মুহাম্মদ আবুল হুসাইন এর গল্প: আত্মত্যাগ

মুহাম্মদ আবুল হুসাইন
মুহাম্মদ আবুল হুসাইন
10 মিনিটে পড়ুন

রাশিয়ার একটি মফস্বল শহরে বাস থেকে নামার পর ক্লান্ত লাইটা একটি সরু পথ ধরে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো। তার হাতে ছিল একটি ছোট ব্রিফকেস। কনকনে ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য সে যথাসম্ভব গরম কাপড় পড়ে নিয়েছিল। প্রায় আধা কিলোমিটার হাঁটার পর সে তার গ্রামে পৌছুলো।

গ্রামের প্রথম বাড়িটাই ছিল ভ্লাদিমির সাহেবের। লাইটা লক্ষ্য করলো, দরজার নাম ফলকে লেখা আছে ‘এ কে ভ্লাদিমির। সে আলতো করে ডোর বেলটাতে চাপ দিল। সাথে সাথেই ভিতর থেকে একজন মানুষের ডাক শোনা গেল, কে? স্যার আমি, লাইটা’ বিনীত কন্ঠে জবাব দিল সে।

দরজা খুলে গেল। ষাট বছর বয়সি যে ব্যক্তি বেরিয়ে এলেন তিনি আর কেউ নন, এ কে ভ্লাদিমির। লাইটা হাসিমুখে তাকে অভিবাদন জানাল। ভ্লাদিমির আবেগে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছো আমার পুত্র?’ লাইটা বলল, ‘আপনার দোয়ায় আমি ভাল আছি।’

ভ্লাদিমির লাইটাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেট বন্ধ করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, লাইটা, তোমার পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে?

- বিজ্ঞাপন -

‘জ্বি, আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থান লাভ করেছি। আমি স্বর্ণপদক পেয়েছি।’ উত্তরে বলল লাইটা। সে পকেট থেকে স্বর্ণ পদকটি বের করে ভ্লাদিমির সামনে টেবিলের উপর রাখল। ভ্লাদিমির খুব খুশি হলেন। তিনি লাইটার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, আজ যুদ গুসেভ বেঁচে থাকতো, তোমার এই সফলতায় সে কতই না খুশি হত। সে আনন্দে উল্লাসিত হয়ে দৌড়ে গ্রামের রাস্তায় চলে যেয়ে চিৎকার করে বলত, ‘‘আমার লাইটা ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় সেরা হয়েছে, সে গোল্ড মেডেল পেয়েছে।’’

বাবার কথা শুনে লাইটার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো। সে তার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। তারপরও তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।

ভ্লাদিমির তার বোকামি বুঝতে পেরে এবং পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করার জন্য তার ভৃত্যকে ডাকলেন, ‘‘ল্যাস্সি, তাড়াতাড়ি করে দুই কাপ গরম কফি নিয়ে এসো। আজ অনেক ঠাণ্ডা পড়েছে।’’ ‘না স্যার, কফি পরে খাব, আমি আগে আমার বাবার কবরের কাছে যাব’’ চোখ মুছতে মুছতে বলল লাইটা। ‘ঠিক আছে বাবা, তুমি যেমনটা চাও। আমিও তোমার সাথে যাব।’’ লাইটা’র কাঁধে হাত রেখে বললেন ভ্লাদিমির। পরে দুজনই কবরস্থানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল।

কবরস্থানটি গ্রাম থেকে বেশি দূরে নয়। সামান্য দূরত্ব পার হয়ে তারা সেখানে পৌছে গেল। সেখানে ছিল সাত-আটটি কবর, তার মধ্যে একটি ছিল লাইটার বাবার কবর। কবরের নাম ফলকে লেখা ছিল, ‘‘কর্তব্যনিষ্ঠ গুসেভ, যে তার মনিবের জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছিল।’’ লাইটার চোখ আবার পানিতে ভরে গেল, টপ টপ করে পড়তে লাগল গাল বেয়ে। ভ্লাদিমির নিরবে লাইটার পিছনে দাঁড়িয়ে রইলেন। তৎক্ষণাৎ তার চোখের সামনে বিশ বছর আগে ঘটনাটি আবার ভেসে উঠল।

