বর্ষার মৌসুম। সন্ধ্যা হতেই সুড়সুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ছে লোকজন। সারারাত ঝমঝম বৃষ্টি হবে। চরম আর্দ্রতার কারণে কাপড়ে জমেছে চিতি-গন্ধ, রান্নাঘরে গলছে লবণ আর খাটপালং আসবাব খুলে যাবে বলে আটকে রাখতে হচ্ছে পেরেক ঠুকে ঠুকে। সকালে কিন্তু বৃষ্টি নেই। এ এক আজব দেশ, রাতে বৃষ্টি দিনে ফটফটে।
সাত সকালে কমলার বাগানে, পানের বরজে কাজ রয়েছে, বাজারে যেতে হবে, বাচ্চারা স্কুলে যাবে, গিরিখাত কিংবা ছোটো নদি ডিঙিয়ে। এমনই খরস্রোত নামে এসব নদিতে যে জলের তোড়ে টন টন ওজনের পাথর গড়িয়ে যায় বহুদূর। নৌকোর প্রশ্ন এখানে অবান্তর। তবুও এমন বৈরী পরিবেশে খর-নদী পার হয়ে যায় মেহনতি মানুষ, অদ্ভুত এক জীবন্ত সেতুর ওপর দিয়ে। এই সেতু এলাকার মানুষ নিজেরাই তৈরি করে, স্টিল বা কংক্রিট দিয়ে নয়, জীবন্ত গাছের শেকড় দিয়ে।
বাংলাদেশের উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, যেখানে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল জায়গা চেরাপুঞ্জি। ‘গিনিস্ বুক’ অবশ্য সামান্য ওপরে রেকর্ড করেছে আরেকটি জায়গা, যার নাম মওসিনরাম, চেরাপুঞ্জি থেকে আরো ১৬ কিলোমিটার পশ্চিমে। চেরাপুঞ্জিতে আট মাস অবিরাম বৃষ্টিপাতের জল একঠায় জমে থাকলে তার উচ্চতা হবে প্রায় চার তলা দালানের সমান। পর্যটকরা সেখানে বেড়াতে যায় শীতকালে, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, ৪ মাসের শুকনো মৌসুমে।
চেরাপুঞ্জিকে বাংলায় বলা যায় কমলা রাজ্য, নামের অর্থ অনুসরণ করেই। কমলা ছাড়া এখানে আরো আছে প্রচুর পান-সুপারির গাছ। এই সুপারি গাছের খোল দিয়েই খাসিয়ারা শুরু করে ব্রিজ বানানোর আদি কাজ। প্রথমে সুপারি গাছটাকে দুই ভাগে ভাগ করে নেয় তারা। তারপর হেলালি চাঁদের মতো খোদাই করে নেয় তার বুক। এই খোলের ভেতর দিয়েই তারা প্রবাহিত করে গাছের শেকড় যার একটি হলো রবার গাছ (Ficus elastica)।
শেকড় বাড়তে থাকে ধীরে, বাড়তে বাড়তে এক সময় নদীর অন্য পাড়ে মাটিতে গিয়ে পৌঁছায়, বেশ কয়েক বছর পরে। সেখানে মাটির রস পেয়ে শেকড় পুষ্ট হলে তাকে কাজে লাগানো হয় সেতুর মূল কাঠামো তৈরিতে। অন্যান্য শেকড়গুলো এবার প্রবাহিত করা হয় ব্রিজের ডেক নির্মাণে। তারপর আরো কিছু শেকড়, এমন কি সুলভে পাওয়া গেলে, দীর্ঘ কাষ্ঠল লতা লিয়ানা (Liana) দিয়েও তৈরি হতে পারে এর রেলিং। পাথুরে মাটির কুচি দিয়ে ভরাট করা হয় ডেকের যাবতীয় ছিদ্র আর তার ওপর পাতলা পাথর বা সুপারির কাণ্ড বিছিয়ে দেয়া হয় চলাফেরার জন্য। অনেক ক্ষেত্রে বাংলার আদি বট Ficus beghalensis এর মূল এবং অস্থানিক শেকড়ও ব্যবহার করা হয়েছে এ ধরনের যুগব্যাপী সেতু নির্মাণে। হয়তো নির্বাচিত কোনো স্থানে গিরিখাতের দুই পাশে লাগানো হয়েছে দুটি বট গাছ। দুটো গাছের শেকড়কেই প্রবাহিত করা হয়েছে বিপরীত দিক থেকে। তারপর মাঝখানে দুই গাছের শেকড় দিয়ে বেণী পাকিয়ে সেটাকে শক্ত করা হয়েছে।
