।।এক।।
শীতকাল। দুপুর বেলা। বুক অবধি লেপ দিয়ে ঢেকে বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিল ইচ্ছেকুঁড়ি। বইটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘চরিত্রহীন।’ দেহের ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। শরীরটা ভেঙে গেছে। দেহে সেরকম জোর পায় না। তার সঙ্গে যে এরকম ঘটনা ঘটবে, সেটা সে ভাবতেই পারেনি। কারও সাথে কোনও ঝগড়া নেই, শত্রুতা নেই, তবু এমন জঘন্য ঘটনায় খুব কষ্ট পাচ্ছিল এবং সে মনে মনে ভাবছিল, আমি কোন অন্যায় করিনি, কোনও অপরাধ করনি, তবুও কেন আমার জীবনে এমন কুৎসিত ঘটনা ঘটল! মা প্রায়ই বলত, একা একা কোথাও যাস না। দিনকাল ভালো না। রাস্তাঘাটে ছেলেরা খুব বিরক্ত করে। সুযোগ পেলে বদমাশ ছেলেরা শ্লীলতাহানি, এমনকি বাজে ঘটনা পর্যন্ত ঘটাতে পারে। তাই সব সময় সাবধানে চলাফেরা করতে হবে, বাধ্য না হলে কোথাও একা যাওয়ার ঝুঁকি নেওয়া সঠিক নয়।
কস্ত্তরী বৌদি বাড়ি ঢুকল। জোরে ডেকে বলল, ইচ্ছকুঁড়ি ঘরে আছিস? ইচ্ছেকুঁড়ি ছবি আঁকে। ঘরের একপাশে রঙ, তুলি, আর্টপেপার, পেন্টিংবোর্ড, ইজেল বা ক্যানভাস স্ট্যান্ড ছবি আঁকার সব ধরনের উপকরন রয়েছে। দরজা ভেজানো ছিল। ইচ্ছেকুঁড়ি বিছানায় শুয়ে থেকেই বলল, বৌদি, ঘরে এসো।
কস্ত্তরী বৌদি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। এই ঘরে একাই থাকে ইচ্ছেকুঁড়ি। মেঝে পাকা, ঘরের দেয়াল পাকা। ঘরটির ওপরে খাঁড়া টিনের চাল। টিনের নিচে বাঁশের চাটাইয়ের ছাদ। টিন ও দেওয়াল, চাটাই এবং দেওয়ালের মাঝখানে অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে।
কস্ত্তরী বৌদি ঘরে ঢুকে সোফার ওপর বসল। কাঁধের ব্যাগটা সোফার একধারে রেখে জিজ্ঞাসা করলো, কেমন আছিস?
উত্তরে ইচ্ছকুঁড়ি বলল, ভালো নয়। মনের মধ্যে সবসময় ভয় তাড়া করছে। রাতে ঠিকমতো ঘুমোতে পারছি না। শরীরটা দুর্বল লাগছ। মাঝে মধ্যেই আঁতকে উঠছি।
কস্ত্তরী বৌদি ইচ্ছকুঁড়ির পিসতুতো দাদার বউ। ইচ্ছেকুঁড়িকে খুব ভালোবাসে। দূরে হরিরামপুরে বাড়ি।
কখন ঘটেছিল ঘটনাটা? কস্ত্তরী বৌদি প্রশ্ন করল।
রাত আটটার সময়। বলল ইচ্ছেকুঁড়ি।
ছোট টর্চ ছিল না তোর কাছে?
না, টর্চ নিয়ে যাইনি।
মোবাইলের টর্চ ব্যবহার করতে পারতিস?
মোবাইলেরর চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল।
রাস্টার ল্যাম্পপোস্টে ইলেকট্রিক লাইট জ্বলছিল না?
