ফেসবুকে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সাহিত্যচর্চা কতখানি উপযোগী? এ বিষয়ে প্রথমেই ভাবতে বসি আর প্রথমেই যা মনে আসে তা হল: বর্তমান সাহিত্যচর্চা সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা যেমন নিজস্ব অ্যাপ খুলেছে, তেমনি ব্লগ ম্যাগাজিন বা নেট ম্যাগাজিনও নিত্যনতুন আবির্ভূত হচ্ছে। সেখানেও সচিত্র রঙিন পেজে সৃষ্টিকর্ম উপস্থাপন করার ব্যবস্থা হচ্ছে। কাগজ-পেন-খাতার যেমন প্রয়োজন পড়ে না, তেমনি ছোট্ট একটি যন্ত্র হাতে থাকলেই যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো জায়গায় তা অন করে পাঠ করাও সুবিধাজনক। মানুষের জীবনযাত্রার দ্রুততার জন্য এন্ড্রয়েড মোবাইলের ব্যবহার বেড়েছে। সেইসঙ্গে সব প্রয়োজনও মিটিয়ে দিচ্ছে সবজান্তা গুগুল।
প্রিন্ট ম্যাগাজিনে যে লেখা বেরোচ্ছে, সেই লেখারও স্ক্যান করে সোশ্যাল মিডিয়ায় দিচ্ছে। যে নতুন বই ছাপা হচ্ছে, বইয়ের রিভিউ, বইয়ের প্রাপ্তিস্থান সবই চোখের সামনে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এমনকী কোথাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সাহিত্য পাঠ করছে তার সংবাদসহ পাঠের ভিডিও ফুটেজও দিয়ে দিচ্ছে। লাইভ অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ এবং সাহিত্য আলোচনাও আজকাল সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর। লকডাউনের দিনগুলিতে এইসব কাজেই একটা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আজও তার ট্রাডিশান ক্ষুণ্ণ হয়নি। দূরকে যেমন নিকট করে তুলেছে, তেমনি সাহিত্য ও সাহিত্যিককেও হাতের তালুতে এনে বসিয়েছে। চেনার ও জানার পরিধি বহুগুণ বেড়ে গেছে। সারাবিশ্ব এসেছে হাতের মুঠোয়। যে বন্ধু আমেরিকার বা ইউরোপের কোনো শহরে বসে সাহিত্য চর্চা করছে, তাঁর সদ্য লেখাটি কয়েক সেকেন্ডেই পড়ার সুযোগ ঘটছে। ডাকযোগে লেখা পাঠানো, লেখা প্রকাশের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করার প্রয়োজন যেন ফুরিয়ে গেছে। লেখায় নতুনত্ব আনা, ভিন্ন ধারার পরীক্ষামূলক লেখা প্রকাশ করার জন্য আর কারও মুখাপেক্ষী হবার দরকারও হচ্ছে না। নিজেই একটা ব্লগ ক্রিয়েট করে সেখানেই ইচ্ছেমতো লেখা প্রকাশ করে চলেছে। এইসব লেখার বহু পাঠক এবং ফ্রেন্ড-ফলোয়ারও জুটে যাচ্ছে। আবার সরাসরি ফেসবুকেও লেখা পোস্ট করে দিচ্ছে। তাতেও নিমেষের মধ্যেই বহু সাড়া পাচ্ছে। এমন একটা সময়ে আমরা উপস্থিত হয়েছি, আমাদের ধর্মাচরণ থেকে শুরু করে রোমান্টিক জীবন, বাস্তব জীবন, দাম্পত্য জীবন বা সেক্স লাইফও সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর হয়ে উঠেছে। আমরা ধ্বংস হলে এই সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বারাই হব। আমরা উন্নত হলেও এই সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বারাই হব। তাই