রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা

সিদ্ধার্থ সিংহ
সিদ্ধার্থ সিংহ
15 মিনিটে পড়ুন

এক: ব্যাকরণ বই

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রচুর লোক তাঁদের লেখা বই দিতে আসতেন। একবার এক শিক্ষক এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাঁর লেখা একটি বাংলা ব্যাকরণ বই দিয়ে বললেন, গুরুদেব, সময় পেলে একটু দেখবেন বইটি কেমন হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, ঠিক আছে দু’চার দিন পরে আসুন, আমি দেখে রাখব।

ঠিক তিন দিনের মাথায় লোকটি রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে হাজির। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, গুরুদেব, আমার ব্যাকরণ বইটি দেখেছিলেন?

রবীন্দ্রনাথ তাঁর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বললেন, দেখেছি, খুব ভাল করে দেখেছি। বাংলা ভাষা যে এত কঠিন এই প্রথম জানলাম।

- বিজ্ঞাপন -
72700CEE 6A40 4520 99D6 7AC9ECD45D46 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 59

দুই: গাবগাছ

শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কথাশিল্পী প্রমথনাথ বিশী। তো, একবার প্রমথনাথ বিশী কবিগুরুর সঙ্গে শান্তিনিকেতনের আশ্রমের একটি ইঁদারার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ওখানে একটি গাবগাছ ছিল। কবিগুরু হঠাৎ তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘জানিস, একসময়ে এই গাছের চারাটিকে আমি খুব যত্ন করে লাগিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল, এটা অশোকগাছ, কিন্তু যখন গাছটি বড় হল দেখি ওটা অশোক নয়, গাবগাছ।’

তার পর তিনি প্রমথনাথের দিকে সরাসরি তাকিয়ে স্মিতহাস্যে যোগ করলেন, ‘তোকেও অশোকগাছ বলে লাগিয়েছি, বোধ করি তুইও গাবগাছ হবি।’

E98CD058 1AF9 40C0 9FED 64CBA2D7D3CC রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 60

তিন: বিষ

একবার রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজি একসঙ্গে বসে সকালের জলখাবার খাচ্ছেন। গান্ধীজি লুচি পছন্দ করতেন না, তাই তাঁকে ওটসের পরিজ খেতে দেওয়া হয়েছিল; আর কবিগুরু খাচ্ছিলেন গরম গরম লুচি।

গান্ধীজি তাই দেখে বললেন, ‘গুরুদেব, তুমি জানো না যে তুমি বিষ খাচ্ছ।’ উত্তরে কবিগুরু বললেন, ‘বিষই হবে; তবে এর অ্যাকশন খুব ধীরে। কারণ, আমি বিগত ষাট বছর যাবৎ এই বিষ খাচ্ছি।’

55237F15 9884 40B5 86F9 775D8797FB84 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 61

চার: পাদুকা-পুরাণ

রবীন্দ্রনাথের একটা অভ্যাস ছিল, যখনই তিনি কোনও নাটক বা উপন্যাস লিখতেন, তা প্রথমে শান্তিনিকেতনে গুণীজনদের সামনে পড়ে শোনাতেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই গুণীজনদের মধ্যে ছিলেন একজন। একবার বাইরে জুতা রেখে আসায় সেটা চুরি হয়ে গিয়েছিল। তার পর থেকে তিনি জুতা জোড়া কাগজে মুড়ে বগলদাবা করে আসরে ঢুকতেন।

- বিজ্ঞাপন -

রবীন্দ্রনাথ সেটা টের পেয়ে একদিন তাঁকে এভাবে ঢুকতে ‌দেখে বলেলেন, ‘শরৎ, তোমার বগলে ওটা কি পাদুকা-পুরাণ?’

52A636E8 DDF7 4F64 8BCD EB124E260BBB রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 62

পাঁচ: দেহরঞ্জন

একবার এক দোলপূর্ণিমার দিনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাক্ষাৎ ঘটে। পরস্পর নমস্কার বিনিময়ের পর হঠাৎ দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর জামার পকেট থেকে আবির বের করে রবীন্দ্রনাথকে বেশ ভাল করে মাখিয়ে দিলেন।

আবিরে রঞ্জিত রবীন্দ্রনাথ রাগ না করে বরং সহাস্যে বলে উঠলেন, ‘এত দিন জানতাম দ্বিজেনবাবু হাসির গান ও নাটক লিখে সকলের মনোরঞ্জন করে থাকেন। আজ দেখছি শুধু মনোরঞ্জন নয়, দেহরঞ্জনেও তিনি একজন ওস্তাদ।’

