ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, আমরা ইতিহাস বদলালে রুখবে কে? কিন্তু যে ইতিহাস লেখা হয়ে গেছে তাকে বদলানো কী সম্ভব? বোধ হয় না। ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনা এমনই কিছু মারাত্মক চমকে ওঠার মতো তথ্য মানুষকে জানানোর উদ্দেশ্যেই লেখার অবতারণা। এই লেখার প্রধান উৎস ইতালির লেখিকা গবেষক মার্জিয়া ক্যাসোলারি’র একটি প্রবন্ধ এবং বই। উত্তরপ্রদেশে ঘটে যাওয়াএকটি ঘটনার সূত্র ধরে লিখতে বসা।
উত্তরপ্রদেশের সারদা (Sharda) বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষায় ছাত্রদের কাছে পরীক্ষার প্রশ্ন ছিল:”তুমি ফ্যাসিবাদ/নাৎসিবাদ এবং হিন্দু ডানপন্থার মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পাও? যুক্তি দিয়ে বিস্তারিত লেখ।” যে শিক্ষক প্রশ্নটি করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করেছিলেন, কারণ প্রশ্নটি আমাদের দেশের মহান জাতীয় পরিচয়ের সম্পুর্ণ বিরোধী এবং এই প্রশ্নে সামাজিক বিভেদ সৃষ্টির সম্ভাবনাও থাকতে পারে এই অজুহাতে।
সারদা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে ঐ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে নিষেধ করা হয়েছিল কেন? সেই প্রশ্নের জবাব দিতেই এই লেখা। ২০০০ সালে ইতালিয়ান ইতিহাসবিদ প্রফেসর মার্জিয়া ক্যাসোলারির ইকনোমিক আ্যণ্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে “১৯৩০-এর দশকে, হিন্দুত্বের ফরেন টাই-আপ” শিরোনামে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়, এবং তার বিশ বছর পরে প্রকাশিত একটি বইটি, নাম In the Shadow of the Swastika: The Relationships Between Indian Radical Nationalism, Italian Fascism and Nazism.
ড. ক্যাসোলারি ইতালি, ভারত এবং যুক্ত রাজ্যের আর্কাইভ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন এবং বিভিন্ন ভাষার প্রাথমিক উপকরণ থেকে তিনি তাঁর লেখার কাজটি সম্পন্ন করেন। তিনি দেখান যে, ১৯২০ এবং ১৯৩০-এর দশকে, মারাঠী প্রেস ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানকে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে এবং প্রশংসনীয়ভাবে কভার করেছিল। ভারতে অনুরূপ একটি মতাদর্শ পিছিয়ে পড়া কৃষিপ্রধান দেশকে একটি ক্রমবর্ধমান শিল্প শক্তিতে পরিণত করতে পারে এবং জনগণের মধ্যে শৃঙ্খলা ও রেজিমেন্টেশন আনতে পারে এটা ভেবে। বেনোজিৎ মুসোলিনি এবং ফ্যাসিবাদের উপর ঐ উজ্বল প্রবন্ধগুলো এবং ক্যসোরালির উদ্ধৃতিগুলো কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার, আরএসএস এর প্রাক প্রখ্যাত নেতা মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার, বিনায়ক দামোদর সভারকর ও বি এস মুনজে খুব ভালোভাবে পড়েছিলেন। ঐ বিশিষ্ট হিন্দু মহাসভার চার নেতারই মাতৃভাষা ছিলো মারাঠী। ক্যাসোলারি লিখেছেন “১৯২০- দশকের শেষের দিকে, মহারাষ্ট্রে ফ্যাসিস্ট শাসন এবং মুসোলিনির সমর্থক থাকতে পারে। ফ্যাসিবাদের আবেদনের দিকটা হিন্দু নাগরিকদের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। ফ্যাসিস্ট শাসনের আবেদন স্বচ্ছভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ইতিবাচক বিকল্প হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।
ক্যাসোলারির গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন বি এস মুনজে- হিন্দু ডানপন্থীদের একজন প্রধান মতাদর্শী। মুনজে ১৯৩১ সালে ইতালি সফর করেন এবং ফ্যাসিস্ট শাসনের অনেক সমর্থকদের সাথে দেখা করেন। তিনি বেনিতো মুসোলিনি এবং তার আদর্শ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, এবং ভারতীয় যুবকদের মধ্যে সামরিকবাদের চেতনা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন।
তার (মুনজের অনুরোধে) মুনজেকে মুসোলিনির সাথে সাক্ষাতের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ডিউস ভারতীয় দর্শনার্থীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তিনি ফ্যাসিস্ট যুব সংগঠনগুলি সম্পর্কে কি ভাবছেন, তখন মুনজে উত্তর দিয়েছিলেন, “মহামান্য, আমি খুবই প্রভাবিত হয়েছি, প্রতিটি উচ্চাকাঙ্খী এবং ক্রমবর্ধমান জাতির এই জাতীয় সংগঠনের প্রয়োজন। ভারতের সামরিক পুনর্জন্মের জন্য তাদের সবচাইতে বেশি প্রয়োজন।”
ইতালির ফ্যাসিস্ট স্বৈরশাসকের সাথে তার কথোপকথন সম্পর্কে মুনজে বলেছেন, “So I ended my memorable interview with Signor Mussolini, one of the great men of European world. He is a tall man with broad face and double chin and broad chest.His face shows him to be a man of strong will and powerful personality. I have noted that Italians love him.”
