প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার কে দেখেছেন..?
ছোট করে ছাঁটা চুল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর সংকল্পবদ্ধ দৃঢ় মুখমণ্ডল। সব জায়গায় অগ্নিকন্যার এই একটাই ছবি।
১৯৩২ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে প্রীতিলতা যখন আত্মাহুতি দেন, তখন হিজলি বন্দিশিবিরে ছিলেন তাঁর জ্ঞাতিভাই বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদার। সেখানেই এর কয়েক দিন আগে প্রীতিলতার শেষ চিঠি পান তিনি। সেই চিঠিতে প্রীতিলতা লিখেছিলেন,
‘আঁধার পথে দিলাম পাড়ি/মরণ-স্বপন দেখে।’ 💐
বহু বছর পরে ১৯৬৯ সালে পূর্ণেন্দু দস্তিদার লিখেছিলেন প্রীতিলতার জীবনী। সেই বইয়ে তাঁর আঁকা প্রীতিলতার একটি আবক্ষ ছবিও ছাপা হয়েছিল। সেই ছবিটিই পরবর্তীকালে সব জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু কী করে ওয়াদ্দেদার পরিবারের ছয় সন্তানের দ্বিতীয় সন্তান প্রীতিলতা হয়ে উঠলেন অগ্নিকন্যা?
প্রীতিলতা ১৯১১ সালের ৫ই মে চট্টগ্রামের পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার ছিলেন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালটির বড়বাবু থাকতেন শহরে, সেখানেই কৈশোর কাটে তাঁর। অন্তর্মুখী স্বভাবের প্রীতিলতা ১৯১৮ সালে খাস্তগীর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে তাঁর সহপাঠী ছিলেন আরেক বিপ্লবী কল্পনা দত্ত। ভালো ফলাফলের জন্য প্রীতিলতা শিক্ষকদের স্নেহভাজন ছিলেন। এর মধ্যে ১৯২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের টাইগার পাস মোড়ে ঘটে এক ছিনতাইয়ের ঘটনা। রেলওয়ের কর্মচারীদের বেতনের ১৭ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেন সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের সদস্যরা। এই ঘটনার পরপর মাস্টারদা সূর্য সেন ও তাঁর সহযোগী অম্বিকা চক্রবর্তী গ্রেপ্তার হন পুলিশের হাতে। খাস্তগীর স্কুলের ছাত্রীদের কাছে এই বিপ্লবীরা ছিলেন ‘স্বদেশি ডাকাত’। এক দিদিমণি ছাত্রীদের মুখে ‘ডাকাত’ কথাটা শুনে বলেছিলেন, ‘ডাকাত নন, ওরা স্বদেশি। দেশকে ওঁরা ভালোবাসেন। তাই ইংরেজরা ওঁদের বলে ডাকাত।’ কথাটা স্পর্শ করলো স্কুল পড়ুয়া প্রীতি কে !
১৯২৪ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারত উপমহাদেশে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে ব্রিটিশ সরকার ১ নম্বর বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স নামের এক জরুরি আইন পাস করে। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল, রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বিনা বিচারে আটক রাখা। এই কালাকানুনের কারণে বিপ্লবীরা বাড়িতে বই রাখতেও ভয় পেতেন। মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী দল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির সদস্য পূর্ণেন্দু দস্তিদার নিরাপদ ভেবে এসব নিষিদ্ধ বই এনে রাখতেন তাঁর বোন প্রীতিলতার কাছে। প্রীতিলতা কৌতূহল মেটাতে গিয়েই লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে ফেলেন দেশের কথা, বাঘা যতীন, ক্ষুদিরাম আর কানাইলালের জীবনী ।
১৯২৮ সালে কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকায় ইডেন কলেজে আইএ পড়তে যান প্রীতিলতা। দেশের কথার মতো নানা বই পড়ে ভেতরে তখন আগুন জ্বলছিল। তাই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কিছু একটা করতে যোগ দেন লীলা রায়ের দিপালী সংঘ সংগঠনে।
সূর্য সেনের বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়ার ইচ্ছেটা ক্রমশ দানা বেঁধে উঠছিল প্রীতিলতার মধ্যে। ১৯২৯ সালের মে মাসে চট্টগ্রামে ভারতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনের সময় সে উদ্দেশ্য নিয়ে কল্পনা দত্তের সঙ্গে হাজিরও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেবার বিফল হয়ে ফিরে যেতে হয় তাঁদের।