- বিজ্ঞাপন -
7D0575B9 1C32 4762 84A6 8A73CC484EE1 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 63

ছয়: চিনি গো চিনি

মরিস সাহেব শান্তিনিকেতনে ইংরাজী ও ফরাসি পড়াতেন। তিনি একবার তাঁর ছাত্র প্রমথনাথ বিশীকে বললেন, গুরুদেব সুগার অর্থাৎ চিনি নিয়ে একটা গান লিখেছেন। যেটা খুবই মিষ্টি হয়েছে। প্রমথনাথ বিশী সে কথা শুনে বললেন, চিনি নিয়ে লিখলে সেটা তো মিষ্টি হবেই। তা গানটা কী? মরিস সাহেব গাইলেন, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী।’ এটা শুনে প্রমথনাথ বিশী বললেন, গানটাতে বেশ কয়েক চামক চিনি মিশিয়েছেন গুরুদেব। তাই এত মিষ্টি। কিন্তু এই চিনিই যে সুগার সেটা আপনাকে কে বলল?

মরিস সাহেব জানালেন, কে আবার, স্বয়ং গুরুদেব নিজেই তাঁকে এ কথা জানিয়েছেন।

54316439 76ED 400F 9113 CBB1948ACCEB রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 64

সাত: কাশির শব্দ

কবিগুরুর পঞ্চাশ বছর বয়সে পদার্পণ উপলক্ষে শান্তিনিকেতনের একটি কক্ষে সভা বসেছিল। যেখানে তিনি স্বকণ্ঠে গান গেয়েছিলেন। তো, তিনি সে দিন গাইলেন, ‘এখনো তারে চোখে দেখিনি, শুধু কাশি শুনেছি।’ কবিগুরু এটি গেয়েছিলেন আচার্য যতীন্দ্রমোহন বাগচি ওই কক্ষে ঢোকার আগ মুহূর্তে, তাই বাগচি মহাশয় কক্ষে প্রবেশ করে বিস্মিত নয়নে সকলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

‘সিঁড়িতে তোমার কাশির শব্দ শুনেই গুরুদেব তোমাকে চিনেছেন’, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তখন বাগচি মহাশয়কে বুঝিয়ে দিলেন, ‘তাই তো তাঁর গানের কলিতে বাঁশির স্থলে কাশি বসিয়ে তিনি গানটি গেয়েছেন।’

082B5532 47A9 4128 86C3 E375A814C485 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 65

আট: কানাই

সাহিত্যিক ‘বনফুল’ তথা শ্রী বলাইচাঁদের এক ছোট ভাই বিশ্বভারতীতে পড়ার জন্য শান্তিনিকেতনে পৌঁছেই কার কাছ থেকে যেন জেনেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ কানে একটু কম শোনেন। ফলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি যখন দেখা করতে গেলেন রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘কী হে, তুমি কি বলাইয়ের ভাই কানাই নাকি?’, তখন বলাইবাবুর ভাই চেঁচিয়ে জবাব দিলেন, ‘আজ্ঞে না, আমি অরবিন্দ।’

রবীন্দ্রনাথ তখন হেসে উঠে বললেন, ‘না কানাই নয়, এ যে দেখছি একেবারে সানাই!’

77FAA204 65DC 4F9E AABA 72A0754E073E রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 66

নয়: অন্তর্নিহিত অর্থ

একবার কালিদাস নাগ ও তাঁর স্ত্রী জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথ মৃদুহাস্যে নাগ-দম্পতিকে প্রশ্ন করলেন, ‘শিশু নাগদের কোথায় রেখে এলে?’

আরেক বার রবীন্দ্রনাথ তাঁর চাকর বনমালীকে তাড়াতাড়ি চা করে আনতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে কপট বিরক্তির ভাব দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘চা-কর বটে, কিন্তু সু-কর নয়।’

আরও একবার কবিগুরুর দুই নাতনি এসেছেন শান্তিনিকেতনে, কলকাতা থেকে। একদিন সেই নাতনি দু’জন কবিগুরুর পা টিপছিলেন; অমনি তিনি বলে উঠলেন, ‘পাণিপীড়ন, না পা-নিপীড়ন?’ প্রথমটায় তাঁরা কিছুই বুঝতে না পারলেও পরে কথাটার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পেরে খুবই মজা পেয়েছিলেন।