না, লোডশেডিং চলছিল।
ছি, ছি, ছি- রাতের অন্ধকারে কেউ চলে? কস্ত্তরী বৌদি মুখমণ্ডলে ভীষণ বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠেছে।
ইচ্ছেকুঁড়ি বলল, বৌদি, সে সময় ঘন অন্ধকার ছিল না, আবছা অন্ধকার।
বৌদি বলল, ঘন অন্ধকার হোক আর আবছা অন্ধকার হোক- যত রকমের খারাপ কাজ এখন রাতের অন্ধকারের মধ্যে হয়। কিন্তু জানিস ইচ্ছেকুঁড়ি, রাতের আঁধারের একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। সেই সৌন্দর্যকে উপভোগ করার জন্য উপযুক্ত মন ও যোগ্য চোখ থাকা দরকার। বাজে লোকেরা রাতের অন্ধকারের সেই রূপকে তৃপ্তি সহকারে ভোগ না করে রাতের আঁধারের অপব্যবহার করে তারা। রাতের অন্ধকারকে করে তোলে বিভীষিকাময়। গড়গড় করে এক নাগারে কথাগুলো বলল কস্ত্তরী বৌদি।
ইচ্ছেকুঁড়ির মা এসে দাঁড়াল। মনটা খুব খারাপ। বলল, আমি ওকে বলেছিলাম, বাইরে যাচ্ছিস, বলা যায় না রাত হতে পারে, তাই সঙ্গে একটা টর্চ নিয়ে যা। আমার কথা শোনেনি। ও বলেছিল, মা রাত হবে না, টর্চ লাগবে না। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
ইচ্ছেকুঁড়ির বাবা ঘরে এল। চোখে মুখে একরাশ বিষণ্ণতা। চেয়ার টেনে নিয়ে কাছে বসল। বলল, কথায় বলে সাবধানের মার নেই। আমি ওকে সাবধান করেছিলাম- কোথাও একা একা যাওয়া-আসার ব্যাপারে। মেয়ে আমার সাবধানে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু সাবধানে আসতে পারেনি। কথাগুলাও বলে বাবা মাথা নিচু করল।
এবার মায়ের রাগ গিয়ে পড়ল বিদ্যুত দপ্তরের ওপর। বলল লোডশেডিং হলো আলো-ব্যবস্থার কলঙ্ক। কিছু বাজে মানুষের জন্যে যেমন সমস্ত পাড়ার দুর্নাম হয়, তেমনই কয়েক ঘন্টার লোডশেডিং সমগ্র বিদ্যুত ব্যবস্থাকে কলুষিত করে।
বাবা বলল, রাস্তার পথ-বাতি মানুষের সাথে ছলনা করে। বোধহয় ছলনা করে ভীষণ মজা পায়। পথ-বাতিগুলো ধপ করে জ্বলে ওঠে, আলোর প্রলোভন দেখায়, লোককে রাস্তা দিয়ে চলার উৎসাহ জোগায়, লোকজনকে ঘর থেকে বাইরে বের করে আনে, তারপর ধপ করে নিভে গিয়ে মানুষকে চরম বিপদের মধ্যে ফেলে দেয়।
কস্ত্তরী বৌদি জিজ্ঞেস করল, কোথায় ঘটেছিল ঘটনাটা?
ইচ্ছেকুঁড়ি বলল, গলির মধ্যে।
আঁতকে উঠল কস্ত্তরী বৌদি। বলল, গলির মধ্যে! সর্বনাশ! গলি আকারে ছোট হলেও অনেক বড় বড় জঘন্য ঘটনা গলির মধ্যে ঘটে। গলি খুবই বিপজ্জনক জায়গা হয়ে উঠছে!
ইচ্ছেকুঁড়ি বলল, মেইন রাস্তা ধরে এসে আমাদের বাড়ি আসার গলি। আবছা অন্ধকার গলি। ধীর পায়ে এগোচ্ছিলাম। কিছুটা দূরে পরিত্যক্ত ভাঙা ইটের দেওয়াল। দেওয়াল লাগোয়া ঝোপ। ঝোপের আড়ালে ওৎ পেতেছিল লম্পটটা। দেওয়ালের কাছে আসতেই আমার পায়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল বদমাশটা- ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ইচ্ছেকুঁড়ি।
বাবা-মা দু’জনে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগল। ইচ্ছেকুঁড়ি বলতে লাগল, আমি একদম আঁচ করতে পারিনি। আগাম একটুও টের পাইনি। যদি সামান্য বুঝতে পারতাম দেওয়ালের ওখানে ঝোপের আড়ালে কেউ লুকিয়ে আছে, তাহলে আমি সামনের দিকে আর এগোতাম না। দৌড়ে ফিরে আসতাম। আমার এই বুঝতে না পারার পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে ওই লম্পট দুর্বৃত্তটা।”
কস্ত্তরী বৌদি জিজ্ঞেস করল, চিৎকার করে লোক ডেকেছিলি?
আমি ‘বাঁচাও’, ‘বাঁচাও’ বলে চিৎকার করেছিলাম। আমার চিৎকার বোধহয় কেউ শুনতে পায়নি। কেউ আসেনি আমাকে রক্ষা করতে- বলল ইচ্ছেকুঁড়ি।
এখনকার দিনে বেশিরভাগ লোক নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কেউ কারও খোঁজ রাখে না। কারও বিপদে কেউ এগিয়ে যায় না । দুনিয়াটা স্বার্থপর হয়ে গেছে। বলল কস্ত্তরী বৌদি।
বৌদি জিজ্ঞেস করল, তারপর কী হয়েছিল?
