রাজনীতির সেকাল আর একাল লিখতে গিয়ে শেষ করে ছিলাম রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রী হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু এই লেখাটা শুধুমাত্র রাজীব গান্ধীর উপর ভিত্তি করে লেখা। তাই তার জীবনী ছোট করে জেনে নিলে তাকে জানতে সুবিধা হবে। সেই কারণে তাঁর জীবনীটা একটু ছোট করে লিখেছি। কেননা ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর রাজীবের প্রধানমন্ত্রী হওয়া থেকে শুরু করবো। জানবো রাজনীতির ভিতরে রাজনীতির খবর।
রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত এক পরিবারের উত্তরসূরী হয়েও রাজনীতিতে অংশগ্রহণে প্রথমে তাঁর ছিল তীব্র অনীহা। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং পরবর্তীকালে দেশের রাজনীতিতে এই পরিবারের নিবিড় যোগাযোগ ছিল প্রায় চার প্রজন্মের। ছোট ভাই সঞ্জয় গান্ধীর অকাল মৃত্যুর পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও খানিকটা বাধ্য হয়েই রাজীব গান্ধী রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।
২০ আগস্ট ১৯৪৪, রাজীব গান্ধীর জন্ম বোম্বাইতে। ভারতের স্বাধীনতা লাভ এবং তাঁর মাতামহ প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সময় রাজীবের বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। তাঁর মা-বাবা নয়াদিল্লি থেকে লক্ষ্ণৌতে স্থানান্তরিত হন। তাঁর পিতা ফিরোজ গান্ধী একজন সাংসদ হিসেবে সাহসিকতা ও কর্মনিষ্ঠার জন্য বিশেষ সুনাম অর্জন করেন।
মাতামহের সঙ্গে তিনমূর্তি ভবনে রাজীবের শৈশব অতিবাহিত হয়। এই বাড়িতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন তাঁর মা ইন্দিরা গান্ধী। দেরাদুনের ওয়েলহ্যাম্প প্রেপ-এ তিনি খুব অল্পদিন পড়াশোনা করেন। এরপরে ভর্তি হন দুন স্কুলে। স্কুলের সঙ্গে তাঁর সুদীর্ঘ মৈত্রীর এক নিবিড় বন্ধন তৈরি হয়। পরে তাঁর ছোট ভাই সঞ্জয়ও একই স্কুলে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন।
পঠনপাঠন শেষ করে রাজীব ভর্তি হন কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি চলে যান লন্ডনে ইম্পিরিয়াল কলেজে পড়াশোনা করতে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়েই তিনি পড়াশোনা করেন। পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা– এই নীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন না। পরে তিনি একথার উল্লেখও করে গেছেন।
রাজনীতি তাঁকে সেভাবে কোনদিনই আকর্ষণ করেনি। তাঁর সহপাঠীদের কাছ থেকে জানা যায় তাঁর পড়ার ঘরে দর্শন, রাজনীতি বা ইতিহাসের গ্রন্থের তুলনায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপরই মোটা মোটা বই সাজানো থাকত। এছাড়াও তিনি ছিলেন সঙ্গীতানুরাগী। আধুনিক গান ছাড়াও হিন্দুস্থানী ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতে তাঁর ছিল গভীর আগ্রহ। এছাড়াও, তাঁর শখের মধ্যে ছিল ফটোগ্রাফি ও অ্যামেচার রেডিও।
তার আকর্ষণ ছিল বিমান চালনায়। ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে আসার পর দিল্লি ফ্লাইং ক্লাবের প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হন এবং একজন কমার্শিয়াল পাইলটের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য নিয়মিত অনুশীলন শুরু করেন। পরে, দেশের অভ্যন্তরীণ উড়ান সংস্থা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান চালক পদে যোগ দেন তিনি।
