প্রতিদিন আমার কাছে জাগরণ আসে, টের পাই আমি। জাগরণ এসে কিছুই বলে না, চুপচাপ চেয়ে থাকে। ওর চেয়ে থাকা তো আমার চোখেই। ওর দেখা তো আমার দেখাতেই। ওর চুপচাপ হওয়া তো আমার চুপচাপ থাকার মধ্যেই প্রবেশ করে। আমি যখন নিজের হাত নিজেই ছুঁই, মনে হয় জাগরণকে ছুঁলাম। আমি যখন বিকেলে একা একা কাঁদি, মনে হয় জাগরণই কেঁদে ফেলল। হ্যাঁ, আমি ঘুমালে জাগরণ ঘুমায়। আমি জেগে উঠলে জাগরণ জেগে ওঠে। আমি লিখতে বসলে জাগরণই লেখে। আমি কথা বললে জাগরণই বলে। জাগরণকে কীভাবে পেলাম? তবে বলি শোনো।
আমাদের ঘরভর্তি দুঃখ। দলবেঁধে অভাবেরা যাওয়া-আসা করত। কত কান্নাকাটি ভাইবোন মিলে খেলাধুলা করত। মা শীতের দিনে পরনের পুরনো কাপড় গলায় জড়িয়ে বেঁধে দিলে আমরা সকলেই সকালে সূর্য মামাকে ডাকতাম। সূর্যমামা রোদের ঘোড়া ছেড়ে দিলে আমরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে তেপান্তর পার হতাম। জাগরণ আমাদের সাহস দিত। সত্যি বলছি, আমাদের শীতই লাগত না।
গ্রীষ্মকালে ঘরের উঠোনে চাটাই পেতে বসতাম। মা লম্ফু জ্বালিয়ে দিত। আমি তখন পড়া শিখিনি। বাবা একখানা পুরনো ‘কেতাব’ নিয়ে বসতেন। পাঁচালির সুরে পড়ে যেতেন কত যুদ্ধের কথা। কত মৃত্যু আর জয়ের কাহিনি। বাবার পড়ার সুরেই তরবারির ঝনঝনা আওয়াজ পেতাম। কত পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, বন-জঙ্গল পার হয়ে সেইসব নতুন দেশে চলে যেতাম। আলিফ-লাইলার সেই উড়ন্ত চাদরে আমি আর জাগরণ একই দেহে বসে থাকতাম। আপন মনে তখনই তো কথা বলতে শিখি!
বর্ষাকাল এলে আমাদের ঘরে কষ্টরা খুব অত্যাচার করত। খাবার থাকত না, জ্বালানি থাকত না। কেরোসিন বিনা লম্ফুও জ্বলত না। সারাদিন সারারাত স্যাঁতসেঁতে ভেজা উনানের পাশে বসে থাকতাম। ফুটো চালে বৃষ্টি পড়লে মাটির ভাঁড় পেতে দিতাম। কষ্টকে তবু পরোয়া করিনি। জাগরণ কাছে কাছে থাকত। একবার জাগরণ লিখেছিল:
আমার চোখেও আছে জল
বর্ষা, তুই কি করবি বল?
বর্ষা কিছুই করতে পারেনি। জাগরণ কতই লিখেছে:
আমিও ভেজাতে পারি
আমিও ভাসাতে পারি নাও
আমার ইচ্ছার মেঘে সূর্য হাসে
এ সূর্য কি তুমি দেখতে পাও?
জাগরণের প্রতিটি মুহূর্তই যেন অস্তিত্বের সঙ্গে বোঝাপড়া। এই বোঝাপড়ার ভাষাটিকেই কবিতা করে নিয়েছে জীবন। যার মধ্যে কিছুই নেই অথবা এক শূন্যতার রূপান্তর মাত্র। Edmund Burke এই কারণেই বলেছিলেন : Poetry is the art of substantiating shadows and lending existence to nothing. এই অস্তিত্বসঞ্চারী শূন্য শিল্পকেই কবিতা করে তোলা হয়। যে কবিতার মধ্যে থাকে দিনযাপনের প্রতিটি ক্ষয় ও যাতনা এবং Vital truth. এই দিনযাপন তো ব্যক্তিগত ব্যাপার। সুতরাং কবিতা এক নিবিড় আত্মযাপনেরই অভিব্যক্তি।
জীবনের শূন্যতায় যে বোধ ভাষা খুঁজে ফেরে, যে সামাজিক টানাপোড়েনে নিজের অবস্থানটিও বারবার টাল খায়, যে কথা বলা হয়ে ওঠে না- কবিতা সেই প্রয়াসকেই তুলে আনে। একদিকে প্রেম, অন্যদিকে হাহাকার; বস্তুতান্ত্রিক চাহিদার ঊর্ধ্বে হৃদয়ের মর্মকে উপলব্ধি করার এক মানবিক দায় থাকে কবির। সেই দায়-ই হল জাগরণ। একেই প্রতিবোধ বা প্রতিবোধন বলা চলে। ইংরেজিতে এর কতগুলি রূপ পাই: Revelation, Manifestation, Awakening, Consolation ইত্যাদি। এই আত্মবোধনের প্রতিটি পদক্ষেপেই একটি রূপান্তর কাজ করে। তা সর্বদা সত্যের অন্বেষণেই ব্যাপৃত। অবশ্যই সুন্দর একটি পৃথিবী, জীবনের সারল্য, রূপমুগ্ধতা আর বিস্ময়ের দরজায় করাঘাত করাই কবিতার উদ্দেশ্য। আত্মার পীড়িত করুণ সংলাপে ও সংকেতে, রূপকে ও রূপান্তরে, গতিময় ক্রিয়ায় কবিতার সিদ্ধি খুঁজতে হয় বলেই লিখতে হয়:
সমস্ত জিজ্ঞাসার নদীতে খুঁজে যাচ্ছি নাও
পরপারে যাব
পরপারে যদিও অব্যয় সব সংশয় সূচক
তবু বিস্ময় দাঁড়িয়ে আছে
আমাদের প্রতিটি বিশ্বাসে
‘বিস্ময়’ এবং ‘বিশ্বাস’ শব্দদুটিই আত্মবোধনের গতি সঞ্চার করে। জীবনের ভাঙনের মাঝখানেও অপার্থিব এক তরণির নিরীক্ষণ সর্বদা তাকে সচল রাখে।
যখন বাস্তবিক দৈন্য আমাকে ঘরছাড়া লক্ষ্মীছাড়া করে মুম্বাইয়ের রাস্তায় মুটেগিরি করতে বাধ্য করেছিল। যখন রাস্তার মানুষের সঙ্গে একটা ইঁটের উপর মাথা রেখে চট পেড়ে ঘুমোতে বাধ্য করেছিল, তখন এই ভাবসম্মোহনের তরণিটিই আমি অনুভূতির আলোকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। কবিতা জীবন-রসায়নের তদ্বিরে লেখা হয়ে গিয়েছিল:
আলোর স্তনের নিচে আমি এক পথের সম্রাট।
অন্ধকারের প্রজাপতিরা চারিপাশে উড়ে যাচ্ছিল। কত কত হাতছানি। আমি গিরগিটির বাসনাকে কোনো অবদমন ক্রিয়ায় চালান করে লিখতে পেরেছিলাম:
হাহাকার ছুটে আসছে প্রত্যেকের কাছে
হাহাকার অসুখ বোঝে না আমাদের
এই সেই ‘হাহাকার’ যা Nothingness এর নামান্তর। সভ্যতার প্রতিটি মানুষই এর দ্বারা আক্রান্ত। আমি ‘পথের সম্রাট’ হলেও মনুষ্যপ্রবৃত্তিরই দাসমাত্র।
Nothingness কখনো কখনো Emptiness হয়ে আসে। জীবন ঘুরপাক খায়। জাগরণ হাত ধরে থাকে। এতকিছু অমেয় উচ্ছ্বাস তবু মনে হয় কিছুই নেই। পৃথিবীতে ‘বসন্ত’ নেই, ‘শুভেচ্ছা’ নেই:
এত কোকিল ডাকছে চারিদিকে
তবু বসন্ত এল না-
কোলাহল আগে থেকে জায়গা দখল করে বসে আছে।
কিংবা:
ঘরে ভাত নেই
তোমার পাঠানো শুভেচ্ছা খাই আজ-
ভাত নয়, শুভেচ্ছা দেয় সুশীল সমাজ।
কবিতা জীবনচুয়ানো ভাষায় লেখা হতে থাকে। প্রকৃত কবিতায় কখনো ছলনা চলে না। যে আত্মদহন ব্যক্তির মধ্যে ক্রিয়াশীল, কবিতা সেই দহনকেই গ্রথিত করতে জানে। জীবনের ছায়ায় জীবনের দোসর হয়েই তার বেড়ে ওঠা। Leonard Cohen এই কারণেই বলেছেন: Poetry is just the evidence of life. If your life is burning well, poetry is just the ash. জীবন পুড়লে কবিতা জীবনেরই ছাই স্বরূপ। একসময় যে প্রেম আমাকে তিল তিল করে দহনের ক্রিয়ায় নিমগ্ন করেছিল। টিউশন করা সাইকেলটি এসে প্রেমিকার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে যেত। তখন আমার পৃথিবীটাই বিরহকাতর যন্ত্রণায় সর্বদা ভস্ম হয়ে যেত। কবিতা তখন ভাষা পেত, যে ভাষায় আমি পুড়তাম। কবিতা তখন আশ্রয় চাইত। যে আশ্রয় আমি চাইতাম। তখন তো কেবল কবিতাই আমার আত্মবোধনের পীড়ন সহ্য করেছে।
প্রেমিকা তো বিবাহিতা। তার কৃষ্ণের জন্য মাংস-ভাত। সেও নতুন শাড়ি পরে কলতলায় থালা মাজছে। টেপে হিন্দি গান বাজছে। এ সময় তো আর কিছুই বলার নেই। তবু কবিতাতেই সে কথা বলা হয়ে যায়:
ঝকঝকে থালায় মুখ।
স্বপ্নে ঢুকে যাব—
তোমার পেটের ভ্রূণ হয়ে
ফিরে আসব আজকে রাতেই।