১৯৩০ সালের ১৯ এপ্রিল আইএ পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন প্রীতিলতা। আগের দিন রাতেই চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের দীর্ঘ পরিকল্পিত আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেছে অস্ত্রাগার, পুলিশ লাইন, টেলিফোন অফিস ও রেললাইন। ঘটে গেছে ভারতবর্ষের ইংরেজ আমলের অন্যতম তোলপাড় করা ঘটনা ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’।
নিজের শহরে এমন ঘটনা ঘটলেও তিনি এর অংশ হতে পারেননি। এই আক্ষেপ পোড়াচ্ছিল প্রীতিলতাকে। আর আক্ষেপ নিয়েই আইএ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়ে কলকাতায় বেথুন কলেজে পড়তে যান তিনি। বিপ্লবী দলে যোগ দিতে না পারলেও দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে এ সময় মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।
১৯৩২ সালে ডিস্টিংশন নিয়ে তিনি বিএ পাস করে চট্টগ্রামে ফিরে পরিবারের প্রয়োজনে অপর্ণাচরণ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার পদে চাকরিও নিলেন। মন থেকে তখন সমাজ-সংসার সবই লোপ পেয়েছে। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে অনেক বিপ্লবী মারা গেছেন তত দিনে। অনেকে জেলে। আর আত্মগোপনে থাকা সূর্য সেনসহ কয়েকজনের মাথার দামও ঘোষণা করেছে ব্রিটিশ সরকার। এমন কোণঠাসা অবস্থায়ও বিপ্লবীরা লড়াই জারি রেখেছিলেন। এই সময় আত্মগোপনে থাকা নির্মল সেনের সঙ্গে দেখা করে প্রীতিলতা তাঁর দীর্ঘ প্রতীক্ষার কথা জানালেন। নির্মল সেন বুঝতে পারলেন টলানো যাবে না এই মেয়েকে।
১৯৩২ সালের ১২ই জুন তুমুল ঝড়-বৃষ্টির দিনে মাস্টারদার পাঠানো এক লোক প্রীতিলতাকে চট্টগ্রামের এক বাড়িতে নিয়ে আসেন। সাবিত্রী দেবীর ওই বাড়িতে মাস্টারদা ও নির্মল সেন ছাড়াও ছিলেন তরুণ বিপ্লবী অপূর্ব সেন (ভোলা)। কিন্তু বিপ্লবী জীবনের শুরুতে কী অপেক্ষা করছে তা জানতেন না প্রীতিলতা। টের পেলেন এর পরদিন।
বিপ্লবীদের অবস্থানের খবর জেনে ১৩ই জুন সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের নেতৃত্বে পুলিশ অভিযান চালায় ধলঘাটের ওই বাড়িতে। অভিযানে নির্মল সেনের গুলিতে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন মারা গেলেও পাল্টা গুলিতে তিনি নিজেও নিহত হন। মারা যান বিপ্লবী অপূর্ব সেনও। তবে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন প্রীতিলতা ও সূর্য সেন।
নির্মল সেন ও অপূর্ব সেনের মৃত্যুর পর পাল্টা আঘাত হানার প্রয়োজন ছিল যেন। আর সূর্য সেন সেটাই করেন। ২৪শে সেপ্টেম্বর পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাবে হামলার পরিকল্পনা নিলেন। হামলার দায়িত্বভার তিনি দিতে চেয়েছিলেন কল্পনা দত্তকে। কিন্তু ঘটনার এক সপ্তাহ আগে কল্পনা দত্ত গ্রেপ্তার হলে স্বেচ্ছায় দায়িত্ব নিলেন প্রীতিলতা।
হামলার দিন নিজ হাতে সূর্য সেন প্রীতিলতাকে সামরিক পোশাক পরিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিন ছিল শনিবার, প্রায় ৪০ জন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিল। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ শুরু করেন রাত ১০টা নাগাদ। প্রীতিলতার পরনে ছিল খাকি শার্ট, ধুতি, মাথায় পাগড়ি ও কোমরে চামড়ার কটিবদ্ধে রিভলবার। অভিযানের শেষ দিকে হঠাৎ একজন ইংরেজ অফিসারের ছোড়া গুলিতে প্রীতিলতা মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন। নির্দেশ অনুযায়ী ধরা না দিতে মুখে পুরে দেন পটাশিয়াম সায়ানাইড। পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী সেদিনের আক্রমণে মিসেস সুলিভান নামের একজন ইংরেজ নারী নিহত হন এবং চারজন পুরুষ ও সাতজন নারী আহত হন।
‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ বইয়ে পূর্ণেন্দু দস্তিদার লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামের একটি তরুণী নিজের মাতৃভূমিকে সাম্রাজ্যবাদের কবলমুক্ত করার জন্য যে “মরণ-স্বপন” দেখেছিল, তাঁর কর্মপন্থা যুগের সঙ্গে সঙ্গে নিঃসন্দেহে পরিত্যক্ত হয়েছে। কিন্তু তার দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত, তার অটুট আদর্শনিষ্ঠা আজও প্রেরণা সঞ্চারী।
প্রয়াণ দিবসে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি..
লেখক: স্বপন সেন
(স্যোসাল মিডিয়া থেকে)