গাছটি দেখতে আদৌ নারিকেল গাছের মতো নয়, কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে সে-গাছেই ঝুলছে ছোট ছোট লম্বাটে-গোল নারিকেলের মতো ফল। দূর থেকে ডালে ডালে ঘন পাতার আড়ালে ফলগুলো দেখে প্রথম দৃষ্টিতে নারিকেলই মনে হবে। ঢাকায় টিএসসি চত্বরের গাছ দেখে এমনই মনে হয়েছে আমার। বুদ্ধনারিকেল নামটির সাথে বুদ্ধের যোগ আছে, পরম জ্ঞানের যোগ আছে। আবার একই গাছকে হিন্দিতে বলে ‘পাগাল পাত্তা’ বা ‘পাগল পাতা’ গাছ।
এই গাছের একই ডালের কোনো দুটো পাতা দেখতে একরকম হয় না, এই তথ্য সব গাছের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। গবেষণায় জানা যায়, কিছু গাছে এমন মরফোলজিকাল পরিবর্তন দেখা যায় যার বৈজ্ঞানিক কারণ এখনো অস্পষ্ট। কিছু উদ্ভিদবিদ এই পাগল-পাতা জাতের গাছকে নতুন প্রজাতি হিসাবে মানতে নারাজ, অন্যদিকে যারা মানছেন তারা বলতে চাইছেন এর প্রজাতি নাম Pterygota alata (Roxb.) R. Br. var. irregularis (W. W. Sm.) Deb & S. K. Basu. শেষোক্ত প্রজাতির পত্র-কাঠামোতে সুষ্ঠু জ্যামিতিক আচরণ বলে কিছু চোখে পড়ে না বলে এই আচরণকে পাগলামি ভাবা যায়। এই ভিন্নতা বেশ নৃতাত্ত্বিক মনে হয়, যেমন কেউ বেঁটে মঙ্গলয়েড, কেউ লম্বা নিগ্রয়েড, আবার কেউ মোটা হিস্পানিক, কেউ-বা ক্ষীণ এশিয়ান।
দেখতে নারকেলের মতো এবং গন্ধও অনেকটা সেরকম মনে হলেও, ভিতরে নারকেল বলতে যা থাকে তা অত্যন্ত ক্ষীণ। ফলের ভেতরে বিসরণের জন্য থাকে ভাঁজ করা পক্ষল বীজ যা জোর বাতাসে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে পড়ে। এই বীজের নেশাকর গুণাবলী আছে, কিছুটা আফিমের মতো, যা কেউ কেউ খেয়ে থাকেন।
কলকাতার বাজারে আগে উচ্চমূল্যে কোকোডুমের বা জোড়ানারিকেলের টুকরো শাঁস বিক্রি হতো। এখন আর কোকোডুমরের সেই ফল তেমন পাওয়া যায় না, যা এক সময় সেশেলস্ দ্বীপপুঞ্জ থেকে মালদ্বীপের সমুদ্রতটে ভেসে আসতো। বাজারে এখন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মুনাফার লোভে বুদ্ধ নারিকেলকেই জোড়ানারিকেল বা ‘দরিয়াই নারিয়ল’ নামে বিক্রি করেন। তারার মতো দেখতে বুদ্ধনারিকেলের ফুল খুব ছোট, যার পাপড়ি হয় না, বৃতিগুলোই (Sepals) দেখতে পুষ্পসম। স্টারকিউলেসিয়ি পরিবারের এই ছায়াদায়ী গাছটিকে হয়ত পরিপূর্ণ পত্রমোচী বলা যায় না কারণ পত্রমোচনের সময় বেশ কিছু পাতা রয়ে যায় গাছে।
বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে বুদ্ধনারিকেল (Pterygota alata) গাছ দেখা যায়। আছে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে, আসাম, পুনা, কর্ণাটক এবং তামিলনাড়ুতেও। এই গণের আগেকার নাম ছিল স্টারকিউলিয়া (Sterculia), লাতিন দেবতা স্টারকিউলিয়াসের নামানুসারে, বর্তমানে যা টেরিগোটা (Pterygota)। এই গণে বেশি গাছ নেই। মাদাগাস্কার, বোর্নিও, মালয়েশিয়া, চীন ও আফ্রিকা মিলিয়ে সন্ধান পাওয়া গেছে ২১টি প্রজাতির। এই গাছের কাঠ হালকা যা দিয়ে প্যাকিং বাক্স ও প্লাইউড তৈরি করা যায়। বীজ থেকে তৈরি হতে পারে উপাদেয় তেল এবং গাছের ছাল থেকে পাওয়া যায় শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যার ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক মূল্য আছে।
