অনিরুদ্ধদা বললেন, কাল তোর কী কাজ আছে রে?
আমি বললাম, না না, তেমন কোনও কাজ নেই। কেন?
তিনি বললেন, তা হলে একটু দেবনারায়ণ গুপ্তের বাড়ি যাবি?
আমি বললাম, যাব। কথাটা বললাম ঠিকই, তবে তার পরেই ভাবতে লাগলাম, হঠাৎ দেবনারায়ণ গুপ্ত! সানন্দায় তখন যে সংখ্যার কাজ চলছিল, সেখানে ‘পক্ষে-বিপক্ষে’ বা ‘বিতর্ক’তে যে বিষয় আগে থেকে ঠিক করে রাখা আছে, সেটার সঙ্গে তো দেবনারায়ণ গুপ্তের কোনও সম্পর্ক নেই। তবে কি শেষ মুহূর্তে বিষয় চেঞ্জ হল, নাকি উনি কোনও পুরস্কার-টুরস্কার পেলেন! ‘বাবু-বিবি-সংবাদ’ হবে! হতে পারে! কিন্তু ওটা তো শঙ্করদা দেখেন।
শঙ্করদা মানে শঙ্করলাল ভট্টাচার্য। তিনি তখন সানন্দা’য় কাজ করেন। আর অনিরুদ্ধ ধর একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার। দীর্ঘদিন একটি সরকারি সংস্থায় অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উচ্চপদে কাজ করেছেন। কিন্তু সিনেমার প্রতি আর সিনেমা সংক্রান্ত লেখালেখির প্রতি তাঁর এমন ঝোঁক যে, অত টাকা মাইনের নিশ্চিন্ত চাকরি ছেড়ে অনেক কম টাকায় তিনি আজকাল পত্রিকায় যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে তখন গলায় গলায় ভাব পুরুলিয়ার ছেলে সিদ্ধার্থ সরকারের। যিনি পরে ই টিভি-র পূর্বাঞ্চল শাখার সর্বময় কর্তা হন।
শুনেছি, আনন্দবাজার গোষ্ঠী, এখন অবশ্য ‘গোষ্ঠী’ বলা হয় না। বলা হয় ‘সংস্থা’, তারা ‘সানন্দ’ নামে একটি পত্রিকা বের করার পরিকল্পনা নেয়। সম্পাদক হিসেবে ভাবা হয় সন্তোষকুমার ঘোষের নাম। কিন্তু তাঁর প্রয়াণে সেই পত্রিকার পুরো খোলনলচেটাই পাল্টে যায়। এমনকী, নামটা পর্যন্ত। ‘সানন্দ’ থেকে হয়ে যায় ‘সানন্দা’। এবং সেটি হয় শুধুমাত্র মেয়েদের কাগজ। সম্পাদক হন অপর্ণা সেন। তিনি আবার তাঁর পছন্দের কিছু লোককে সেই পত্রিকায় নিয়ে আসেন। সেই তালিকায় প্রথম নামটি ছিল আজকাল পত্রিকার রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সেই রঞ্জনদা আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসেন আরও দু’জনকে। তার একজন অনিরুদ্ধ ধর। আর অন্য জন সিদ্ধার্থ সরকার।
বলতে গেলে সে সময় অনিরুদ্ধদাই কাগজটা দেখভাল করতেন। আরও অনেকের সঙ্গে ছিলেন সুদেষ্ণা রায়ও। যিনি পরে প্রতিদিন-এ জয়েন করেন। পরে সেটাও ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি অভিনয় আর চলচ্চিত্র পরিচালনায় নেমে পড়েন।
যে দফতরে এতগুলো লোকের ছায়াছবি অন্তর্গত প্রাণ, যাঁদের বস অপর্ণা সেনের মতো স্বনামধন্য একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী কাম সফল চিত্রপরিচালক, তাঁরা নিজেরা কোনও ছবি বানাবেন না, এমনটা কি হয়? হয় না। তাই তাঁরা ঠিক করলেন, দূরদর্শনের জন্য একটি সিরিয়াল বানাবেন। না, তখন দূরদর্শন ছাড়া আর অন্য কোনও চ্যানেল ছিল না। কিন্তু কী নিয়ে সিরিয়াল বানাবেন তাঁরা? কীসের ওপরে?