EEE407C4 9E89 4144 ADBB 3CFB6C43D6CF রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 67

দশ: প্রমথনাথ

একদিন সকালবেলায় রবীন্দ্রনাথ জলখাবার খেতে বসেছেন। প্রমথনাথ এসে তার পাশে বসলেন। উদ্দেশ্য, গুরুদেবের খাবারে ভাগ বসানো। ফল, লুচি, মিষ্টি সবকিছুরই ভাগ পেলেন তিনি। কিন্তু তার নজর একগ্লাস সোনালি রংয়ের শরবতের দিকে যেটা তাকে দেওয়া হয়নি। গুরুদেব তার ভাব লক্ষ করে বললেন, ‘কী হে এই শরবত চলবে নাকি?’ প্রমথনাথ খুব খুশি। অমনি গুরুদেব বড় এক গ্লাসে সেই সরবত প্রমথনাথকে দেওয়ার আদেশ দিলেন। বড় গ্লাস ভর্তি হয়ে সেই সোনালি শরবত এল। প্রমথনাথ এক চুমুক খেয়েই বুঝলেন, সেটা চিরতার শরবত!

2408461B 4E2A 4C1E A2F5 BD6813B5F906 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 68

এগারো: গোল

শান্তিনিকেতনের ছেলেদের সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানের ছেলেরা ফুটবল খেলছে। শান্তিনিকেতনের ছেলেরা আট-শূন্য গোলে জিতেছে। সবাই দারুণ খুশি। শুধু রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করলেন, ‘জিতেছে ভাল, তা বলে আট গোল দিতে হবে? ভদ্রতা বলেও তো একটা কথা আছে, নাকি।’

436E4D64 44FA 4808 9818 01A62D4CCB1A রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 69

বারো: ফকির

শান্তিনিকেতনে নতুন একটি ছেলে ভর্তি হয়েছে, তার নাম ভাণ্ডারে। ছেলেটির সঙ্গে তখনও রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয়নি। রবীন্দ্রনাথ একদিন শান্তিনিকেতনের পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, তার পরনে দীর্ঘ আলখাল্লা, মাথায় টুপি। ভাণ্ডারে তাকে দেখে ছুটে গিয়ে হাতে আধুলি মানে আটআনা পয়সা দিয়ে এল। অন্য ছেলেরা জিজ্ঞাসা করল, ‘গুরুদেবকে তুই কী দিলি?’

‘গুরুদেব কোথায়? ও তো একজন ফকির। মা বলেছে ফকিরকে দান করলে পুণ্যি হয়।’ ভাণ্ডারের সাফ জবাব।

যাই হোক, অল্পদিনেই বোঝা গেল ভাণ্ডারে ভীষণ দুরন্ত ছেলে। তার দৌরাত্বে ছাত্র-শিক্ষক সবাই অস্থির। নালিশ গেল গুরুদেবের কাছে। গুরুদেব তাকে ডেকে বললেন, ‘ভাণ্ডারে তুই কত ভাল ছেলে। তুই একবার আমাকে একটা আধুলি দিয়েছিলি। কেউ তো আমাকে একটা পয়সাও কখনও দেয় না। তুই যদি দুরন্তপনা করিস, তা হলে কি চলে?’

গুরুদেবের কথায় ভাণ্ডারের দুষ্টুমি কিছুটা কমেছিল।

210039A7 02A8 4D2E BA65 CADB664E8609 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 70

তেরো: নালিশ

রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের বকাঝকার পক্ষপাতি ছিলেন না। তিনি কাউকে কখনও আঘাত দিতে চাইতেন না। একবার প্রমথনাথ বিশী সম্পর্কে একটা নালিশ এল। এমন অবস্থা যে, তাকে না বকলেই নয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুরুদেব প্রমথনাথকে অনেকক্ষণ ধরে বকলেন। তিনি একটু থামলে প্রমথনাথ বললেন, ‘কিন্তু ঘটনা হল আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।’

রবীন্দ্রনাথ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, ‘বাঁচালি। তোকে বকাও হল আবার তুই কষ্টও পেলি না।’

CBA2E962 B588 4536 AE5D 26CF9B26A73E রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 71

চোদ্দো: দণ্ড

একবার শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক নেপাল রায়কে রবীন্দ্রনাথ লিখে পাঠালেন, ‘আজকাল আপনি কাজে অত্যন্ত ভুল করছেন। এটা খুবই গর্হিত অপরাধ। এ জন্য কাল বিকেলে আমার এখানে এসে আপনাকে দণ্ড নিতে হবে।’

এ কথা শুনে চিন্তিত নেপালবাবু পরের দিন কবির কাছে উপস্থিত হলেন। আগের রাতে দুশ্চিন্তায় তিনি ঘুমাতেও পারেননি। সারাদিন ছটফট করেছেন। কি ভুল করেছেন তিনি!

