কুমিল্লার লালমাই উপজেলায় ৯ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর অভিযুক্তকে ৫ হাজার জরিমানা করে ঘটনার “সমাধান” করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীর। ঘটনাটি উপজেলার পেরুল দক্ষিণ ইউনিয়নের গজারিয়া ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামের।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ জুলাই পেরুল দক্ষিণ ইউনিয়নের গজারিয়া ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামের ৯ বছরের এক মেয়ে শিশুকে ধর্ষণ করে একই বাড়ির আব্দুল মতিন (৬৫)। অভিযুক্ত মতিন সম্পর্কে মেয়েটির দাদা। প্রথমবার ধর্ষণের পর কাউকে এই ঘটনা বললে শিশুটিকে গলা কেটে হত্যার হুমকি দেয় সে। ভয় দেখিয়ে শিশুটিকে আবার ধর্ষণ করে মতিন।
এবার নির্যাতিত শিশুটি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফেরে। অভিভাবকরা আশ্বস্ত করলে সে নির্যাতনের বর্ণনা দেয়।
এরপর স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য জাহাঙ্গীর আলম মজুমদারকে ঘটনা জানিয়ে বিচার দাবি করেন শিশুটির বাবা।
সোমবার (১১ জুলাই) সকালে ওই গ্রামের জামিয়াতুস সুন্নাহ মাদ্রাসা মাঠে এ ঘটনার বিচারের জন্য সালিশ বৈঠক বসে। স্থানীয় প্রভাবশালী (সর্দার) মিজানুর রহমান, ফিরোজ আহমেদ ভূইয়া, ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলম মজুমদার এবং আরেক সর্দার বাবুল মজুমদার সেখানে সিদ্ধান্ত দেন।
সালিশে নির্যাতিত মেয়েটির সাক্ষ্য নেওয়া হয় এবং ধর্ষক মতিনের স্বীকারোক্তিতে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেন সালিশদাররা। এরপর সালিশদাররা মেয়েটির পরিবারকে এ ঘটনায় কোনো মামলা বা অভিযোগ করতে নিষেধ করেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে অভিযুক্ত মতিনকে কল করা হলেও তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলম মজুমদারকে কল করা হলে তিনি বলেন, “আমি অন্যায় করে ফেলেছি। আপনি আসুন, আপনার সঙ্গে গ্রামবাসীদের নিয়ে সরাসরি বসে কথা বলব। আমি এখন কিছু বলতে পারব না।”
সালিশ বৈঠকে উপস্থিত মিজানুর রহমান মোবাইল ফোনে বলেন, “ধর্ষণের ঘটনা সত্য। তবে সালিশে গ্রামের সবাই উপস্থিত ছিল। আমরা গোপনে কোনো কিছু করিনি। সব সবার সামনেই করেছি।”
তিনিও গ্রামে গিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলার আহ্বান জানান।
যোগাযোগ করা হলে পেরুল দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খন্দকার সাইফুল্লাহ বলেন, “আমি এই ঘটনার কিছুই জানিনা। পাঁচ হাজার টাকায় ধর্ষণের বিচার করার মতো কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আমি ওই গ্রামে গিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখব। এমন কিছু হয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
নির্যাতিত শিশুটির বাবা বলেন, “আমি কুমিল্লা শহরে রিকশা চালাই। আমার স্ত্রী একটা কোম্পানিতে চাকরি করে। আমাদের উপার্জনে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাই। কাজের জন্য আমি সবসময় এবং আমার স্ত্রী দিনের বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকে। এই সুযোগ নিয়েছে মতিন। এরপর আমি বিচারের জন্য মেম্বারের কাছে যাই। মেম্বার আমারে বলে ঈদের পরে বিচার হইব।”
“ঈদের পরে আমাদের গ্রামের সরদার মিজানুর রহমান, মজু, বাবুল ও জাহাঙ্গীর মেম্বরসহ কয়েকজন মাদ্রাসার সামনের একটা চা দোকানে সালিশ বসায়। সালিশে প্রথমে তারা মতিনকে ৫০ বার কানে ধরা ও ১০০ বেত্রাঘাতের সিদ্ধান্ত নেয়। কিছুক্ষণ পরে তারাই এ সিদ্ধান্ত পাল্টে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার রায় দেয়।”
প্রকাশ্যে এই রায়ের বিরোধিতা করেছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “আমি বলছি, আমি মেয়ের শরীর বেচি নাই। টাকা দিয়ে আবার এই ঘটনার কী বিচার! এ বিচারের প্রতিবাদ করায় আমার আত্মীয়-স্বজনের ওপর হামলা করেছে তারা। এখনও দুইজন হাসপাতালে ভর্তি। এখন তারা বলছে আহতরা হাসপাতাল থেকে ফিরলে আবার সালিশ হবে। আমি বলেছি, বিচার পছন্দ না হলে আমি থানায় যাব।”
এ বিষয়ে লালমাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আইয়ুব বলেন, “এখনও এমন কোনো ঘটনার কথা শুনিনি। লিখিত অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
লালমাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফোরকান এলাহী অনুপম বলেন, “আমি আপনার কাছ থেকে প্রথম শুনলাম। এমন কিছু ঘটলে তা অবশ্যই অন্যায়। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”