ইচ্ছেকুঁড়ি বলল, কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই বদমাশটা আমার দু’পায়ের মধ্যে ঢুকে আমার ডান পায়ে খুব জোরে কামড় দিয়ে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল। প্রাণ বাঁচাতে আমিও সজোরে লাথি মেরেছিলাম হারামজাদাটাকে। আমি টের পারছিলাম, আমার ডান পা দিয়ে রক্ত ঝরছে। আমার মনে হয়, আমার পায়ের লাথির আঘাতে ওই বর্বর, দুষ্কৃতিটার অবস্থাও নিশ্চয়ই খুব খারাপ।
।।দুই।।
দিন পনেরো আগে ইলোরা এসে ইচ্ছেকুঁড়িকে বলেছিল, ইচ্ছেকুঁড়ি, চল, ‘আইরা ফরেস্ট’ থেকে ঘুরে আসি। সপ্তপদী, ওদের ওখানে ফরেস্টে যাওয়ার জন্য খুব করে ধরেছে।
ইচ্ছেকুঁড়ি, ইলোরা ও সপ্তপদী তিন বান্ধবী। সপ্তপদীর বাড়ি মহিপালে। ওখান থেকে কিছুটা দূরে আইরা ফরেস্ট। এই আইরা ফরেস্টে শীতের সময় লোকেরা পিকনিক করতে আসে। ফরেস্টের মাঝে রয়েছে একটি পুকুর। পুকুরে নৌকা রাখা আছে- যাতে পর্যটক’রা নির্দিষ্ট ভাড়া নিয়ে নৌকাবিহার করতে পারে। পুকুরের চারদিকে রয়েছে খড়ের চাল দেওয়া বসার জায়গা। মাঝে গোলটেবিল। অন্য ঋতুতে এখানে নিরিবিলিতে বসে সময় কাটানো যায়। ইচ্ছেকুঁড়ি রাজি হয়ে গিয়েছিল।
মা বলেছিল, না, না। পাকুয়াহাট থেকে আইরা ফরেস্টের দূরত্ব প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার। অতদূর যাওয়া হবে না।
আর বাবা বলেছিল, মেয়েদের স্বাধীনভাবে চলতে দিতে হয়। মেয়েদের নিয়ে বেশি ভয় করলে এখন আর চলে না। ওদেরও তো আনন্দ করতে ইচ্ছে করে। আর সঙ্গে তো ওর বান্ধবী ইলোরা ও মহীপালের বান্ধবী সপ্তপদী থাকছেই।
সকালবেলা ইচ্ছেকুঁড়ি ও ইলোরা পাকুয়াহাট থেকে বাস ধরে ডিটলহাট মোড়ে অটো ধরে সোজা মহিপাল দিঘি বাসস্ট্যান্ডে এসে নামল। সেখানে আগে থেকেই সপ্তপদী ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। মহিপাল বাস স্ট্যান্ড থেকে টোটো ধরে তিনজন মিলে অল্প সময়ের মধ্যে আইরা ফরেস্টেএসে পৌঁছলো। ওইদিন ফরেস্টে বহুলোক পিকনিক করতে এসেছিল।
বিকেল অবধি আইরা ফরেস্টে পিকনিক করা লোকজন দেখে, পুকুরে নৌকাবিহার করে, আশপাশ ঘুরে, গোলটেবিল আর খড়ের চালের বসার জায়গায় তিন বান্ধবীতে বসে আনন্দে গল্পগুজব করতে করতে কাটিয়ে দিয়েছিল। তারপর টোটো ধরে তিন বান্ধবী মহিপাল বাস স্টান্ডে ফিরে এসেছিল। সেখান থেকে অটো ধরে ইচ্ছেকুঁড়ি ও ইলোরা ডিটলহাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল। ওখান থেকে ওদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে নিজ গন্তব্য রওয়ানা দিল সপ্তপদী।
অটোটি বেশি যাত্রী নিয়ে ফেলেছিল। তার ওপর রাস্তা খারাপ। তাই অটোটি ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল। দুর্ঘটনার ভয়ে বেশি জোরে চালানোর কথা বলাও যাচ্ছিল না। এক ফাঁকা জায়গায় এসে অটোটি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। গাড়ি সারায় করতে বেশ কিছুটা সময় চলে গিয়েছিল। ডিটলহাট মোড়ে আসতে প্রায় সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে বাস ধরে পাকুয়াহাট বাস স্ট্যান্ডে পৌছাতে রাত সাড়ে সাতটা বেজে গিয়েছিল। মাঝপথ থেকে ইলোরা অনুমতি নিয়ে নিজ বাড়ি্র দিকে রওয়ানা দিল।