অন্য সবকিছুর মতো আমরা সাহিত্য-সংস্কৃতিকেও সোশ্যাল মিডিয়ার হাতে ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের বাজার থেকে বেডরুম, আমাদের রাজনীতি থেকে ধর্ম, আমাদের বিদ্বেষ থেকে ভালোবাসা সবই এই মাধ্যমে প্রকাশ করে চলেছি। সংবাদপত্র, বা প্রিন্ট পত্রিকা এই কারণে অনেকটাই গুরুত্ব হারিয়েছে। নামকরা পত্রপত্রিকাগুলিও সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিতে বাধ্য হচ্ছে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া বর্তমান প্রজন্মকে কতখানি গ্রাস করেছে।
কবি-লেখকরা আর প্রিন্ট ম্যাগাজিনের ভরসায় সাহিত্য চর্চা করছেন না। তাঁর হাতেই রয়েছে অ্যান্ড্রয়েড ফোন। যখন যা ইচ্ছে মনে আসছে লিখে ফেলছেন সেখানে। সেটি সাহিত্য হল কিনা, সিদ্ধির পর্যায়ে পৌঁছাল কিনা সেই বিচার করার সময় তাঁর নেই। লেখা এবং লেখা প্রকাশ করা তাঁর কাছে একেবারে সহজ একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর মাথার ওপরেও কেউ নেই অভিভাবক হিসেবে তাঁকে নির্দেশ দেওয়ার, শাসন করার। নিজেই সে নিজের অভিভাবক। গর্বিত একজন স্বয়ম্ভু লেখক। নিজেকে পরিমাপ করার যেমন তাঁর সময় নেই, তেমনি পড়াশোনায় গভীরতা অর্জনেরও সময়ও তাঁর নেই। খুব অল্পদিনেই লিখতে এসে তাঁর সুনাম ও যশ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ক্রমশই বেড়ে চলে। সোশ্যাল মিডিয়া ছাপিয়ে যায় তাঁর প্রতিভার বন্যায়। এক সময় বাজারের পত্রপত্রিকাগুলিও হয়তো তাঁকে জায়গা করে দেয়। সে তখন পরিপূর্ণ একজন লেখক হিসেবেই সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়। বলাই বাহুল্য এই ধরনের লেখকের সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। আর এর জন্য সোশ্যাল মিডিয়া যে বড় ভূমিকা পালন করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এইভাবে কি লেখক হওয়া যায়?
একজন লেখক সারাজীবন ধরে সাহিত্যচর্চা করেও আলোর সম্মুখে আসতে পারেন না— এমনও কেউ কেউ আছেন। হয়তো তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর মূল্যায়ন শুরু হয়। বাংলা সাহিত্যের বহু দিকপাল কবিকেই এই পর্ব অতিক্রম করতে হয়েছে। মাইকেল থেকে জীবনানন্দ, বিনয় থেকে শম্ভু রক্ষিত যাঁরা বাংলা কবিতার জগৎকে নতুন দিশা দেখাতে পেরেছেন। জীবিত অবস্থায় এঁরাই থেকে গেছিলেন আড়ালে। পাঠক তাঁদেরকে এক সময় চিনতে পেরেছেন। তাই নতুন করে আজও তাঁদের মূল্যায়ন শেষ হয়নি। ফাঁকি দিয়ে কি কবি হওয়া যায়? সোশ্যাল মিডিয়া কি প্রতিভাহীন নকলনবিশ কোনো ব্যক্তিকে কবি তৈরি করে দিতে পারে? যদি তা পারে তাহলে বাংলা সাহিত্যের বড় দুর্দিন অবস্থা বুঝে নিতে হবে। কবি হতে গেলে প্রথমেই যা হওয়া উচিত সে সম্পর্কে আমেরিকান কবি এবং ঔপন্যাসিক এরিকা জং (১৯৪২) বলেছেন: “What makes you a poet is a gift for language, an ability