তখন উত্তমকুমার মারা গেছেন মাত্র কয়েক বছর। সেই শোক মিছিলে আমিও ছিলাম। প্রত্যেক বাড়ির ছাদে ছাদে লোক। শববাহী গাড়ির পিছনে জনস্রোতের শেষ যে কোথায়, কেউ জানে না। যত দূর চোখ যায়, শুধু মানুষ আর মানুষ। মনে আছে, মেট্রোরেলের কাজের জন্য তখন রাসবিহারী মোড়ে আট-দশ তলা বাড়ির সমান একটা লোহার স্ট্রাকচার দাঁড় করানো ছিল। যে কোনও সময় বিপদ ঘটতে পারে জেনেও তাতে গিজগিজ করছিল লোক। শুধুমাত্র উত্তমকুমারকে এক ঝলক দেখার জন্য। আনন্দবাজারের তৎকালীন চিফ-ফটোগ্রাফার তারাপদ ব্যানার্জি সেই দৃশ্য ধরে রাখার জন্য যে ক’টা রিল খরচ করেছিলেন আমি জানি না। তবে হ্যাঁ, মোবাইলে কিন্তু কেউ একটাও ছবি তুলতে পারেননি। কারণ, তখনও বাজারে মোবাইলই আসেনি। পর দিন শুনেছিলাম, মহানায়কের শেষ ছবি তোলার জন্য নাকি তারাপদদা শুধু ইলেকট্রিক চুল্লির ভিতরে ঢুকতে বাকি রেখেছিলেন। শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথের পরে নাকি এত বড় শোকমিছিল উত্তমকুমারের দৌলতেই আবার চাক্ষুষ করল এই শহর।
তো, অনিরুদ্ধদা প্রথমে ঠিক করেছিলেন উত্তমকুমারকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানাবেন। মোটামুটি আশ্বাস পাওয়া গিয়েছিল, সরকারি সাহায্য মিলবে। কিন্তু কিছু দিন পরে বোঝা গেল, ওটা শুধু আশ্বাসই। ফাঁকা আওয়াজ। আসলে কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে না। অগত্যা সবাই যখন টাকার অভাবে হাত-পা গুটিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছেন, ঠিক তখনই প্রযোজনা করতে এগিয়ে এলেন গায়ক ইন্দ্রনীল সেনের দাদা ইন্দ্রজিৎ সেন। ঠিক হল, তথ্যচিত্র নয়। তাঁরা সিরিয়াল বানাবেন। কিন্তু উত্তমকুমার তো বেঁচে নেই, কী ভাবে বানাবেন! ঠিক হল, যাঁরা যাঁরা তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন, সেই সব অভিনেতা-অভিনেত্রী, ক্যামেরাম্যান, লাইটম্যান, স্পটবয়, মেকাআপম্যান, ড্রেসার, আত্মীয়স্বজন, কাছের মানুষ থেকে দূরের মানুষ— মোদ্দাকথা, তাঁর সঙ্গে যাঁর যাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাঁদের সাক্ষাৎকার-ভিত্তিক ধারাবাহিক হবে এটি। মাঝে মাঝে ঢুকবে তাঁর অভিনীত নানান ছবির নির্বাচিত অংশ, স্থিরচিত্র, তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র, ঘরবাড়ি মায় সব কিছু।
এই সিরিয়ালেই প্রথম অভিনয় করতে আসেন অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী। পরে যিনি ছবি পরিচালনায় হাত দেন এবং ‘অন্তহীন’, ‘অনুরণন’-এর মতো ছবি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। ছিনিয়ে নেন দেশ-বিদেশের প্রচুর পুরস্কার। অভিনয় করেন নাটকের অশোক মুখোপাধ্যায়ও।
