নাটোরের লালপুরে অসুস্থ গবাদিপশুর জবাই করা মাংস থেকে অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। উপজেলার ওয়ালিয়া ইউনিয়নের দেলুয়া গ্রামে রোগাক্রান্ত গাভি গরু জবাই করে গোস্ত কাটা ধোয়ার কাজে নিয়োজিত ২ নারী সহ ৯ জনের হাতে পায়ে ফোস্কা পড়া ক্ষত ও ফোলা রোগ দেখা দিয়েছে।
মাংস খেয়ে আক্রান্ত দুলাল হোসেন (৫৫) নামে একজন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন বলে দাবী করা হচ্ছে। এটিকে এনথ্রাস্ক রোগ বলে সন্দেহ করলেও স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ বিষয়টি নিশ্চিত করেনি।
শনিবার (১৬ জুলাই) দুপুরে লালপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এ কে এম শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘এটা কি ধরণের রোগ তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কেবল মাত্র আইডিসিআর ল্যাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার পরই নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
দেলুয়া গ্রামের গাভি মালিক মহিদুল ইসলাম জানান, ‘গত ৭ জুলাই বিকেলে তার প্রায় ২ লাখ টাকা দামের গাভি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। স্থানীয় ভেটেরিনারি ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ খাওয়ানো হলেও সুস্থ হওয়ার লক্ষণ না দেখে ওই দিনই গ্রামের ১১ জন মিলে গাভিটি জবাই করে গোস্ত ভাগাভাগি করে নেওয় হয়।
ঘটনার ২ দিন পর মাংস কাটা সহ অন্যান্য কাজে জড়িত আফতাব উদ্দিন নামে একজনের হাতে পায়ে ফোস্কা পড়ার মতো ক্ষত ও ফোলা দেখা যায়। এরপর একে একে মনি খাতুনের (৩০) হাতে-মুখে, বিলকিস (৩০), সাখাওয়াৎ (৩৫), মোহন (৪৫),
হাবিবুর (৩০) ও সাদ্দাম হোসেনের (১৪) হাতে পায়েও ওই রোগ দেখা দেয়। তবে গোস্ত ভাগাভাগি করে নেওয়ার সাথে জড়িত ১০ জনের একজন দেলুয়া গ্রামের আব্দুল্লাহ বলেন, ওই গরুর গোস্ত যারা শুধু খেয়েছেন তাদের কিছুই হয়নি। ’
লালপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ওয়ালিউজ্জামান পান্না বলেন, ‘আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। নতুন করে যেন কেউ আক্রান্ত না হয় সেজন্য সতর্ক করা হয়েছে। এটা আসলে কি রোগ তা আইডিসিআর এর ল্যাবে পরীক্ষা করার আগে নিশ্চিত করে বলা যাবে না। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটি চিকিৎসক দল আক্রান্ত রোগীদের দেখেছেন।’
চিকিৎসক দল জানান, ‘জরুরিভাবে ঢাকা থেকে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বিশেষজ্ঞরা ডা. রায়হানের নেতৃত্বে একটি দল কাল রোববার ভোরে রওনা দেবেন। তাঁরা ওয়ালিয়ার দেলুয়া গ্রামের রোগীরা অ্যানথ্রাক্স-আক্রান্ত কিনা তা পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করে নিশ্চিত করবেন। তার আগে রোগীদের অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত্র নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।’
ওয়ালিয়া ইউনিয়নের দেলুয়া কমিউনিটি ক্লিনিকের চিকিৎসক শারমিন আক্তার তানিয়া বলেন, ‘গত ৭ জুলাই রুইগাড়ি গ্রামের আইয়ুব সরদারের ছেলে দুলাল হোসেন (৫৫) অ্যানথ্রাক্স সন্দেহে ক্ষত নিয়ে ক্লিনিকে চিকিৎসার জন্য আসেন। তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
বৃহস্পতিবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান বলে জানাগেছে। ময়নাতদন্তে মস্তিস্কে ইনফেকশন ও ক্ষত জনিত কারনে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলা হয়েছে। তিনি আরও জানান, ইতিমধ্যে অ্যানথ্রাক্স সন্দেহে একই গ্রামের চিকিৎসা নিচ্ছেন,
শহিদুল ইসলামের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম (৪৫) ও ছেলে সাদ্দাম হোসেন (২১), মহিদুল ইসলামের স্ত্রী রুমা বেগম (৩৫), মো. ওমর আলীর ছেলে আব্দুল মজিদ (৪০) ও সাখাওয়াত হোসেন (৩০), আরজেদ প্রাংয়ের ছেলে আফতাব আলী (৫০),
মৃত দুলাল হোসেনের ছেলে হাবিবুর রহমান (৩০), রূপচান্দ আলীর ছেলে মোহন আলী (৪০) এবং নুরুজ্জামানের স্ত্রী বিলকিস বেগম (৩২)। এদের মধ্যে মনোয়ারা বেগম ও আফতাব আলী আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন।’
লালপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. ইসাহাক আলী বলেন, ‘আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হচ্ছে। সেই সাথে সংক্রমণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এ কে এম শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘অ্যানথ্রাক্সের কারণ এক বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়া (ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাকিস)। এরা মাটির নিচে বহু বছর বেঁচে থাকতে পারে।
বর্ষা মৌসুমে মাটির নিচ থেকে ওপরে উঠে আসে। গরু, ছাগল, মহিষ বা ভেড়া ঘাস খাওয়ার সময় এদের শরীরে এই ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে। জীবাণু শরীরে প্রবেশের পর গবাদিপশু খুব দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে।’
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ইউএলও) চন্দন কুমার সরকার বলেন, ‘গবাদিপশুদের টিকা দিয়ে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধ করা হয়। ইতিমধ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দেলুয়া গ্রামে শনিবার ক্যাম্পিংয়ের মাধ্যমে সন্দেহজনক ৩০০টি গবাদিপশুকে অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগের টিকা দেওয়া হয়েছে। কোনো গবাদিপশুতে রোগের লক্ষণ দেখা দিলে প্রাণিসম্পদ কার্যালয় বা পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে সাধারণ মানুষের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।’