to see into the heart of things, and an ability to deal with important unconscious material. When all these things come together, you’re a poet. But there isn’t one little gimmick that makes you a poet. There isn’t any formula for it.” অর্থাৎ যা আপনাকে কবি করে তোলে তা হল ভাষার জন্য একটি উপহার, জিনিসগুলির হৃদয়ে দেখার ক্ষমতা এবং গুরুত্বপূর্ণ অচেতন উপাদানের সাথে মোকাবিলা করার ক্ষমতা। এই সব কিছু একত্রিত হলে আপনি একজন কবি। কিন্তু এমন একটি ছোট ছলনা নেই যা আপনাকে কবি করে তোলে। এর কোনো সূত্র নেই। সুতরাং কবি বা লেখক হওয়ার কোনো কৃত্রিম ছদ্মবেশ নেই, কোনো বিদ্যা বা মন্ত্রও নেই। কোনো কোচিং সেন্টারেও তার শিক্ষা পাওয়া যায় না। হৃদয় ও মেধা, পড়াশোনা ও নিষ্ঠা, ভাষাকে ভালোবাসা এবং বস্তুপৃথিবীর সঙ্গে নিজের হৃদয়ের সম্পর্ক স্থাপন করার মাধ্যমই সাহিত্য রচনার প্রক্রিয়াকে সচল ও সজাগ করে তোলে। এই বিষয়ে আরেকজন বিখ্যাত আমেরিকান কবি বিলি কলিন্স (১৯৪১) কবিতা রচনা ও পাঠের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। কলিন্স একটি কবিতাকে একটি জাদুঘর হিসাবেই বিবেচনা করেন, যেখানে মানুষের হৃদয়ের ইতিহাস রয়েছে। তাই তিনি বলেছেন, এটি একটি জাদুঘর যা প্রত্নবস্তুতে ভরা (The Allegory of the Museum) এবং কবির জীবনের খোলা ডায়েরি পাঠকদের দেখার জন্য। তিনি Turning Toward The Abstract: The Discovered Subject বা ‘বিমূর্তের দিকে বাঁক: আবিষ্কৃত বিষয়’ অংশে লিখেছেন: “যখন আমরা একটি জাদুঘর অন্বেষণ করি, তখন আমাদের অভিনব জিনিসের উপর ভিত্তি করে আমরা একটি প্রদর্শনী থেকে পরবর্তীতে চলে যাই। কবিতার রচনার ক্ষেত্রও তাই। একজন কবি তাঁদের সংঘকে তাড়া করেন- তাঁরা যেখানেই যেতে পারেন তাঁদের অনুসরণ করেন, পাঠকদেরও সাথে টানতে থাকেন। একটি কবিতা কবির চিন্তাভাবনা, অনুভূতি এবং কবির সাথে পথপ্রদর্শকের ভূমিকার একটি অসীম জাদুঘরের মধ্য দিয়ে একটি ভ্রমণ পথের মতোই। যদি তাঁরা আকর্ষণীয় প্রদর্শনীসহ একটি আকর্ষণীয় জাদুঘর তৈরি করার কঠোর পরিশ্রম করেন, আপনিও তাঁদের যেকোনো জায়গায় অনুসরণ করবেন।
এই প্রসঙ্গে তিনি The Final Exhibit বা চূড়ান্ত প্রদর্শনীতে লেখেন: “The poem’s turns from stanza to stanza get increasingly imaginative until the final turn. Here, the poet turns back to reality or reflects on everything so far. They combine the Starting subject with the Discovered subject.” অর্থাৎ স্তবক থেকে স্তবক পর্যন্ত কবিতার বাঁক চূড়ান্ত মোড় পর্যন্ত ক্রমশ কল্পনাপ্রবণ হয়ে ওঠে। এখানে কবি বাস্তবের দিকে ফিরে যান বা এ পর্যন্ত সব কিছুর প্রতিফলন ঘটান। তাঁরা আবিষ্কৃত বিষয়ের সাথে প্রারম্ভিক বিষয়কেও একত্রিত করেন।
