কয়েকদিন আগে “বর্তমান” কাগজে দেখলাম ছাত্রপরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসে প্রবীন নেতারা লিখবেন অতিতের কখা এবং সেইসাথে একালের অভিজ্ঞতার তুলনামুলক ও রাজনীতির যদি কোনো গুণগত তফাত এসে থাকে তার উপর আলোকপাত করবেন। তবে আমার মনে হয় সেকালের কথা লিখলে একালের সঙ্গে তফাৎ আপনিই নজরে আসবে, আলাদা করে আর একালের উপর আলোকপাত করার খুব একটা দরকার পড়বে না। আমার মধ্যে জাতীয়তাবাদের উণ্মেষ ঘটতে শুরু করে ১৯৬২ সালে, চিন-ভারত যুদ্ধের সময় থেকে। তখন আমার বয়স ৮ বছর। দেশের সীমান্তে চিন আমাদের সৈন্যদের খুব মারছে। আমার দেশের মাটি চিন দখল করে নিচ্ছে গায়ের জোরে। বড়দের মধ্যে এই বিষয়ে আলোচনা শুনে আমার মনের ভিতর আগুন জ্বলতো ভীষণ কষ্ট হতো মৃত সৈন্যদের কথা ভেবে। আমার দেশের জমি অন্য দেশ দখল করছে, আমার দেশের সৈন্যদের মেরে ফেলছে তার জন্য আমার মনের এই কষ্ট পাওয়ার অনুভুতিটাই যে “জাতীয়তাবাদ” সেটা বুঝেছি অনেক পরে। তবে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে ভারতের জয় আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল জাতীয়তাবাদের স্রোতে। কিন্তু পরে বুঝেছি এই যুদ্ধ কোনোদিন মানুষের মঙ্গল ডেকে আনতে পারে না।
কিছুদিন আগে অভিষেক ব্যানার্জী সারা বাংলায় একটি বক্তৃতা প্রতিযোগীতা সংগঠিত করেছিলেন। বারাকপুরের তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব সেই বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় আমাকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ করেছিল। তৃণমূল স্তর থেকে বক্তা তৈরি করার সেই প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে। বারাকপুরের বর্তমান তৃণমূল নেতৃত্ব আমার অতিত রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। সেই কারণে আমাকে বক্তৃতা প্রতিযোগিতার বিচারকের সম্মান দিয়েছিলেন। বারাকপুর তৃণমূল কংগ্রেসের বর্তমান নেতৃত্ব আমাকে যে সম্মান দিয়েছে সেই ঘটনাও আমাকে “রাজনীতর সেকাল আর একাল”-র এই কাহিনী লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে।
আমি খুব ভালো ছবি আঁকতাম লোকে বলতো। ছোটবেলায় পাবলো পিকাসোর সেই যুদ্ধ নয় শান্তির ছবি আমার মনে আজও গেঁথে আছে। পৃথিবীতে হিংসা আর তা থেকে জন্ম নেওয়া যুদ্ধের উন্মাদনা না থাকলে আজকের পৃথিবী কত সুন্দর হতো!
১৯৬৫ সাল পেড়িয়ে এসে পরলাম ৬৭-র খাদ্য আন্দোলনের যুগে। আমার বয়স তখন কেবল মাত্র ১৩ বছর। কংগ্রেস খুব খারাপ, বামপন্হীদের কাছ থেকে জেনে ছিলাম। স্বাভাবিক ভবেই স্কুলের গেটে বামেদের বক্তৃতায় আকর্ষিত হয়ে খাদ্য আন্দোলনের মিছিলে হেঁটেছিলাম। সামনে তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতৃত্ব, এস এ ডাঙ্গে, সোমনাথ লাহিড়ি, জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, বারাকপুরে রেনু চক্রবর্তী, সুরেনধর চৌধুরী। বিপক্ষে ইন্দিরা গান্ধী, রাজ্যে প্রফুল্ল সেনের মতো সৎ গান্ধীবাদী নেতৃত্ব। ওদিকে উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তী মিত্র-র মতো নাট্য ব্যক্তিত্ব। দেখতে দেখতে এসে পরলো ১৯৭০-র উত্তাল রাজনীতি, চারিদিকে হিংসার আবহাওয়া, শ্রেণীশত্রু খতমের রাজনীতিতে নিরীহ মানুষের রক্তের স্রোত দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পরলাম। মুক্তির উপায় খুঁজতে ঐ বয়সে শুরু করলাম রাজনীতি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা। চারিদিকে