সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং কথিত গণমাধ্যমের কল্যাণে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের দোহাই দিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ধর্মীয় উপসনালয় এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার যেসব ঘটনা, আমরা জানতে পারি, ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি। সব ঘটনা গণমাধ্যমে আসে না, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও আসে না। ব্যক্তিক পর্যায়ে এমন অনেক নিগ্রহের ঘটনা ঘটে, যেগুলি সেই ব্যক্তির পরিবার, সমাজ অবলীলায় মেনে নেয়, এই ভয়ে যে হামলার ঘটনা যাতে বসতবাড়ি পর্যন্ত কিংবা কমিউনিটি পর্যায় পর্যন্ত না গড়ায়! পরিসংখ্যান উপস্থাপন এই লেখার মুল উদ্দেশ্য নয়। যদি একটি ঘটনাও ঘটে সেটা মানবাধিকার লংঘন। কারণ জীবন এবং নিরাপত্তার অধিকার মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। সামগ্রিক বিবেচনায়, সার্বক্ষণিক শংকার মধ্যে বসবাসও মানবাধিকার লংঘন। এই লেখা যখন লিখছি, তখন আমার পার্টনার আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, তুমি কি সরকারের বিরুদ্ধে লিখছ? তার জিজ্ঞেস করার কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপে না গিয়ে লেখাতেই মনোনিবেশ করতে চাইলাম। কিন্তু এটা তো সত্য কারণ জিজ্ঞেস না করলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সে চায় না আমি সরকারের বিরুদ্ধে কিছু লিখি। কারণ আমাদের মনোজগতে একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়ে গেছে। আমি যদিও এটাকে সংস্কৃতি বলতে রাজী নই। যে প্রসঙ্গে আলাপ শুরু করেছিলাম, মনে হতে পারে আলাপ ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে। আপনাদেরকে নিশ্চিত করে বলতে পারি আলাপ ঠিক পথেই আছে। কারণ, এই দুইয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগসুত্র রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা বক্তব্য আছে এ রকম যে, মুখে যে যাই বলুক না কেন, নিজের প্রশংসা শুনতে সবাই ভালবাসে। এখন প্রশংসা তো আর এমনি, এমনি জুটবে না। প্রশংসা পাবার জন্য কিছু না কিছু তো করতে হয়। মানুষ তুলনামুলকভাবে সহজ পন্থায় প্রশংসা পেতে চায়। কিন্তু প্রশংসার ব্যাপারে আমরা দারুণভাবে কৃপণ। পারতপক্ষে আমরা অন্যের প্রশংসা করি না, কেন করি না! সেটা অন্য আলাপ। কিন্ত যারা প্রশংসা পান না, তাদের একাংশ বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। তারা নিজদের অস্তিত্ব জানান দিতে চান। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হলে তার সেই অস্তিত্ব জানান দেবার একটা হাতিয়ার হল, প্রতিপক্ষের উপর মামলা, প্রতিপক্ষ কিংবা সাধারণ মানুষের নামে সরকার প্রধান কিংবা জাতীয় ব্যক্তিত্বকে অবমাননার মামলা। ঠিক একই ভাবে ক্ষমতার বলয়ের বাইরে যারা আছেন, তাদের অস্ত্র হল, তদের চেয়ে ক্ষমতাহীন গোষ্ঠীর উপর হামলা। এখন একটা উছিলা তো লাগবে। সেই উছিলার নাম হল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত।
বর্তমান বাস্তবতায় ক্ষমতাসীন দলের হামলার বিপরীতে হামলার স্বীকার মানুষের পাশে দাঁড়াবার লোক যেমন কম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভু্মিকাও ততটাই নিস্ক্রিয়। আবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতারে পুলিশ দারুণ ততপর। ঠিক একইভাবে ধর্মীয় আঘাতের কথিত অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি উপর তো বটেই, তার পরিবার, পাড়া-পড়শি এবং তাদের বসতবাড়ি ও উপাসনালয়ে হামলার ক্ষেত্রেও আমরা দেখি আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াবার মানুষের সংখ্যা নগন্য। হামলা প্রতিরোধে পুলিশ খুব তৎপর ভুমিকা রেখেছে এমন ঘটনাও আমরা উল্লেখ করতে পারি ন।
সমাজের একাংশ এই দুইটা ঘটনার কোনোটাকেই হয়ত সমর্থন করেন না। কিন্তু তাঁরা আক্রান্তদের পাশে এসে দাঁড়ান না! দাঁড়ানো তাদের নৈতিক দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনে, তারা ব্যর্থ হলে সমাজের ক্ষতি হয় বটে, নিগ্রহের স্বীকার মানুষেরা মনোবল হারান সেটাও সত্য। তবে সেজন্য দায়িত্ব পালনে অবহেলায় তাঁদেরকে শাস্তির আওতায় আনা যায় না। কিন্তু পুলিশের দায়িত্ব তো শুধুমাত্র নৈতিক নয়, তাঁদের আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই হামলার স্বীকার ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জান মালের নিরাপত্তা রক্ষা তার জন্য অবশ্য করণীয়। কিন্তু পুলিশ সেই কর্তব্য পালনে ব্যর্থতার জন্য শাস্তির আওতায় এসেছে এমন নজির কোথায়?