এদিকে ইচ্ছেকুঁড়ি টোটো ধরে ওর বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিল। ইচ্ছেকুঁড়ির বাড়ি মেইন রাস্তা থেকে অনেকটা পথ গলি ধরে যেতে হয়। টোটো ধরে মেইন রাস্তা অবধি পৌঁছেছিল সে। সেসময় গলিতে পথ-বাতি জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল। টোটোওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে গলির রাস্তা দিয়ে আসছিল। গলির একেবারে শেষ মাথায় ইচ্ছেকুঁড়ির বাড়ি। সরু গলি। তিনটে মানুষ পাশাপাশি যেতে অসুবিধে হয়। বড় গাড়ি ঢুকতে পারে না গলিতে। বিদ্যুতের আলোতে গলি ধরে অনেকটা পথ চলে এসেছিল ইচ্ছেকুঁড়ি। এরমধ্যেই হঠাৎ করে লোডশেডিং। গলির ভেতরটা তখন আবছা অন্ধকার। ওর কাছে যে মোবাইলটা ছিল, তার চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। টর্চও ছিল না ওর কাছে। অন্ধকার গলির মধ্যে একা সে। সামনে গেলে অন্ধকার, পেছনে ফিরলেও অন্ধকার। সামনে অর্থাৎ বাড়ির দিকে এগোনোকেই শ্রেয় মনে করেছিল ইচ্ছেকুঁড়ি। আস্তে আস্তে সাবধানে পা ফেলে এগোচ্ছিল সে। এভাবেই বেশ কিছুটা পথ চলে এসেছিল। সামনে ছিল পুরনো ভাঙা ইটের দেওয়াল। দেওয়ালের পাশেই ছিল একটা ঘন ঝোপ । ধীরে ধীরে পা ফেলে ইটের দেওয়ালের ওখানে যেতেই ছোট আকারের নরম দেহের একটা কিছু পায়ের মধ্যে এসে প্রবেশ করেছিল। দুটো পায়ের মধ্যে ঢুকে ল্যাটর প্যাটর শুরু করেছিল। ল্যাটর প্যাটর স্বভাব, ছোট আকার, নরম দেহ ও জ্বলজ্বল দুটি আলো বিন্দু দেখে ইচ্ছেকুঁড়ি বুঝেছিল, প্রাণীটি বিড়াল। কোন কিছু করার আগেই বিড়ালটি খ্যাঁক করে ওর পায়ে কামড় দিয়েছিল। সেও ছাড়েনি, জোরেকষে একটা লাথি মেরেছিল বিড়ালটিকে। লাথির আঘাতে বিড়ালটি পাশের বাড়ির দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে অন্ধকারের মধ্যে দ্রুত পালিয়ে গিয়েছিল।
পড়িমড়ি করে অন্ধকারের মধ্যে একদৌড়ে বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিল ইচ্ছেকুঁড়ি। দেখেছিল, ক্ষতস্থান দিয়ে রক্ত ঝরছিল। মা দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করেছিল, ” কী হয়েছে? পা দিয়ে রক্ত ঝরছে কেন? হাঁপাচ্ছিস কেন?
ইচ্ছকুঁড়ি উত্তর দিয়েছিল, মা, তীরে এসে তরী ডুবে গেল।
উৎকণ্ঠিত স্বরে মা বলল, মানে?
ইচ্ছেকুঁড়ি বলল, মা, আমি অতদূরে আইরা ফরেস্টে গেলাম, ওখানে থাকলাম, পাকুয়াহাট বাস স্ট্যান্ডে ফিরে এলাম, কিন্তু কিছুই ঘটল না। অথচ আমাদের বাড়ির একদম কাছে গলির মধ্যে একটা বিড়াল আমার পায়ের মধ্যে ঢুকে আমার পায়ে কামড়ে দিয়েছে, দাঁত বসিয়ে দিয়েছে।
বাবা তড়িঘড়ি করে ডাক্তার ডেকে নিয়ে এসেছিল। ডাক্তার এসে ওষুধ দেবার পরে পা থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হল। এরপরে ডাক্তারবাবু ডিপথেরিয়া রোগ প্রতিরোধের ইনজেকশন পুশ করে দিয়েছে। ডাক্তারবাবু বলল, বাড়িতে কুঁড়ি–পঁচিশ দিন সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। বিড়াল কামড়ানোর দাগ ইচ্ছেকুঁড়ির পায়ে এখনও স্পষ্ট।
।।তিন।।