সেদিন বিকেলটা ছিল অনেক হাস্যোজ্জ্বল। আকাশে মেঘের কোন চিহ্ন ছিল না। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তুষারঢাকা পর্বতগুলো এত চমৎকার লাগছিল যে, তিনি ভ্রমণে যাওয়ার লোভ সামলাতে পারছিলেন না। ভ্লাদিমির সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি স্লেজে চড়ে ভ্রমনে যাবেন। সাথে যাবে তার ছেলে ও ভৃত্য গুসেভ। ভ্লাদিমির স্লেজে চড়ে ভ্রমণ করা খুব উপভোগ করতেন। এটি ছিল এমন এক ধরনের বাহন যা বরফাচ্ছাদিত রাস্তার উপর দিয়ে চলত। অনেকটা আমাদের দেশের ঘোড়ার গাড়ির মতই, তবে স্লেজ গাড়িকে ঘোড়ার পরিবর্তে টানতো একদল কুকুর। এটা বরফ প্রধান দেশের একটি জনপ্রিয় বাহন। ঘোড়ার গাড়ির মতই একদল কুকুর বাহনটিকে দ্রুত টেনে নিয়ে যায়। সেদিনও ভ্লাদিমিরদের স্লেজকে তাদের পালিত কুকুরগুলো দ্রুত টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় আচমকা একপাল নেকড়ে কোত্থেকে এসে হাজির। তারা ভ্লাদিমিরদের স্লেজের দিকেই তেড়ে আসলো। নেকড়ের পাল দেখে ভীতসন্ত্রস্ত ভ্লাদিমির সাথে সাথেই গাড়ি ঘুরিয়ে ফেললেন এবং বিপজ্জনক গতিতে ছোটা শুরু করলেন। কিন্তু কুকুরগুলো নেকড়েদের সাথে দৌড়ে পেরে উঠছিল না। নেকড়েগুলো কাছাকাছি চলে আসছিল। এ অবস্থা দেখে ভ্লাদিমির স্লেজের গতি বাড়ানোর জন্য কুকুরগুলোর গায়ে চাবুক মারা শুরু করলেন। কুকুরগুলো সাধ্যমত দৌড়াতে লাগলো, কিন্তু তাতে খুব একটা সুবিধা হলো না। নেকড়েগুলো এখন অনেক কাছে চলে এসেছে।

- বিজ্ঞাপন -

বিপদ বুঝতে পেরে ভ্লাদিমির চিন্তা করলেন তাকে কঠিন কিছু করতে হবে, না হয় তারা সকলেই মারা পড়বেন। এদিকে গুসেভও বুঝতে পারছিলেন। এমন সময় তার মনে পড়ল তার স্যারের রিভরভারের কথা। তিনি চিৎকার করে বললেন, স্যার নেকড়েগুলোকে গুলি করেন, নাহলে ওরা আমাদেরকে মেরে ফেলবে। ভ্লাদিমিরেরও মনে পড়ল, তিনি বললেন, ‘‘ওহ, আমি তো রিভলভারের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। বলেই তিনি রিভলভার বের করলেন এবং তেড়ে আসা নেকড়ে পালের সব থেকে এগিয়ে থাকা নেকড়ের মাথায় গুলি করলেন। নেকড়েটা সাথে সাথে মারা পড়ল।

নেকড়েপাল ছিল খুবই ক্ষুধার্থ। রক্তের গন্ধ পেয়ে তারা আরও প্রলুব্ধ হলো। প্রতিহত করতে না পেরে তারা তাদের সঙ্গির দেহের উপরই ঝাপিয়ে পড়ল। ভ্লাদিমির এক মুহূর্ত স্বস্তি পেলেন। কিন্তু আরও দ্রুততার সাথে তার স্লেজ চালানোর চেষ্টা করলেন, যাতে যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া যায়।

এদিকে, নেকড়েগুলো মুহূর্তের মধ্যেই নিহত নেকড়েটার মাংস খেয়ে সাবার করে ফেলেছে। তারপর আবারও স্লেজের দিকে তেড়ে আসা শুরু করল এবং অল্প সময়ের ব্যবধানেই তারা তাদের কাছাকাছি চলে আসলো। ভ্লাদিমির আবারও গুলি করে আরেকটা নেকড়েকে মেরে ফেললেন। নেকড়েগুলো আবারও মৃত নেকড়েটির উপর ঝাপিয়ে পড়ল এবং মাংস খেয়ে সাবার করে আবার তেড়ে আসলো। এভাবে এটা একটা রুটিনে পরিণত হল। ভ্লাদিমির গুলি করে একটি নেকড়ে মারেন, বাকি নেকড়েগুলো সেটাকে মুহূর্তের মধ্যে ছিড়ে-ফেরে খেয়ে সাবার করে এবং আবার স্লেজের দিকে তেড়ে আসে। এভাবে ভ্লাদিমির একে একে ছয়টি নেকড়েকে গুলি করে মারেন কিন্তু তারপরও নেকড়ের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, তাদের ক্ষুধাও মিটে না আর তারা স্লেজ আরোহীদেরকে তাড়া করাও বন্ধ করে না। সব শেষ নেকড়েটার মাংস সাবার করে বাকি নেকড়েগুলো যখন আবার তেড়ে আসলো তখন ভ্লাদিমিররা তাদের বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে একই সময় তার রিভলভারের গুলিও শেষ হয়ে যায়। অবস্থাটা হয়েছে তীরে এসে তরী ডোবার মত।

- বিজ্ঞাপন -

অনিবার্য মৃত্যুকে উপলব্ধি করে ভ্লাদিমির কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যেও ভীষণভাবে ঘেমে উঠলেন। তিনি অত্যন্ত হতাশ ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। আর কোন উপায় না পেয়ে তিনি আকাশের দিকে তাকালেন এবং ঈশ্বরের নিকট সাহায্য পার্থনা করলেন।

