্ব ঝুলে আছে,আলো জ্বলছে। দাওয়ায় খানিক স্পষ্ট,খানিক অস্পষ্ট হয়ে ছড়িয়ে আছে। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলে দাওয়া অন্ধকার। পাওয়ার থাকলেও আলো একবারে টুমটুম করে জ্বলে, লো ভোল্টেজ। যখন তখন চলেও যায়। হ্যারিকেনে তেল থাকে না।চিমনির কাঁচ নেই। লম্প নিয়ে মোহনকে পড়তে হয়। লম্প-র কালি ঘরের ওপরের দিকে জমে জমে কালো হয়ে ঝুল পড়ে আছে। রান্নাবান্না হলে লম্পটা উনুনের কাছে থাকে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত এলে এই পাড়ার মেয়ে-বউরা রাত আটটা নটার মধ্যেই শুয়ে পড়ে। ভোর থাকতে উঠতে হয়, সারাদিন খাটাখাটনি।নেতিয়ে পড়ে। ঘুমে বিভোর হয়ে যায়। তবুও জেগে থাকে,পাইকপল্লী। তাজপুরের নিরন্ন নেশাতুর জনপদ। মাতালদের আনাগোনা গভীর রাত অবধি , রাত্রির হাওয়ার মতো চলতে থাকে। এই পাড়ায় মাতামাতি করার কিছু না থাকলেও এই নেশা নিয়ে তাদের বিস্তর মাতামাতি।
মোহন রাত জেগে বই পড়ে। সারা গ্রাম ঘুমিয়ে থাকে। পাইকপল্লী নিস্তরঙ্গ হয়ে একটা নতুন দিনের অপেক্ষা করে। মাঝরাতে পথের কুকুরগুলোর গোঙানি কানে এলে অভাবী মানুষের কান্নার মতো মোহনের বুকে এসে বিঁধে যায়। মাতালদের টুকিটাকি অস্পষ্ট আস্ফালন ভেসে এলে বইয়ের পাতা থেকে তার মনোযোগ সরে যায়। আবার , সে বইয়ের পাতায় মন দেয়। লিখে লিখে পড়ে। গলা শুকিয়ে এলে তক্তোপোষ থেকে নেমে কলসি থেকে জল গড়িয়ে খায়। রাতের পর রাত চলে যায়। সে পড়ে যায়। বড় বউদি যত অসুবিধা হোক, তাকে একটু করে দু-বেলা ঝোল ভাত করে দেয়। পরীক্ষার আগে শরীর খারাপ হলে পরীক্ষার বারোটা বাজবে, তার দিকে অনবরত খেয়াল রাখে।
আর সে প্রতীক্ষা করতে থাকে।পরীক্ষা শেষ হলে লেখালেখি, পাখির মতো ঘুরে বেড়ানোর জন্যে। গভীর রাতে কোনও পাখি ডেকে উঠলে অনেক দূরের প্রতিধ্বনি তার বুকে বেজে ওঠে। বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকার পরাধীনতা তাকে অস্থির করে তোলে। পাখির কিচিমিচির মতো সে মুক্ত হতে চায়। পাখির ঝরা পালকের মতো সে বন্ধন ছিঁড়ে জীবনের পাতাগুলো নিজে হাতে সাজাতে চায়, তবু সে বইয়ের পাতায় নিজেকে আটকে রাখে,সে শেষপর্যন্ত বুঝতে পারে,মুক্তির আলো ও আনন্দ বইয়ের ভেতর থেকেই সে খুঁজে পাবে। এই বইয়ের হাত ধরে সে জগত পারাবারের তীরে পাড়ি দেবে।
চলবে…