ইচ্ছেকুঁড়ির মা চা নিয়ে এল। কস্ত্তরী বৌদি চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, “ইচ্ছকুঁড়ি, তুই অন্ধকারের মধ্যে চলছিলি, দোষটা কিন্তু তোর।” ইচ্ছেকুঁড়ি বলে উঠল, “অসম্ভব। আমার সামান্যতম দোষ নেই। সম্পূর্ণ দোষ ওই বিড়ালের। বিড়াল রাতেরবেলা আবছা আঁধারে খুব ভালোভাবে দেখতে পায়। বিড়ালের দুটো চোখ মুখমণ্ডলের অনেকটা বাইরের দিকে থাকায় দুটো চোখ-ই একসঙ্গে কাজ করে। একটি চোখের দৃষ্টি অপর চোখের দৃষ্টিক্ষেত্রের ওপর এসে পড়ে ঠিক বাইনোকুলারের মতো। ফলে বিড়াল আবছা অন্ধকারে পরিষ্কার দেখতে পায়। আবার বিড়ালের চোখে ‘ট্যাপেটাম লুসিডাম’ নামে আয়নার মতো প্রতিফলক স্তর থাকায় অন্ধকারে ভালোভাবে দেখতে পায়। অপরদিকে মানুষের চোখে ‘ট্যাপেটাম লুসিডাম’ থাকে না এবং মানুষের চোখ দুটো মুখমণ্ডলের ভেতরে থাকায় মানুষ আবছা অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে পায় না। তাহলে আবছা অন্ধকারের মধ্যে আমি একটা মানুষ আসছিলাম, এটা দেখতে পেয়ে বিড়ালটির উচিত ছিল আমার চলার রাস্তার মধ্যে না আসা। সেটা না করে বিড়ালটি আমার পায়ের মধ্যে এসে ঢুকে পড়েছিল। পায়ের মধ্যে ল্যাটর–প্যাটর করছিল। আমার কোনও দোষ নেই। আমি পুরোপুরি নির্দোষ।”
কস্ত্তরী বৌদি অভ্যেসমতো চায়ের মধ্যে বিস্কুট ডুবিয়ে বিস্কুট খেতে খেতে বলল, “জানিস ইচ্ছেকুঁড়ি, বিড়াল খুব আদুরে প্রাণী। যখন খুশি তাকে কোলে নিয়ে আদর করা যায় আবার যখন খুশি ক্যাত করে একটা লাথিও মারা যায়। বিড়ালকে ইচ্ছেমতো লাথি মারা গেলেও ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে। প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে দেবী বাস্টের সাথে জড়িয়ে আছে বিড়ালের নাম। বাস্টের মন্দির বুবাস্টিসে শতাধিক বিড়ালের মন্দির রয়েছে। মানুষের মতো সসম্মানে সমাধিস্থ করা হয়েছে ওদের ওখানে।
আমাদের দেশে বিড়াল কিন্তু ষষ্ঠীদেবীর বাহন। মিশরীয়রা বিড়ালের দেবী বাস্টকে খুব ভয় করত ও পুজো করত। বিড়ালকে নরডিক দেবী ফ্রেয়া’র বাহনও বলা হয়। ফ্রেয়া জাদুর দেবী। অর্থাৎ জাদুর সাথে বিড়ালের সম্পর্ক রয়েছে। আবার এই জাদুই ডাইনিদের কাছে ব্ল্যাক –ম্যাজিক রূপ ধারণ করেছে। সেখানেও বাহন হিসেবে এক ও অদ্বিতীয়ভাবে হাজির বিড়াল। আবার মৃত মানুষের আত্মার সাথে বিড়ালের সম্পর্ক রয়েছে। বিড়াল ‘রহস্যময় প্রাণী।’
কস্তুরী বৌদি আবার চায়ের কাপে চুমুক দিল। বলল, “জানিস ইচ্ছেকুঁড়ি, আবদ্ধ ঘরের ভেতর বিড়াল ভয় পেয়ে প্রথমে লুকোয়। কিন্তু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সে মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিড়ালের কিন্তু একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। বিড়াল খুব সহজে বাড়ি চিনতে পারে। গাড়ি করে বিড়ালকে দূরে কোথাও ছেড়ে আসলেও বাড়ি চিনে সে ঠিক চলে আসে। তবে আকারে, শক্তিতে ও গতিতে বাঘের সমতুল্য না হলেও কেন যে বিড়ালকে ‘বাঘের মাসি’ বলে সেটা আমার বোধগম্য হয় না।”