অন্যদিকে, গুসেভ চিন্তা করছিলেন, ‘আমি আমার মনিবের নিকট অনেক ঋণী। তিনি আমাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন, আমাকে খাওয়াচ্ছেন, যখন যা দরকার সাহায্য করছেন এমনকি আমার ছেলেকেও লেখাপড়া করাচ্ছেন। অথচ আজ আমার মনিব যখন বিপদের মুখে তখন আমি তাকে কোন সাহায্যই করতে পারছি না। না, না, আমার কিছু করা উচিত। অবশ্যই আমি এখানে একটা কিছু করতে পারি।’’

ইতোমধ্যে নেকড়েগুলো একেবারে স্লেজের কাছাকাছি চলে এসেছে। মনে হচ্ছে যে কোন সময় তারা বাহনটির আরোহীদেরকে ধরে ফেলবে। ভ্লাদিমিরের ছেলে কেঁদে উঠল। কী করবেন বুঝতে না পেরে ভ্লাদিমির তার ছেলের হাতটা শক্ত করে ধরলেন। গুসেভও খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ তিনি বললেন, ‘‘প্রভু, আমি নেকড়েগুলোর সামনে ঝাপিয়ে পড়ছি, দয়া করে আমার অবর্তমানে আমার ছেলেকে দেখে রাখবেন।’’

ভ্লাদিমির গুসেভের কথায় হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘‘গুসেভ, তুমি এমনটা করতে পার না, এটা অন্যায়।’’ ‘‘প্রভু, আমার ছেলেকে দেখে রাখবেন। আমাকে বিশ্বাস করুন, আমি সঠিক কাজ করছি।’’ এটা বলেই গুসেভ নেকড়ের পালের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

‘গুসেভ…’’ চিৎকার করে উঠলেন ভ্লাদিমির। সত্যিই তিনি তখন ছিলেন একেবারেই অসহায়।

নেকড়েগুলোর সমস্ত মনোযোগ এখন তাদের শিকার গুসেভের উপর। তারা গুসেভের উপর ঝাপিয়ে পড়ল এবং মুহূর্তের মধ্যেই তাকে ছিন্ন-ভিন্ন করে খাওয়া শুরু করল। গুসেভ চিৎকার করে উঠেছিল, কিন্তু তার চিৎকার সেই লোমহর্ষক পরিস্থিতির মধ্যে কিছুক্ষণের মধ্যেই হারিয়ে গেল। ভ্লাদিমির সেই ভয়ংকর দৃশ্য সহ্য করতে পারছিলেন না, তাই তিনি তার মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলেন। তিনি তাড়াতাড়ি তার পুত্রকে নিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করলেন। তাদের দুজনের হৃদয়টা ছিল অত্যন্ত ভারাক্রান্ত।

ভ্লাদিমির দ্রুত বাড়ির ভিতর ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলেন এবং জানালা দিয়ে নেকড়েগুলোর দিকে আবার তাকালেন। পশুগুলো গুসেভের শরীরের মাংস খুবলে খাচ্ছিল। ভ্লাদিমিরের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তিনি ভারাক্রান্ত মনে বললেন, ‘গুসেভ, তুমি মহান। তুমি আমার জন্য তোমার জীবন উৎসর্গ করলে। তোমার আনুগত্যের জন্য সব সময় তোমার কাছে ঋণি থাকব। তোমার এই মহৎ আত্মত্যাগের জন্য বিশ্ব তোমাকে সব সময় স্মরণ করবে।

এই মর্মান্তিক ঘটনা ভ্লাদিমিরকে ভিতর থেকে একেবারে নাড়িয়ে দিল। এখন, তিনি সবসময় গুসেভের চিন্তায় ডুবে থাকেন। তিনি নিশ্চিত হলেন, গুসেভের ছেলে একজন ভাল এবং সফল মানুষ হবে। তাই তিনি তাকে নিয়ে এসে লালন পালন শুরু করেন এবং তাকে একটি ভাল স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। দেখতে দেখতে সময় চলে যায়। এক সময় ভ্লাদিমির চেষ্টা সফল হয়। লাইতা এখন ইঞ্জিনিয়ারিক ডিগ্রী লাভ করেছে। ভ্লাদিমি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। তিনি এই ভেবে স্বস্তি পেলেন যে, গুসেভের ঋণ তিনি কিছুটা হলেও শোধ করতে পেরেছেন।

হঠাৎ, ভ্লাদিমির তার ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি তার মুখ থেকে চোখের পানি মুছলেন, তারপর লাইটা’র পিঠে মৃদু থাপ্পড় দিলেন। লাইতা নিজেকে সম্বরণ করতে পারছিল না এবং ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ভ্লাদিমির তাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং সান্ত্বনা দিলেন।#

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
জন্ম ৯ জুলাই, ১৯৭২, ঢাকা বাংলাদেশ। ঢাকা কলেজ থেকে তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। এ পর্যন্ত যৌবনের যত্ন (২০১৮), ছাত্রজীবন: সাফল্যের শর্তাবলী নামে দুইটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!