লাল রক্তের স্রোত তখন জমাট বেঁধে কালো হয়ে গেছে। রাজনীতির নামে এই নরহত্যা এবং রক্তের হোলি খেলার বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী। আবির্ভাব হলো প্রিয়-সুব্রত, নুরুল ইসলাম, নির্মলেন্দু ভট্টাচার্য, সোমেন মিত্রের মত যুব নেতৃত্বের। এসে পড়লো ১৯৭১ এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতিতে তখন বইতে শুরু করলো এক অন্য হাওয়া, ভারতবাসীর গর্বিত হওয়ার হাওয়া, পরিবর্তনের হাওয়া। মাত্র ১৬ বছর বয়সে আমিও ভাসলাম পরিবর্তনের সেই স্রোতে। শুরু হলো আমার লড়াই, তেরঙ্গা ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে। সেই যে পথ চলা শুরু করলাম আজও সেই পথে হেঁটে চলেছি বিরামহীন।
যেহেতু বামপন্হায় মশগুল ছিলাম তাই মনের ভিতর সেই আদর্শ গেঁথে গিয়েছিল। কংগ্রেসে বামপন্হা বরাবর ছিল। বামপন্হীদের অহঙ্কার ছিল একমাত্র তারাই পারে মানুষের কল্যাণ করতে। ১৯৬৯ সালে বামেদের সেই মিথ ভেঙ্গে দিলেন নেহরু কন্যা প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা। কংগ্রেসের ভেতর সংরক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে গিয়ে ব্যাংক জাতীয়করণ করলেন। তার আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভি ভি গিরি, সংরক্ষণশীলদের বিরোধীতা সত্বেও, বিবেক ভোটের ডাক দিয়ে গিরিকে জিতিয়ে এনে ভারতবর্ষের কংগ্রেসি রাজনীতির ধারা আমূল পাল্টে দিলেন লৌহমানবী ইন্দিরা। সমাজতান্ত্রিক পরিমণ্ডলের একচ্ছত্র অধিকার আর বামপন্হীদের হাতে থাকলো না, পালটে গেল মানুষের মন। ‘৭১ এর লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরার নব কংগ্রেস ৫১৮ টা আসনের মধ্যে ৩৫২ টা জিতলো। আর এখন মোদীজী ৫৪৫ টার মধ্যে ৩০০ আসন জিতেই ৫৬ ইঞ্চি দেখাচ্ছে, আজকের রাজনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে! সরকারের বিরুদ্ধে বললেই বিরোধীদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে জেলে বন্দী করা হচ্ছে হিংসার রাজনীতি দিয়ে রাজনীতিকেই কলুষিত করা হচ্ছে।
এবার ভারতবাসীর গর্বের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করার দিন এসেগেল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্বীকৃতি দিলেন সেই ছোট্টখাট্ট ইন্দিরা। ভারতবর্ষের মানুষ সেই প্রথম দেখলো মহা শক্তিধর দেশের রাষ্ট্রপতির চোখে চোখ রেখে কথা বলতে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও বিদেশ সচিব কিসিঞ্জারের সমস্ত হুমকি অগ্রাহ্য করে ইন্দিরা বলতে পেরেছিলেন হাজার হাজার মাইল দূর থেকে কোনো শক্তিধর দেশ আমাদের চোখ রাঙাবে আর আমরা তা সহ্য করবো না। আমাদের কি কর্তব্য তা আমরা ভালোই জানি। সেদিন ইন্দিরা গান্ধী দশ লাখ টাকার শাড়ি পরে নিক্সনের সামনে হাতজোড় করে দাঁড়ান নি বা স্টেডিয়াম ভাড়া করে কাউকে নমস্তেও করেন নি। ফিদেল কাস্ত্র ইন্দিরা গান্ধীকে বোন বলে জড়িয়ে ধরেছিলেন, আরাফাতও তাঁকে ভগ্নী বলে সন্মোধন করতেন। ইন্দিরা গান্ধী ভারতকে বিশ্বের দরবারে এক সম্মানজনক আসনে বসাতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের যে হাল ইন্দিরা গান্ধী করেছিলেন তার কাছে বালাকোটের স্যারজিক্যাল স্ট্রাইক নস্যি মাত্র। কিন্তু গদি মিডিয়ার প্রচারে এমন ভাব করা হয় যেন এর আগে পাকিস্তানের ভুখণ্ডে ঢুকে পাকিস্তানকে কেউ প্রহার করেনি। ভক্তরা কি জানেন না ৭১ এ লাহোর ভারতীয় সেনা বাহিনীর কামানের গোলার আওতায় ছিল?
