কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার খুব অসুস্থ অবস্থায় ভক্তকুল পরিবেষ্টিত হয়ে শুয়ে আছেন এবং বলছেন, এ যাত্রায় আমি আর টিকব বলে মনে হয় না। এক ভক্ত বলে উঠলেন, কি বলছেন গুরুদেব! আমরা আপনি জীবিত থাকা অবস্থায়ই আপনার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করতে চাই। কবিগুরু বললেন, পঁচিশ টাকায় আমার কোনো লোভ নাই।
আমাদের প্রজন্ম সিকি, আধুলি, ষোল আনা পয়সার এই হিসাব তো বটেই নামগুলিও ভুলে গেছেন এতদিনে হয়ত। এই দেশ পঁচিশ পয়সার একটা কয়েন ছিল, যেটাকে সিকিও পয়সাও বলা বলা হত। চার সিকিতে এক টাকা। রবীন্দ্রনাথ রসিকতা করেই বলেছিলেন, পঁচিশ টাকায় আমার কোনো লোভ নাই। শতবার্ষিকীকে তিনি শত বার সিকি হিসাবে হিসাব করে এই হাস্যরসের সৃষ্টি করেছিলেন। কবিগুরু কি জানতেন, তাঁর সেই রসিকতাই আজ একটা রাষ্ট্র তাঁর নাগরিকদের সাথে করবেন? অবশ্য রাষ্ট্র এই রসিকতা যাদের সাথে করছেন, তাদেরকে নাগরিক মনে করেন কিনা সেটাও প্রশ্ন। নইলে যেখানে একটা রাষ্ট্র মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণ করার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্নের দারপ্রান্তে বলে দাবী করছে, যে রাষ্ট্র দাবী করছে, পরিসংখ্যান, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করছে এদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় তিন হাজার ডলার, সেই দেশ লক্ষাধিক মানুষের দৈনিক মুজুরি কিভাবে ১২০ টাকা হয়?
আমরা যারা নগরে বাস করি, তাঁদের নানা রকম বায়নাক্কা আছে, যেগুলির সাথে চা ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। যেমন বেড টি, মর্নিং টি না হলে অনেকেই নাকি ঠিকঠাক মত প্রাতকৃত সম্পন্ন করতে পারেন না। অনেকের ইভিনিং এ কড়া লিকারের এক কাপ চা না খেলে রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয় না। আর মধ্যবিত্তের স্টিমই নাকি চা। এতকথা বলছি, তার কারণ হল এই চা যারা উৎপাদন করেন, বাগান হতে চায়ের সবুজপাতা সংগ্রহে যাদের হাত রঞ্জিত হয়, এক সময় সেই হাত দিয়ে আর রক্তও বের হয় না, সেই মানুষদের কথা কি আমরা জানি? গত বেশ কিছুদিন ধরে তারা ন্যুনতম ৩০০ টাকা মুজুরির দাবীতে আন্দোলন করছে এবং মিডিয়ার কল্যাণে সেটা আমরা জানতে পারছি। এই আন্দোলন নতুন নয়, এর আগেও আন্দোলন হয়েছে কিন্তু আমাদের কথিত গণমাধ্যম হয়ত সেগুলির কোনো সংবাদমূল্য থাকতে পারে, সেটাই ভাবনাতে আনতে চান নাই। তাই দেশের সিংহভাগ মানুষ চা শ্রমিকদের এই বঞ্চনার কথা জানতেনই না। এবার জেনেছেন, কিন্তু তাতে চা শ্রমিকদের যে খুব লাভ হয়েছে, তা নয়। দ্রব্যমুল্যের উরধগতি, জ্বলানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, আবহাওয়ার বৈরীরূপ সব কিছু মিলিয়ে জনজীবন যখন নাকাল, ঠিক সেই সময়ে ১২০ টাকা দিয়ে একটা পরিবারের জন্য আসলে কি কি কেনা সম্ভব, কিভাবে জীবন নির্বাহ সম্ভব, সেটা ঠান্ডা মাথায় হিসাব করার মত সময় আমাদের কোথায়?