আমরা তখন সানন্দায় ফ্রিল্যান্স করি। আমি, শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি পরে সানন্দার চিফ সাব-এডিটর হন এবং তারও পরে এইচ এম ভি-র জনসংযোগ আধিকারিক। কিছু দিন অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যবসায়িক সংস্থার দেখভাল করতেন। এই মুহূর্তে একটি জনপ্রিয় সিরিয়ালের উপদেষ্টা। ছিলেন মিকি। মানে বাল্মিকী। বাল্মিকী চট্টোপাধ্যায়। তিনি কিছুকাল আনন্দলোকের সিনিয়র সাব-এডিটর ছিলেন।বিয়ে করেছিলেন অভিনেত্রী মৌমিতাকে। ওঁর মেয়ে রিমঝিম তো এখন রীতিমতো নায়িকা। ছিলেন মণিশংকর দেবনাথ। যিনি পরে ই টিভি-তে জয়েন করেন। তারও পরে বাংলা স্টেটসম্যানে।
তখন পত্রিকা দফতরগুলো এ রকম কর্পোরেট হাউসের মতো ছিল না। ছিল একান্নবর্তী পরিবারের মতো। সিদ্ধার্থদার বিয়ে দেওয়ার জন্য সহকর্মীরাই উঠেপড়ে লেগেছিলেন। চাঁদা তুলে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন খবরের কাগজে। অজস্র চিঠি এসেছিল। সুদেষ্ণাদি আমাকে বলেছিলেন, সিধু, তুই এই মেয়েগুলোকে দেখে, আগে পাঁচটা মেয়ে পছন্দ কর। তার পরে আমরা সেই পাঁচটা মেয়েকে দেখে একটা পাত্রী ঠিক করব।
আমি সল্টলেকের করুণাময়ীতে প্রথম যে পত্রীটিকে দেখতে গিয়েছিলাম, তার বাড়ি থেকে আমাকে প্রচুর খাইয়েছিল। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমি এমনিতেই ভীষণ খেতে ভালবাসি। আর তখন খেতেও পারতাম। সানন্দা থেকে পর পর কয়েক বছর বনভোজন হয়েছিল। পুরো ব্যবস্থাটাই করতেন রিনাদি, মানে অপর্ণা সেন। একবার ফিরে আসার সময় দেখি, দু’হাঁড়ি দই আর ষাট-সত্তর পিস ভাজা মাছ বেচে গেছে। সেটা একটা বড় পলিপ্যাকে ভরছি দেখে অনিরুদ্ধদা বললেন, ওগুলো কি নিয়ে যাবি নাকি? ধ্যাত, খেয়ে নে, খেয়ে নে।
ও দিকে বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। ঘন ঘন হর্ন দিচ্ছে। সবাই সবাইকে বাসে ওঠার জন্য ডাকাডাকি করছে। কিন্তু কেউই উঠছে না। সবাই এ দিকে ও দিকে জটলা পাকিয়ে গল্পে মশগুল। আমি সঙ্গে সঙ্গে মাছগুলোকে চটকে, তার কাঁটাগুলো ফেলে দিয়ে তার মধ্যে দইয়ের হাঁড়ি দুটো উপুড় করে ঢেলে, ঝপাঝপ করে মেখে ঝটপট খেয়ে নিয়েছিলাম। কোথাও কোনও প্রেস কনফারেন্স থাকলে ওঁরা বলতেন, সিধু, তুই তো খেতে ভালবাসিস, তুই যা।
তা, সিদ্ধার্থদার পাত্রী দেখতে গিয়ে সল্টলেকের ওই বাড়ি থেকে এমন খাইয়েছিল যে, ফিরে এসে সুদেষ্ণাদি-অনিরুদ্ধদাদের বলেছিলাম, পাঁচটা নয়, একটাই দেখেছি। এবং এর সঙ্গেই সিদ্ধার্থদার বিয়ে দেওয়া উচিত। হয়তো ভেবেছিলাম, সিদ্ধার্থদার ওখানে বিয়ে হলে মাঝে মাঝেই যাওয়া যাবে এবং এ রকমই খাবার-দাবার পাওয়া যাবে। তা যাই হোক, সুদেষ্ণাদি-অনিরুদ্ধদা এবং ডিপার্টমেন্টের আরও কয়েক জন গিয়ে পাত্রীকে দেখে এলেন। তাঁদেরও পছন্দ হল এবং তড়িঘড়ি করে বিয়েও হয়ে গেল।
ঠিক সে সময়ই একদিন অনিরুদ্ধদা আমাকে দেবনারায়ণ গুপ্তের বাড়ি যাবার কথা বলাতে আমার মনে হয়েছিল, নিশ্চয়ই সানন্দার কোনও লেখার ব্যাপারে তাঁর বাড়ি যেতে হবে। তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম, বড় ইন্টারভিউ নাকি?
