বনজ্যোৎস্না ও আবীর গন্ধ
এক
বুকের তলায় গহীন সাগর বুকের তলায় বন্যা
বুকের নীচে কথার পাহাড় শুনবি নাকি কন্যা
বুকের মাঝে জমিয়ে রাখা স্মৃতির কালো মেঘ
বুকের কাছে থমকে দাঁড়ায় সময় গতিবেগ
বুকের নীচে সাত রাজা-ধন ব্যথার মণিহার
বুকের মধ্যে গভীর ক্ষত দারুন হাহাকার
বুকের মাটি খুঁড়লে পাবি নিঝর ফল্গুধারা
বুকের নীচেই গুমরে মরে আমার বাঁচা মরা
বুকের ওপর যোজন সেতু অলীক পারাপার
বুকের মাঝে ভূবনডাঙা স্বর্গ তোমার আমার
বুকের দহে উজান ভাঙে প্রেমের চোরাস্রোত
বুকের ছায়ায় তুমি আমি জড়িয়ে ওতপ্রোৎ
বাইরে যখন ঝড়তুফানী বুকে ফাগুন মাস
বুকের মধ্যে তোমার আমার দীর্ঘ অজ্ঞাতবাস।
দুই
কথা- আজ সারাদিন, জানো, মনে মনে তোমায় চেয়েছি আর
সময়কে যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছি সন্তর্পনে
পাঁচ হাতে খরচ না হয়ে যায় রাতারাতি –
অথচ তুমি যখন পাশে থাকো ডানা গুটিয়ে বসে থাকি
অথর্ব পেঁচার মতন – কি জানি কি ভয়ে মনে মনে
সর্বনাশা ঝড়ের পূর্বাভাস গুনি
উপকথা- তোমার কাছে হয়ত কবিতার মতো শোনাবে, তবু বলি
ডানা মেলে ফুলের ওপর না বসলে প্রজাপতি, ফুলেরও অস্বস্তি
প্রজাপতিকেও বড় অপ্রকৃতিস্থ লাগে –
নিজেকে বেঁধে রেখে নিজের প্রকৃতিকে শাস্তি দাও, আমাকেও …
অবশ্য অজানা ভয়ে বুকের ভিতর তখন দামামা বাজে –
ভয়টা যে নিজেকে নিয়েই, সে তো জানি,
কথা- ভাবতে পারো মেঘ ঝেঁপে হুড়মুড়িয়ে অকালে বৃষ্টি নামলে
কি প্লাবনে ভেসে যাবে পৃথিবীর মাটি– বৃষ্টি বড় নির্বোধ
সমাজ সংস্কার আদব মানে না–
যদিও বৃষ্টির আলাদা সংসার আছে – মেঘেদের ঘরবাড়ি –
আনাচেকানাচে অজস্র তারা প্রতিবেশী– নিয়ম শাসন
সন্তানসন্ততি – অনিচ্ছার দায়,
উপকথা- জানি জানি, যে স্রোতে ভেসে যায় নদী
অন্তঃস্থ মাটি জানে কেন নদী ভাসে –
কেন তার চোখ ভরেজলস্রোত হাসে – কেন পাড় ভাঙে
নদীও শান্তি চায় – যথেচ্ছ কোলাহলে মন ভার করে –
জীবন কৃপণ বড় একমুঠো শান্তি সে চড়া দামে বেচে –
ইচ্ছা অনিচ্ছার দ্বন্দ্ব বড় দায়।
তিন
যখন তোমায় ছুঁয়ে থাকি
তোমার ভালোবাসার হাতে আমার পাগল হাত
সাগরডোবা ঠোঁটে আমার হারিয়ে যাওয়া কথা
মেঘলা চুলের অন্ধকারে আমার নেভা দিন
অগাধ বুকে তলিয়ে যাওয়া আমার সারা রাত
যখন তোমায় নিয়ে থাকি
নিঝুম রাতের স্বপ্নমাখা অঝোর সোহাগবৃষ্টি
তোমার আমার জলের শরীর ভীষণ স্রোতে ভাসে