কিন্তু রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন, তাঁদেরকে ঠিকই খবর রাখতে হয়, মাথা ঠান্ডা রেখে হিসাব কষে সমাধান দিতে হয়। দেখলেন না, ঢাকায় শ্রমভবনে এসে মালিক-শ্রমিকদের বৈঠক হল, কিন্তু সমাধান হল না। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান ঠিকই সুরাহা করে ফেললেন, মালিকপক্ষ ১২০ টাকার সাথে আরো ২০ টাকা যোগ করে ১৪০ টাকা মুজুরি নির্ধারণ করে প্রস্তাব করে। রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, তা কি করে হয়? আরো ৫ টাকা বাড়িয়ে দিন। ভাবা যায় একেবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই রসিকতার সাথে মিল রেখে একবার, দু-বার সিকি নয়, শত বার সিকি মানে ২৫ টাকা। ভাবা যায়? তারপরও অপোগণ্ড মূর্খগুলোর একাংশ নাকি বলছে, এতে তারা একেবারেই খুশি নয়। তাদের দাবী ৩০০ টাকায় মুজুরি হতে হবে।
আসুন রসিকতা ছেড়ে একটু বাস্তবে ফিরি, অন্যান্য সকল বাস্তবতা পাশে সরিয়ে রেখেও যদি আমরা তিনবেলা একজন মানুষের খাবারের হিসাব ধরি, তাহলেও কি এই দ্রব্যমূল্যের বাজারে ১২০ টাকায় একজন মানুষের তিনবেলার পুষ্টিকর খাবার কেনা সম্ভব? আর একজন মানুষ তো কাজ করে তার একার জন্য না। পরিবারে আরো সদস্য থাকেন। হতে পারেন তারা বয়সের ভারে ন্যুজ, হতে পারে তারা শিশু। কিন্তু বছরের পর বছর এই টাকায় তারা জীবন নির্বাহ করে আসছে। যদিও কয়েক বছর আগে টাকার এই পরিমাণ আরো কম ছিল। কোনো একটা পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম, শ্রমিকদের আনুসাংগিক সুবিধাসহ সাকুল্য মজুরি দাঁড়ায় ৪০০ টাকার মত। প্রথমত কথা হল, মুল মুজুরীর চেয়ে অন্যান্য সুবিধাদির আর্থিক পরিমাণ যখন বেশি হয়, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, সেখানে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়ে গেছে। তাছাড়া একজন মাটি কাটা শ্রমিকের মজুরিই যেখানে ৬০০ টাকা, সেখানে দৈনিক কাজ করা একজন শ্রমিকের মজুরি কিভাবে ১২০ টাকা হয় এবং কোন যুক্তিতে আপনারা সেটা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা করেন? আমি সরাসরি ভুক্তভোগী না হয়ে এই সিদ্ধান্ত মানতে তো পারিই না, বরং এই মালিক এবং রাষ্ট্রের এই রসিকতায় ক্ষুব্ধ, সেখানে চা শ্রমিকেরা কেন সেটা মানবেন? শ্রম দপ্তরের কর্তারা আমাদেরকে ছবক শোনাচ্ছেন, এই আন্দোলন শ্রম আইন বিরোধী। শ্রম আইন অনুযায়ী ধর্মঘটে যেতে হলে নাকি ১৪ দিন আগে লিখিতভাবে জানাতে হয়। এ থেকেই রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের চরিত্র বোঝা যায়। এই আন্দোলন যদি শ্রম আইন বিরোধী হয়, তাহলে শ্রম অধিদপ্তরর শ্রমিক নেতাদের সাথে একাধিকবার বৈঠকে বসলেন কেন? শুধু শ্রম অধিদফতর, সাংসদও সেখানে ছিলেন। আসলে রাষ্ট্র চাইছে, ১৪৫ টাকাতেই শ্রমিকদের রাজি করাতে।
শ্রমিকরা আন্দোলনের যৌক্তিকতা তো বটেই, পাল্টা যুক্তি দিয়ে প্রশ্ন করেছেন, আলোচনা ছাড়াই কিভাবে রাত বারোটায় জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যায়? কি জবাব দেবে রাষ্ট্র। রাস্তা একটাই, দমন-পীড়ন। শ্রমিকেরাও কৌশলী ব্যানারে রাষ্ট্রপ্রধানের ছবি ব্যবহার করছেন। রাষ্ট্রপ্রধানের চোখে কি সেটা পড়েছে? সেজনই কি পাঁচ ষোল আনা বাড়িয়ে দিলেন?
দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের একাংশ বিবৃত্তি দিয়েছেন, শাহবাগে একটা সমাবেশ হয়েছে, দু-একটা রাজনৈতিক দলও সমর্থন করেছেন এই আন্দোলনকে। আমরা এখনো নাগরিক হয়ে উঠতে পারিনি। নইলে এই ইস্যুতে আমাদেরই রাজপথে থাকার কথা ছিল, নাগরিক অধিকার আদায়ে। রাজপথে থাকতে পারিনি, সংহতি তো রয়েছেই এবং জোরালোভাবে দাবী জানাই, অবিলম্বে চা শ্রমিকদের এই দাবী মেনে নেওয়া হোক। শ্রমিক হিসাবে, এই দাবী তাদের কাছে ন্যায্য দাবী। নাগরিক হিসাবে আমি, আমরা মনে করি এটা টাকার পরিমাণ আরো বেশি হওয়া উচিৎ।