হঠাৎ করে বরিশালের কীর্তনখোলা ও ঝালকাঠীর বিষখালী নদীতে অস্বাভাবিক লবণাক্ততা দেখা দিয়েছে। এরফলে স্বাদু পানির জলজ প্রাণী হুমকির মুখে পড়তে পারে আশংকা করছে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তবে হঠাৎ করে কীর্তনখোলা নদীর পানিতে লবণাক্ততা স্বাভাবিক সময়ের চারগুণের বেশী হওয়ার কারন বলতে না পারলেও, এটি উজান থেকে আসা পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি বা বৃষ্টিপাত কম হওয়ার ফলে হতে পারে বলে ধারনা করছেন তারা। অন্যদিকে বিষখালী নদীর লবণাক্ততা বিষয়ে এখন পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কোন তথ্য দিতে পারেননি। তাদের বক্তব্য স্বাভাবিক রুটিন অনুসারে দক্ষিণাঞ্চলের ১৫ টি নদীর পানি পরীক্ষা করে বিশ্লেষন করা হয়। এর মধ্যে শুধু মাত্র কীর্তনখোলা নদীর পানির রিপোর্ট পাওয়া গেলেও অন্যান্য নদীর রিপোর্ট পেতে আরো কয়েকদিন সময় প্রয়োজন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। তবে স্থানীয়দের মতে, বিষখালি নদীতেও মাত্রাতিরিক্ত লবণের উপস্থিতি তারা সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করেছেন।
১৬০ কিমি দীর্ঘ কীর্তনখোলা নদী বরিশালের শায়েস্তাবাদ থেকে উৎপন্ন হয়ে ঝালকাঠী জেলার গাবখানে পড়েছে।
গত প্রায় দুই সপ্তাহ যাবৎ কীর্তনখোলা পাড়ের বস্তিবাসীদের মধ্যে কীর্তনখোলা নদীর পানির লবণাক্ততার বিষয়টি নজরে আসে। নদীতে গোসল করতে গিয়ে পানিতে মুখ দেয়া মাত্র অনেকে ফিরিয়ে নেয়।
কীর্তনখোলা পাড়ের স্টেডিয়াম বস্তিতে বসবাসকারী বিথী আক্তার জানান, হঠাৎ করে গত বেশ কয়েকদিন ধরে কীর্তনখোলার পানি মুখে দিলে নোনতা লাগছে। এই নদীর পানিতে তারা গোসল করলেও, বর্তমানে অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারনে তারা গোসল করতে পারছে না।
কীর্তনখোলা নদীতে খেয়া পারাপারকারী মোসলেম মাঝি জানান, গত এক মাস যাবৎ এই নদীর পানিতে হঠাৎ লবণাক্ততার বেড়েছে। আগে এই পানিতে তারা হাত মুখ ধুলেও বর্তমানে লবণাক্ততার কারনে তারা মুখ ধুতে পারছে না।
কীর্তনখোলা নদীর পূর্ব তীরের চরকাউয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম ছবি জানান, গত এক মাস যাবৎ পানিতে লবণাক্ততার কথা এলাকাবাসী তাকে জানিয়েছে।
মঙ্গলবার বরিশালের এক টিভি সংবাদ কর্মী পারভেজ রাসেল নদীর পানির লবণাক্ততা নিয়ে রিপোর্ট করার প্রয়োজনে পানি মুখে দিয়ে জানান, এর স্বাদ নদীর পানির মতো নয়, কুয়াকাটার সমুদ্রের পানির মত নোনতা লাগছে। হঠাৎ করে নদীর মিষ্টি পানি তীব্র নোনতা হওয়ায় অনেকেই পরিবেশ বিপর্যয় আশংকা করছেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় অফিসের সহকারী বায়োকেমিষ্ট মুনতাসির রহমান জানান, এই নদীর চরকাউয়া, লঞ্চঘাট ও দপদপিয়া পয়েন্টে, গত ৭ মার্চ নদী পানি পরীক্ষা করে পানিতে লবণাক্ততার পরিমাপক ইলেকট্রিকাল কনডাকটিভিটি (ইসি) পাওয়া গেছে ১৩৬০, মাইক্রো সিমেন্স পার সেন্টিমিটার। যা স্বাভাবিক সময়ে ৩০০-৪০০ মাইক্রো সিমেন্স পার সেন্টিমিটার পাওয়া যেত। সাধারণত ইসি ১২০০ পর্যন্ত স্টান্ডার্ড ধরা হয়ে থাকে।মুনতাসির জানান পানিতে লবণ বেড়ে গেলে ইসি বেড়ে যায়।