অশ্বগতি ভুলে সময় বিহ্বলতায় স্তব্ধ
নশ্বরতার মাঝেও আবার নতুন প্রেমের সৃষ্টি
যখন তোমার ভাবে থাকি
মনের মধ্যে উথালপাথাল ঘুমিয়ে থাকে বিশ্ব
একলা ঘরে আকাশ গোঙায় বজ্রপাতের শেষে
অপেক্ষাতে প্রহর কাটে কখন পোহায় যাম
উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সূর্যোদয়ের দৃশ্য।
চার
তুমি নাকি দশদিগন্ত আকাশ
কেমন তুমি নিমীল আকাশ দেখবো বলে
তোমার বুকে ভাসিয়ে দিই নিজেকে
নীল নীল মেঘেদের কবোষ্ণ তুলোর পাহাড়
রহস্য পালক দিয়ে সন্তর্পনে ঢাকা
আশ্চর্য রামধনু রঙ শরীরের সবখানে
তুমি নাকি খরস্রোতা নদী
কেমন তুমি নদী হয়েছ দেখবো বলে
অবগাহন ডুবি তোমার স্নিগ্ধ শীতল জলে
লজ্জার নুড়ি সরিয়ে অতলের সন্ধানে
বেলা ফুরিয়ে যায় – তল পাই না
আমার ছেলেমানুষী দেখে তুমি হাসো
তোমায় নিয়ে অনেক কথা শুনি
তোমায় নিয়ে অনেক গল্প অনেক গুঞ্জন
ফুলের বনে তোমায় নিয়ে কথার চালাচালি
গুজবের জেরে বাতাসে কান পাতা দায়
অথচ মাটিতে তোমার পা পড়লে
দশ থেকে আশি সবার বুকে কাঁপন।
পাঁচ
যেখানে তোমার আমার নিভৃত আলাপ
হাতে হাত রেখে নির্দ্বিধায় লজ্জা বিনিময়
মেঘশরীরের ডানা মেলে নিশ্চিন্ত উড়ান
ঘরে ফেরা পাখীদের উদ্বিগ্নতা নেই
যেখানে হৃদয়েরা পাইনের গাছ হয়ে ঢলাঢলি করে
অবেলায় বৃষ্টি মাখে
সূর্যালোক পান করে বিমুগ্ধতায়
সেইখানে এসে সবুজের হাত ধরে বনচারী মেঘ
ভালোবাসাবাসি করে আমাদের মতো
নবীন শিক্ষার্থী ওরা আমাদের কাছে
ভালোবাসা শেখে
প্রেমের পাঠ নেয় সৃষ্টির আশ্বাসে
ভালোবাসা সময়ের চেয়ে দ্রুত ক্ষত ভরে দেয় –
ভরে দিতে জানে।
ছয়
এত কাছাকাছি তবু একমুঠো ছোঁয়া পেতে কত সতর্কতা
কত অগনন কষ্ট মুখ বুঁজে – কত অসহ্য দিনগোনা অহরহ
কতটা সাহস বুকের মধ্যে জড়ো করে দুবাহু বাড়ানো
কত ভয়ার্ত পদক্ষেপ– শঙ্কিত চোরা চোখে মৌন আন্দোলন
আদিগন্ত চাওয়া ঠেলে এক চিলতে আদরেতে হৃদয় ভরানো কোনও মতে
এই একফোঁটা জীবনের কত দাম তুমি আমি জানি
আর জানে শেষ রাতে ফুল হতে চাওয়া অসমাপ্ত কুঁড়ি
ফুরিয়ে যাওয়ার আগে হয়ত বা দিনান্তের আলো
এই ক্ষণটুকু চেয়ে মাথাকুটে মরে–
এভাবেই মরেছি তো কত অগণনকাল কে আর গুনেছে
মৃত্যুর দুয়ার থেকে আমাদের মতো কে আর ফিরেছে
সহস্র মৃত্যুর মাঝে আয়ুর সামান্য ক্ষণটুকু
অমরত্ব পেয়ে যাক– তুমি আমি মরে যাই ক্ষতি নেই
ক্ষতি নেই
নিঃশর্তে মৃত্যুকে এ জীবন লিখে দিয়ে যাবো।