কস্তুরী বৌদি এবার আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “সুযোগ পেলে বিড়াল অঢাকা গরুর দুধ খেয়ে ফেলে, মাছ ভাজা খেয়ে ফেলে। ভাজা মাছ একবার মুখের এদিকে নেয়, আর একবার ওদিকে নেয়। কখনও পেটের দিকে কামড় দেয়, কখনও বুকের দিকে কামড়ে দেয়। মাছকে একবার এদিকে ওল্টায়, আরেকবার ওদিক ওল্টায়। কখনও লেজের দিকে, কখনও মাথার দিকে কামড়ায়। কড়মড় শব্দে মজা করে খায়। বিড়ালের মাছ ভাজাখাওয়া একটা আর্ট। একটা শিল্প। তবে দোষ কিংবা গুণ যেটাই বলা যাক না কেন বিড়ালের একটা স্বভাব হলো, বিড়ালকে উঠতে দিলে বসতে চায়, বসতে দিলে শুতে চায়।”
চা শেষ করে চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর রাখল কস্ত্তরী বৌদি। ব্যাগটি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বলল, “আজ আসি। ভালো থাকিস, নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিস।” কস্ত্তরী বৌদি চলে গেল।
।।চার।।
দিনের পৌঢ়কাল এল। ভোরবেলা সূর্য ওঠার সাথে সাথে দিনের জন্ম হয়; সন্ধেবেলায় সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে দিনের সমাপ্তি ঘটে। সকালবেলা হলো দিনের শৈশবকাল, দুপুরবেলা দিনের যৌবনকাল, আর বিকেলবেলা দিনের পৌঢ় কাল। দিনের এই পৌঢ়কালে যুবতী ইলোরা সাইকেল চালিয়ে যুবতী ইচ্ছেকুঁড়ির বাড়ি এল। বাবা বলল, “ইলোরা, তোর বান্ধবীকে ভালো করে বোঝাস, ইনজেকশন নেওয়া হয়ে গেছে, তাই ডিপথেরিয়া রোগ হওয়া নিয়ে আর ভয়ের কিছু নেই।” ইচ্ছেকুঁড়ি ও ইলোরা অন্তরঙ্গ বান্ধবী। মা বলল, “ইচ্ছেকুঁড়ির মনের মধ্যে আতঙ্ক গেঁড়ে বসেছে। তুই ওর প্রিয় বান্ধবী। ওর সঙ্গে কথা বলে তুই-ই পারবি তাড়াতাড়ি ওকে স্বাভাবিক করে তুলতে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বাবা-মা’কে কথা দিয়ে বান্ধবীর ঘরে ঢুকল ইলোরা। “আয়, আয়, পাশে এসে বস ” বলল ইচ্ছেকুঁড়ি। ইলোরা বিছানায় উঠে ইচ্ছেকুঁড়ির কাছে গিয়ে বসল।
ইচ্ছেকুঁড়ি খুব জেদি মেয়ে। সে ছাড়বার পাত্রী নয়। ওই বিড়ালটি কোন বাড়ির- এই বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিল ইলোরার ওপর। বিড়াল তার- নোংরা, পা দিয়ে মাটি তুলে মাটি দিয়ে ঢেকে রাখে। মনে করে, কেউ তার–নোংরাকে দেখতে পাবে না অথচ সকলে তা দেখতে পায় । এমন নির্বোধ, বোকা, ছোট একটা প্রাণীর কাছে মানুষ হয়ে হেরে যাওয়াকে ইচ্ছেকুঁড়ি কোনো মতেই মেনে নিতে পারছিল না। খোঁজ নিয়ে কয়েকদিন আগে ইলোরা এসে প্রিয় বান্ধবীকে জানিয়েছিল, এই পাড়াতে কারও বাড়িতে বিড়াল নেই। তবে ইদানীং অনেকে একটা বিড়ালকে পাড়ার এদি্কে ওদিকে ঘুরতে দেখেছে। চকালো কুচকুচে গায়ের রঙ। চোখ দুটো বাদামি। বাঁ’ পা খোঁড়া। তবে কার বাড়ির বিড়াল কেউ তা জানে না। কোনও কিছু বোঝার আগেই বিড়ালটি অদৃশ্য হয়ে ।
ইলোরা আরও একটু এগিয়ে ইচ্ছেকুঁড়ির একদম কাছে গিয়ে বসল । ইলোরা ঘাড় ঘোরাতেই চমকে উঠল। দেখল, ইজেলে পেইন্টিং বোর্ডে ক্লিপ দিয়ে লাগানো আর্ট পেপারে আঁকা একটি ছবি। ছবিটি একটি কালো বিড়ালের। তবে ছবিটিতে কালো বিড়ালটির চোখ এখনও আঁকা হয় নি। ইলোরা অবাক হয়ে বান্ধবীর দিকে তাকাতে ইচ্ছেকুঁড়ি বলল, “ছবিটি আমিই এঁকেছি। এটি সেই বিড়াল যে বিড়াল আমার পায়ের মধ্যে ঢুকে আমাকে আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছে। ওর চোখ আঁকিনি আমি। ওকে আমি অন্ধ করে রেখেছি।”