মুনজে মুসোলিনির ব্যক্তিত্বে বিস্মিত হয়েছিলেন এবং তার আদর্শে ভেসে গিয়েছিলেন। তারই গুণকীর্তন করতে একনায়কের অনুমোদিত বিবৃতি উদ্ধৃত করতেন, “War along brings up to its highest tension all human energy and put the stamp of nobility upon the peoples who have the courage to meet it.”
আর একটি বিবৃতি, “Fascism believes neither in the possibility nor the utility of perpetual peace. I thus repudiates the doctorin of Pacifism which is born on renunciation of the struggle and [is]an act of cowardice in the face of sacrifice.”
মুনজে পরবর্তীকালে আরএসএস- এর প্রতিষ্ঠাতা, কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার এর পরামর্শদাতা (Mentor) ছিলেন। মি. হেডগেওয়ার তরুণ ছাত্রাবস্থায় নাগপুরে মুনজের বাড়িতে থাকতেন। মুনজে হেডগেওয়ারকে মেডিসিনের উপর পড়তে কলকাতায় পাঠান। মুনজের ইতালি সফরের পরে মুনজে এবং হেডগেওয়ার দুজনে মিলে হিন্দু মহাসভা এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)কে আরো ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় আনতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। ক্যাসোলারির লেখা থেকে জানা যায় যে, ১৯৩৪ সালে মুসোলিনি ও ফ্যাসিবাদের উপর আলোচনার জন্য একটি সম্মেলনে হেডগেওয়ার সভাপতিত্ব করেন এবং সেই সম্মেলনে প্রধান বক্তা ছিলেন ড. মুনজে। সেই বছরে মার্চ মাসে হেডগেওয়ার এবং তার সহকর্মীরা একটি দীর্ঘ সভা করেছিলেন। সেখানে ড. মুনজে মন্তব্য করেন, “হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে আমি একটা পরিকল্পনা করেছি, হিন্দু ধর্মের চিন্তা ভাবনা ও তার শ্রেষ্ঠত্বের মন্ত্রকে সারা ভারতে ছড়িয়ে দেওয়ার। কিন্তু এই কর্মসূচী ততদিন কার্য্যকরী বা ফলপ্রসু হবে না যতদিন পর্যন্ত অতীতের শিবাজী ও বর্তমানে ইটালির মুসোলিনি এবং জার্মানির হিটলারের মতো একজন আমরা হিন্দু একনায়কের নেতৃত্বে পূর্ণ স্বরাজ অর্জন করতে না পারছি কিন্তু তার মানে এটা নয় যে যতদিন পর্যন্ত ভারতে সেরকম কোনো একনায়ক পাচ্ছি ততদিন পর্যন্ত আমরা হাতগুটিয়ে বসে থাকবো। আমাদের উচিৎ একটি বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা তৈরি করে নিরন্তর প্রচার চালিয়ে যাওয়া|”
জানতে ইচ্ছে করে, মুনজে-হেডগেওয়ার ও সাভারকারের আত্মা কি সেরকম কোনো হিন্দু একনায়ক পেয়ে গেছে!?
মুনজে ইতালীয় ফ্যাসিবাদ এবং আরএসএস এর আদর্শের মধ্যে একটি সাদৃশ্যতা দেখতে পান। সেই জন্য তিনি লিখেছেন, “ফ্যাসিবাদের ধারণাটি প্রানবন্তভাবে মানুষের মধ্যে (হিন্দুদের মধ্যে) ঐক্যের ধারণাটি প্রথিত করে। ভারতে বিশেষ করে ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন যারা হিন্দুদের মধ্যে সামরিক প্রজন্ম তৈরি করবে। নাগপুরে হেডগেওয়ারের অধীনস্ত আরএসএস সেইরকম একটি প্রতিষ্ঠান- যেটা হেডগেওয়ারের স্বাধীন চিন্তার ফসল।”
ক্যাসোলারি লক্ষ্য করেছিলেন যে আরএসএস এর সদস্য নিয়োগের পদ্ধতিটা কার্যত ইতালির বালিল্লা (balilla) সংগঠনের মতই অভিন্ন ছিল।” আরএসএস এর সদস্য সংগ্রহের পদ্ধতি বয়েস অনুযায়ী কয়েকটি ক্রমে ভাগ করা হতো (৬/৭ -১০, ১০-১৪, ১৪-২৮ এবং ২৮ এর ঊর্ধ্বে)। এটি ফ্যাসিস্ট যুব সংগঠনের শ্রেণীবদ্ধ বয়সের ভাগের সাথে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়। আরএসএস সদস্যদের শ্রেণী বিন্যাসের এই ক্রম অবশ্যই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে এসেছিলো এবং সম্ভবত এই পদ্ধতি ফ্যাসিবাদ থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকতে পারে।”
