অনন্তকাল ধরে অনন্তবিস্তৃত লতা, সে-কারণে অনন্তলতা, স্বমহিমায় টিকে আছে অদ্যাবধি। এর বংশবিস্তারের কৌশলের কমতি নেই। বীজগুলো জলে ভাসে, জলজ মুল্লুক হলে ভেসে চলে যায় দূরে। ডাঙার দেশে পাখিরা খায়, হরিণ, ছাগল জাতীয় প্রাণীরাও খায়, খাবারের মাধ্যমে বীজ চলে যায় আরেক জায়গায়। আগুন লেগে ছাই হয়ে যায় চারদিক কিন্তু গাছের নিচেকার কন্দ আর সাকার-রুট (Sucker Root) থেকে নতুন করে জন্ম হয় অক্ষয় অনন্তলতার। বকুল, টগর, বটের মতো দারুণ মৃত্তিকা ও বায়ুদূষণের মধ্যেও বছর বছর ধরে বহাল তবিয়তে টিকে থাকে এরা। আঁকশি দিয়ে বেয়ে ওঠে তিন-চার তলা উঁচুতে। দিন দিন মোটা হয় কাণ্ড, হতে হতে রূপ নেয় কাষ্ঠল লিয়ানা-তে। যে গাছের ওপর দিয়ে বেয়ে যায়, সে গাছ শ্বাসরূদ্ধ হয়ে পড়ে, লতার জটাজালে ভারবাহী গাছের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে চায়।
এদের বহুবিধ বংশবিস্তারের তরিকার কথা জানলেও দুঃসংবাদ হলো, কলকাতায় আজকাল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর এই লতা। এক সময় অসংখ্য লতা ছিল আলীপুর কোর্টের কাছে, সেগুলি নিশ্চিহ্ন। শুনেছি বালিগঞ্জে আর টালিগঞ্জে এখনো রয়েছে কিছু। নার্সারির মালিকরা শৌখিন ক্রেতাদের কাছে তারিখের পর তারিখ দিতে থাকে, বীজ আর সহজে আসে না। এলেও তা থেকে গাছ হবে কি না এই নিয়ে দেখা দেয় সংশয়। কী অজ্ঞাত কারণে এমনভাবে বিলুপ্ত হয়ে চলেছে অনন্তলতার গাছ তা এক গবেষগণার বিষয়। আদিবাস মেক্সিকো থেকে সারা দুনিয়াতে আদরে আদরে এই গাছ ছড়িয়েছে কচুরি পানার মতো। পথে পথে যুগে যুগে কত নাম কুড়িয়েছে সে, লাভ চেইন, লাভ ভাইন, আরো কতো রোম্যান্টিক বিশেষণ।
সুন্দর ফুল দেখে আবেগী মানুষ এদের ক্ষতিকর দিকটা অগ্রাহ্য করে এসেছে চিরকাল। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে আগাছা হিসাবে এরা চরম আকার ধারণ করেছে। অস্ট্রেলিয়া, ফ্লোরিডাতে চিহ্নিত হয়েছে আগ্রাসী আগাছা (Exotic Pest Control Council, Florida) হিসাবে। তবে এই দুটো জায়গায় আগ্রাসন এখনো অতটা প্রকট নয়, বলা যায় দ্বিতীয় শ্রেণির। মারাত্মক আগাছা বলে প্রথম শ্রেণিতে স্থান দিতে হলে এদের পরিবেশ দূষণের মাত্রা বিবেচনা করে দেখতে হবে। এদিকে ভারতবর্ষে আমরা হতাশায় আছি, আমাদের হৃদয়ের সাথে বহুকালব্যাপী জড়ানো অনন্তলতা বুঝি সীমিতলতা নামে নতুন পরিচিতি লাভ করে!
