গল্পকার পার্থ প্রতিম পাঁজা’র ছয়টি অণুগল্প

ড. পার্থ প্রতিম পাঁজা
ড. পার্থ প্রতিম পাঁজা
13 মিনিটে পড়ুন
সাময়িকী আর্কাইভ

জীবনানন্দ সিনড্রোম

মাঝ রাত। কিছুতেই ঘুম আসেনা শুভাশীষের। বিছানা ছেড়ে সে ছাদে চলে আসে। ছাদে তখন যেন আকাশটা নেমে এসেছে। আকাশের উজ্জ্বল তারারা যেন মেলা বসিয়েছে ছাদে। সেই তারাদের সঙ্গে সে খেলা করে। তার গায়ে, হাতে, মুখে, বুকে ছড়িয়ে পড়ে তারারা। হঠাত্‍ তার মনে হয় স্ত্রী নন্দিতাকে ডেকে আনলে খুব ভাল হতো। দৌড়ে গেল সে স্ত্রীর কাছে। ঘুম থেকে তাকে ডেকে তোলার খুব চেষ্টা করল সে। কিন্তু নন্দিতা বিরক্ত হয়ে উল্টে শুয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
ছাদে ফিরে গিয়ে শুভাশীষ একাএকাই তারাদের সঙ্গে খেলতে থাকে। অপার্থিব সেই খেলা! খেলতে খেলতেই তার মনে হয় এই নশ্বর জীবন অর্থহীন, ওই ঘুমন্ত স্ত্রী ,সংসারেরও কোনো অর্থ নেই তার কাছে। তার চেয়ে ঢের ভালো এই তারাদের সঙ্গে খেলতে খেলতে তারাদের দেশেই চলে যাওয়া-‘সাতটি তারার তিমির ঘনিয়ে ওঠে যেখানে।’ তারাদের সঙ্গে খেলতে খেলতেই তাই সে ছাদ থেকে তারাদের দেশে উড়ে যাওয়ার জন্যে ডানা মেলে উড়তে থাকে…
তারপর হঠাৎ একটি শব্দ, ঝুপ! এবার শুধু তারায় তারায় অভিসার!

পরকীয়া

ফালতু কথা একদম বলবেনা। আমি তোমার কোন অভাবটা রেখেছি?জন্মদিন,বিবাহবর্ষিকীতে দামী সোনার গয়না, মাঝে-মধ্যেই মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা, শহরের সেরা রেস্টুরেন্টে খাওয়ানো, বছরে অন্তত দুটো বড় ট্যুর- আর কী চাই তোমার?
তোমাকে চাই তোমাকে। তোমার মন, তোমার শরীকে- সেই আগের মতো ।সত্যি, ভাবতে অবাক লাগে, আমরা নাকি বিয়ের আগে আট বছর প্রেম করে কাটিয়েছি!
মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজের ওয়ার্কলোড বোঝো? সারদিনের নাকে দড়ি দেওয়া দৌড়ঝাঁপের পরে শরীর ও মনের কিছু অবশিষ্ট থাকে? আমি বলেই তারপরেও এতকিছু করি তোমার জন্যে। আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব নয়, ব্যাস!
তা সম্ভব হবে কী করে! তৃষা, সৃজিতা, রুমনিদের জন্যে তো তোমার ঠিক সময় বেরিয়ে যায়?
দেখো, কলিগ আর বন্ধুর বউদের নামে এই সব আলফাল কথা একদম বলবেনা।
কী করবে, মারবে? মারবে আমাকে? মারো, মেরে শেষ করে দাও। মরে বাঁচি আমি। আমার তো আর কোনো দাম নেই তোমার কাছে। এখন তুমি নতুন আবিষ্কারের খেলায় মেতেছো না!
কী! …তোমার যা মনে হয় বলো, যা ইচ্ছে হয় তাই করো,আমার কিচ্ছু বলার নেই। আমি ভীষণ টায়ার্ড, খুব ঘুম পাচ্ছে। কাল ভোরেই মুম্বাই ছুটতে হবে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ে অভিক। বালিশে বুক চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সৌমি। কোথাও একটা পাড় ভাঙার শব্দ সে শুনতে পায়।
মাস দুয়েক পর। সৌমির হাতে দুটো গোয়ার টিকিট- ভায়া মুম্বাই। এসি ট্রেনের কামরায় দুজনে অনেক কাছাকাছি। তারপর গোয়ার নামী হোটেলের বিলাসবহুল কামরায় শরীরী ঘনিষ্টতা- আবেগ, আশ্লেষ! উন্মুক্ত সমুদ্র সৈকতে সমুদ্র স্নান, ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা…
সৌমির বুকের থেকে ধুয়ে যাচ্ছে সব গুমট অন্ধকার। অদ্ভুত তৃপ্তি তার চোখেমুখে, অদাহ্য শরীরে। চুমু আর আদরের উষ্ণ লোনা স্রোতে ভাসতে ভাসতে আবিষ্ট সৌমি বলে, এই জন্যে তোমায় এত ভালোবাসি প্রশান্ত!