রাজনীতিটা মুলত এখানেই। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাস্ট্রে এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় পশ্চিমবঙ্গে যখন শান্ত, স্বাভাবিক পরিবেশ, তখন সাংবাদিকরা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সারা ভারতে যখন দাঙ্গা তখন এখানে কিভাবে শান্ত, স্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ করছে? প্রত্যুত্তরে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, এখানে সরকার চায় না, তাই কোনো দাঙ্গা নেই! বোঝা গেল বিষয়টা? রাজনীতিটা কোথায়? সরকার না চাইলে ধর্মের দোহাই পেড়ে ধর্মীয় সংখ্যালগুদের উপর হামলা হতে পারে না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর হামলাও গ্রহণযোগ্য না, কিন্তু কথিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় না হয় সেটা মেনে নিলাম। কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা, যাদেরকে আওয়ামলীগের ভোটব্যাংক ভাবা হয় এবং যেখানে হামলাকারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আওয়ামী বিরোধী রাজনীতির সাথে যুক্ত।কিন্তু তারপরেও কেন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশ নিস্ক্রিয়। আসলে এখানেও সরকার চায় না। কেন চায় না! সেটা নিয়ে নানা হিসাব নিকাশ করা যেতে পারে। কিন্তু সরকার চাইলে যে পারে তার উদহারণ হল, শাপলা চত্ত্বর, তার উদহারণ হল নারায়ণগঞ্জ থেকে মামুনুল হককে গ্রেফতার।
উপরন্তু অধিকাংশ হামলার ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্থানীয় আওয়ামলীগের কোন না কোন নেতা এই হামলার সাথে যুক্ত ছিলেন। আমরা দেখেছি, শুধু নেতা কেন ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রীর সম্পৃক্ততাও প্রকাশ্যে এসেছে। কিন্তু এই ঘটনাগুলির বলা যায় কোনোটির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হয় নাই। ফলতঃ যেটা হয়েছে, যে গোষ্ঠী তাঁদের অস্তিত্ব জানান দিতে চায়, যাদের প্রকাশ্য কোনো জন সম্পৃক্ততা নাই, তারা বারবার এই পন্থা বেছে নিচ্ছেন! সরকারও প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিদের পরিবর্তে সরকার যাঁদেরকে বিরোধী মনে করেন, তেমন লোকেদের নামে মামলা দিয়ে তাঁর দায় সারছে। এই চক্রের মধ্যে আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি!
কিন্তু এই ঘটনাগুলির সামাজিক প্রভাব অনেক ব্যাপক! আক্রান্ত পরিবার এবং সম্প্রদায়, এই রাস্ট্র ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। তাঁদের প্রতিবেশি অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের উপর বিশ্বাস হারাচ্ছে। আর হামলাকারীদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায়, অন্যরাও একই পন্থায় বেপোরোয়া হয়ে উঠছে। যার ফলে দেশে, একের পর এক ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের অভিযোগে হামলার ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিষয়টা এমন আমাদের সকল অনুভূতি ভোতা হয়ে গিয়ে কেবল ধর্মীয় অনুভূতিটাই প্রবল হয়ে উঠছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের এই অপরাজনীতি বন্ধ হওয়া জরুরী। নইলে এটা শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য শংকার মধ্যে সীমিত থাকবে না, রাষ্ট্রের জন্য, রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা আছেন, তাঁদের জন্যও অশনিসংকেত হিসাবে দেখা দিবে অচিরেই।