প্রেমিকা এখন অন্যের। থালায় মুখ দেখছে। তাকে পাওয়া যাবে না, কিন্তু তার পেটে ভ্রূণ হয়ে আসার ইচ্ছাটিও বাঁচার নতুন হাতছানিতে ভাস্বর করেছে। প্রেমিকও যে সন্তান হয়ে উঠতে চায় তা সেদিনই আমার জীবনবোধে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। আত্মদহন, রূপান্তরে অনুগমন করে। যেমন এই বাঁচা, স্বপ্ন দেখা, পীড়িত হওয়া সবকিছুর মধ্যে দিয়েই কবিতাযাপনের মুহূর্ত রচিত হয়। আমরাতো নিজেকেই দেখতে থাকি। কিছুতেই জীবনের শূন্যতাকে ঢেকে রাখা যায় না। Rita Dove এই জন্যই একটি রচনায় বলেছেন : Poetry is language at its most distilled and most powerful, জীবনের ভাষা, জীবনের উপলব্ধি যা সর্বদা এক অভিজ্ঞতা থেকেই প্রাপ্ত হতে থাকে। তাই বয়ঃসন্ধির অস্থিরতা থেকে বার্ধক্যের শূন্যতায় জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে কবিতা পাল্টে যায়। যেমন করে আমিও পাল্টে গেছি। আজ আত্মবোধনের ঘোষণা এরকমই:
আমাদের জয় নেই
প্রবাহের নিচে এক ক্ষয়
প্রবল ঘোরের টানে পাক খায়
রাত্রির নিরর্থক ঘুম
জীবন অবশেষে পরাজয়কেই বরণ করে। নিরর্থক ঘুমের মধ্যেও প্রবল ঘোরের টানে শুধু ক্ষয়েরই সাম্রাজ্য। অবিনশ্বর হতে চাওয়ার প্রচেষ্টা কি সদর্থক তীরের নাগাল পায়? এই জিজ্ঞাসা ও বিস্ময় নিয়েই কবিকে ফিরে যেতে হয়।
জাগরণ তবু হাল ছাড়ে না। ব্যক্তির মধ্যে থেকেই শাশ্বত বোধির নৈর্ব্যক্তিক আহ্বানে তার সদ্গতি খোঁজে। তার জীবন সীমানায় বিশ্ববোধির বাজনা বেজে ওঠে। যা নিজের তা অন্যেরও। যা ঘরের তা পরেরও। যা কালের তা মহাকালেরও। যা আকাশের তা মহাকাশেরও। যখন মানুষ থাকে না তখন মানব থাকে। একের কণ্ঠস্বরেই অনন্তকে শোনা যেতে থাকে।
কবিতা যাপনের এই বহুমুখী কালপ্রবাহই যুগের পথ পরিক্রমা করে অন্য যুগে প্রবেশ করে। যে শীতে হুহু করে কাঁপতে কাঁপতে রোদ্দুরের ঘোড়ার প্রতীক্ষা করেছি, যে খিদের কারণে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি, যে বিরহে প্রেমিকার সন্তান হতে চেয়েছি তা শুধু ব্যক্তিগত বোধের সীমাকেই অতিক্রম করেনি, তা যুগের সীমাকেও অতিক্রম করেছে। এই শাশ্বত বোধির নিয়ত অভিক্ষেপ থেকেই একজন সংবেদনশীল অনুভূতিপ্রবণ মানুষকে কবি হতে সাহায্য করে। প্রতিটি মুহূর্ত সময়ের রক্তাক্ত ছোবলে যেমন সে রাঙা হয়ে ওঠে,তেমনি আত্মদ্রোহের ভেতর তার গর্জনও শোনা যায়।
মানবতাবোধের এক দায় তার থাকে। বিষয় ধরে উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো কবিতা লেখা হয় না ঠিকই; কিন্তু কোনো বিষয় বা উদ্দেশ্য এসেই উদ্দীপন বিভাবটির সংরাগ স্বাক্ষর করে যায়। জাগরণ তখনই প্রবল হয়ে ওঠে। আমার নাম কেন তৈমুর? এ প্রশ্ন অনেকের সঙ্গে আমারও। উত্তর দেবার দায়টি জাগরণই নিজে তুলে নেয়:
আমি কেন তৈমুর
আর লোকে কেন লঙ্ বলে ডাকে
ভাবতে ভাবতে অন্ধকার হয়ে যায় আমার পৃথিবী
চপ্পল ছিঁড়ে গেলে খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে ফিরি
এ শহর, ধূসর শহরে আমার কোনো বসতি নেই
সারাদিনের ক্লান্ত সাম্রাজ্য খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেঙে পড়ে
নিজের নিঃস্ব জীবনের ছবিটিই পরমার্থ হয়ে ওঠে আত্মবৈভবে এবং অনৈতিহাসিক মানবীয় চেতনায়।