সুতরাং কবি তাঁর হৃদয়ের জাদুঘরের প্রদর্শনীতে পাঠকদের আমন্ত্রণ জানান, সেখানে মানবমহিমার অজস্র উপলব্ধির ঘনীভূত পর্যটন অপেক্ষা করে থাকে। একে একে আবিষ্কৃত হতে পারে নানা বিস্ময়। সংকেতবদ্ধ চেতনার ভাব সমৃদ্ধ যাপনের এই নিগূঢ় প্রশ্রয় একজন প্রকৃত কবি ছাড়া অন্য কারও দ্বারা সম্ভব হয় না। যাঁরা নিছক ফেসবুকেই তাঁদের কাব্যচর্চার প্রতিফলন ঘটান, তাঁদের মধ্যে এর গভীরতা কতখানি সে বিষয়ে প্রশ্ন জাগে। ভাষার প্রতি ভালোবাসা, গভীর অধ্যবসায়, শ্রম ও আন্তরিকতা কতখানি সে বিষয়েও সন্দেহ হয়। আদৌ এঁরা যশ ও খ্যাতি পাওয়ার যোগ্য কিনা তাও ভেবে দেখা উচিত। প্রকৃত কবি লেখক একজন সাধকের মতোই। তিনি তাঁর সাধনার বা চর্চার বা প্রতিভার মূল্যের জন্য কাঙাল হবেন কেন? বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন: “যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভাল হইবে না। লেখা ভাল হইলে যশ আপনি আসিবে।”
ক’জন লেখক সোশ্যাল মিডিয়ায় সাহিত্যচর্চা করে যশের কাঙাল হন না? আশ্চর্যের বিষয় হল মূলত তিনি যশের জন্যই লেখেন। তাই লেখা পোস্ট করার আগে তিনি শিরোনামে লিখে দেন: “আমার এই লেখাটি পড়ে মন্তব্য করবেন।” কেউ বা লেখেন : “দয়া করে অবশ্যই পড়বেন।” এসব লিখেও তাঁরা ক্ষান্ত হন না, ফোনে বা ম্যাসেজেও পাঠকদের কাছে আবেদন জানান। পাঠকেরা কোন্ শ্রেণির, কতখানি বিদগ্ধ, কতখানি সাহিত্যমনস্ক বা সাহিত্যবোদ্ধা সে বিষয়টিও বিবেচনা করেন না। শুধুমাত্র সুনাম পাওয়ার জন্যই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। শুধুমাত্র একটি আবেদন: “আমাকে যশ দাও, খ্যাতি দাও!” বঙ্কিমচন্দ্র আরও বলেছেন: “যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন। যাঁহারা অন্য উদ্দেশ্যে লেখেন, তাঁহাদিগকে যাত্রাওয়ালা প্রভৃতি নীচ ব্যবসায়ীদিগের সঙ্গে গণ্য করা যাইতে পারে।” এই অন্য উদ্দেশ্যের লেখকেই আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া পূর্ণ হয়ে চলেছে। সাহিত্যচর্চার নামে ব্যক্তি চর্চা যেমন বেড়েছে, তেমনি স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারও বেড়েছে। নিজের ইচ্ছেমতো যেকোনো ধরনের লেখা পোস্ট করা যেতে পারে এটা তার স্বাধীনতা, কিন্তু সেই লেখাকে সাহিত্য হিসেবে দাবি করা যেতে পারে না। প্রকৃত সাহিত্য যদি হয় তবে তা কালের বিচারে আপনিই ঠাঁই পায়। লেখক যদি যশ-খ্যাতি পাওয়ার যোগ্য হন, তবে তিনি তা আপনিই পান, জোর করে আদায় করতে হয় না। সাহিত্য রচনার জন্য শুধু সোশ্যাল মিডিয়াই যথেষ্ট নয়, নিজেকে তৈরি করাই কঠিন কাজ। তার জন্য দীর্ঘদিন নীরবে সাধনা করে যেতে হয়। সেখানে কোনো ফাঁকি চলে না। কিন্তু সাম্প্রতিককালের সাহিত্যিকরা অধিকাংশই ফাঁকির সাহিত্যিক। ছলনার সাহিত্যিক। সেই নিষ্ঠা ও শ্রম তাঁদের মধ্যে নেই বললেই চলে। তাহলে কি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভালো সাহিত্য পাওয়া যায় না?