কে?

তখন প্রায় রাত দশটা। বাগনান থেকে শেষ বাসটা ধুকতে ধুকতে নিমতলা স্টপেজে নামিয়ে দিল সুতনুকে। অনেক দিনের পরে কলকাতা থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরছে সে। বলাই বাহুল্য, সঙ্গী কেউ নেই। হি হি কাঁপন লাগানো জমাটি শীতের রাত। রূপোলী চাঁদের আলোয় হালকা কুয়াশা চাদর। মায়াবী প্রতিবেশ। প্রাণের আনন্দে গান গাইতে গাইতে মেঠো পথ ধরে চলতে লাগলো সে। কিছুটা এগিয়ে মোড় ঘুরতেই সে লক্ষ্য করল চাদর গায়ে দেওয়া একটি মেয়ে হেঁটে চলেছে তার আগে আগে। এত রাতে, গ্রামের পথ ধরে, তাও আবার মেয়ে! খুব অবাক হল সুতনু। আপনা থেকেই গান থেমে যায় তার। মেয়েটিও থামে। সন্দিগ্ধ মনে এগিয়ে যায় সুতনু। মেয়েটির কাছে গেলে হঠাত্‍ কথা বলে ওঠে সে, “কী হল, গান থামিয়ে দিলে কেন? এখনো কত ভালো গাও তুমি!” অবাক হয়ে সুতনু বলে, “তার মানে, তুমি আমাকে অনেক আগে থেকেই চেনো? কে বলতো তুমি? এত রাতে কোথা থেকেই বা ফিরছো?” মেয়েটি উত্তর দেয়, “আমি তোমার পাড়ারই মেয়ে, আবার এককালের সহপাঠিনীও–কমলিনী।” নামটা চেনা চেনা লাগলেও পুরোপুরি চিনতে পারেনা সে। তবু একটা আন্দাজ করে সে-“আচ্ছা, তুমি মনে তুই কি কমলি?” চাদরের ঘোমটার নীচে একটা অপার্থিব হাসি খেলে যায় মেয়েটার মুখে। তারপর পুরো রাস্তাটা পুরোনো দুই সহপাঠী কথায়- গানে মশগুল হয়ে ওঠে। কমলি বলে, “জানোতো, এলাকায় আমার খুব দুর্নাম। আমি ভালো মেয়ে নই। আমার সঙ্গে কেউ মেশেনা। দেখো, আজ এত রাতে তুমি আমার সঙ্গে ফিরছো- লোকে আমার তো বটেই, তোমারও বদনাম করবে।”
সুতনু বলে, “আমি এসব পরোয়া করিনা। তুমি থুড়ি তুই আমার সহপাঠিনী, এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পরিচয়। তাছাড়া, আমরা সবাই কি খুব ভালো, ধোয়া তুলসিপাতা?”
অনেকটা চলার পর ওরা একটা মোড় মতো যায়গায় উপস্থিত হয়। ডানদিকের সরু রাস্তা দিয়ে একটু এগোলেই কমলির বাড়ি। বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে সে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। তার চোখে যেন খুশির সঙ্গে বেদনার অশ্রু। সুতনু এগিয়ে যায় সোজা- শীতলাতলা, কলতলা পেরিয়ে তার বাড়ির দিকে।
বাড়িতে ঢুকেই মায়ের একচোট বকুনি খেতে হল সুতনুকে। সত্যি, গ্রামের দিকে শীতকালের রাত হিসেবে অনেক দেরী করে ফেলেছে সে। কিন্তু মাকে নিশ্চিন্ত করার জন্যে সে বলে যে সে একা ছিলনা, ওপাড়ার কমলিও সেই নিমতলা থেকে তার সঙ্গেই এসেছে। ছেলের কথা শুনে হতবাক হয়ে যায় সুতনুর মা, “কী বলছিস! গত সপ্তাহেই তো ওই নিমতলার রাস্তায় কারা যেন কমলির উপর শারিরীক নির্যাতন করে মেরে ফেলে গিয়েছিলো!”
নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারেনা সুতনু। হাড় হিম করা একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় তার শিরদাঁড়া বেয়ে। তবে একটু আগে পর্যন্ত তার সঙ্গে সারাটা রাস্তায় কে ছিল, কে?

