খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯৯ সাল। দার্শনিক সক্রেটিসের হাতে পানপাত্র। পাত্রের ভেতরে রয়েছে হেমলক (Hemlock) যা তাকে স্বেচ্ছায় পান করতে হুকুম দেয়া হয়েছে। সক্রেটিস তা স্থিরচিত্তে পান করে চলেছেন। হেমলক মূলত এক প্রকার গুল্ম হলেও এখানে এর অর্থ, হেমলক-গাছ থেকে প্রস্তুত বিষাক্ত পানীয়, হলাহল। হেমলক গাছের আটটি পাতার রস একজন মানুষের জীবন-হন্তারক হতে পারে। এই বিষপানে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যু ঘটে মানুষের।
হেমলক বা সূক্ষ্ম পরিচয়ে পয়জন হেমলকের বৈজ্ঞানিক নাম কোনিয়াম ম্যাকিউলেটাম (Conium maculatum L.)। কোনিয়াম শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ ‘কোনাস’ (konas) থেকে যার অর্থ ‘শিরোঘুর্ণন’, হেমলক পান করার ফলে যা ঘটে থাকে। ম্যাকিউলেটাম মানে spotted, কারণ গাছটির নিচের অংশে দেখা যায় লাল-বেগুনি রঙের ছোপ। এই রং সম্ভবত প্রকৃতির তরফ থেকে বিষাক্ত গাছ সনাক্তকরণের একটি উপায় যা একধরনের অ্যাপোসিমেটিজম্ (Aposematism, E B Poulton)।
আত্মরক্ষার মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত এমন ধরনের অ্যাপোসিমেটিজম্ প্রাণিজগতে প্রথম লক্ষ্য করেন আলফ্রেড ওয়ালেস। লেডিবার্ড বিটল্সের গায়ের রং দেখে কোনো খাদক (Predator) সহজেই বুঝে নেয়, এই পোকা বিষাক্ত। মনার্ক প্রজাপতিকেও খাদকরা সহজে শনাক্ত করতে পারে বলেই এড়িয়ে যায়; এই প্রজাপতির শূককীট গাছের পাতা খেয়ে এমন বিষাক্ততা অর্জন করে। চার্লস্ ডারউইন অ্যাপোসিমেটিজমের বিষয়ে চমৎকৃত হয়ে বিশেষ আগ্রহ প্রদর্শন করলে ১৯৬৯ সালে লন্ডনের পতঙ্গতত্ত্ব বিভাগে পাখি ও শূককীটের আচরণ বিশ্লেষণ করে এই উপপ্রমেয় (Hypothesis) প্রমাণিত হয়।
পয়জন হেমলক গাছ আদিতে ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকাতে দেখা গেলেও পরে উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে পরিবেশানুগ হয়ে পড়েছে। ১৮ শতকে ইউরোপ থেকে এই গাছ আমেরিকাতে রোপন করা হয়েছিল অলঙ্করণের জন্য, হাওয়াই ও আলাস্কা বাদ দিয়ে। পশ্চিম ওয়াশিংটন ও দক্ষিণ ক্যানাডাতে এদের বেশ দেখা যায় রাস্তার পাশে, খানাখন্দ, পতিত জমিতে এমনকি কনস্ট্রাকশন সাইটেও।
গাজর পরিবারের হেমলক পাঁচ-সাত ফুট উঁচু দ্বিবর্ষজীবী গাছ (Biennial plant) অর্থাৎ দুই বছরে এর জীবনচক্র শেষ হয়, যেমনটা দেখা যায় হলিহক গাছে। তাই প্রতিবছর নিয়মিত হলিহক ফুল পেতে হলে পরপর দু’বছরের চারা নির্বাচন করে লাগাতে হয়। হেমলকের পাতা দেখতে গাজরের পাতার মতো একারণে অস্ট্রেলিয়াতে হেমলকের আরেক নাম ক্যারট ফার্ন। গাছের ভেতরটা বাঁশের মতো ফাঁপা, সন্ধিস্থল বাদ দিয়ে। এর ক্ষুদ্র সাদা পুষ্পমঞ্জরির বিন্যাস ছত্রাকার।
