আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিম ১০ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে বিদেশে গেছেন। এভাবে দণ্ডিত একজনের বিদেশে যাওয়ার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী বলছেন, এভাবে তিনি বিদেশে যেতে পারেন না। এই মুহূর্তে তার বিদেশে যাওয়ার আইনগত কোনো সুযোগ নেই।
তবে হাজী সেলিমের আইনজীবী বলছেন, আদালতের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি স্বাধীন মানুষ। তার বিদেশ যেতে আইনগত কোনো বাঁধা নেই। তিনি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশে ফিরে আসবেন এবং আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন।
অবৈধ সম্পদ অর্জনে দুদকের মামলায় দণ্ডিত পুরাণ ঢাকার এই সংসদ সদস্য শনিবার (৩০ এপ্রিল) থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক গেছেন।
তার ব্যক্তিগত সচিব মহিউদ্দিন মাহমুদ এ বিষয়ে বলেন, “তিনি অন্য সময় যেভাবে বিদেশে যান, এবারও সেভাবেই গেছেন। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোজাম্মেল হক সঙ্গে গেছেন। কারণ তিনি কথা বলতে পারেন না।”
মহিউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, “চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্যই তিনি সবসময় একজনকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। এবারও সেভাবেই গেছেন। চিকিৎসা শেষে ৬ মে দেশে ফিরে আসবেন। তিনি একজন সংসদ সদস্য, কেন তিনি পালিয়ে যাবেন?”
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম এ বিষয়ে বলেন, “হাজী সেলিমের দেশত্যাগের বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। উনি কীভাবে যেতে পারলেন তা আমাদের প্রশ্ন। উনি একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি, তার যাওয়ার আইনি কোনো সুযোগ নেই। উনার তো আদালতে আত্মসমর্পণ করার কথা ছিল।”
খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এই আইনজীবী বলেন, “দণ্ডিত হওয়ার কারণে খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারেননি। খালেদা জিয়ার পক্ষে সরকারের কাছে আবেদনও করা হয়েছিল। আমরা যতদূর জেনেছি, হাজী সেলিমের পক্ষে কোনো আবেদনও করা হয়নি। ফলে উনি কিভাবে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পেলেন আমরা বুঝতে পারছি না। আদালতে যখন মামলাটি উঠবে তখন আমরা বিষয়টি আদালতের নজরে আনব।”
তাহলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কি তাকে আটকানো উচিৎ ছিল? জবাবে জনাব খান বলেন, “আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হয়ত আদেশের কপি নেই। কিন্তু উনার আইনজীবী তো বিষয়টি জানেন। হাজী সেলিম সাহেব নিজেও জানেন। তাহলে উনি কিভাবে বিদেশে যান?”
২০২১ সালের ৯ মার্চ “অবৈধ সম্পদ” অর্জনের অভিযোগে দুই যুগ আগের একটি মামলায় হাজী সেলিমের ১০ বছরের কারাদণ্ড বহাল রাখে হাইকোর্ট। হাইকোর্টে আগের দণ্ড বহাল রাখার আদেশের পর হাজী সেলিমের সংসদ সদস্য পদ নিয়েও হুমকি তৈরি হয়। দুদকের করা “অবৈধভাবে সম্পদ” অর্জনের মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল ২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর- সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে জরুরি অবস্থার মধ্যে।
পরের বছর ২৭ এপ্রিল বিশেষ আদালত তাকে দুই ধারায় মোট ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়। পাশাপাশি জ্ঞাত আয় সম্পদ অর্জনে “সহযোগিতার” দায়ে হাজী সেলিমের স্ত্রী গুলশান আরা বেগমকে দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। হাজী সেলিম ও তার স্ত্রী ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করলে ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি উচ্চ আদালত তাদের সাজা বাতিল করে রায় দেয়।