তারপর ইলোরাকে জিজ্ঞেস করল, “বল , নতুন কোনও খবর বল।” ইলোরা বলল, “অনেক খোঁজ করে জানলাম, তোকে যে বিড়াল কামড়েছে, সেটা হলো প্রবাহ সরকারের বাড়ির বিড়াল। কালো রঙ এবং বাঁ পা খোঁড়া। বাদামী চোখ। এখান থেকে চারটে পাড়া পেরিয়ে পশ্চিম পাড়ায় প্রবাহ সরকারের বাড়ি। প্রবাহ সরকারের কলেজ পড়ুয়া ছেলে প্রবাহনীল সরকারের পোষা বিড়াল এটা। বিড়ালটি প্রবাহনীলের পাশে শুয়ে থাকে। সে দেখভাল করে বিড়ালটির।” ইলোরা খানিকটা থেমে আবার বলল, “তোকে বিড়ালটি কামড়েছে এটা জানার পর প্রবাহনীল বিড়ালটি নিয়ে দূরে তার পরিচিত কারও বাড়ি অন্য জায়গায় চলে গেছে। কোথায় গেছে পাড়াপড়শি কেউ জানে না। আরও জানতে পারলাম, মাস দুয়েকের আগে প্রবাহনীল বাড়ি ফিরবে না। এদিকে পরিস্থিতি ঠান্ডা হওয়ার পরই সে বাড়ি ফিরবে।”
বাবা-মা’র কথামতো ইচ্ছেকুঁড়িকে বেশ করে বোঝাল, এরপরে ইলোরা চলে গেল।
।।পাঁচ।।
রাতের বেলা বেশ ঝাঁকিয়ে শীত নামলো। ইচ্ছেকুঁড়ি হলুদ কভার দেওয়া লেপ দিয়ে শরীর ঢেকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। রাত এগারোটা বাজে। শীতের রাত, এগারোটা মানে অনেক রাত। বাইরে একদম নিঝুম, নিস্তব্ধ। থমথমে। বাইরে কোনও লোক চলাচল নেই। লোকের কোনও কোলাহল নেই। ঘন্টা তিনেক আগেও দূরে যে গম ভাঙানো মিলটা ঘট ঘট শব্দ করে শীতকে উপেক্ষা করছিল, সেটিও শীতে কাবু হয়ে মাথায় বালিশ দিয়ে শুয়ে পড়েছে। পাখি, পশু, মানুষ সবাই ঘরে ঢুকে গেছে। আর ঘরে ঢুকবেই বা না কেন? এই কনকনে ঠান্ডায় কেউ কী বাইরে বের হয়? আর বাইরে থাকাটাও কী সম্ভব? অনেক শক্তিশালী মানুষও এই শীতে বাইরে বেরোনোর ইচ্ছে পোষণ করবে না।
পাশের ঘরে বাবা-মা ঘুমিয়ে পড়েছে। ইচ্ছেকুঁড়ির ঘরের ভেতর জিরো পাওয়ার বাল্বের আবছা অন্ধকার। পাশে শরৎচন্দ্রের ‘চরিত্রহীন’ বইটি রয়েছে। এই ঘরটাই ইচ্ছেকুঁড়ির পড়া, থাকা, শোওয়ার ঘর। ওর মা দুপুরবেলায় লেপ রোদে গরম করতে দিয়েছিল। শীতের রাতে গরম লেপের ভেতর দারুন আরাম লাগে। বেশ কটা উষ্ণ উষ্ণ ভাব। শরীর গরম হয়ে ওঠে। ছেলে হোক বা মেয়ে হোক- লেপের এমন উষ্ণ গরমে সকলে বলে ওঠে, আহ, কি আরাম! কি মজা! ইচ্ছেকুঁড়ির মুখ দিয়েও বেরিয়ে গেল, “আহ, কি সুখ!”
আরও ভালো করে গায়ে দেওয়ার জন্য লেপটাকে ঠিকঠাক করতেই ঘরের মেঝের দিকে চোখ গেল তার। চমকে উঠল। দেখল, ঘরের মেঝেতে বসে একটি কালো বিড়াল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। বিড়ালটি কখন, কীভাবে, কোন পথ দিয়ে ঘরে ঢুকেছে সেটা সে একদম বুঝতে পারেনি। ইচ্ছেকুঁড়ি মনে মনে বলে উঠল, “বিড়াল রহস্যময়, রহস্য ঘেরা, রহস্যমোড়া।”
ইচ্ছেকুঁড়ির মনে সংশয় দেখা দিল, এটা কী প্রবাহনীলের বিড়াল নাকি অন্য কারও বিড়াল? বিড়ালটি বোধহয় ইচ্ছেকুঁড়ির মনের দ্বিধা বুঝতে পারল। বিড়ালটি দু’পা সামনের দিকে এগিয়ে এল। ইচ্ছেকুঁড়ি দেখল, বিড়ালটির সামনের বাঁ পা খোঁড়া। খোঁড়ানো দেখে বুঝল, এটা প্রবাহনীলের কালো বিড়াল। ইচ্ছেকুঁড়ি ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠল। নিচে নামল। রঙ ও তুলি হাতে নিল। বিড়ালটি নড়ল না। একই জায়গায় বসে রইল। ইচ্ছেকুঁড়ি ইজেলের কাছে গেল। ইজেলের ওপর পেইন্টিং বোর্ডে ক্লিপ দিয়ে আটকানো আর্ট পেপারে আঁকা কালো বিড়ালটির চোখ দুটো আঁকতে লাগল সে। ইচ্ছেকুঁড়ি ইজেলের পেইন্টে চোখ দুটো ফোটানোর সাথে সাথে কালো বিড়ালটি ডেকে উঠল, “মিঁয়াও, মিঁয়াও, মিঁয়াও।”