দেখতে দেখতে এসে গেল ১৯৭২~এর বিধানসভা নির্বাচন। তখন আমাদের মতো যুবশ্রেণীর মানষিকতায় পরিবর্তন ঘটে গেছে। এরপরে ঢুকে পরবো আজকের রাজনৈতির গণ্ডির ভিতরে, সেখানেই বুঝতে পারা যাবে রাজনীতির সেকাল আর একালের ফারাক।
১৯৭১-নব কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলেও পশ্চিমবঙ্গে তখনও হুমকি আর হত্যার রাজনীতি অব্যাহত। সিপিএম, নক্সালের রক্তক্ষয়ী হত্যার রাজনীতিতে মানুষ বোবা হয়ে গেছে। বঙ্গে সেই সময় জোট সরকারের পতন হলো, হিংসা আরও বাড়ল। পশ্চিমবঙ্গকে ঐ রক্তক্ষয়ী অবস্হা থেকে টেনে তুলতে পদক্ষেপ নিলেন ইন্দিরা গান্ধী, জারী হলো রাষ্ট্রপতি শাসন।
বঙ্গে কংগ্রেসকে নেতৃত্ব দিতে চিত্তরঞ্জন দাসের নাতি সিদ্ধার্থশংকর রায়ের আবির্ভাব, সঙ্গে সেনাপতি প্রিয়, সুব্রত, সৌমেন, নুরুল, নির্মলেন্দুরা। আমার তখন বয়স মাত্র ১৭, পাড়ার মাস্টারমশাই আমার হাত ধরে আমাকে সক্রিয় রাজনীতিতে নিয়ে এলেন। এমনিতেই খুনের রাজনীতি চোখের সামনে দেখতে দেখতে ক্লান্ত মন মুক্তির উপায় খুঁজছিল। একরাশ আশঙ্কা নিয়ে ঐ ধ্বংসের রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হাতে তুলে নিলাম রঙতুলি, শুরু করলাম দেওয়াল লিখন। মা, দাদার অজ্ঞাতে প্রথম দেওয়াল লিখন বাড়ির অদুরেই একটি দেয়ালে। হাতে কেরসিন তেলের লম্ফ, প্রাচীরের দু পাশে দুটো মোম জ্বলছে। লেখা শুরু হতেই মিছিলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল আমার বাড়ির গলি থেকে- ‘কংগ্রেসের কালোহাত ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও।’ আমার হাত-পা থর থর করে কাঁপতে লাগলো। পিছনে তাকিয়ে দেখি আমার সঙ্গীরা জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। আমার পীঠ তখনও কাঁপছে। তবে মিছিল থেকে আমার উপর কোনো রকম আক্রমণ সেদিন হয়নি। মিছিলে যারা হাঁটছিল সিপিএমের যুব বাহিনী তারা আমার পরিচিত ছিলেন এবং আমাকে একটু অন্য চোখে দেখতো। ঐ সেকালের রাজনীতিতে আমার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছিলাম। মিছিল থেকে আমাকে কিছু বলা হলো না বটে তবে পরের দিন সকাল থেকে বামপন্হীতে বিশ্বাসী মানুষ জন আমাকে বোঝাতে শুরু করলেন কংগ্রেস কত বাজে কত অগণতান্ত্রিক দল! আমি মুখ বুজে সব সহ্য করলাম। কিন্তু সম্ভবত প্রিয়দার তৈরি করে দেওয়া একটি প্রচার ক্যাপশন “দুই বাংলার দুই পশু ইয়াহিয়া আর জ্যোতি বসু” দেওয়ালে লেখার সাথে সাথে সিপিএমের অন্য রুপ সামনে এলো। রাতের অন্ধকারে ঐ দেওয়াল লিখেছিলাম বলে রক্ষে ওরা সরাসরি আমাকে কিছু না বলে ঘুরিয়ে আমাকে হুমকি দিতে লাগলো, মায়ের কোল খালি করে দেবো হাত কেটে ফেলে দেবো। যারা ঐ হুমকি দিল তাদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই যারা বেঁচে আছেন তারা…
ঐ হুমকির ঘটনার পর আমি ন্যাড়া হয়ে নবদ্বীপে মামার বাড়ি চলে গেলাম। সিপিএমকে পর্যুদস্ত করে কংগ্রেস বাংলায় ক্ষমতায় এলো। নবদ্বীপ থেকে ফিরে দেখলাম, পাড়ায় এক অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। সিপিএমের যে পার্টি অফিসগুলো লোকজনে গম গম করতো সেগুলো সব পরিত্যক্ত অবস্হায় পরে আছে।
চলবে…