অনিরুদ্ধদা বললেন, না রে, উত্তমকুমারকে নিয়ে যে ধারাবাহিকটা করছি, তাতে তো দেবনারায়ণ গুপ্তের একটা দৃশ্য আছে, আমরা পরশু শট নিতে চাই। উনি সে দিন সময় দিতে পারবেন কি না, আর দিলে মোটামুটি কী বলবেন, তার একটু জিস্ট নিয়ে আয়।
তখনই শুনেছিলাম, স্টার থিয়েটারে দেবনারায়ণবাবুর সঙ্গে উত্তমকুমারের নাটক করার কথা। দেবনারায়ণবাবু স্টার থিয়েটারের সিঁড়িতে বসে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা। তাঁর সঙ্গে অভিনয়ের অভিজ্ঞতার কথা। প্রতিটি জায়গা দেখিয়ে দেখিয়ে স্মৃতিচারণ করছিলেন, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা চা খেতাম। এখানে বসে আড্ডা মারতাম। একদিন ও আমাকে এই বলেছিল, তাকে সেই বলেছিল। কত কথা! ক্যামেরা অন করা ছিল। প্রতিটি শট নেওয়া হচ্ছিল। না, পুড়ে যাওয়ার পরে নয়। ভেঙে নতুন করে তৈরি হওয়া এই স্টার থিয়েটারে নয়। পুরনো স্টার থিয়েটারে।
এই ফাঁকে একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। তখন এত কিছু ভেবেচিন্তে করা হতো না। সাক্ষাৎকারের শ্যুটিং চলাকালীন সিদ্ধার্থদা বললেন, কয়েকটা স্টিল ছবি তুলে রাখতে পারলে ভাল হতো। সঙ্গে সঙ্গে অনিরুদ্ধদা বললেন, সিধু, একটা কাজ কর তো… এই স্টার থিয়েটারের পাশের গলি দিয়ে ঢুকে দেখবি সামনেই ডান হাতে সাদা রঙের একটা বাড়ি। তার দোতলায় সোজা উঠে যাবি। গিয়ে দেখ তো অরুণ আছে কি না… থাকলে ক্যামেরা নিয়ে এক্ষুনি আসতে বল।
অরুণ মানে অরুণ চট্টোপাধ্যায়। এক সময় সর্বাধিক বিক্রিত সাপ্তাহিক ‘পরিবর্তন’-এ কাজ করতেন। দারুণ ছবি আঁকতেন। পরে এই উত্তমকুমার ধারাবাহিকের ছবি তোলার সূত্র ধরেই সানন্দা দফতরে যাতায়াত এবং ঘনিষ্ঠতা। ফলে, এই বুড়ো বয়সেও তাঁর চাকরি হয় সানন্দায়। সেই গল্প অবশ্য আলাদা। তো, তিনি এসে ছবি তোলা শুরু করলেন এবং সে দিনই ঠিক হয়ে গেল, এ বার থেকে তিনিই এই ধারাবাহিকের ছবি তুলবেন।
এ ভাবেই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল ভারতী দেবীর। তিনি তখন চলৎশক্তিহীন। তাঁর ঘরের খাটে বসেই তিনি বলেছিলেন অনেক কথা। এখনও মনে আছে গেঁথে আছে ক’টি শব্দ— ‘ওই নাটকে উত্তম আমার ছেলে হয়েছিল। নাটকে মা ডেকেছিল দেখে সারাটা জীবনই ও আমাকে মা ছাড়া আর অন্য কিছু ডাকেনি। মায়ের মতোই ভক্তি করত। শ্রদ্ধা করত।’