কেম্ব্রিজে থাকার সময় এক ইতালিয়ান তরুণী সোনিয়া মাইনোরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সোনিয়া সেখানে ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতেন। পরে, ১৯৬৮ সালে নয়াদিল্লিতে তিনি সোনিয়ার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। দুই সন্তান, পুত্র রাহুল ও কন্যা প্রিয়াঙ্কাকে সঙ্গে নিয়ে রাজীব ও সোনিয়া, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নয়াদিল্লির বাসভবনেই বসবাস করতেন। রাজনৈতিক ব্যস্ততা ও কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যেও রাজীব একান্তে এক ব্যক্তিগত পারিবারিক জীবন অতিবাহিত করতেন।
১৯৮০ সালে ছোট ভাই সঞ্জয়ের বিমান দুর্ঘটনায় আকস্মিক মৃত্যুর পর পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। ঘরে-বাইরে নানারকম চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় মা ইন্দিরা গান্ধীকে সাহায্য করতে বিভিন্ন মহল থেকে রাজনীতিতে প্রবেশ করার জন্য তাঁর (রাজীব গান্ধী) ওপরে চাপ আসে। প্রথমে তিনি রাজি হননি, কিন্তু অনেক চিন্তাভাবনার পর তিনি রাজনীতিতে যোগ দিতে মনস্থির করেন তিনি। ভাইয়ের মৃত্যুর পর উত্তর প্রদেশের আমেথি কেন্দ্রের উপ-নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তিনি জয়লাভ করেন।
৩১ অক্টবর ১৯৮৪, সন্ধ্যা বেলা তড়িঘড়ি করে রাজীব গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী করা হলো, সঙ্গে চার মন্ত্রী তার মধ্যে একজন ছিলেন প্রণব মুখার্জী। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর নির্বাচন তখনও একবছর বাকি ছিল। কিন্তু কংগ্রেস দল ১৯৮৪ সালেই লোকসভা নির্বাচন চাইল। ইন্দিরা গান্ধীর নৃশংস খুনের ঘটনা মানুষের মনে তখনও টাটকা। দেশটার কি হবে সেই ভাবনাও মানুষকে উদ্বেলিত করে রেখেছিল। ১৯৮৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের ঘোষণা হয়ে গেল। মৃত ইন্দিরার শক্তি এত প্রবল ছিল যে বিরোধীরা ভোটের ময়দানে দাঁড়াতে পারলো না। ৪০৪ টি লোকসভা আসন জিতে আগের সমস্ত জয়ের রেকর্ড ম্লান করে ক্ষমতায় এলো কংগ্রেস। ঐ নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গেও ঘটলো অঘটন। যাদবপুর কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী মমতা ব্যানার্জীর কাছে হেরে গেলেন সি পি এম-র সোমনাথ চ্যাটার্জী। স্বাভাবিক ভাবেই মাত্র ৪০ বছর বয়সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন শ্রী রাজীব গান্ধী। তিনি ছিলেন দেশের তরুণতম প্রধানমন্ত্রী। শুধু তাই নয়, সেসময় বিশ্বের অন্যান্য দেশের নির্বাচিত সরকারের তরুণতম প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। ১৯৬৬ সালে তাঁর (রাজীব গান্ধী) থেকে মাত্র আট বছর বেশি বয়সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন তাঁর মা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। দেশের ৭০ কোটি মানুষের নেতা হিসেবে এভাবেই রাজনৈতিক জীবনে রাজীবের উত্থান।
চমক আরও বাকি ছিল, রাজীব মন্ত্রীসভা গড়লেন সেই মন্ত্রীসভায় ঠাঁই হলো না ইন্দিরা গান্ধীর দক্ষিণ হস্ত প্রণব মুখার্জীর আর স্থান পেলেন না গণি খান চৌধুরী। বাংলার মানুষ অবাক হয়ে গেল। বঙ্গে কংগ্রেসিরা মনমরা হয়ে পরলেন। ১৯৮০ সালে সঞ্জয় গান্ধীকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী করার দাবি ইন্দিরা নস্যাৎ করে ভি পি সিং-কে মুখ্যমন্ত্রী করেন। সেই ভি পি সিং-কে রাজীব গান্ধী তার মন্ত্রীসভায় অর্থমন্ত্রী করলেন।
