এরকম প্রশ্ন কয়েকবার চোখের সামনে এলো – “যেখানে খেলতে আসা নারীরা সব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর, আর নারীবাদীরা মূলত নগরকেন্দ্রিক প্রগতিশীল, সেখানে নারীদের খেলা কিভাবে নারীবাদী হয় বা নারীদের ক্ষমতায়ন করে???”… তাই এটা লেখা
১। নারীদের খেলা বা উইমেনস স্পোর্ট এর ধারণাটাই খালি বেশ কিছু নারী বিষয়ক স্টেরিওটাইপের বিরুদ্ধে কাজ করে, যেমন “নারীরা খেলতে পারেনা”, “নারীরা কেবল রাঁধা আর চুল বাঁধার কাজ করবে” ইত্যাদি। এগুলো নারীদের নিয়ে সামাজিক ধারণা পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে।
২। নারীদের খেলা যত জনপ্রিয় হবে ও খেলোয়াররা যত সাফল্য আনবে, তত বেশি মানুষ নারীদের খেলা কনজিউম করবে, অর্থাৎ টাকা দিয়ে দেখবে, এতে নারীদের খেলার ইকোনমি শক্তিশালী হবে, অন্যদিকে নারীদের খেলার ঘরোয়া কাঠামোও শক্তিশালী হবে (যেটা নারীদের ফুটবলের ক্ষেত্রে খুবই দুর্বল), একই সাথে খেলোয়ারদের ইনকামও অনেক বাড়বে। এর ফলে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক নারী খেলায় উৎসাহিত হবে, স্কুলে স্কুলে নারীদের ফুটবল টিম গঠিত হবে, অনেক নারী স্কুল লেভেলের খেলায় কম্পিটিশন করবে, এর জন্য শরীরচর্চা করবে, খেলায় সাফল্য না পেলেও তাতে তাদের কনফিডেন্স বাড়বে, তারা বাইরে কাজ করতে উৎসাহিত হবে, যেটা আবার একই সাথে তাদের জীবনের উন্নতি ও স্বাবলম্বনে ভূমিকা রাখবে, একই সাথে দেশের ইকোনমিতেও অবদান রাখবে।
৩। একই ভাবে নারীদের খেলা জনপ্রিয় হবার সাথে সাথে কনজিউমারিজম বৃদ্ধি পেলে অনেক বেশি নারী খেলা দেখতে আসবে। নারীরা খেলা কম দেখে, তাছাড়া কোন নারীর দ্বারা পুরুষের খেলা দেখা আর নারীর খেলা দেখায় পার্থক্য আছে, কারণ নারীদের নিয়ে সেই স্টেরিওটাইপগুলোই। নারীরা যদি বেশি করে নারীদের খেলা কনজিউম করতে পারে তাহলে নারীদের তারাও ঘরের বাইরে প্রতিযোগিতামূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহী হবে, পুরুষেরাও এদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নারীদের বাইরে কাজ করায় ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা শুরু করবে, বিশেষ করে যদি নারী ও পুরুষ ছোটবেলা থেকেই নারীদেরকে খেলা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয় তাহলে এর এরকম মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব কাজ করবে। বুঝতে হবে, খেলা কেবল খেলা না, আর খেলার সম্প্রচার কেবল খেলার সম্প্রচার না, এখানে যারা খেলে তাদের মানসিক চাপ, জেতার জন্য স্ট্র্যাটেজি, প্রতিযোগিতা, প্রতিযোগী মনোভাব, জয়ের পর আনন্দ, হারার পর গ্লানি সবই সামনে আসে, আর যারা খেলা দেখে তারা এগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিশেষ করে এমপ্যাথিকরা বা সহমর্মীরা এগুলোর দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়, আর নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি এমপ্যাথিক হয়ে থাকে বলে তাদের ওপর এগুলোর প্রভাবটাও বেশিই হবে।
৪। আমাদের সমাজের অনেক রক্ষণশীল মানুষ আছে যারা নারীদের এরকম খেলাধুলা পছন্দ করেনা। এমনকি ২০১৮ সালে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে নারীদের ফুটবল ম্যাচের বিরুদ্ধে রক্ষণশীলদের আন্দোলনও দেখা গেছে, যার ফলে ম্যাচ বাতিল করা হয়। যাই হোক, সমাজে অনেক কিছুই হয় যা ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক, কিন্তু তাই বলে সব কিছু নিয়েই রক্ষণশীলরা এরকম প্রতিবাদ করতে আসেনা। নারীর খেলা নিয়ে তারা প্রতিবাদ করতে আসে কারণ এটা তাদের কাছে অনেকটাই অভিনব। যদি নারীদের খেলাটা জনপ্রিয় হয় তাহলে ধীরে ধীরে এসব রক্ষণশীলদের কাছেও অন্যান্য অনেক ধর্মবিরোধী বিষয়ের মত এটাও নরমালাইজড বা স্বাভাবিকীকৃত হয়ে আসবে, এটা যেমন নারীদের খেলা, বাইরে বের হওয়া, ‘পর্দা’ না করার মত বিষয়কে সাধারণ মানুষের কাছে নরমালাইজ করায় ভূমিকা রাখবে, একই ভাবে এইসব রক্ষণশীলদের মন পরিবর্তনেও একটা ভূমিকা রাখবে, আর তাতে সর্বোপরি উপকার হবে নারীরই, বিশেষ করে যারা বাইরে বের হতে চায়, বাইরে কাজ করতে চায়, ‘পর্দা’ ছাড়া চলতে চায় তাদের, যা নারীর ক্ষমতায়নেরই অংশ।
সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়শিপে নারী ফুটবল দলের শিরোপা জয় ও গোটা টুর্নামেন্ট জুড়ে অজেয় থাকার জন্য অভিনন্দন। আপনারা হয়তো জানেন না যে আপনারা কেবল নিজেদের টিমের জন্য আনছেন না, সেই সাথে দেশের সমাজেও এক পরিবর্তন নিয়ে আসছেন…
লেখক: সুমিত রায়
(স্যোসাল মিডিয়া থেকে)