বিকেল হওয়ার আগেই তিনি পৌঁছে গেলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। নেপাল রায় এসেছেন শুনে রবীন্দ্রনাথ একটি মোটা লাঠি হাতে নিয়ে তাঁর সামনে এলেন। নেপালবাবুর তখন ভয়ে অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা। তিনি ভাবলেন, এ বার সত্যিই বুঝি তাঁর মাথায় লাঠি পড়বে।

কবি তখন সেটি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই নিন আপনার দণ্ড! সে দিন আপনি এই লাঠিটা মানে এই দণ্ডটা আমার এখানে ফেলে গিয়েছিলেন। তা একদম ভুলে গেছেন। 

57B9FF4E 9929 4575 80CA 0EF8B33588DE রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 72

পনেরো: বাঁদোর

একবার এক ঘরোয়া আসর জমেছে। সবাই হাসি গল্পে মশগুল।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, এ ঘরে একটা ‘বাঁদোর আছে।’

সবাই এ ওর মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছেন। গুরুদেব কাকে বাঁদর বললেন!

ঠিক তখনই রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়ে দিলেন, ‘এ ঘরে দুটো দরজা আছে, মানে দোর। একটা ডান দিকে অন্যটা বাম দিকে। তাই বলছিলাম, এ ঘরে একটা বাঁদোর আছে।’

7124777B 46CD 494F ABFF 5CC119F897DB রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 73

ষোলো: দ্বিধা

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভক্ত ও ছাত্রছাত্রীদের সামনে গান গাইছেন, ‘হে মাধবী, দ্বিধা কেন?’

তখন ভৃত্য বনমালী আইসক্রিমের প্লেট নিয়ে তাঁর ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বনমালী ভাবছে ঘরে ঢুকবে কি ঢুকবে না। কারণ রবীন্দ্রনাথ গান গাইছেন, এ সময় ঢুকলে উনি বিরক্ত হবেন কি না কে জানে!

গুরুদেব বনমালীর দিকে তাকিয়ে গাইলেন ‘হে মাধবী, দ্বিধা কেন?’

বনমালী আইসক্রিমের প্লেট গুরুদেবের সামনে রেখে লজ্জায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘বনমালীকে যদিও মাধবী বলা চলে না। তবে তার দ্বিধা মাধবীর মতোই ছিল। আর আইসক্রিমের প্লেট নিয়ে দ্বিধা করা মোটেই ভাল নয়।’

C395557C F849 4025 9BF0 EFE68769EBC4 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 74

সতেরো: চাঁদ ঢাকা

একবার রবীন্দ্রনাথ ঘুমোচ্ছেন। ঘরের জানালা খোলা। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। ফুটফুটে জ্যোৎস্না। আলোতে ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথ ভৃত্য মহাদেবকে ডেকে বললেন, ‘ওরে মহাদেব, চাঁদটাকে একটু ঢাকা দে বাবা।’

মহাদেব তো হতভম্ব। চাঁদ সে কী ভাবে ঢাকা দেবে?

গুরুদেব হেসে বললেন, ‘জানালাটা বন্ধ করে দে, তা হলেই চাঁদ ঢাকা পড়বে।’

A18D6819 EC35 432B 9A7D A5507DC7A6FE রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 75

আঠেরো: গরু বানান

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানান সংস্কারের জন্য একটা কমিটি গঠন করে দিলে সেই কমিটি বাংলা বানানের পুরনো রীতি পালটে নতুন বানানরীতি চালু করে। এই কমিটি এই কাজ করতে গিয়ে ‘গরু’ বানান নিয়ে সমস্যায় পড়ে। কমিটি ঠিক করে যে ‘গরু’ বানানটি গরু না লিখে ‘গোরু’ লেখা উচিত। কারণ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃতের ‘গো’ শব্দ থেকে এসেছে। আদিতে ‘ও’ কার, সে জন্য এখানেও ‘ও’ কার থাকা উচিত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, প্রায় সব বাংলাভাষী লেখক, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক সবাই ‘ও’ কার ছাড়া গরু বানান লেখেন। কিন্তু কী করা যায়! কমিটির সিদ্ধান্ত হল, এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের মত নেয়া দরকার। দেখা যাক, উনি কী বলেন। কমিটির প্রধান ছিলেন ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁর নেতৃত্বে কমিটির লোকজন চলল শান্তিনিকেতনে। সেখানে গিয়ে তাঁরা সাক্ষাত প্রার্থী হলেন কবির।

