রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক বাহিনীর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গাম্বিয়ার করা মামলায় মিয়ানমারের প্রাথমিক আপত্তি খারিজ করে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে)। এর ফলে আপাতত বিচারকাজ চলমান রাখতে কোনো বাধা না থাকায় গণহত্যার মূল মামলার শুনানির পথ আরও প্রশস্ত হলো।
শুক্রবার (২২ জুলাই) নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের পিস প্যালেসে আইসিজে সভাপতি বিচারক জোয়ান ই দোনোঘুই এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে জানানো হয়, জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল সরেজমিনে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পরিদর্শন করেছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেখানে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে হওয়া ঘটনাগুলো ১৯৪৮ সালে গণহত্যা বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনের সুস্পষ্ট লক্ষণ। তাই “কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইড” এর আর্টিকেল ৯ এর ভিত্তিতে ১১ নভেম্বর ২০১৯ সালে গাম্বিয়া যে মামলার আবেদন করছে সেটি গ্রহণযোগ্য।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা বন্ধের পাশাপাশি দোষীদের শাস্তি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৯ সালের নভেম্বরে আইসিজে-তে দেশটির বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলের পর দেশটির সামরিক সরকার ওই মামলার শুনানি প্রশ্নে তাদের প্রাথমিক আপত্তি জানায়।
এর আগে ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের প্রাথমিক আপত্তির ওপর শুনানি শুরু হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট চার দিন বিষয়টির ওপর আদালত দুই পক্ষের যুক্তি পাল্টাযুক্তি শোনেন। তখন আদালতের শুনানিতে মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব করা আন্তর্জাতিক সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী কো কো হ্ল্যাং দাবি করেন, “গণহত্যার অভিযোগ শুনানির এখতিয়ার আদালতের নেই। মিয়ানমার গণহত্যা সনদের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ বলে তার ফৌজদারি আইন সংশোধন করে গণহত্যাকে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে।”
এছাড়া, আদালতের আগেই গাম্বিয়া বিশ্ববাসীর কাছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে হত্যাকারী হিসেবে উপস্থাপিত করতে চায় বলেও দাবি করেন কো কো হ্ল্যাং।
মিয়ানমারের উত্থাপন করা আপত্তিগুলোর মধ্যে যেসবের ওপর জোর দেওয়া হয়, সেগুলো হলো- আদালতের এখতিয়ার; ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) প্রতিভূ হিসেবে গাম্বিয়ার মামলা দায়ের, যার সুযোগ গণহত্যা সনদে নেই; গাম্বিয়ার কোনো নাগরিক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায় দেশটির সংক্ষুব্ধ হিসেবে নিজেকে দাবি করতে না পারা এবং দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা না করেই আদালতের শরণাপন্ন হতে না পারা।
মিয়ানমারের আপত্তিগুলোর জবাবে গাম্বিয়ার দাবি, দুই বছর আগেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়ার অন্তর্বর্তী আদেশ জারির সময় আদালতের এখতিয়ার ও গাম্বিয়ার মামলা করার অধিকারের প্রশ্নগুলো নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
গাম্বিয়ার প্রতিনিধি দেশটির আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল দাওদা জালো জানান, গাম্বিয়া ওআইসি বা অন্য কারও প্রতিভূ হিসেবে নয়। গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী হিসেবে নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই গাম্বিয়া মামলা করেছে।
পাশাপাশি মিয়ানমারের প্রাথমিক আপত্তির আবেদন নাকচ করে দিয়ে দ্রুত মূল মামলার শুনানি করার আবেদন জানায় গাম্বিয়া। তাদের ভাষ্যমতে, মিয়ানমারের প্রাথমিক আপত্তির মূল উদ্দেশ্য সময়ক্ষেপণ। আর মিয়ানমারের সময়ক্ষেপণের চেষ্টায় রোহিঙ্গাদের জীবন আরও বিপন্ন হয়ে পড়ছে।
২০১৭ সালে সশস্ত্র রোহিঙ্গাগোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) বিরুদ্ধে আরাকানে কয়েকটি থানা ও সেনা ছাউনিতে বোমা হামলার অভিযোগ ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে হামলা চালায়। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলার ফলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশসহ আশপাশের বিভিন্ন দেশে পালাতে শুরু করে।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।