অবশ্যই পাওয়া যায়। যাঁরা যোগাযোগের অভাবে অনেক দূরে দূরে অবস্থান করেন, আত্মপ্রকাশের সুযোগ পান না, শহরের জুলুসে যাঁরা সামিল হতে পারেন না, যাঁদের উপকার করার কেউ নেই, যাঁরা বিভিন্ন বর্ণের ও সম্প্রদায়ের জন্য কার্যত বিচ্যুতির শিকার—তাঁরা অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সর্বসমক্ষে উঠে আসতে পেরেছেন। বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে তাঁদের। তাঁদের নাম তাঁদের প্রতিভার মূল্যে আজ অনেকেরই জানা। সুতরাং সোশ্যাল মিডিয়া সাহিত্যচর্চায় যে প্লাবনের সৃষ্টি করেছে এবং সেই প্লাবনে যে সবাই ঝাঁকের কৈ এ কথা বলা চলে না। অনেকেই ব্যতিক্রমী আছেন, তাঁদের প্রতিভার দীপ্তি আমাদের সচকিত করে। কিন্তু ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়াই যে প্রতিভার দীপ্তি বহন করেছে এমনটি নয়। কারণ আমরা জানি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী তাত্ত্বিক পদার্থবিদ পিটার হিগস তাঁর ক্যারিয়ার নির্মাণে সম্পূর্ণ সময় ইন্টারনেট এবং ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে দূরে ছিলেন। যখন তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন তখন সাংবাদিকরা তাঁকে হ্যারিকেন জ্বালিয়েও খুঁজে পায়নি। এটা ভাবাও মুশকিল। তেমনি উডি অ্যালেন বিখ্যাত চিত্রনাট্যকার এবং মুভি ডিরেক্টর। তিনি ১৯৬৯-২০১৩, ৪৪ বছরে ৪৪ টি মুভির স্ক্রিপ্ট লিখেছেন এবং পরিচালক ছিলেন। এই সময়ে তিনি ২৩ টি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছেন। এই পুরো ৪৪ বছরের ক্যারিয়ারে এবং লেখালেখির সময়ে তিনি ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। এমনকী তাঁর কোনো কম্পিউটারও ছিল না, লেখালেখির কাজে কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস বা কম্পিউটার ব্যবহার করেননি।হ্যারি পটারের লেখক জে. কে. রাওউলিং শুধু কম্পিউটারেই লেখালেখি করতেন। কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাঁর ছিল না। সুতরাং সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াও তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী লেখক অনেকেই তৈরি হয়েছেন এবং বর্তমানেও হচ্ছেন। তবু সোশ্যাল মিডিয়াকে বাদ দিতে পারি না। বিনয় মজুমদার, শম্ভু রক্ষিত, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামী প্রমুখ বহু কবিকেই সোশ্যাল মিডিয়া আরও বেশি করে চিনিয়ে দিয়েছ। অনেক তরুণ-তরুণী যাঁদের সব লেখা পড়তে পেতেন না, তাঁরাও এখন পড়তে পারেন। বই এবং লাইব্রেরির অপর্যাপ্ততা অনেকটাই কেটে গেছে। তাই আমাদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছেন এই সময়ের বহু তরুণ কবি-লেখক। যেকোনো সময় তাঁদের সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে থাকতে দেখা যায়: মলয় রায়চৌধুরী, মলয় গোস্বামী, মন্দাক্রান্তা সেন, মাসউদ আহমাদ, মাসুদার রহমান, গোলাম রসুল, অনুপম মুখোপাধ্যায়, সেলিম মণ্ডল, পারমিতা ভৌমিক, সৌরভ বর্ধন, আমিনুল ইসলাম, সোমনাথ বেনিয়া, পিনাকীরঞ্জন সামন্ত, প্রদীপ চক্রবর্তী, বিভাস রায়চৌধুরী, দয়াময় মহান্তি, বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়, লক্ষীকান্ত মণ্ডল, সুনীল মাজি, শঙ্খশুভ্র পাত্র, জফির সেতু, গৌতম রায়, সব্যসাচী মজুমদার, নিয়াজুল হক, একরাম আলি প্রমুখ আরও বহু কবি। গল্পকার এবং অণুগল্পকারেরও সংখ্যা গণনার বাইরে। তবে মজার কথা হল, এঁরা শুধু সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর কবি বা কথাসাহিত্যিক নন, কেউ কেউ প্রিন্ট ম্যাগাজিনের সম্পাদক, কেউ কেউ ব্লগ ম্যাগাজিনেরও সম্পাদক। ইতিমধ্যেই এঁরা পাঠকের নজরে পড়েছেন এবং সাহিত্য ক্ষেত্রে নিজস্বতা অর্জন করেছেন। নিছক সোশ্যাল মিডিয়াকে কেন্দ্র করে সাহিত্যচর্চা সম্ভব নয়, পুস্তকেরও প্রয়োজন আছে এবং প্রিন্ট ভার্সন বের করাও দরকার এটা তাঁরা বোঝেন। তাই প্রত্যেকেই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করলেই যে তা শেষকথা তা বিশ্বাস করেন না। বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরাই সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশি সাহিত্য চর্চা করে থাকেন যা আর কোনো ভাষায় ততটা লক্ষ করা যায় না।
তবে সাহিত্য চর্চা করতে গিয়ে আমরা যে পড়াশোনাকে উপেক্ষা করি, এবং নিজেদের লেখাটিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলি, মননশীল পাঠকের দরবারে পৌঁছাতে পারি না—এটা মানতেও চাই না, আর এটাই আমাদের দোষ। এই কারণেই সোশ্যাল মিডিয়ার কাব্য কবিতাকে অপরিশুদ্ধ বালখিল্য বলেই অনেকেই দূরে সরিয়ে রাখেন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র লালসালুতে একটা কথা আছে ‘শস্যের চেয়ে আগাছা বেশি, ধর্মের চেয়ে টুপি’… এই সাহিত্যও অনেকটাই তেমনি। আয়োজন বা আড়ম্বর অনেক, কিন্তু ফলপ্রসূ শূন্য। তবে প্রকৃত সাহিত্যকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারেনি, পারবেও না। প্রকৃত সাহিত্যের জন্য যে অবদান তিনি রেখে যাচ্ছেন তা একসময় নজরে আসবেনই। আমরা উপরোক্ত যে কয়েকজন সাহিত্যিকের নাম উল্লেখ করেছি তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়া এবং প্রিন্ট মিডিয়া উভয় ক্ষেত্রেই নিজেদের স্বাক্ষর রেখেছেন। আগামীতেও রাখবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।
সোশ্যাল মিডিয়ায় সাহিত্যচর্চা করতে কোনো বাধা নেই, কিন্তু কিছুটা সর্তকতা অবশ্যই দরকার। আমাদের স্বাধীনতা আছে যখন তখন পোস্ট করার, কিন্তু আমরা তা করবো কেন? আদৌ সেটা সাহিত্য কিনা, মৌলিক কিনা, কোনো নতুনত্ব বহন করছে কিনা সেই বিষয়টিও যাচাই করা দরকার। শুধুমাত্র আবেগের বশে আমার অসম্পূর্ণ, অপরিশুদ্ধ, দুর্বল সৃষ্টিকে জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেবো তাতে খুব ভালো ইমেজ সৃষ্টি হবে তা কাঙ্ক্ষিত নয়। বরং লেখাটিকে আরও কিছুদিন ফেলে রেখে সম্পাদনা করে পোস্ট করলেই ভালো হয়। তাতে অনেকটা পরিবর্তন আসবে, ত্রুটিগুলিও নির্ণয় করা সম্ভব হবে। আর এই কাজটি করার জন্যই আমাদের শৈল্পিক ধৈর্য চাই। এক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা এবং খ্যাতির আকাঙ্ক্ষাকে সংযত করা একান্তই বাঞ্ছনীয়। বঙ্কিমচন্দ্র তাই নব্যলেখকদের এই উপদেশ দিয়ে বলেছেন: “যাহা লিখিবেন, তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না। কিছু কাল ফেলিয়া রাখিবেন। কিছু কাল পরে উহা সংশোধন করিবেন। তাহা হইলে দেখিবেন, প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে। কাব্য নাটক উপন্যাস দুই এক বৎসর ফেলিয়া রাখিয়া তার পর সংশোধন করিলে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে। যাঁহারা সাময়িক সাহিত্যের কার্য্যে ব্রতী, তাঁহাদের পক্ষে এই নিয়ম রক্ষাটি ঘটিয়া উঠে না। এজন্য সাময়িক সাহিত্য, লেখকের পক্ষে অবনতিকর।” সোশ্যাল মিডিয়া লেখকদের পক্ষে অনেকটাই অবনতিকর, তাই এখানে অপরিশুদ্ধ বস্তাপচা জিনিসের আমদানি বেশি, রত্নের আমদানি কম। পাঠকদের তীক্ষ্ণ ও চতুর হতে হবে, তা না হলে হতাশ হতে হবে।