গাছের নামটি চমকপ্রদ, লায়লা-মজনু। খুব চেনাজানা এক লোককাহিনীর নায়ক-নায়িকার নাম এসে ভর করেছে গাছে। কেমন করে এমন নামকরণ হলো, আর উপমহাদেশের সবাই তা কীভাবে একবাক্যে গ্রহণ করল, উদ্ভিদজগতের জন্য তা এক বিস্ময়। এই গাছের পাতার উপরের দিক সবুজ কিন্তু নিচের দিকটা রক্ত-লাল। মূলত উপর থেকে দেখলে সহজে বোঝাই যায় না নিচের দিকটা অদ্ভুতরকম ভিন্ন রঙের। প্রকৃতিতে দোরঙা এমন পাতা চোখে পড়ে না। পাতার কোন দিক মজনু আর কোন দিক লায়লা তা নিয়েও কেউ কেউ চিন্তা করেছেন, কিন্তু যতই ভেবেছেন ততই সামনে এগিয়ে এসেছে লায়লা-মজনুর কালজয়ী প্রেম কাহিনী, একের প্রতি অন্যের গভীর অনুভব, প্রেমজ রক্তক্ষরণ।
আরবি ভাষায় ‘লায়লা’ মানে রাত্রি আর ‘মজনুন্’ মানে পাগল। আমরা বাংলা বা হিন্দিতে আত্তীকরণ করে বলি লায়লা-মজনু। মজনুর আসল নাম ছিল কায়েস, ‘কায়েস বিন মুলাওয়াহ’ আর লায়লার নাম ‘লায়লা বিন্তে মাহদি।’ আরবে কাউকে সঠিকভাবে শনাক্তকরণের জন্য অনেক আগে থেকেই দ্বিপদী নামের প্রচলন রয়েছে যেখানে ছেলেমেয়ের নামের সঙ্গে বাবার নাম যুক্ত করা হয়। স্কুলে দেখা হওয়ার পর থেকেই কায়েস ও লায়লা দুজনাই দুজনার প্রেমে পড়ে যায়। মজনুর প্রেমোচ্ছ্বাস পাগলামিতে রূপ নেয়। লায়লার গমনপথে, চোখের তারায় স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সে। তখনকার সমাজ এসব মানতে পারে না। অচিরেই লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় দুজনের। প্রেমে পড়ে কায়েস অনন্য কবি হয়ে ওঠে। কাঠি দিয়ে মরু বালুর উপর যখনতখন কবিতা লিখতে থাকে সে, মরু-জঙ্গলে নিজেকেই নিজে আবৃত্তি করে শোনায় লিখিত কবিতা। যে-সব কবিতায় তার পাগলামির উল্লেখ পাওয়া যায় একটির ভাবানুবাদ হলো–
“দেয়াল ঘেরা বাড়ি, চুপিসারে আমি তার চৌদিকে ঘুরি
অস্থির হয়ে চুম্বন করি দেয়ালের তনু কটি
হৃদয় আমার পাগল করেছে যে, সে কখনো দেয়াল নয়
লায়লা তো বাস করে দেয়ালের ঐ পাশে।”
সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ থেকে ৩৩০ কিলোমিটার দূরে ‘আফলাজ’ মরুদ্যান এলাকায় দেখার মতো দুটো জিনিস আছে। এক হলো প্রাকৃতিক একটি হ্রদ, ‘আয়ুন’, আর সেখান থেকে মাইল দশেক দূরে লায়লার বাড়ি। খুব আগ্রহ করে বলল লোকজন, ‘তোমরা এত দূর থেকে এসেছ, চলো নিয়ে যাই লায়লার বাড়ি।’ বাড়িটা সাদামাটা হলেও অসামান্য মনে হলো, কারণ এর ভেতর জড়িয়ে আছে এক বিশাল প্রেমের উপাখ্যান।
পীড়িত ছেলেকে ঔদাসিন্য থেকে রক্ষা করার জন্য কায়েসের বাবা প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল লায়লার বাবার কাছে। তিনি রাজীও হয়েছিলেন কিন্তু কায়েসের পাগলামির জন্য শেষমেশ বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। এরপর বিধ্বস্ত কায়েস আশ্রয় নিয়েছিল মরু-জঙ্গলে। লায়লাকে জোর করে বিয়ে দেয়া হলো তায়েফের এক বণিকের সাথে। সেখানে পীড়িত হৃদয়ের রক্তক্ষরণের কারণে মারা যাওয়ার আগে সে তার মাকে বলেছিল, কায়েসকে তার মৃত্যুখবর জানাতে। খবর দেয়া হয়েছিল, এবং এর কিছুদিন পর কায়েসকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল লায়লার কবরে যার আশেপাশে পাথরের গায়ে লেখা ছিল কয়েকটি কবিতা।
প্রাক ইসলামিক যুগ থেকে লায়লা-মজনুর কাহিনীর উল্লেখ দাবী করা হলেও ১২শ শতকে ফারসি কবি নিজামি প্রথম বিস্তৃতভাবে প্রেমের উপাখ্যানটা কবিতায় লিপিবদ্ধ করেন যা প্রকারান্তরে অনুসৃত হয়েছে যুগে যুগে, তৈরি হয়েছে কাহিনীর বহুবিধ ভার্শন। এক ভার্শনে বলা হয়েছে, লায়লা-মজনু নিরাপদে প্রেমময় জীবন কাটাতে ভারতের মরু রাজস্থানের একটি গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল যেখানে তাদের কবরও রয়েছে। দূরদূরান্ত থেকে নবদম্পতিরা তা দর্শন করতে যায়। বাংলা সাহিত্যে প্রথম ‘লায়ালা-মজনু’র কাহিনী সংযোজন করেন দৌলত উজির। কলকাতায় স্যার উইলিয়াম জোনস্ এই রোমান্টিক কাহিনী প্রকাশ করেন ১৭৮৮ সালে। এরপর লায়লা-মজনু চলচ্চিত্র হয়েছে ১৯৭৯ সালে, ঋষিকাপুর-রঞ্জিতাকে নিয়ে।