শ্মশানে অমাবস্যার রাতে

কথা হচ্ছিল ভূতের ভয় নিয়ে ঠাকুরবাখুলের দাবায়। বঙ্কিম জেঠুই পাড়ল কথাটা, “কেউ যদি অমাবস্যার রাতে শ্মশানের নিমগাছে পেরেক পুঁতে দিয়ে আসতে পারে তবেই বুঝতে পারা যাবে সে সত্যিকারের বাপের ব্যাটা! ভূতের ভয় তার নেই। “এমন কথায় সকলের মুখই শুকনো হয়ে গেল। এমনিতে গ্রামাঞ্চলে ভূতে বিশ্বাস আর ভূতের ভয় অনেকটাই বেশি। তার উপর অমাবস্যার রাত, শ্মশান, নিমগাছ, পেরেক- বাপরে! কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে চ্যালেঞ্জটা নিল জেঠুরই সমবয়সী বেরা পাড়ার হরেকিষ্ট রায়। সারা জীবনে একশোরও বেশি মড়া পুড়িয়েছে সে। ভুতে বিশ্বাস করেনা যে তা নয়, কিন্তু ভূতের ভয় তার নেই। বরং লোকে বলে ভূতেরাই নাকি কিঞ্চিত ভয় পায় তাকে। তাই পাড়ায় তো বটেই আশপাশের দু’চারটে গ্রামেও খবরটা ছড়িয়ে পড়ল, সেই সঙ্গে প্রবল আগ্রহ।
দিন সাতেক পরেই এল সেই আকাঙ্ক্ষিত দিন, উত্তেজনার ও আতঙ্কের রাত! ঠাকুরবাখুল থেকে হাতুড়ি আর পেরেক হাতে রহনা দিল হরেকিষ্ট রায়। শীতকালের অমাবস্যার রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার হলেও শ্মশানের রাস্তা তার খুব চেনা। আধ-ঘন্টার মধ্যেই শ্মশানে পৌঁছে গেল সে। নদীর ধার থেকে সাঁই সাঁই করে বইছে কনকনে উত্তরে হওয়া। তার গায়ের চাদর পত্‍ পত্‍ করে উড়ছে সেই হওয়ায়। চারিদিকে কী রকম সব অদ্ভুত অদ্ভুত শো শো করা খসখস শব্দ! এখানে ওখানে ছড়ানো পোড়া কাঠের টুকরো, হাড়, খুলির অংশ…
অন্য কেউ হলে হয়তো ভয়েতে ভিরমি খেয়ে যেত। কিন্তু সে হরেকিষ্ট রায়। তার গলায় “বল হরি, হরিবোল!”
শুনে ছোটোছোটো ছেলেমেয়েরা তো বটেই, বড়দেরও পিলে চমকে যায়! সে ভয় পায়না কিছুতেই। নিম গাছের কাছে গিয়ে সে সাহসে বুক বেঁধে হাতুড়ি দিয়ে পেরেক পুঁততে লাগল। কই, কেউ তো তাকে ভয় দেখাচ্ছে না! মনে মনে হাসলো সে। পেরেক পুঁতে নিশ্চিন্ত মনে সে পিছন ফিরল। অমনি তার গলায় জড়ানো চাদরে টান পড়ল পিছন থেকে। এবার একটু ভয় পেল সে। জোর করে হ্যাঁচকা টান মারতে গিয়ে শিশিরে পিছলে গেল তার পা। তার গলাটা পেঁচিয়ে গেল চাদরে। এবার অজানা এক আতঙ্কের শিহরণ খেলে গেল তার শরীরে। এই প্রথম ভয়ে সেই প্রবল ঠান্ডাতেও ঘেমে নেয়ে উঠল সে। যত টান মারে ততই চাদরটা তার গলায় বসে গিয়ে শ্বাস বন্ধ করার উপক্রম করে। এইভাবে চেষ্টা করতে করতে শেষ পর্যন্ত অচেতন হয়ে পড়ে সে।
ঘণ্টা দুয়েক পরেও হরেকিষ্টকে ফিরতে না দেখে উদ্বিগ্ন গ্রামের লোকজন আলো জ্বেলে নিয়ে শ্মশানের সেই নিমগাছটার সামনে পৌঁছল। কিন্তু সামনের দৃশ্য দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠল তারা। তারা দেখল যে নিজের চাদরেই পেরেক পুঁতে গলা পেঁচিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে ঝুলে আছে হরেকিষ্ট রায়। দেহে তার প্রাণ নেই।