।।ছয়।।
ইচ্ছেকুঁড়ি রঙ ও তুলি গুছিয়ে রেখে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। শরীরটা লেপ দিয়ে ঢেকে নিল। বিড়ালটির দিকে তাকাল। ইচ্ছেকুঁড়ি বিড়ালটির দিকে তাকিয়ে বলল, “আয়, আয়, পুসি আয়।”
বিড়ালটি স্থির চোখে তাঁকিয়ে রইল ইচ্ছেকুঁড়ির দিকে। বিড়ালটি বোধহয় মনে মনে ভাবছিল, বিড়ালকে’ বিড়াল তপস্বী ‘অর্থাৎ ‘ভন্ড তপস্বী’ আখ্যা দেওয়া মানুষকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে কী? এরা মুখে খুব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, তারপর বুকে ছুরি বসায়। মানুষ সকাল বিকেল ঘর বাড়ি ঝাট দিয়ে পরিষ্কার করে, কিন্তু মনকে ঝাট দিয়ে পরিস্কার করে না। সকাল সন্ধ্যেয় মানুষ দোকানে, বাড়িতে ধুপের ধুনো দেয়, কিন্তু নিজের মনকে একবার ধূপ ধুনো দেখায় না। এদেরকে ভরসা করা কী ঠিক হবে? মানুষের ‘পুসি আয়, পুসি আয়’ ডাকের মধ্যে ভয়ানক বিপদ লুকিয়ে থাকে। বিড়ালটি হয়তো আরও ভাবছিল, যেখানে যার মরণ লেখা থাকে, সেখানে সে নৌকা ভাড়া করে যায়। তার ক্ষেত্রে তেমন কিছু হবে না তো? বিড়ালটা কিন্তু তার জায়গা থেকে এক চুলও নড়ল না।
ইচ্ছেকুঁড়ি মনে মনে বলল, “কালো রাতের জন্য নতুন বিয়ে করা বর-বউ অধীর অপেক্ষায় থাকে, নারীর কাজল পরা কালো চোখের দিকে পুরুষরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, কালো গরুর দুধ ভালো, কালো তাল খেতে সুস্বাদু, কালো ছাতা উত্তম রোদ প্রতিরোধক, কলমের কালো কালির ব্যবহার ব্যাপক, কালো রঙের ব্ল্যাকবোর্ডে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি, তবু লোকে কেন যে কালো রঙয়ের বিড়ালকে একদম সহ্য করতে পারে না! কালো রঙকে কেন অশুভ মনে করে, কে জানে?”
আমাদের দেশে রাস্তা দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় কিংবা হেঁটে হেঁটে যাওয়ার সময় আমাদের সামনে রাস্তার মধ্যে বিড়াল এসে পড়লে বলি বিড়ালে রাস্তা কেটেছে, অশুভ মনে করে, আমরা গাড়ি থামিয়ে দেই কিংবা দাঁড়িয়ে পড়ি। কালো বিড়াল হলে তো খুবই অমঙ্গলজনক। এসব ভাবতে ভাবতেই ইচ্ছেকুঁড়ি আবারও বিড়ালটিকে আবার ডেকে উঠল, “আয়, আয়।”
বিড়ালটি অল্পক্ষণ চুপচাপ থাকল। হয়তো বিড়ালটি ভেবে নিল, রাখে কেষ্ট মারে কে? এতক্ষণ ধরে যখন ডাকছে, তখন দেখাই যাক না কী হয়? বিড়ালটি আর দেরি করল না। এক লাফ দিয়ে ইচ্ছেকুঁড়ির বিছানার ওপর উঠে বসল। তারপর ‘বিড়ালকে উঠতে দিলে বসতে চায়, বসতে দিলে শুতে চায়’ কথাটার সম্পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে বিড়ালটি ইচ্ছেকুঁড়ির পাশে গিয়ে শুয়ে পরল। ইচ্ছেকুঁড়ি বিড়ালটির গায়ে মোলায়েম করে হাত বোলাতে লাগল । বিড়ালটি চুপ করে রইল। বাধা দিল না। ইচ্ছেকুঁড়ি বিড়ালটিকে উষ্ণ গরম লেপের ভেতর ঢুকিয়ে নিল। আদর পেয়ে লেপের মধ্যে থেকে বিড়ালটি ডেকে উঠল, “মিঁয়াও, মিঁয়াও।”