লায়লা-মজনু গাছ ভারত উপমহাদেশ ও চীনের দেশীয় গাছ। তবে আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়াতেও এটি বিস্তারলাভ করেছে। গাছের সাধারণ ইংরেজি নাম ব্লাইন্ডনেস ট্রি, চাইনিজ ক্রোটন, জাঙ্গল ফায়ার ইত্যাদি। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম এক্সসিকেরিয়া কোচিন.চিনেন্সিস (Excoecaria cochinchinensis Lour.)। এক্সিকেরিয়া-র অর্থ অন্ধ হয়ে যাওয়া, যা থেকে ‘ব্লাইন্ডনেস ট্রি’ নামকরণ হয়েছে। ইউফরবিয়া পরিবারের অপরাপর গাছের মতো এর কষও দারুণ বিষাক্ত। চোখে স্বল্পমাত্রায় গেলেও মানুষ অন্ধ হয়ে যায় সাময়িকভাবে। এই ‘ডিটারপিন’ বিষ মৎস্যনাশক হিসাবে ব্যবহার করা হয়। প্রজাতি নাম কোচিন.চিনেন্সিস বলতে কোচিন-চায়না বোঝায় যা বর্তমানের ভিয়েৎনাম, লাওস, ক্যাম্বোডিয়া প্রভৃতি অঞ্চল।
এই গণে ৪০টি প্রজাতির মধ্যে সবিশেষে রয়েছে সুন্দরবনের গেওয়া গাছ, এক্সসিকেরিয়া অ্যাগালোকা (E. agallocha) ও বাটুল গাছ (Shirakiopsis indica, syn: Excoecaria indica) যাদের ভেতরেও এই বিষ উপস্থিত। এই গণের গেওয়া গাছ বহুল ব্যবহৃত হতো খুলনার নিউজপ্রিন্ট পেপার মিলে। তবে অন্যান্য জায়গায় অন্য গাছ ব্যবহার করা হয় কাগজ উৎপাদনে। যেমন, কর্ণফুলী পেপার মিলে ব্যবহার করা হয় মুলি বাঁশ, পাকশি পেপার মিলে আখের ছোবড়া, সিলেটে নলখাগড়া ও এক ধরনের কড়ুই গাছ (Albizia moluccana)।
লায়লা-মজনু গাছ সহজেই ইনডোরে রাখা যায়। মাঝে মাঝে রোদে দিলেই চলে। দুবছর পরপর টব পালটে দিতে হয়। জানুয়ারি মাস পটিং ও প্রুনিং উভয়ের জন্য উৎকৃষ্ট সময়। এতে সার দিতে হয় না তেমন, সাধারণ গোবর সার ও রান্নাঘরের বর্জ্য ভার্মিকম্পোস্ট দিয়ে লাগালেই চলে। চারা পলিব্যাগে থাকলে টবে স্থানান্তরের সময় চারদিকের জমাট মাটি ঝুরো করে নিতে হয়। পানি জমে থাকলে গাছ মরে যেতে পারে, এজন্য টবের নিচে নারকেলের ছোবড়াযুক্ত কোকোপিট দেয়া ভালো। কাটিং, কলম বা এয়ার লেয়ারিং করে এই গাছ জন্মানো ভালো কারণ এক থেকে দেড় বছর পরে বীজ থেকে অঙ্কুরোদ্গমের সম্ভাবনা থাকে মাত্র শতকরা ৫ ভাগ।
লায়লা-মজনু গাছের পাতায় রং তৈরি হয় অ্যান্থোসায়ানিনের উপস্থিতির কারণে যেমনটা দেখা যায় শিবঝুল, কৈলাস বা মিষ্টি আলুর লালাপাতা কাল্টিভারে। এই গাছের কচি পাতা পুষ্ট পাতার দুই রঙের পরিবর্তে কেবল লাল রঙের হয়ে থাকে। এই রং ও কটূস্বাদের কচিপাতা-রসায়ন কীটপতঙ্গকে দূরে রাখে বলে অনেক গাছের দুর্বল কিশলয় লাল হতে দেখা যায়। তবে যেসব গাছের সবুজ কিশলয় থাকে তাতে প্রায়শ সূক্ষ্ম হুলযুক্ত ‘ট্রাইকোম’ থাকে যা কীটের চলাচল বিঘ্নিত ক’রে একধরনের প্রতিরক্ষা তৈরি করে।
এক থেকে দুই মিটার লম্বা লায়লা-মজনু গাছ আমাদের দেশীয় গুল্ম হলেও একে নিয়ে গবেষণা অনগ্রসর অবস্থায় আছে। ভূদৃশ্যে, ইনডোর প্লান্ট হিসাবে ও হেজ নির্মাণে এর ব্যবহার হলেও ঔষুধি গুণাবলী নিয়ে তেমন কিছু জানা যায় না। এর বিষাক্ত কষ সফলভাবে চুলকানি ও একজিমায় বহুকাল আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ক্ষতিকর জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিপ্যারাসাইট হিসাবে এবং রক্ত জমাট বাঁধার বিরুদ্ধে একে ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করা যায়। এটি একটি সুন্দর নান্দনিক গাছ যা সহজেই ইনডোরে লালন করা যায়।