ক্যাসোলারি ১৯৩০ সালের এক পুলিশ অফিসারের নোটের উল্লেখ করেছেন সেই নোটে আরএসএস সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, “এটা দাবি করা হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে সংঘ ভবিষ্যতে ভারতে বর্তমানে ইতালিতে ‘ফ্যাসিস্ট’ এবং জার্মনিতে ‘Nazi’s’ এর অনুরূপ হবে।” ঐ নোটে আরো দাবি করা হয়েছে, “সংঘ মূলত একটি মুসলিম বিরোধী সংগঠন এবং এর লক্ষ্য হলো দেশে একচেটিয়া হিন্দু আধিপত্য বিস্তার করা। “ক্যাসোলারি গবেষণায় সাভারকরের বিশ্ব দর্শন সম্পর্কে কিছু আকর্ষণীয় অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে। তিনি লিখেছেন, “১৯৩৮ সালে সাভারকারের সভাপতিত্বের সময় নাৎসি জার্মানের রেফারেন্স হিন্দু মহাসভার মূল বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। জাতি সম্পর্কিত জার্মানির উন্মত্ত নীতিগুলি মুসলিম সমস্যার সমাধানের জন্য আদর্শ হিসাবে গৃহিত হয়েছিল।”
“সাভারকরের মন্তব্যগুলোর মধ্যে থেকে ক্যাসোলারি উদ্ধৃতি দিয়েছেন, “জার্মানিদের নাৎসিবাদ এবং ইতালীয়দের ফ্যাসিবাদ অবলম্বন করার অধিকার আছে। সেখানকার পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ঐ ধরণের মতবাদ বা ইজম এবং সরকার গঠন করা তাদের কাছে অপরিহার্য এবং হিতকর ছিল।”
“জাতীয়তা একই ভৌগলিক সীমায় একই ভাবনা, ধর্ম, ভাষা এবং সংস্কৃতির ঐক্যের উপর নির্ভর করে না। এই কারণে জার্মান এবং ইহুদিদের জাতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।”
“জার্মানে জার্মানিদের আন্দোলন হচ্ছে জাতীয় আন্দোলন সেখানে ইহুদিরা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক।”
“জাতি গঠন হয় সেখানে বসবাসকারি সংখ্যাগুরু মানুষদের নিয়ে। ইহুদিরা জার্মানে কি করছে?”
“ভারতীয় মুসলমানরা জার্মানির ইহুদিদের মতই তাদের পাশের বাসিন্দা হিন্দুদের চেয়ে ভারতের বাইরের মুসলমানদের সাথে তাদের স্বার্থগুলোর সনাক্ত করতে সম্পুর্নভাবে ঝুঁকে আছে|”
সাভারকর অতি অবশ্যই আজ ভারতে ক্ষমতায় থাকা হিন্দুত্ববাদী সরকারের কাছে একজন আইকন। ক্যাসোলারি তাঁর বইতে আরও একজন হিন্দুত্ববাদীর প্রতিমূর্তি শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী’র নামের উল্লেখ রয়েছে। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইতালির সরকার উৎসাহের সাথে ভারতীয় বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদদের- যারা ফ্যাসিবাদের প্রতি সহানুভুতিশীল হতে পারেন তাদের চাষ করতেন। সেই কাজটি ইতালীয় প্রাচ্যবিদ Giuseppe Tucci যিনি নিজেই একজন ফ্যাসিবাদের সমর্থক ছিলেন তিনি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। Tucci মুনজের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। ১৯৩০-এর দশকে, তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর সথেও তার যোগাযোগ ছিল, যিনি জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং ভারতীয় জনতা পার্টির পূর্বসূরি ছিলেন। Tucci তার পরামর্শদাতা Giovanni Gentile এর কাছে লেখার সময় শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীকে কলকাতায় আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
প্রফেসর মার্জিয়া ক্যাসোলারি-ই প্রথম ব্যক্তি নন, যিনি ফ্যাসিবাদ ও হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে সাদৃশ্যতার অনুসন্ধান করেছেন। বরং তিনি অন্যান্যদের চাইতে অত্যন্ত কঠোর গবেষণা সহকারে আরও বেশি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছেন। তার গবেষণা এটাই প্রমাণ করে যে সারদা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের গুরুত্বপূর্ণ ও সঠিক প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করেছেন। সারদা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক ছাত্রদের ঐ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া থেকে বিরত রেখে এবং প্রশ্নকারি ঐ শিক্ষককে বিলম্বিত করে এটা প্রমাণ করেছেন যে তাঁরা সত্যকে ভয় পান। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসকরা আরও বেশি ভয় পায় তাদের রাজনৈতিক মণিবদের। ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা ইউরোপিও ফ্যাসিবাদের দ্বারা অনুপ্রানিত হয়েছিলেন এই সত্যকে সারদার প্রশাসকরা ভুলিয়ে দিতে চাইছেন।
এখনকার রাজনীতিবীদদের উচিৎ আরো বেশিকরে এ বিষয়ে চর্চা করা এবং হিন্দুত্ববাদীদের মুখোশ খুলে দেওয়া যুক্তিযুক্ত বলে মনে করি।