রাজীব গান্ধীর আমলে ইন্দিরা গান্ধীর দক্ষিণহস্ত প্রণব মুখার্জী অপমানিত হয়ে কংগ্রেস ত্যাগ করলেন এবং ‘রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস’ নামে নতুন দল গড়লেন। প্রণব বাবু নতুন দল গড়ায় পশ্চিম বাংলায় কংগ্রেসের খুব একটা ক্ষতি হলো না কিন্তু অন্য রাজ্যে ক্ষতি হলো। দেখতে দেখতে ১৯৮৯ এর নির্বাচন চলে এলো। তার আগে শাহাবানু তালাক মামলার রায় নিয়ে রাজীব গান্ধীর ভূমিকায় দেশজুড়ে হৈ চৈ শুরু হয়। বিরোধীরা বলতে শুরু করে মুসলিম ভোটের স্বার্থে রাজীব গান্ধী ঐ আইন বাতিল করে। এদিকে আবার রাজীব রাম মন্দিরের তালা খোলারও ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীকালে বি জে পি তার সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নেয়। এই সময়েই রাজীব গান্ধীর সাথে বেঈমানি করে বসল সেই ভি পি সিং। বোফর্স কেলেঙ্কারি সামনে এনে রাজীবের পতনের রাস্তাকে প্রশস্ত করে দেন ভি পি সিং। বোফর্স ঘুষ মামলায় আজ পর্যন্ত প্রমাণ হলো না ঘুষ কারা নিয়েছিল! এলটিটিই এবং অন্যান্য বিষয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কাজ করলো। এদিকে ব্রিগেড ময়দানে জ্যোতি বসু, বাজপাই এবং ভি পি সিং হাত ধরাধরি করে, সভা করে জনতার কাছে আবেদন রাখলেন তারা যেন কংগ্রেসকে ভোট না দেন। ভোটের ফল প্রকাশের পরে দেখা গেল এই প্রথমবার কোন দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল না। সেখানে প্রথমবারের মতো একটি হাঙ্গ লোকসভা হলো। কংগ্রেস জিতেছে ১৯৭, জনতা দল ১৪৩। যে বি জে পি ১৯৮৪ সালে মাত্র ২ টি আসন জিতেছিল তারা বাম ও ভি পি সিং এর সহযোগিতায় এবার জিতল ৮৫ টি আসন। অর্থাৎ ভারতের রাজনীতিতে বিজেপির রথের চাকা গড়াতে সাহায্য করলেন বামেরা। জনতা দল, বিজেপি এবং বাম দলগুলির বাইরের সমর্থন নিয়ে জাতীয় ফ্রন্ট সরকার গঠন করে। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং (ভিপি সিং) প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৯০ সালে জনতা দলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী চন্দ্র শেখর জনতা দল ভেঙে সমাজবাদী জনতা পার্টি গঠন করেছিলেন। ফলস্বরূপ, ভি পি সিংকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। চন্দ্র শেখর তখন ১৯৯০ সালে কংগ্রেসের বাহ্যিক সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী হন। এই পরীক্ষাটি অল্প সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। দুই বছরের মধ্য সাধারণ নির্বাচন হয়। এরই মধ্যে প্রণব বাবুকে আবার কংগ্রেসে ফিরিয়ে আনা হয়।
এলটিটিই ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের শেষ পর্যায়ে রাজীব গান্ধীকে হত্যা করলো। দুটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী ইস্যুর উপরে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করা এবং রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ ইস্যু। তাই এই নির্বাচনকে ‘মণ্ডল-মন্দির’ নির্বাচনও বলা হয়।
রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায় না রাজীবজীর শাসনকালীন প্রভাব। তার আমলেই গৃহীত হয় ভারতকে ২১শতকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা। সে কাজ আজও চলছে কিন্তু দৈ মারছে নেপোয়।
১৯৮০ সালের মাঝামাঝি রাজীব গান্ধী ২১শতকের পরিবর্তন দেখতে পান। অর্থাৎ দেশের নেতা হিসাবে বা জননেতা হিসাবে ভবিষ্যত দর্শন যার আছে সেইতো আসল দেশনেতা। যে নেতার সেই ভবিষ্যত দর্শন নেই সেই নেতাই তো বিক্রি করতে পারেন দেশের সম্পদ। ১৯৪৭ থেকে গড়ে তোলা দেশের সম্পদ একে একে আজ জনগণের হাত ছাড়া হচ্ছে। যে কৃষক সমাজ দেশের মেরুদণ্ড আজ অসহায়ের মতো সেই কৃষকরা সরকারের পুলিশ দ্বারা আক্রান্ত।
আজকে যে ডিজিটাল ইণ্ডিয়ার কথা মোদীজীরা বলছেন সেই কাজের সূচনা করে যান রাজীব গান্ধী। আগের সরকার ৭০ বছরে কিছুই করেনি!