কবি তাঁদের আগমনের হেতু জানতে চাইলে তাঁকে বিষয়টি বোঝানো হল। বলা হল, আমরা আপনার মত জানতে এসেছি।

রবীন্দ্রনাথ কথাটা শুনে মৃদু হেসে বললেন, ‘তা তোমাদের ও-কার দিয়ে গরু লেখার ব্যাপারে অন্তত একটা সুবিধেই হবে যে, আমাদের দেশের জীর্ণকায় হাড় জিরজিরে গরুগুলোকে অন্তত একটু মোটা ও তাজা দেখাবে!’

B357A45D 5F8F 474C ACC8 54D817B5D8F4 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 76

উনিশ: কলম

একবার এক ভদ্রলোক কবিতার দুটি লাইন নেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে কলম ধার চাইলেন। তিনি কলম চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি এই কবিতার দ্বিতীয় লাইনটা জানেন? প্রথম লাইনটা হচ্ছে ‘সকল পক্ষী মৎস্য ভক্ষী, মৎস্যরাঙ্গী কলঙ্কিনী’।

রবীন্দ্রনাথ কলমটা দিয়ে বললেন, ‘নিশ্চয়ই জানি। লাইন দুটো দাঁড়াল এ রকম—

সকল পক্ষী মৎস্য ভক্ষী, মৎস্যরাঙ্গী কলঙ্কিনী। /সবাই কলম ধার চেয়ে নেয়, আমিই শুধু কলম কিনি!’

443CC753 3777 4226 AE43 94E5521E82A9 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 77

কুড়ি: পাত্রী দেখা

কবিগুরু একবার কিছু বন্ধু বান্ধব নিয়ে বাংলা মুলুকের বাইরে পাত্রী দেখতে গেলেন। পাত্রী খুব ধনী, সাত লাখ টাকার উত্তরাধিকারী। সে যুগে সাত লাখ টাকা যৌতুক, ভাবা যায়! তিনি যে ঘরে বসে আছেন, সে ঘরে দুজন অল্প বয়সী মেয়ে এসে বসল। এক জন চুপচাপ, সাধাসিধে, জড়ভরতের মতো এক কোণায় বসে রইল। অন্য মেয়েটি যেমন সুন্দরী, তেমনি চটপটে, স্মার্ট। একটুও জড়তা নেই, সুন্দর ইংরেজি উচ্চারণ। পিয়ানো বাজাল দারুণ। সংগীত নিয়ে জ্ঞানগর্ভ টুকটাক আলোচনাও করল। রবীন্দ্রনাথের খুব পছন্দ হল মেয়েটিকে। এমন সময় বাড়ির কর্তা ঘরে ঢুকে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর মেয়ে দুটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সুন্দরী মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন, ‘হিয়ার ইজ মাই ওয়াইফ। আর জড়ভরতকে দেখিয়ে বললেন, ‘হিয়ার ইজ মাই ডটার।’ পাত্রী দেখার দল বিস্ময়ে হতবাক!

ACE166D7 45D6 4519 BF2C 75667C5EA792 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 78

একুশ: উপুড়

জীবনের শেষ দিকে এসে রবীন্দ্রনাথ একটু সামনের দিকে ঝুঁকে উবু হয়ে লিখতেন। একদিন তাঁকে ও ভাবে উবু হয়ে লিখতে দেখে তাঁর এক শুভাকাঙ্ক্ষী বলল, ‘আপনার নিশ্চয় ও ভাবে উপুড় হয়ে লিখতে কষ্ট হচ্ছে। বাজারে এখন এ রকম অনেক চেয়ার আছে, যেগুলোতে আপনি হেলান দিয়ে বেশ আয়েশের সঙ্গে লিখতে পারেন। ও রকম একটা আনিয়ে নিলেই তো পারেন।’ লোকটার দিকে খানিকক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ জবাব দিলেন, ‘তা তো পারি। তবে কি জানো, এখন উপুড় হয়ে না লিখলে কি আর লেখা বেরোয়! পাত্রের জল কমে তলায় ঠেকলে একটু উপুড় তো করতেই হয়।’