তিনি জানান ’ আমরা ইসি চারগুণ বেশী হওয়ায় প্রথমে মনে করেছিলাম রিডিং ভুল উঠেছে, পরে ৩ বার পরীক্ষা করলেও একই রিডিং আসে, তখন নিশ্চিন্ত হই হঠাৎ করে পানি লবণাক্ত হয়ে গেছে। তবে এতটা লবণাক্ততা আর কোন সময় হয়নি, এটি অ্যালর্মিং।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কামরুজ্জামান সরকার জানান, হঠাৎ পানিতে লবণাক্ততার বৃদ্ধি চিন্তার কারন। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়া বা উজান থেকে আসা পানিতেও লবণাক্ততা বৃদ্ধি এর কারন হতে পারে। এর ফলে স্বাদু পানিতে বসবাসকারী জলজপ্রাণী হুমকির মুখে পড়তে পারে। স্বাদু পানির আবাস স্থল ধ্বংস হলে জীবন জীবিকায় এর প্রভাব পড়বে। এর সাথে নির্ভরশীল মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তবে আমরা এখনই এর সুনির্দিষ্ট কারন বলতে পারছি না। এ বিষয়ে আরো পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরের সূত্রটি জানায়, গতবছরও বলেশ্বর নদীতে হঠাৎ লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছিল। পরে দেখা গিয়েছিল যে শাখা নদীর মাধ্যমে উজানের পানি আসত সেটি বাধাগ্রস্থ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে বাধা অপসারন করা হলে পুনরায় পানির লবণাক্ততা স্বাভাবিক হয়ে আসছিল।
তবে পরিবেশ অধিদপ্তর ঠিক কয়টি নদীর পানি লবণাক্ত সীমার উপরে আছে, তা এই রিপোর্ট পর্যন্ত জানাতে পারেনি। ঝালকাঠীর জেলার রাজাপুর উপজেলার স্থানীয় মানুষরা জানিয়েছে যে গত কয়েকদিন ধরে নদীর পানি নোনতা হয়ে গেছে। এর ফলে তারা মহাবিপর্যয়ের আশংকা করছেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এই সূত্র জানায়, তারা ১৫ টি নদীর পানি পরীক্ষা করে। তবে অন্যান্য নদীর পানির মান নিয়ে তারা এই মুহুর্তে বলতে পারছে না।
এদিকে বরিশালে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় লবণাক্তা এখন প্রধান সমস্যা বলে স্বীকার করেছেন দশমিনা বীজ উৎপাদন খামারের উপ পরিচালক শেখ ইকবাল আহমেদ। তিনি জানান’ এই অঞ্চলে লবণের কারনে কৃষি উৎপাদন কমে গেছে, গত বছর লবণের কারনে এখানে বীজের উৎপাদন টার্গেট এর চেয়ে কম হয়েছিল। এখনই লব্ণ সহনীয় বি আর-৬৭ জাতের ধান উৎপাদনে মনোযোগী না হলে কৃষি উৎপাদনে বিপর্যয় নামতে পারে। নদ নদীর পানি তীব্র লবণাক্ত হয়ে উঠলে এর প্রভাব ইলিশের বিচরণেও প্রভাব সৃষ্টি করবে বলে পরিবেশবিদরা মনে করেন। এর ফলে ধান নদী খালের সবুজ, শস্য শ্যামলা বরিশাল এর খাদ্য ভান্ডার এর তকমাও খুলে পড়তে পারে। লবণাক্ত নদীর পানি দিয়ে কৃষি ও সেচকাজ অসম্ভব জলে জানিয়েছে কৃষকরা। তারা জানান একবার জমিতে লবণ পানি গেলে বেশ কয়েক বছর কাঙ্খিত ফসল উৎপাদন সম্ভব নয়।
এদিকে পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধিতে উদ্বেগ জানিয়েছে, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)বরিশাল বিভাগীয় অফিসের সভাপতি রফিকুল আলম। তিনি জানান , অবিলম্বে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণ জেনে তার সমাধান না লে দক্ষিণাঞ্চলের জলজ বাস্তুতন্ত্রে তা আঘাত করতে পারে। এর ফলে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে।
পরিবেশ কর্মী শুভংকর চক্রবর্তী জানান, নদ নদীর পানিতে অস্বাভাবিক লবনের উপস্থিতি দক্ষিণাঞ্চলকে মরুকরণের দিকে ঠেলে দিতে পারে, বিষয়টির অনুসন্ধান করে এখনই এর সমাধানে ত্বরিৎ ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতের ভয়ংকর রূপ আমাদের দেখতে হতে পারে।