আমাদের ওই ধারাবাহিকের স্ক্রিপ্ট লিখছেন মূলত অনিরুদ্ধদা, সিদ্ধার্থদা আর কিছুটা শিবাশিস। আর স্ক্রিপ্ট লেখার নানা মালমশলা, মানে তথ্য জোগাড় করে আনতাম আমি, বেহালা চৌরাস্তার অরুণ গাঙ্গুলি এবং আরও কয়েক জন। শিবাশিসের একটা পকেট টেপ রেকর্ডার ছিল। সেটা নিয়ে একবার গেলাম সুমিত্রা চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি। তিনি তখন খুবই অসুস্থ। তাতেও তিনি যা বলেছিলেন, সেটা মনে পড়লে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। যখন উত্তমকুমারের হার্ট অ্যাটাক হয়, তখন তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পুরো ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। কার কোন কথার জোরে হঠাৎ করেই এমন বিপর্যয় ঘটেছিল, তিনি তা অকপটে বলেছিলেন। বলেছিলেন, উত্তমকুমার মরেননি। তাঁকে মারা হয়েছে। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। আমার কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন। সেই কথাবার্তা বহু দিন পর্যন্ত টেপ-বন্দি ছিল। বহু লোককে আমি সেটা শুনিয়েও ছিলাম। যাঁরা শুনেছিলেন, প্রত্যেকেই চমকে উঠেছিলেন। কারণ, তিনি সেই মহিলা অভিনেত্রীর নামটাও নির্দ্ধিধায় বলেছিলেন।
উত্তমকুমারকে নিয়ে ওই ধারাবাহিকটি বানাতে গিয়ে কত লোকের সঙ্গে যে আমরা মিট করেছিলাম! তখন সানন্দায় কাজ করতেন নিবেদিতা দে। থাকতেন উত্তমকুমারের বাড়ির খুব কাছেই। ওই বাড়ির সঙ্গে ওদের বেশ যাতায়াত ছিল। ও-ই আমাদের নিয়ে গেল উত্তমকুমারের ভবানীপুরের বাড়িতে। ঢুকতেই দেখি, বাড়ির সামনে শ্বেত পাথরের উপরে লেখা— সুহৃদ সংঘ। উত্তমকুমারকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আগেই জেনেছিলাম, তাঁদের পারিবারিক নাট্যদলের কথা। সেই নাটকের দলের নাম ছিল সুহৃদ সংঘ। এত দিন বাদেও যে সেটা থাকবে, ভাবতে পারিনি। উত্তম-পুত্র গৌতম আমাদের উপরে নিয়ে গেলেন। ঘরের ভিতরে সিলিং থেকে ঝুলছিল দোলনা। সোফা-টোফা ছেড়ে আমি আর অনিরুদ্ধদা সেখানে গিয়ে বসলাম। কথা হচ্ছিল। গৌতম বলছিলেন, বাবার কাছে আমার কখনও কিছু বায়না করতে হয়নি। যেটা চাইব বলে ভাবতাম, তার আগেই বাবা সেটা নিয়ে আসতেন।
হঠাৎ কথায় কথায় অনিরুদ্ধদা জিজ্ঞেস করলেন, আপনার গাড়িটার অবস্থা ও রকম ভগ্নদশা কেন?
কথাটা শুনে এক মিনিট থমকে গেলেন গৌতম। তার পরে থেমে থেমে বললেন, সম্পত্তি নিয়ে এখনও মামলা চলছে। নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কিচ্ছু করতে পারব না। না হলে নতুন একটা গাড়ি কিনতে কী আর এমন লাগে! কথাটা উনি বলছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর চোখমুখ দেখে আমার মনে হচ্ছিল, তিনি বিব্রত। কোথায় যেন একটা খোঁচা লেগেছে।