D49B05BF FAB3 44D9 9EBC 98444F4E2186 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 79

বাইশ: গোপেশ্বর এবং দাড়িশ্বর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক গানের আসরে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। আসরে গান গাইছেন বিখ্যাত ধ্রুপদ গানের শিল্পী গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়।

কবি তার গান শুনে মুগ্ধ। গোপেশ্বরের গাওয়া শেষ হলে উদ্যোক্তারা রবীন্দ্রনাথের কাছে এসে অনুরোধ করলেন, ‘গুরুদেব, এবার আপনাকে গান গাইতে হবে।’ সেদিনের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ শুধু গান শুনতেই গিয়েছিলেন। গান গাওয়ার কথা ছিল না।

উদ্যোক্তাদের অনুরোধ শুনে তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘বুঝেছি, বুঝেছি, গোপেশ্বরের পর এবার দাড়িশ্বরের পালা।’ 

65B09D17 69D3 4275 BD41 AEF5BE87EE4D রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 80

তেইশ: ভূতে বিশ্বাস

রবীন্দ্রনাথকে একবার এক ভদ্রলোক লিখলেন, ‘আপনি কি ভূতে বিশ্বাস করেন?’

কবি উত্তরে লিখলেন, ‘বিশ্বাস করি বা না করি, তাদের দৌরাত্ম্য মাঝে মাঝে টের পাই— সাহিত্যে, রাজনীতিতে সর্বত্রই একেক সময় তুমুল দাপাদাপি জুড়ে দেয় এরা। দেখেছি। দেখতে ঠিক মানুষের মতো!’

72E4420C 0336 4136 B54C AF9DECE1233E রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 81

চব্বিশ: দুই মণ

একবার শান্তিনিকেতনে ওজন মাপার যন্ত্র কেনা হল। যন্ত্র দিয়ে ছেলেমেয়েদের একে একে ওজন নেওয়া হচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা লক্ষ্য করছিলেন।

একেক জনের ওজন নেওয়া শেষ হলেই কবি তাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘কিরে, তুই কত হলি?’

এর মধ্যে একটি মেয়ের ওজন হল দুই মণ।

মেয়েটির বিয়ের কথা চলছিল, কবি তা জানতেন। মজা করে তিনি বললেন, ‘কিরে, তুই এখনও দু’মন? এখনও এক মন হলি নে!’

29796CD2 603F 4124 AFA7 1E308135F381 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 82

পঁচিশ: জীবনস্মৃতি

শরৎচন্দ্র পণ্ডিত নিয়মিত যেতেন গুরুদেবের কাছে। বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা করতেন। একদিন রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রকে হাসতে হাসতে বললেন, শরৎ তোমার জীবন সম্পর্কে লোকের বড় কৌতূহল। আমার জীবনস্মৃতির মতো তুমিও তোমার জীবনের কথা লেখো। সেই লেখা পড়ে বাংলার পাঠকসমাজ তোমার জীবন সম্বন্ধে জানতে পারবে। 

উত্তরে শরৎচন্দ্র পণ্ডিত বললেন, গুরুদেব, সেটা বোধহয় সম্ভব নয়। কারণ আমার জীবন তো আপনার মত ভাল নয়। আগে থেকে বুঝতে পারিনি এত বড় হবো। তবে না হয় একটু বুঝে সমঝে ভাল হয়ে চলতাম। তা তো হয়নি। তাই এই জীবনে আমার আর জীবনী লেখা ঠিক হবে না।

শরৎচন্দ্রের উত্তর শুনে রবীন্দ্ৰনাথ গোঁফের ফাঁকে মুচকি হাসলেন।

D37C98C1 48B3 4396 9F51 D48B0D15317B রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২৫টি মজার ঘটনা 83

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
২০২০ সালে 'সাহিত্য সম্রাট' উপাধিতে সম্মানিত এবং ২০১২ সালে 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। আনন্দবাজার পত্রিকার পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, স্বর্ণকলম পুরস্কার, সময়ের শব্দ আন্তরিক কলম, শান্তিরত্ন পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা সহ অসংখ্য পুরস্কার। এছাড়াও আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর 'পঞ্চাশটি গল্প' গ্রন্থটির জন্য তাঁর নাম সম্প্রতি 'সৃজনী ভারত সাহিত্য পুরস্কার' প্রাপক হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!