রাজীবের আমলেই টেলিফোন সেক্টরে বিপ্লব এসেছে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগ তাঁর হাত ধরেই এদেশে শুরু হয়। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার সূত্রপাতও হয় তাঁরই সময়ে। দেশের গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত টেলিফোনের সুবিধা আসে তাঁর আমলেই। তিনি চালু করে দেন পিসিও বা পাবলিক কল অফিস। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিপ্লব আসে রাজীবের আমলেই। কম্পিউটার, এয়ারলাইন্স, ডিফেন্স ও টেলিকমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন যন্ত্রের আমদানীর ওপর ট্যাক্স কম করে দিয়ে তিনি দেশে তা জনপ্রিয় করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর আমলেই রেলে আধুনিকীকরণের শুরু হয়। কম্পিউটার চালিত টিকিট বুকিং সিস্টেম তাঁর আমলেই শুরু হয়।
দেশে নাগরিক ভোটদানের বয়স ২১ থেকে কমিয়ে ১৮ বছর করেন রাজীব গান্ধী। এর জন্য তিনি সংবিধান সংশোধনও করেন। ফলে দেশের তরুণদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়।
গণতন্ত্রের সুবিধা তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে রাজীবের অবদান। তাঁর আমলেই পঞ্চায়েতি রাজ সিস্টেমের ভীত তৈরি হয়। ১৯৯২ সালে সংবধিান সংশোধন করে পঞ্চায়েতি রাজ চালু করা হয়। তবে তার ভীত আগেই তৈরি করে যান রাজীব গান্ধী।
রাজীব গান্ধীর আমলেই পাস হয় জাতীয় শিক্ষা নীতি। জওহর নবোদয় বিদ্যালয় তৈরি হয় এই জাতীয় শিক্ষা নীতি চালু করা হয়। গ্রামীণ এলাকা থেকে প্রতিভাধর ছেলেমেয়েদের তুলে আনার ক্ষেত্রে এইসব স্কুলগুলি যথেষ্টই কাজে দেয়। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিনা খরচে পাঠদানের ব্যবস্থা হয় ওইসব স্কুলে।
তবুও অপপ্রচার চলছে ৭০ বছর কিছুই হয়নি। দুঃখ লাগে যে সেই মিথ্যা প্রচার মানুষ বি়শ্বাসও করছে। দেশের অখণ্ডতা বজায় রাখতে, দেশের মানুষের রুটি-রুজির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং দেশকে আধুনিক করে গড়ে তুলতে গিয়ে দুটি প্রাণ চলে গেলো। এর পরেও প্রমাণ করতে হবে দেশপ্রেমিক কারা? স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা বৃটিশের দালালি করলো, ধর্মের নামে বিভাজন তৈরি করে যারা ভোট বৈতরনী পার করলো তারা আজ দেশপ্রমিক। জীবিত অবস্থায় নিজের নামে স্টেডিয়ামের নামকরণ করা তাও আবার সর্দার প্যাটেলের নাম কেটে তারা দেশপ্রেমিক? এমন দেশপ্রেমিকদের আমি অন্তত সম্মান করতে পারবো না।
৩১ শে অক্টেবর ১৯৮৪, ইন্দিরা গান্ধীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর আমরা ভেবেছিলাম বোধহয় প্রণব মুখার্জী অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হবেন। অতীতে এর একটি নজির ছিল। নানান গালগল্প বাজারে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সমস্ত গুজব যে একেবারেই গুজব সেটা প্রণববাবু তার স্বীকারোক্তিতে পরিষ্কার করে দিয়েছেন।
নিজের আত্মজীবনীতে প্রণববাবু সাফ করেছেন যে তিনি কখনো আপত্তি করেননি রাজীবের প্রধানমন্ত্রী হওয়াতে। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর কি তাঁর স্থানটি নিতে চেয়েছিলেন প্রণব মুখার্জী? মসনদ থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন ইন্দিরা পুত্র রাজীবকে? এই নিয়ে আছে অনেক বিতর্ক, অনেক জল্পনা। নিজের আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড ‘The Turbulent Years: 1980-1996’-এ এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, যে কোনও ভাবেই তিনি পদের জন্য ছোটেন নি। বরং প্রথম থেকেই তিনি রাজীবের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন।