বুদ্ধনারিকেলের বয়স্ক গাছের গোড়ায় যে চ্যাপ্টা অধিমূল (Buttress) সৃষ্টি হয় তা বেশ চোখে পড়ার মতো, শিমুলের সঙ্গে যা কিছুটা তুলনীয়। ব্রাজিল-নাট, শিমুল বা বুদ্ধনারিকেল বৃষ্টিবনের সর্বোচ্চ স্তবক বা ইমার্জেন্ট লেয়ারের গাছ। এদের মাথা অন্য গাছের ক্যানপির উপর দিয়ে দেখা যায়। একটি গাছের বাট্ট্রেস বা অধিমূল সৃষ্টি হওয়ার পেছনে কিছু কারণ থাকে। যদি কোনো গাছ খোলা জায়গায় থাকে তাহলে বাতাসের চাপ সামলাতে গিয়ে এর অধিমূলের দরকার হয়। দ্বিতীয়ত, বৃষ্টিবনের ঘন ক্যানপির ফাঁক দিয়ে আলোর বন্দোবস্ত পেয়ে কোনো গাছ দ্রুত বেড়ে গিয়ে অন্য গাছের চেয়ে উঁচু হয়ে গেলেও বায়ুতাড়িত হতে পারে। তৃতীয়ত, বৃষ্টি বনের পুষ্টির সিংহভাগ যেহেতু মাটির উপরিভাগেই থাকে তাই কিছু মহীরুহের শিকড়ের বিস্তার ঘটে অধিমূলরূপে। অধিমূলের কোনাচে খাঁজে কিছু আবর্জনা জমে পচে যায় এবং তা থেকেও গাছ কিছু পুষ্টি পায়।
অধিমূলের বড় ধরনের আর কোনো ব্যবহার নজরে পড়ে না, কাঠামো মজবুত রাখা আর পুষ্টি সংগ্রহ ছাড়া। আমাজন বনের উপজাতীয় লোকেরা বড় অধিমূলের গায়ে মুগুর দিয়ে আঘাত ক’রে এক ধরনের দুমদুম শব্দ সৃষ্টি করে, দলীয় নিরাপত্তা ও আকস্মিক যোগাযোগের জন্য। এসব শব্দ সাংকেতিক, নিছক আঘাত নয়, এর একটি ভাষাও আছে যা কেবল আদিবাসীদের কাছেই বোধগম্য।
বুদ্ধনারিকেল গাছ বেশ লম্বা হয়, পুরনো গাছ ১৫০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। ভারত-বাংলাদেশে অধিকাংশ পুরানো গাছই কাটা পড়েছে। কলকাতা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল গার্ডেনে শতবর্ষী ক’টি গাছ এখনও আছে। এই গাছগুলোতে কিছু লুপ্তপ্রায় শকুন (Gyps benghalensis) বাস করে, যা তাদের অভয়ারণ্যের মতো। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, মেমোরিয়াল কর্তৃপক্ষ এদের বাসাবাড়ি তদারক করে, এমন কি বাচ্চা পড়ে গেলেও সুব্যবস্থা নেয়। গবাদিপশুর চিকিৎসায় এক সময় ডাইক্লোফেনাক ওষুধ ব্যবহার করা হতো যা শকুনের মৃত্যুর একটি বড় কারণ হয়েছিল। এখন মৃতের ভাগাড় নেই, শকুনের খাবার এবং বাসস্থান, দুটোরই অভাব।
বাস করার জন্য চিল শকুন ঈগল ইত্যাদি ভাস্পাখিদের জন্য চাই কমপক্ষে ৪০-৫০ ফুট উঁচু গাছ। এত উচ্চতায় বাস করার পেছনে কিছু অকাট্য যুক্তিও আছে। ভোরবেলা থেকে ভারী ভাস্পাখি উঁচু গাছের উপর ওড়ার অপেক্ষায় বসে থাকে। রোদের তাপ বেড়ে গেলে জমির উপরে ছোট ছোট ঘুর্ণিবায়ুর সৃষ্টি হয় এবং সেগুলোর মধ্যে যেটা আস্তানার পাশ দিয়ে যেতে থাকে সেটার উপরেই ডানা ভাসিয়ে দেয় পাখি। এরপর সারাদিন বিভিন্ন ঘুর্ণিবায়ুর উপরে চক্রাকারে ঘুরে বেড়ায়, সেখান থেকেই শ্যেনদৃষ্টিতে ভাগাড় খুঁজে নেমে যায় নিচে। ভরপেট খাওয়ার পরে কষ্ট করে উড়োজাহাজের মতো অনেকখানি দৌড়ে কোনোরকমে উড়ে যায় সনাতন আস্তানায়। কালিদাস রচিত ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ কাব্যে আমরা অনিন্দ্যসুন্দর ‘শকুন্তলা’ নামটি জানতে পারি যে নামটির সঙ্গে সম্পৃক্ত পৌরাণিক শকুন্ত, কিন্তু শকুনকে আমরা কদর্য বলি। প্রকৃতিবিদ ডারউইনও শকুন পাখিকে বলেছেন ‘ডিজগাস্টিং।’ এখন দিনবদলের সময় ঘনিয়েছে, বুদ্ধনারিকেল, শকুন ও চিল আমাদের বন্ধু হয়ে উঠছে।
ভারতীয় জরাথুস্ত্রবাদীরা মৃতমানুষকে রেখে আসে দেয়ালঘেরা খোলা ‘দাখমা’তে, যাকে হিন্দিতে বলে ‘চিলঘর’, ইংরেজিতে ‘টাওয়ার অব সাইলেন্স।’ এখানে মৃতদেহ জল-মাটি-হাওয়াকে নষ্ট করে না, চিল-শকুন সেগুলো ভক্ষণ করে। শকুনের সংখ্যা ৯৫ শতাংশ কমে যাওয়ার কারণে জোরাস্ট্রিয়ানদের সঙ্ঘ শকুন চাষ করতে সচেষ্ট হয়েছে যা কখনো সহজ কাজ নয়। ভাস্পাখিদের জন্য দূরত্ব কোনো বিষয় নয়, বড় বিষয় তাদের খাদ্য ও আস্তানা। মানুষের কারণেই তারা এখন বিপন্ন। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামান্য ক’টি বুদ্ধনারিকেল গাছকে আঁকড়ে ধরে গুটিকয় শকুন প্রাণপণে বাঁচার চেষ্টা করছে। সুখের বিষয়, এর সঙ্গে সহযোগী হয়েছেন কিছু হৃদয়বান প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষ, যাদের একজন রচনা করেছেন কষ্টের এক চরণ…
‘ক্ষমা করো ভাস্পাখি,
তোমার পালক লেখনী করেও আমরা লিখিনি কিছু…’