যাপনের স্বরলিপি
প্রতিদিনের কালির আঁচড়ে ডায়েরির পাতায় সাজানো যাপনের ইতিকথা। শিকড় থেকে কান্ড, শাখা-প্রশাখা, ফলফুলন্ত। আবার ঝরা পাতা, তরলের অভাবে শুকিয়ে মাটিতে মিশে যাওয়া দীর্ঘায়িত একটা আস্ত অরুণাচল বুকের গভীরে।
সুখ দুঃখ, সাদাকালোর মেলবন্ধনে জীবনের স্থাপত্য। পরম প্রশস্তি অল্পস্বল্প চাওয়া পাওয়া ঘিরে। ভালোবাসায়, ভালোলাগায় ঘর বাঁধা। দিনান্তে ক্লান্ত পাখির নীড়ে ফিরে আসা।
শৈশবের পুতুল খেলা, কৈশোরের জলকেলি, যৌবনের বসন্ত একদমকায় উড়িয়ে নিয়ে যায় সময়। ভারী চশমার কাঁচ, জরায়ুর অক্ষমতা, চামড়ার বলিরেখা, অপরাহ্ণের আলোয় লেখে বেলা শেষের গান। “ঐ আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।”
কিশোরী বেলা
ভাঙা বাড়িটার চিলেকোঠা থেকে নীল আকাশটার সাথে উঁচু স্বরে কথা বলা যায়। কথারা নিছক শব্দমালা নয়। স্বচ্ছ জলের গভীরতা থেকে উঠে এসে মাছরাঙ্গা টুপ্ করে গিলে নেয় অঙ্গীকারবদ্ধ কথামালা।
বেলা বাড়লে শরতের উন্মাদনায় নুপুরের রিনিঝিনি, উত্তালকঙ্কণ, মোস্তাকের শীতল পাটি জুড়ে মেঘ রৌদ্রের লুকোচুরি। ভাঙ্গা স্বপ্নের উপর জমিন জরিপ করে কিশোরীর চোখে উৎসবের রঙ। কে বা কারা যেন বলেছিল নীল নদীর অববাহিকা ধরে ফিরে আসবে তার কাছে। দ্বারে দ্বারে সময় ফুরিয়েছে, কেউ ফিরে আসেনি।
খোলা বই, এলো চুল, এলোপাথাড়ি হাওয়ায় জানলার কার্নিশ বেয়ে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় মন ছুটে চলে উন্মত্ত আকাঙ্ক্ষায়। বিজন ঘরে, সাদা পাতায় সেজে ওঠে অস্তরাগের কবিতা।
মেয়েবেলা
ছেলেবেলার শখের খেলনা বাটি এক কোণে জমা রেখে কুয়াশাঘন প্রপাতে অবিরত বয়ে চলা। আটপৌরে জীবনযাত্রায় মেনে নেওয়া বা মানিয়ে নেওয়া।
রূপকথাদের ঘুম পাড়িয়ে বাস্তবতার কুন্তলে দীর্ঘ সময় পথপরিক্রমা, কখনো লেলিহান শিখায় অভিসম্পাত, কখনো জলীয় বাষ্পে ঝিরিঝিরি ধারাপাত। ভাবনাগুলো লাগাম ছাড়া, এদিক-ওদিক ছোটে।
তর্জনী তুলে সময় শাসায়। এবার তবে অবগুন্ঠনের পালা। জীবনভর আলো আঁধারি খেলায় অজস্র বাজনা। তাই বুঝি বিচিত্র কোরকে বিধাতার দান একটি মেয়েবেলা।
তোমায় আমায় মিলে
কতবার সাধ জাগে তোমায় নিয়ে একটা কবিতা লিখব, অক্ষরের শতদল বুকের ভেতর তোলপাড় করে। স্রোতে কেঁপে উঠি। বর্ণ ছন্দের মেলবন্ধন ঘটে না।
বহুবার স্বপ্ন দেখি কবিতার করিডোরে তোমায় নিয়ে বসন্ত সাজাবো। নিরন্তর কালো মেঘ ঘিরে ধরে সুতীব্র নীলে। সীমানাহীন ভয়ে কেঁপে ওঠে হৃদয়। অলিখিত সাদা পাতায় এক বর্ণও লেখা হয়ে ওঠে না।
প্রতিবার ভাবি, মৌনতা ভেঙে কবিতার শিকড় গড়ে নেব তোমার মনের ভিতর। মন নিয়ে খেলা করে পলাশ রোদ্দুর। বর্ণমালায় ডুবে সন্ধ্যা নেমে আসে, আলো জ্বলে না। প্রতীক্ষার প্রহর গুণে কাতারে কাতারে বৃষ্টি নামে ঝেঁপে।
তবুও সবুজ গুল্মের ছায়ায় ভালবাসা সংক্রামিত হয় না।
মিলন
উড়িয়ে উত্তরীয়, মত্ত ভালবাসায় ঢেকে নিলাম । শ্রাবণের অঝোর জলধারায় নিশ্চিহ্ন কাল রজনীর ভয়াবহ তান্ডব। উদাসীনতা ছুয়ে যায় সমুদ্রের বুকে। ফেনিল জলরাশির বুকে ঝিনুক মালার গভীরে উজ্জ্বল মুক্তো লুকিয়ে রাখি সযত্নে অন্দরে।
আজ আর অতীত কাতরতা নয়, সূর্যরশ্মির জাগরণ ও বিচ্ছুরণে সমগ্র জগৎ জুড়ে উন্মাদনা। অমোঘ আকর্ষণ নীল সবুজে। মিলনের মাঝেই অপার ছন্দ। দুই বর্ণ স্তরে স্তরে সাজিয়ে তোলে অক্ষর মালা।
মেঘের দল উড়ে যায় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। দগদগে ক্ষতের উপর প্রলেপ দাও নরম হাতে। স্বপ্ন নিয়ে স্বপ্ন সাজাও মুমূর্ষের চোখে। শরতের নীল আকাশে উৎসবের রং মাখে বিবর্ণ ক্যানভাস।
বিসর্জন
সবে মাত্র মেঘ পিওন ফিরে গেছে দস্তা দস্তা চিঠি নিয়ে না ফেরার দেশে। সোনালী আলোয় ঘাসের মাথায় সোনালী শিশির বিন্দু। শেফালী ফুলে বিছানো নিকানো উঠানে রোদ বৃষ্টির গল্প লেখে রাইকিশোরী। তার বুক জুড়ে প্রবল উত্তেজনা। বহুদিন পর গন্ধরাজ ফুটেছে আকাশে। কামিনীর পরাগে মত্ত প্রজাপতিরা দিশেহারা।
চতুর্দিক থেকে ভেসে আসছে শব্দের জোয়ার। ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ ধ্বনিতে আগমনীর আগমন। নবীন ধানের জমিতে নবীন ফসলের ঘ্রাণ। রঙবেরঙের পরিযায়ী পাখির আনাগোনা। আকাশে বাতাসে প্রাণের উচ্ছ্বাসে ব্যাকুল চাওয়া পাওয়া।
শুধু ময়লা ছেঁড়া ন্যাকড়াপড়া ফুল বিক্রেতা ছেলেটি আজ সদ্য মাতৃহারা। উৎসব মুখর কিছু লোক নেশায় উন্মত্ত হয়ে ডাইনি অপবাদে প্রাণ কেড়ে নিয়েছে মায়ের। শূন্যতায় ভারী হয়ে আসে চোখ। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে অনন্ত পথের পথিক প্রস্তুতি নেয় মায়ের শেষ যাত্রার। বোধনের আগেই ঘাটে বিসর্জন।