কিন্তু তারপরেও হয় ভুল বোঝাবুঝি, দল ছাড়তে বাধ্য হন প্রণববাবু। তিন বছর পর অবশ্য ফের কংগ্রেসে যুক্ত হন তিনি। সেই দিনের স্মৃতিচারণায় প্রণববাবু বলেন, যে রাজীব উত্তরবঙ্গে জনসভায় ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন প্রণবও। তখনই খবর আসে ইন্দিরা গান্ধী গুলিবিদ্ধ। তখনই দিল্লির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন তাঁরা। বিমানেই জানা যায় ইন্দিরা গান্ধী মারা গিয়েছেন। ভেঙে পড়েন প্রণববাবু। কিন্তু অদ্ভুতভাবে শান্ত ছিলেন রাজীব গান্ধী। তখনই অন্যদের সঙ্গে রাজীব গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী হতে বলেন প্রণববাবু। আনকোরা রাজীব তখন তাঁকে বলেছিলেন, আমি কি পারব? প্রণববাবু তখন বলেন যে কোনও সমস্যা নেই, সবাই মিলে সাহায্য করা হবে।
এই অবধি ঠিক ছিল। কিন্তু দিল্লিতে গিয়েই হল সমস্যা। এর আগেও দুইবার অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। তাই অনেকেই ভাবছিলেন হয়তো এবারও সেরকম কিছু হবে এবং দায়িত্ব নেবেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। বকলমে ইন্দিরা ক্যাবিনেটে দুই নম্বরে ছিলেন প্রণব, অবশ্য এর বিরোধিতাই তিনি করেছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন এই কঠিন সময় সহজে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য রাজীবকেই দরকার। এমনকী রাষ্ট্রপতি জৈল সিংকে যে চিঠি পাঠানো হয় সেটাও তিনি ড্রাফট করে দিয়েছিলেন।
তবে কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টি (সিপিপি) ডাকার সময় নেই বলে কংগ্রেস পার্লামেন্টারি বোর্ডকে (সিপিবি) ডাকা হয়। সেখানেই আনুষ্ঠানিকভাবে রাজীব গান্ধীকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত করা হয় এবং সেই চিঠি পাঠানো হয় রাষ্ট্রপতিকে। সাধারণ সচিব মুপানারের সই করা চিঠিতে সম্মতি দেন প্রণব ও নরসিমা রাও।
সেই মুহূর্তে ওমানে ছিলেন তত্কালীন রাষ্ট্রপতি জৈল সিং। সেখানেই তাঁকে এই বিষয় বিস্তারিত বলার দায়িত্ব দেওয়া হয় অরুণ নেহেরুকে। এরপর নরসিমা রাও ও প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। সেখানে পূর্ব সাক্ষাত্কার নেওয়া ছিল না বলে রক্ষীরা তাদের প্রবেশ করতে দেয় নি প্রথমে। পরবর্তী সময় অবশ্য তাঁরা প্রবেশ করেন। অন্যদিকে জৈল সিং দেশে ফিরে এসে সোজা নিহত ইন্দিরা গান্ধীকে দেখতে এইমসে যান ও সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনে যান। সেখানে তাঁকে চিঠি তুলে দেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, মুপানার। জৈল সিং বলেন যে তিনি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রাজীব গান্ধীকে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানাবেন। সেদিনই সন্ধ্যাবেলা ৬:৪৫ মিনিটে চারজনের মন্ত্রীসভা নিয়ে শপথ নেন রাজীব। এরমধ্যে ছিলেন প্রণবও। একই সঙ্গে রাজীবেের শপথ ও ইন্দিরার মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রচার করা হয়।
সেদিনকার ঘটনা বিবৃত করে ইন্দিরার ঘনিষ্ঠ পিসি আলেকজান্ডার ও রাষ্ট্রপতি জৈল সিংয়ের স্মৃতিচারণার কথাও তুলে ধরেন প্রণববাবু। অরুণ নেহেরু চেয়েছিলেন উপরাষ্ট্রপতিকে দিয়ে শপথের কাজ করিয়ে নেওয়ার, যেহেতু জৈল সিং কোনও সমস্যা করবেন কিনা, সেই নিয়ে অরুণবাবুর মনে সন্দেহ ছিল। এই নিয়ে দলের মধ্যে একটা বিভাজন ছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জৈল সিংই প্রধানমন্ত্রীর শপথ পাঠ করান রাজীবকে।#