ভারতে গ্রেপ্তার বাংলাদেশের নাগরিক পিকে হালদারকে ফেরত পাওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু তার পাচার করা অর্থ কি ফেরত পাওয়া যাবে? আইন বিশ্লেষকেরা বলছেন, আইন থাকলেও বাস্তবে তা প্রায় অসম্ভব।
পিকে হালদারের বিরুদ্ধে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানিলন্ডারিংয়ের মোট মামলা এখন ৩৪টি। এই সব মামলায় মোট ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে একটি মামলায় আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। ওই মামলায় ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে । এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক এবং রিলায়েন্স ফাইনান্সের এমডি থাকাকালে তিনি ওই টাকা পাচার করেন।
তার বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি প্রথম ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মানিলন্ডারিংয়ের মামলা মামলা করে দুদক। আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরেও তিনি দেশের বাইরে পালিয়ে যান।
পি কে হালদার ভারত, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, সিংগাপুর ও সংযুক্ত আবরব আমিরাতসহ আরও কয়েকটি দেশে অর্থ পাচার করেছেন বলে দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে।
পিকে হালদার ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর এখন সেখানে পাচারের টাকা ফেরত আনা যাবে কি-না সে প্রশ্ন সামনে এসেছে।
এই অর্থপাচারকারীকে ফেরত আনা সম্ভব হলেও পাচারের টাকা বা সম্পদ কতটা ফেরত আনা যাবে তা নিয়ে নানা সন্দেহ আছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্দি-বিনিময় চুক্তি থাকায় পিকে হালদারকে ফেরত আনায় তেমন বেগ পেতে হবে না। সেক্ষেত্রে অবশ্য ভারতে তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা নিষ্পত্তি হতে হবে।
আর পিকে হালদারের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে পরোয়ানা জারি করা আছে। অর্থ ফেরত আনার সুযোগ আছে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্স-এর মাধ্যমে।
ভারতসহ বিশ্বের ১৩৬টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এই সহযোগিতা যুক্তি আছে। তবে সেজন্য পাচার হওয়া টাকা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। সেটা অনেক সময়ই করা যায় না বলে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার খুব বেশি নজির বাংলাদেশে নেই।
ভারতে পি কে হালদারের নয়টি বাড়ির খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে। কিন্তু সেখানে তার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ কত তা এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। সংবাদমাধ্যমে ৩০০ কোটি টাকার সম্পদের কথা বলা হচ্ছে।
দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম বলেন, “আদালতের নির্দেশের মাধ্যমে এই মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠাতে হবে। আমাদের প্রমাণ দিতে হবে যে, ভারতে পিকে হালদারের অর্থ সম্পদ আমাদের দেশ থেকে পাচার করা অর্থে কেনা হয়েছে। এমএলএআর ওই দেশ একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে জবাব দেবে। এটা মামলা চলাকালে সম্পদ জব্দ করানো সম্ভব। মামলায় অভিযোগ প্রমাণ হলে জব্দ করা অর্থ বা সম্পদ ফেরত আনা সম্ভব। কিন্তু পাচার করা অর্থ সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে।”
“আর পিকে হালদারকে বাংলাদেশে ফেরত আনা যাবে বন্দি-বিনিময় চুক্তির অধীনে। তবে এখনও সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়নি।”
দুদকের আইনজীবী আরও বলেন, “ভারত এখনও আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে গ্রেপ্তারের খবর জানায়নি। সেটা জানানোর পর স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই উদ্যোগ নেবে।”
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক বলেন, “আসামি ফেরত আনা সহজ। আমরা অনুপ চেটিয়াকে ফেরত দিয়েছি। ভারত থেকে কাউন্সিলর নুরকে আমরা এনেছি। এটা বন্দিবিনিময় চুক্তির অধীনে আমরা পেরেছি। পিকে হালদারকেও আনা যাবে। তবে তার সম্পদ আনা প্রায় অসম্ভব বলে আমি মনে করি। কারণ এজন্য দুই দেশের মধ্যে আলাদা চুক্তি থাকতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারে। কারণ সেদেশে আইন আছে। তার দেশের নাগরিকেরা যে দেশেই ব্যাংক হিসাব খুলুক তার তদারকি সে করতে পারে।”
তিনি মনে করেন, “ফেরত আনতে হলে পাচার হওয়া টাকা আগে খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের দেশের মামলায় আগে প্রমাণ করতে হবে ভারতে যে তিনি বাড়ি বা সম্পদ করেছেন তা এখান থেকে পাচার হওয়া টাকায় করা। যদি আবার ওখানে তার ট্যাক্স ফাইল থাকে আর তাতে যদি ওখানকার সম্পদ বা টাকা দেখানো হয় তাহলে নানা সমস্যা আছে। এটা দীর্ঘকালীন একটা প্রক্রিয়া। তবে দুই দেশ যদি সমঝোতায় আসে তাহলে সম্ভব হতে পারে।”
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল বলেন, “মানিলন্ডারিংয়ের অর্থ ট্রেসিং কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। প্রথমত আসামি যদি আদালতে দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তি দেয় যে তিনি কীভাবে টাকা পাচার করেছেন, কোথায় খরচ করেছেন তাহলে তা ধরে চিহ্নিত করা যায়। আবার তার কাছ থেকে যদি ডকুমেন্ট উদ্ধার করা যায় তাহলে সেই ডকুমেন্টের ভিত্তিতেও পাচার হওয়া টাকা সর্বশেষ কোথায় আছে বা তিনি কী সম্পদ করেছেন সেই টাকায় তা প্রমাণ করা যায়। আর যে দেশে যেমন ভারতে সে সম্পদ করে থাকলে আয়কর ফাইলে অর্থের উৎস কী বলা হয়েছে সেখান থেকেও জানা যায়। তবে এরজন্য দুই দেশের মধ্যে চুক্তি থাকা দরকার। মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্স-এর মত এমওইউর মাধ্যমেও তা সম্ভব।”
দুদক ২০১২ এবং ২০১৩ সালে তিন দফায় সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংকে থাকা খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর ২১ কোটি টাকারও বেশি অর্থ ফেরত আনতে পেরেছিল। পাশাপাশি যুক্তরাজ্যকে তিন লাখ মার্কিন ডলার উদ্ধার করে দিয়েছে বাংলাদেশ। এর বাইরে মোরশেদ খান ও তার পরিবারের সদস্যদের হংকংয়ে পাচার করা ৩২১ কোটি টাকা ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রথম ধাপে ১৬ কোটি টাকা ফেরত আনার জন্য হংকংয়ের অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠিয়েছে দুদক।