এর ক’দিন পরে, ও বাড়িতে বসেই তরুণকুমারের একটা কথা শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম। চল্লিশ পয়সা থেকে এক লাফে দশ পয়সা বেড়ে, বাস ভাড়ার প্রথম ধাপ পঞ্চাশ পয়সা হওয়ায়, যখন আমি ভাবছিলাম, এ বার পয়সাকড়ি জমিয়ে একটা পুরনো সাইকেল কিনতে হবে, না হলে আর পারা যাবে না, তখন কোলের উপরে লোমওয়ালা সাদা ফুটফুটে একটা ছোট্ট কুকুরছানাকে আদর করতে করতে তিনি কিনা বললেন, একটা মানুষের বেঁচে থাকতে গেলে এটুকু লাগেই। একটা গাড়ি আর অন্তত দুটো অ্যালসেশিয়ান পোষার মতো আর্থিক সঙ্গতি। তাঁর কথা শুনে আমার মনে হয়েছিল, তিনি মহানায়কের ভাই হতে পারেন, বড় অভিনেতাও হতে পারেন, কিন্তু এই পৃথিবী সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণাই নেই।
ওই সিরিয়ালের কাজ করতে গিয়ে এ রকম বহু লোকের বহু কথা আমি শুনেছি, যা এত দিন পরেও আমার মনে গেঁথে আছে। কে নেই সেই তালিকায়? সরযূবালা দেবী, ছায়া দেবী, অনুপ কুমার, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, অগ্রদূত থেকে শুরু করে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মৃণাল সেন। আরও কত জনের সঙ্গে যে কথা বলেছিলাম, এখন আর মনে নেই। সে যাই হোক, প্রত্যেক দিন শ্যুটিং শেষ হলেই আমরা চলে যেতাম ৭৬ নম্বর রফি কিদওয়াই রোডের চিত্রবাণীতে। সেখান এডিটিং হতো। খাওয়া-দাওয়া হতো। এখানে একটা কথা বলে রাখি, আমি আর শিবাশিস ছাড়া এটা কেউ জানে না। অনিরুদ্ধদা একদিন আমাদের বললেন, যাকেই খাওয়া-দাওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হোক না কেন, তিনি তো তার থেকে দু’-চার পয়সা লাভ রাখবেনই। ফালতু ফালতু অন্য লোককে পয়সা দিতে যাব কেন? তোরা কেউ দায়িত্ব নে। যা হবে, তোদের হবে।
আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি আনব। কিন্তু শুধু আনলেই তো হবে না। বিলও বানাতে হবে। তখন পাড়ায় পাড়ায় এ রকম ডিটিপি সেন্টার ছিল না। তখনও লেটার প্রেসের যুগ। ছাপিয়ে ফেললাম কয়েক পাতার একটা বিল বই। নাম দিয়েছিলাম, তখন যার সঙ্গে প্রেম করতাম, তার নামে— ভারতী ক্যাটারার।
অনিরুদ্ধদা বললেন, শোন, আমাদের বাজেট কিন্তু খুব কম। তিরিশ-পঁয়তিরিশ টাকার মধ্যে প্লেট করবি। আমি আর শিবাশিস খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলাম, কোথায় কত কম দামে বিরিয়ানি পাওয়া যায়। যেখানেই যাই, দেখি তিরিশ-বত্রিশ-পঁয়তিরিশের নীচে কোথাও কিছু নেই। তা হলে আর আমাদের থাকবে কী? বিল ছাপার খরচই তো উঠবে না! তখন আমাদের মাথায় একটা বুদ্ধি এল। ঠিক করলাম, চিকেন বা মটন নয়, আমরা বিফ-বিরিয়ানি দেব। মানে গরুর মাংসের বিরিয়ানি।
একটা মুসলিম দোকান ফিট করলাম। কূড়ি টাকা প্লেট। বেশি নিলে আঠেরো টাকা করে দেবে। অথচ দোকানের নাম— তাজ হোটেল। তখন আলিপুর চিড়িয়াখানার উল্টো দিকে সদ্য সদ্য তাজ বেঙ্গল হয়েছে। কেউ কেউ ওই নামের সঙ্গে এই নামটি গুলিয়ে ফেলতেই পারেন। কেউ জিজ্ঞেস করলে আমরা অনায়াসেই বলতে পারি, তাজ থেকে এনেছি। কেউ তো আর সার্ভে করতে যাবে না— তাজ বেঙ্গল, না তাজ হোটেল!