জাপানের ‘সুগা’ (Tsuga sieboldii) এক ধরনের পাইন পরিবারের গাছ যার পাতা রগড়ালে হেমলকের পাতার মতো ইঁদুর-গন্ধ বের হয় যে-কারণে এই গাছকেও হেমলক বলা হয় যা বিষাক্ত নয়। এ ছাড়া কাইকুটা (Caicuta) গণের আরো কিছু বিষাক্ত গাছ আছে যাদের সাধারণ নাম ‘ওয়াটার হেমলক’। এই গাছগুলো দেখতে জংলি গাজর (Daucus carota) বা জংলি সেলারির (Apium graveolens) মতো। হেমলকের পাতায় একধরনের নিশাচর মথ (Xanthorhoe montanata) ডিম পাড়ে যারা রাতের বেলা রাস্তার বৈদ্যুতিক বাতি বা বাগানের বোলার্ড ল্যাম্পের কাছে ভিড় করে। বাতির পাশে এদের ওড়াউড়ি দেখে সহজেই অনুমান করা যায় ঐ এলাকাতে বিষাক্ত হেমলকের গাছ আছে। পাখিরা এর বীজ খায় যার ফলে বিসরণ ঘটে, বংশবিস্তার হয় দূরবর্তী এলাকায়। আগে এসব পাখি শিকার করে তাদের মাংস খেয়ে বিষক্রিয়ায় মারা গেছে সৌখিন শিকারি মানুষ, তবে এখন পাখি শিকার অনেক নিয়ন্ত্রিত।
প্রাচীন গ্রীসে কারাগারের রাজবন্দীদের জীবননাশ করার জন্য হেমলক ব্যবহার করা হতো। সক্রেটিসের দেহের উপরে হেমলকের বিষক্রিয়া সম্পর্কে প্লেটো যে বর্ণনা করেছেন তা থেকে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছুটা অনুমান করা যায়। এই গাছের ভিতর অনেক ধরনের বিষ আছে যার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক কোনিয়িন (Coniine) যা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বিকল করে দেয়। এই বিষ সেবনের ফলে শরীরের নিচের দিক থেকে ক্রমশ উপরের দিকে পক্ষাঘাত শুরু হয়।
বিষপানের পর সক্রেটিসকে হাঁটতে হুকুম করা হয়েছিল। কিছুক্ষণ হাঁটার পর তিনি বললেন, তার পা অনুভূতিহীন হয়ে পড়ছে। এরপর তার শরীরের আরো উঁচুতে চিমটি কেটে বোঝা গেল বিষক্রিয়ায় পক্ষাঘাতের অগ্রগতি। বিষের ঊর্ধ্বগতির কারণে ফুসফুস বিকল হওয়ার আগপর্যন্ত তিনি তাঁর প্রিয় শিষ্য ক্রিটোর সঙ্গে কথা শেষ কথা বলেছেন, “Crito, we owe a cock to Asclepius. Pay it and do not neglect it.” ক্রিটো তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, ‘তা অবশ্যই করা যাবে, কিন্তু আর কী কথা আছে আপনার?’ সক্রেটিস এ কথার কোনো জবাব দিতে পারেননি। পক্ষাঘাতে ফুসফুস স্তব্ধ, অক্সিজেনের অভাবে অতি দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন তিনি।
চরম বিষাক্ত হওয়া সত্ত্বেও হেমলকের বিষকে ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করে আসছে হোমিওপ্যাথি। শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, কাঁপুনি, চলতে চলতে হঠাৎ পায়ে ব্যথা, জন্ডিস, মূত্রকৃচ্ছতা, টিউমার ইত্যাদি রোগে একে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ইউরোপের মনাস্টারি, যেখানে সন্ন্যাসীরা ব্রত গ্রহণ করে সাম্প্রদায়িক জীবন যাপন করেন সেখানে হেমলকের ব্যবহার ছিল পেশী অবশ করার ক্ষেত্রে। খ্রিষ্টীয় ৫০০ শতাব্দিতে রোম সাম্র্যাজ্যের পতনের পর থেকে রেনেসাঁ বিপ্লব পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ডাকিনীবিদ্যায় (Witchcraft) হেমলকের প্রচুর ব্যবহার ছিল যা জনপ্রিয়তার কারণে আইন করেও সহজে বন্ধ করা যায়নি। জিপ্সীরা হেমলক ব্যবহার করতো পায়ে হেমলক বিষ মেখে অনুভূতিনাশের জন্য। এতে আপাতপদহীন দেহে তাদের উড্ডয়নশীল হওয়ার একটি কাল্পনিক ব্যাপার ঘটতো। শূন্যচারী হওয়ার মানসে তারা আরেকটি হোমিওপ্যাথিক ওষুধ আকোনাইটও (Aconitum nepellus) ব্যবহার করতো বলে জানা যায়।
টীকা:
সক্রেটিসের মৃত্যু ও দর্শন প্রসঙ্গ
সক্রেটিসের বিরূদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি রাস্তার পাশে, গলির মোড়ে যত্রতত্র বক্তৃতা দিয়ে তরুণ সমাজকে বিপথগামী করছেন এবং তদানীন্তন দেবদেবী ও অভিজাত শ্রেণীর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছেন। এ-কারণে রাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কুনজরে পড়ে যান তিনি। কড়া ভাষায় তাঁকে শাসানো হলো, হয় সে দ্রুত এথেন্স ছেড়ে চলে যাবে, না হলে চিরদিনের জন্য বোবা হয়ে থাকবে। চিরকাল স্বীয় মতবাদ ও সিদ্ধান্তে অটল সক্রেটিস এর কোনোটিই মানতে পারলেন না, ফলত বিচারের সম্মুখীন হতে হলো তাকে এবং রায় হলো মৃত্যুদণ্ড। হিতৈষীদের সহায়তায় কারাগার থেকে কৌশলে পালিয়ে যেতে পারতেন দার্শনিক, কিন্তু তিনি তাঁর বিশ্বাসের মূল্য দিতে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করাকেই শ্রেয় মনে করলেন, হাতে তুলে নিলেন হেমলকের পাত্র।
তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য ছিলেন প্লেটো যিনি মৃত্যুর সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। সক্রেটিস সম্পর্কে যা কিছু জানা যায় তার অধিকাংশই পরবর্তীকালে প্লেটোর লিখিত বিবরণ থেকে। ‘অ্যাপোলজি’ নামক পাণ্ডুলিপিতে প্লেটো সক্রেটিসের মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনা করে গেছেন। প্লেটোর শিষ্য ছিলেন অ্যারিস্টটল্ এবং তার শিষ্য ছিলেন দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডার। পাশ্চাত্য দর্শনের পিতা ছিলেন সক্রেটিস। তাঁর আদর্শ প্লেটো ও অ্যারিস্টটল্ অনেকাংশে অনুসরণ করেছেন তবে একজন দার্শনিকের শিষ্য হয়েও আলেকজান্ডারের ভিতর দর্শনের চেয়ে বেশি ছিল দেশ বিজয়ের নেশা। সক্রেটিসের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল, প্রয়োজনীয় বিষয়ের ‘দ্বান্দ্বিকতামূলক বিশ্লেষণ’ করার নীতি, মোটাদাগে যার অর্থ হতে পারে ‘ক্রস চেকিং’, আজকাল যা শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। সক্রেটিসের পদ্ধতিকে বলা যায়, যে কোনো সমস্যার সমাধানে সমস্যাকে একরাশ প্রশ্নে বিভক্ত করে ফেলা যার উত্তর থেকে বেরিয়ে আসবে প্রকৃত সত্য। মৃত্যুর আগে দর্শন বিষয়ে সক্রেটিসের শেষ কথা ছিল, “An unexamined life is not worth living”.