- বিজ্ঞাপন -

সিঁদুর খেলা

ইউনিভার্সিটি চত্তর তুলকালাম! ঘটনাটা সমস্ত ডিপার্টমেন্টে, দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং, লাইব্রেরী এমনকী বাইরে কলেজ স্ট্রীটের রাস্তায়, কফিহাউসেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মতোই। ক্লাসরুমের মধ্যেই বাংলা বিভাগের ছাত্রী সহেলীর সিঁথিতে সিঁদুর তুলে দিয়েছে সহপাঠী তুহিনশুভ্র! বুড়ো ইউনিভার্সিটির নাক উঁচু কর্তাব্যক্তিদের নাকে রীতিমতো ঝামা ঘষে কেলোটা কলতলায় গিয়ে দাঁড়াল। ফলে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা সকলেরই মুখ থমথমে। ‘বিচার চাই’- ধরনা, আত্মহত্যার হুমকি ইত্যাদি ইত্যাদি…
ভাইস চ্যান্সেলারের ঘরে আভ্যন্তরীন বিচারসভা। সব পক্ষই রীতিমতো গম্ভীর। কেউ কোনও কথা বলছেনা দেখে বাংলা বিভাগের প্রধানই প্রশ্ন শুরু করলেন। কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা বললেন- তাহলে তুমিই সহেলীর সিঁথিতে সিঁদুর তুলে দিয়েছো? তোমার এত বড় স্পর্ধা! ক্লাস রুমের মধ্যে! তোমার লজ্জা করল না? এমন একটা প্রাচীন ঐতিহ্যশালী বিশ্ববিদ্যালয়ে…
আজ্ঞে না, আমি তো সিঁদুর তুলিনি, আগামী কাল দোল বলে আমি শুধু আবির দিয়ে…
ও: আবির, কিন্তু ওর সিঁথিতে তুলেছিলে তো? এটাও কম অপরাধ নয়। তা সহেলী, তুমি কি ওর সিঁদুর তোলা, সরি আবির তোলা স্বীকার করো?
মোটেই না, কক্ষনো না। আমি ওকে ঘেন্না করি! ছি!
বেশ, তাহলে আবির মুছে ফেলো, বাড়ি যাও। ল্যাটা চুকে গেল।
তার এমন জলবত্‍ সহজ সমাধান শুনে উপস্থিত সকলে মায় ভাইস চ্যান্সেলার পর্যন্ত স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।