ফলে, আমরা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। এবং অবাক কাণ্ড, কেউ তো কিছু বুঝতেই পারল না, উপরন্ত সবাই চেটেপুটে খেতে লাগল। বলল, বিরিয়ানিটা দারুন তো! কোথা থেকে এনেছিস? পারলে, কালকেও এখান থেকেই আনিস। তাই শুধু তার পর দিনই নয়, তার পরে যত দিন কাজ হয়েছিল, আমরা ওই বিরিয়ানিই সাপ্লাই করেছিলাম।
আমাদের এই কাজে সব রকম সহযোগিতার জন্য যেমন হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী থেকে উত্তমপ্রেমী অত্যন্ত সাধারণ মানুষজন। বাড়ির একটা বড় অংশ শ্যুটিং জোন হিসেবে ফিতে দিয়ে ঘিরে রাখার জন্য, সদ্য বিয়ে করা বউকে পর্যন্ত বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সিদ্ধার্থদা। বউ-ছেলেমেয়ে-বাড়ি ছেড়ে অনিরুদ্ধদা থাকতে শুরু করেছিলেন আমাদের সঙ্গে।
সকাল হলেই আমি সবার জন্য গরম জল বসিয়ে দিতাম স্নানের জন্য। তার ক’দিন আগেই সানন্দার কভার স্টোরি ‘রান্নার পঞ্চাশটি টিপস’ লিখে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন দেখে রান্নার ভার পড়েছিল শিবাশিসের উপরে। ও প্রায়ই আলু আর ডিমের একটা ঝোল করত। সেদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়াতাম আমি।
একদিন শিবাশিস বলল, তোকে আর ডিম ছাড়াতে হবে না, যা। আমি ছাড়িয়ে নেব। তখনই জানলাম, ডিম ছাড়াতে ছাড়াতে খোসার সঙ্গে উঠে আসা ডিম খেতে খেতে আমি নাকি মাঝে মাঝে গোটা ডিমও মুখে পুরে নিই। রোজই একটা-দুটো করে কম পড়ে। গত কাল নাকি পুরো চার-চারটে ডিম কম পড়েছিল।
শুধু এই ধারাবাহিকটা তৈরি করার জন্য আমরা প্রায় প্রত্যেকেই অনেক কিছু জলাঞ্জলি দিয়েছিলাম। বহু লোক বহু ভাবে বিনা স্বার্থে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তেমনই আবার বিরোধিতাও করেছিলেন কেউ কেউ। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, লাভের টাকাটা কে নেবে?
লাভ! আমরা তো সে কথা একবারও ভাবেনি। আমরা তো কাজের আনন্দে কাজ করছি। সানন্দায় লিখে দুটো পয়সা পাই। এই কাজ করতে গিয়ে সেটাও বন্ধ। এ কথা অনিরুদ্ধদাকে বলতেই তিনি বললেন, একটা কাজ কর, তোরা গল্প লেখ। গল্প লেখার জন্য তো তোদের কোথাও যেতে হবে না। কারও ইন্টারভিউও নিতে হবে না। ঘরে বসে লিখবি। সিধু, তুই বাড়ি ফিরে আজ রাতেই একটা গল্প লিখে ফেল। কাল সকালে অফিসে দিয়ে দে।কম্পোজে পাঠিয়ে দেব। তা হলে এই সংখ্যাতেই ওটা ধরানো যাবে। আমি তো অবাক। লিখি কবিতা। গল্প লিখতে হবে! ঠিক আছে, তা-ই লিখব। লিখেও ফেললাম। ছাপা হয়ে গেল সানন্দায়। তার পরেই যত ঝামেলা। যে দিন পত্রিকাটি বেরোল, সে দিন বিকেল থেকেই কাগজ উধাও। কোনও স্টলে আর সানন্দা পাওয়া যাচ্ছে না। পর দিন আমাদের এলাকার এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা তাঁর লোকজন নিয়ে এসে আমাদের বাড়িতে চড়াও হলেন। আমাকে মারধোর করলেন। আমি নাকি তাঁকে নিয়ে গল্প লিখেছি। গল্পের যে চরিত্রটি দলবল নিয়ে মধ্যরাত অবধি রেশন দোকানের ভিতরে ঢুকে, শাটার নামিয়ে মদ্যপান করেন, নীল ছবি দেখেন, সেটা নাকি আসলে তিনিই। যে নেতার মদতে বিভিন্ন এলাকার উঠতি ছেলেপুলেরা পাড়ার মুখে জটলা পাকিয়ে আড্ডা মারতে মারতে মেয়েদের উত্যক্ত করে, সেই নেতা নাকি আসলে তিনিই। যে নেতার চেলাচামুণ্ডাদের নাজরানা না দিয়ে বাড়িতে একটা ইটও কেউ ঘাঁথতে পারে না, সেই নেতা নাকি আসলে তিনিই। আমি নাকি তাঁর পিছনে স্পাইগিরি করে এই গল্প লিখেছি।