অনন্তলতার পাতা দেখতে হৃদয়ের আকৃতির মতো কিন্তু তাকে ঈষৎ কোঁচকানো হৃদয় বললেই যেন ভালো হয়। ফুলের রূপ সহজে ম্লান হয় না। একটু দূর থেকে গাছ দেখে মনে হয়, গাছে বুঝি ফল ধরে না। অথচ সারা গাছে ধরা আছে ফল, সব তার লুকিয়ে রয়েছে ফুলের ৫ পাপড়ির নিচে। অবশ্য সেগুলোকে ঠিক ফুলের পাপড়ি বলা যায় না, বৃতিগুলো বেড়ে গিয়ে পাপড়ির কাজ করে। ফলগুলি এক সেন্টি লম্বা আর দেখতে সুন্দর মসৃণ, জলের ফোঁটার মতো কিংবা নাশপাতি ফলের মতো, নিচের দিক কিছুটা মোটা, ওপরে ক্রমশ চিকন। এই রূপসী ফলের দেহে লেখা আছে আধুনিক পপকর্ন আর সনাতন খইয়ের ইতিহাস।
প্রত্নতত্ত্ববিদরা পপকর্নের যে অস্ত্বিত্ব আবিষ্কার করেছেন তা কমপক্ষে ৮০ হাজার বছর আগেকার, অর্থাৎ গুহাবাসীরাও পপকর্নের ব্যবহার জানতো। ৫৬০০ বছর আগেকার মেক্সিকোর বাদুড় অধ্যুষিত গুহায় (Bat Cave) পাওয়া গেছে অনন্তলতার বীজের অস্ত্বিত্ব। এর খই তাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা ১৭০০ শতাব্দীর এক পেইন্টিং থেকে বোঝা যায়, যাতে দেখা যায় এক ভাস্বর পপকর্ণ দেবতা, মাথায় খইয়ের মুকুট। প্রাচীনকালে অনন্তলতার খই ছিল এক ধরনের দরকারি খাবার, আমাদের দেশের মতো শৌখিন দেবধান আর ঢ্যাঁপের খইয়ের মতো নয়। সে সময়ে দুর্ভিক্ষ না হলে কেউ অনন্তলতার খই খেত না। তখন খই ফোটানোর জন্য পাতিল-ঝাঁঝরও ছিল না মেক্সিকোতে। লতা নির্মিত ঝুড়ির ভেতরে অনন্তলতার বীজের ওপরে ঢেলে দেয়া হতো গনগনে অঙ্গার। দ্রুতগতিতে নাড়াচাড়া করে খই ফুটলেই ঢালা হতো মাটিতে। সেই খই ওড়ানো হতো যেভাবে গ্রামের বাড়িতে কুলো দিয়ে ধান উড়িয়ে থাকি আমরা। এরপর খই থেকে আটা, আটা থেকে তৈরি হতো অনেক রকম খাবার।
খইয়ের বীজের ভেতর ভ্রূণের চারদিকে থাকে মূলত শ্বেতসার যার প্রায় ১৫ শতাংশ জল। প্রচণ্ড তাপে এই জলীয় অংশ বাষ্পে পরিণত হয়ে চাপ সৃষ্টি করলে বীজের শক্ত খোলস ফাটিয়ে সশব্দে তৈরি হয় খই। বীজের ভেতরকার জলের পরিমাণ কমে গেলে তাতে খই-ফোটাবার মতো যথেষ্ট বাষ্প তৈরি হয় না। অনন্তলতার বা অন্য কোনো বীজ দিয়ে খই ফোটাতে হলে তাই বীজকে ভাল মতো পাত্রে বন্ধ করে রাখতে হয়, যাতে বীজের ভেতরে আবদ্ধ জলটুকু উবে না যায়।
শুধু খাবার নয়, নানা রকম চিকিৎসায় বিভিন্ন দেশে ডায়েবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ঠাণ্ডাজনিত রোগে অনন্তলতার বেশ ব্যবহার দেখা যায়। ল্যান্ডস্কেপিং-এর কাজে এর কদর আছে দুনিয়া জোড়া যেখানে নির্বাচিত লাল-সাদা-গোলাপি গাছগুলো স্বেচ্ছায় কখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে না। টবে বা ইন্ডোরে এই লতা বন্দী কাকাতুয়ার মতই শিষ্ট। এর দুটি উৎকৃষ্ট কাল্টিভার বা আবাদি প্রজাতি তৈরি হয়েছে, একটি সাদা, (Antigonon leptopus ‘Alba’) আরেকটি লাল (Antigonon leptopus ‘Baja Red’)