মেটে মাসি

কে যে তার নাম মেটে মাসি রেখেছিল সেটাই একটা ধাঁধা। তবে শুরু থেকেই দেখছি, ছেলেপুলেরা তাকে মেটে মাসি বলেই ডাকে। সেই কোন কাকভোর থেকে রোগা-প্যাটকা মেটে মাসি ঠিক চলা নয়, সামনের দিকে ঈষত্‍ ঝুঁকে অনেকটা ছুটে যাওয়ার ভঙ্গিমায় এর বাড়ি থেকে ওর বাড়ি কাজ করে চলে।শোনা যায় নাকি দশ-বারো ঘর! ঘর, দোকান, ডাক্তারের চেম্বার- কোনও কিছুতেই বাদ নেই। এত কাজ করে কেন মেটে মাসি! এত টাকাই বা কী করে? বাড়িতে ফিরতেই বা হয় কেন তাকে? থেকেই তো যেতেপারে যে-কারো বাড়িতে। অনেকেই তো চায় ও থাকুক, যেমন মুদিখানার বিজয়দা।কিন্তু সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত সাড়ে আটটা বাজলেই মেটে মাসি আবার সেই চিরচেনা ভঙ্গিতে স্টেশনের দিকে ছুটতে থাকে।
আমার বাড়িতেও কয়েকদিনের জন্যে কাজ করেছে মেটে মাসি, অবশ্য ঠ্যাকনা দিতে, বিজয়দার সৌজন্যেই। অল্প দিন হলেও কি জানি কী কারণে মেটে মাসি আমাদের সব্বাইকে খুব ভালোবাসে, আমরাও…
শত-ব্যস্ততার মধ্যেও দেখা হলেই সেই চিরপরিচিতের মতো হেসে দুটো কথা বলা, ছেলেদের খবর নেওয়া, এর ব্যাতিক্রম নেই!
কিছু দিন পরে অনেক কৌশল করে বিজয়দার মুখেই শুনেছি মেটে মাসির বাড়ি অনেক দূরে-গোচরণ স্টেশন থেকেও ঘন্টাখানের পথ। রাতে বাড়ি পৌঁছাতে প্রায় রাত এগারোটা বেজে যায়। তারপর রান্না-বাড়ি, খাওয়া। বুড়োটা যে শয্যশায়ী, তাকে ওটুকু পরিসেবা না দিলে কি চলে? ভোর তিনটেয় উঠে আবার পরের দিনের লড়াই। মেটে মাসি যন্ত্রের মতো সারদিন কাজ করে চলে। কিন্তু কথা বললেই বুঝতে পারি, মেটে মাসি শহরের প্যাঁচ-পয়জার মারা বিল্লিদের চেয়ে অনেক জ্যান্ত, জীবন্ত মানুষ।
মাঝখানে শুনলাম মেটে মাসি নাকি খুব অসুস্থ, তবুও কাজে তার ফাঁকি নেই।ভোর হলেই যথারীতি…
এর পর পরীক্ষা, খাতা দেখা, লেখালেখি, অনুষ্ঠানের সাত-ঝামেলায় মেটে মাসির সঙ্গে আর দেখাই হয়নি অনেক দিন। সেদিন রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে হেঁটে ফিরছি বাড়ির দিকে, আবছা অন্ধকারে দেখি সেই পরিচিত ভঙ্গিমায় দ্রুত হেঁটে অথবা প্রায় ছুটেই আসছে মেটে মাসি। একটু কাছে আসতেই ডাক দিলাম, “মেটে মাসি, কেমন আছো? এখনো ছুটছো আগের মতোই?”
মেটে মাসি কাছে এসে দাঁড়াল। কী আশ্চর্য, এ তো মেটে মাসি নয়! এ যে মেটে মাসির মেয়ে প্রতিমা! ছলোছলো চোখে সে জানাল, “মা তো গেল মাসেই মারা গেছে। লোকের কাজ আর কতদিন ফেলে রাখি, তাই আমার কাজগুলো তো ছিলই, সেই সঙ্গে মায়ের কাজগুলোও আমি করে দিচ্ছি। লোকের অসুবিধার কথা তো ভাবতে হবে। দু’চোখ আমার জলে ভরে উঠল। কিছু একটা বলতে গেলাম, বলতে পারলাম না।
আমাকে নমস্কার জানিয়ে প্রতিমা এগিয়ে গেল স্টেশনের রাস্তায়। সেই একই রকম গড়ন, চলার ভঙ্গিতেও অবিকল মেটে মাসিই! এই ভাবেই বুঝি মেটে মাসিরা চলতে থাকে, চলতেই থাকে…
আমি হতবাক দৃষ্টিতে তার চলার দিকে চেয়ে রইলাম।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ড. পার্থ প্রতিম পাঁজা একাধারে কবি, কথাকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সাংবাদিক এবং অভিনেতা ও বাচিক -শিল্পী। জন্ম সত্তরের দশকে হাওড়া জেলার ডিঙ্গাখোলা গ্রামে। পেশায় শিক্ষক। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'বাংলা পথনাটক' বিষয়ে ডক্টরেট। কর্মজীবনের শুরু 'সংবাদ প্রতিদিন'-এর সাংবাদিক ও 'সোনার বাংলা'-র শিল্পকলা সমালোচক হিসেবে। প্রায় দু'দশক ধরে কলকাতার প্রধান দুই নাট্যদল 'সমীক্ষণ' ও 'পঞ্চম বৈদিক' - এর অভিনেতা ও সংগঠক। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ--' এবং তারপর ', 'এই আছি ', হৃদয়ে বৃষ্টির গন্ধ ', 'প্রবাস পাখি '; গল্পগ্রন্থ --'সুজন দীঘির রহস্য', 'থম্পুই কিং রহস্য' ; ছড়ার বই-- 'ছড়ায় ভরা সূর্য তারা' ; গদ্যগ্রন্থ -- ' ব্রাত্য বহ্নি বাংলা পথনাটক' , 'নাট্যপথের পরিব্রাজন', 'প্রবন্ধ কানন' ; নাট্যগ্রন্থ --'একটি একাঙ্ক চারটি শ্রুতি', '২৫ টি ছোটদের সেরা হাসির নাটক, মজার নাটক ', 'রাক্ষসের সঙ্গে টক্কর' ইত্যাদি। পেয়েছেন-- ' সম্প্রীতি পুরস্কার ', 'বাংলা কবিরত্ন পুরস্কার', 'নাট্যকার আমল রায় স্মৃতি পুরস্কার', 'পারুল শিক্ষা সম্মান ' ইত্যাদি নানা পুরস্কার ও সম্মাননা।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!