যতই বলি, আমি আপনার সম্পর্কে কিচ্ছু জানি না। যদি আপনার সঙ্গে এই গল্পের কোথাও কোনও মিল হয়ে থাকে, সেটা সম্পূর্ণ কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে। আমার কোনও দোষ নেই। আমাকে ছেড়ে দিন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! চড়চাপড়, ঘুসি, লাথি, চুলের মুঠি ধরে টানা, সিগারেটের ছ্যাঁকা— সবই চলতে লাগল। টানতে টানতে নিয়ে গেল উল্টো ফুটপাথের একটি নির্মীয়মান বাড়িতে।
ওরা যখন নেশায় মশগুল, আমি তখন ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তিন তলা থেকে কোনও রকমে পাইপ বেয়ে নেমে এলাম নীচে। সামনের একটি বুথে ঢুকে প্রথমেই ফোন করলাম সুদেষ্ণাদিকে। তিনি বললেন, লোকাল থানায় একটা ডায়েরি করে অফিসে চলে আয়।
পর দিন সকালে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় বড় করে ছাপা হল সেই খবর— ‘লেখক প্রহৃত, কংগ্রেস কাউন্সিলর ধৃত’। দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ছ’কলাম জুড়ে পুরো ঘটনার বিবরণ। সক্কালবেলায় স্থানীয় আর এক নেতার সঙ্গে আমার বাড়ি এসে হাজির মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বললেন, একদম ভয় পাবে না। তুমি আমার ছোট ভাইয়ের মতো। দরকার হলে, আমার লোকজন তোমার বাড়ি পাহারা দেবে। দেখি, তোমার গায়ে কে হাত দেয়।
এর কয়েক দিন পরেই ছিল রাখী পূর্ণিমা। তিনি আমাকে রাখী পরিয়ে গেলেন। পরে আরও কয়েকটি গল্পের সঙ্গে সেই গল্প দীপ প্রকাশন থেকে বই আকারে বেরোয়। বইটির নাম দিই ওই গল্পটির নামেই— ‘বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল’। সেই গল্পের নাট্যরূপ দিয়ে একটি নাট্যদল মঞ্চস্থও করতে থাকে বিভিন্ন মঞ্চে।
খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে বাছুর কিনে। আমার অবস্থাও তাই। লিখছিলাম দু’-একটা ফিচার। মাঝে-মধ্যে কবিতা। গল্প লিখতে গিয়ে এ কী ঝঞ্ঝাট! আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা রুজু হল পাঁচ কোটি টাকার। আমার সঙ্গে সঙ্গে এক কোটি করে মামলা হল বিভাগীয় প্রধান সুদেষ্ণা রায়, মুদ্রক এবং প্রকাশক বিজিৎকুমার বসু, সম্পাদক অপর্ণা সেন আর ওই পত্রিকার সর্বময় কর্তা অরূপ সরকারের নামে। প্রসঙ্গত জানাই, সেই মামলায় অবশ্য আমাকে এক পয়সাও খরচা করতে হয়নি। পুরো মামলাই লড়েছিল আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষ।
যদি এই সিরিয়ালে কাজ করতে না আসতাম, তা হলে তো আর গল্প লিখতে হতো না। কোনও ঝামেলাতেও জড়াতে হতো না। আমাদের লসের পর লস হচ্ছে, আর তিনি বলছেন কিনা লাভের টাকাটা কে নেবে!
এই সময় নানা কারণে দূরদর্শনের লাল ফিতের গেরোয় বাঁধা পড়ে গেল আমাদের কাজ। বড়রা সবাই ছুটে গেলেন। দূরদর্শনের লোকজনদের অনেক বোঝানো হল। কিন্তু তাঁরা অনড়। একে ধরা হল, তাকে ধরা হল। কিন্তু কোনও লাভ হল না। বহু টালবাহানার পরে মাঝপথে বন্ধ করে দিতে হল উত্তমকুমারকে নিয়ে তথ্যবহুল কোনও কিছু তৈরি করার প্রথম সাধু উদ্যোগ। মাঠে মারা গেল আমাদের সমস্ত শ্রম, সমস্ত স্বপ্ন।
তার পর আর উত্তমকুমার নয়, ইউ জি সি-র গ্র্যান্ট পেয়ে আমরা তৈরি করলাম কলকাতার মেট্রোরেল নিয়ে প্রথম তথ্যচিত্র— মেট্রোরেল। কিন্তু অতটা কাজ হয়ে যাওয়ার পরেও শেষ পর্যন্ত উত্তমকুমারকে নিয়ে ওই ধারাবাহিকটি শেষ করতে না পারার শোক আমাদের, অন্তত আমাকে এখনও কুরে কুরে খায়। জানি না, রিল-বন্দি করা সেই দুর্লভ ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোর ক্যাসেট কার কাছে আছে! আদৌ আছে কী!