মোটামুটি ৫০০ বছর আগে থেকেই এতদঞ্চলে এসব সেতু নির্মাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়। অতিবর্ষণে পচে যাবার কারণে ভারত-বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতো কাঠ বা বাঁশ জাতীয় উপাদান দিয়ে এসব সেতু নির্মাণ ফলপ্রসু হতে পারেনি কখনো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সোয়া কিলোমিটার উঁচু মেঘ-ছোঁয়া পাহাড়ি এলাকার খাসিয়া-জয়ন্তিয়া আদিবাসীরা দীর্ঘজীবী গাছের শেকড় দিয়েই তৈরি করে আসছে এসব অত্যাবশ্যকীয় জীবিত সেতু। একেকটি সেতু নির্মাণ করতে এদের সময় লেগে যায় ১০ থেকে ১৫ বছর যার ওপর দিয়ে ৫০ জন মানুষ একবারে হেঁটে যেতে পারে, এবং যার কোনো কোনোটি ১০০ ফুটের চেয়েও বেশি লম্বা হয়।
যত দিন যায় কংক্রিট আর স্টিল নির্মিত সেতুর আয়ু নিয়ে আধুনিক টেকনোলজির দুর্ভাবনা বাড়তে থাকে কিন্তু জীবিত সেতুর ক্ষেত্রে হয় তার বিপরীত। যত দিন যায় তত পুষ্ট হতে থাকে গাছের শেকড়, শক্ত হতে থাকে সেতুর শরীর। জীব-প্রকৌশল বা বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং এখানে বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে। ইংরেজিতে এর নাম হয়েছে লিভিং ব্রিজ (Living bridge) যা দেখার জন্য পৃথিবীর দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে জড় হয়।
খাসিয়া উপজাতির মানুষ মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বাস করে। এসব ব্রিজ নির্মিত হয়েছে নারীনেতৃত্বেই। তবে নির্মাণ-পরিকল্পনা থাকলেও স্বেচ্ছাসেবীদের ভূমিকাও এখানে উল্লেখযোগ্য। সেতু পার হওয়ার সময় একজন খাসিয়া মানুষ সেতুর পাথর ঠিক করে দিতে পারে, স্কুল থেকে ফেরার পথে একটি খাসিয়া মেয়ে রেলিঙের খুলে যাওয়া শেকড়টা ঠিকমত বেঁধে দিতে পারে।
এসব জীবন্তু সেতুদের মধ্যে ট্যুরিস্টদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে নংগ্রিয়াত গ্রামের একটি দ্বিতল সেতু যা ‘উমশিয়াং ডবল-ডেকার’ সেতু নামে পরিচিত। মেঘালয়ের রাজধানী শিলং থেকে এর দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। এই সেতুর বয়স ২০০ বছরেরও বেশি। পুষ্ট শেকড়ের কাঠামোতে এখনও এটা বলিষ্ঠ রয়েছে। এই সেতুতে পৌঁছাতে গেলে পথে আরো কিছু সেতু পার হয়ে যেতে হয় যার মধ্যে স্টিলের তৈরি একটি হ্যাঙ্গিং ব্রিজও রয়েছে। এই ঝুলন্ত লোহার সেতু ১০০ ফুটের অধিক বিস্তৃত নদীর ওপরে বানাতে হয়েছে বলে প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে বানানো সম্ভব হয়নি। পরিবেশের সঙ্গে মোটামুটি খাপ খাইয়ে রঙ মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে একে, যা দৃষ্টিনন্দন না হলেও তেমন দৃষ্টিকটূ নয়।
এখন নির্বনায়নের যুগ। সারা পৃথিবীতেই চলছে এর তৎপরতা, খাসিয়া-জয়ন্তিয়া পাহাড়ের বৃষ্টিবনও এই প্রবণতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। শীতকালে জলের অভাবে গাছের শেকড় দুর্বল হয়ে পড়ছে, চেরাপুঞ্জির মত বৃষ্টিবহুল জায়গাতেও শুকনো মৌসুমে বাইরে থেকে ট্রাক ভরে আনতে হচ্ছে পানীয় জল। আধুনিক প্রযুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে এলাকাবাসীর চেতনায় ঢুকে পড়তে চাইছে ইস্পাতের সেতু। সৌভাগ্যের কথা, ডেনিস রায়েন নামে হলিডে রিসর্টের এক প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষ এলাকাবাসীদের এই অনুপম ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করতে সমর্থ হয়েছেন।