দুদক তখন সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করে। ওই আপিলের শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি হাইকোর্টের রায় বাতিল হয়ে যায়। সেই সঙ্গে হাজী সেলিমের আপিল পুনরায় হাইকোর্টে শুনানির নির্দেশ দেয় আপিল বিভাগ। সেই শুনানি শেষে ২০২১ সালের ৯ মার্চ হাইকোর্ট বেঞ্চ হাজী সেলিমের ১০ বছরের সাজা বহাল রাখে এবং অন্য ধারায় ৩ বছরের সাজা থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়। আর আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় মারা যাওয়ায় বিচারিক আদালতের রায়ে দণ্ডিত হাজী সেলিমের স্ত্রী গুলশান আরা বেগমের আপিলটি বাতিল করা হয়।
হাজী সেলিমের আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা বলেন, “এই মুহূর্তে তার বিদেশ যেতে কোনো আইনি বাঁধা নেই। গত ২৫ এপ্রিল আদালত বলেছে, এক মাস অর্থাৎ ৩০ দিনের মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। সেই সময় এখনও অনেক বাকি। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন।”
তিনি আরও বলেন, “তার কিছু শারীরিক অসুস্থতা আছে, সেটা আপনারা সবাই জানেন। আদালতে আত্মসমর্পণের আগে আমিই তাকে পরামর্শ দিয়েছি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে আসার জন্য। আদালত কিন্তু বলেনি, আত্মসমর্পণের আগে তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না। ফলে তিনি এখন একজন ফ্রি নাগরিক। যেখানে খুশি যেতে পারেন। ২৫ মে এক মাস মেয়াদ শেষ হলে যদি তিনি আত্মসমর্পণ না করেন তাহলে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। এই মুহূর্তে অযৌক্তিকভাবে তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে বলে আমি মনে করি।”
দণ্ড মাথায় নিয়ে এভাবে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ আছে কি-না? জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনসুর হাবিব বলেন, “আদালতের যদি কোনো নির্দেশনা না থাকে তাহলে তিনি যেতে পারেন। আর আদালত যদি বলে দেয়, আত্মসমর্পণের আগে তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না, তাহলে এভাবে বিদেশে যাওয়া অবৈধ। কিন্তু আদালত আদেশে কি সেটা বলেছে? তবে বিতর্ক এড়ানোর জন্য উনি এই মুহূর্তে বিদেশে না গেলেও পারতেন।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “আদালতের নির্দেশনা থাকলেও এয়ারপোর্টে বিএনপি নেতাদের দুই ঘণ্টা করে বসিয়ে রাখা হয়। গুরুতর অসুস্থ খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য অনুমতি দেওয়া হয় না। আর হাজী সেলিম সাহেবরা কোনো অনুমতি না নিয়েই বিদেশ চলে যাচ্ছেন। কিভাবে তারা যাচ্ছেন সেই প্রশ্নের উত্তর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া উচিৎ।”
তিনি আরও বলেন, “এখন তো মনে হচ্ছে, দেশে দুই দলের জন্য দুই আইন। আওয়ামী লীগের জন্য এক আইন, আর বিএনপির জন্য আরেক আইন। এভাবে তো একটা দেশ চলতে পারে না।”
তবে হাজী সেলিমের বিদেশ যাওয়া নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। তিনি বলেন, “এটা আইনগত বিষয়, আইনজীবীরাই ভালো বলতে পারবেন।”
এক্সিম ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি, জয়নুল হক সিকদারের দুই ছেলে সিকদার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রন হক সিকদার ও তার ভাই দিপু হক সিকদার রোগী সেজে ২০২০ সালের ২৫ মে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ব্যাংকক যান। বিষয়টি তখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। নিজেদের মালিকানাধীন আরঅ্যান্ডআর এভিয়েশনের একটি উড়োজাহাজকে “রোগীবাহী” হিসেবে দেখিয়ে তারা সরকারের অনুমোদন নিয়েই দেশ ছাড়েন।
আবার জয়নুল হক সিকদারের মৃত্যুর পর রন হক সিকদার যখন দেশে আসেন তখন বিমানবন্দর থেকে আটকের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তার জামিন হয়ে যায়।
রন হক সিকদার ও তার ভাই দিপু হক সিকদারের বিরুদ্ধে তখন গুলশান থানায় হত্যাচেষ্টার মামলা করেন এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক লে. কর্নেল (অব.) সিরাজুল ইসলাম।
১৯ মে দায়ের করা মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, ঋণের জন্য বন্ধকি সম্পত্তির মূল্য বেশি দেখাতে রাজি না হওয়ায় এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া ও অতিরিক্ত এমডি মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেন সিকদার গ্রুপের দুই পরিচালক। শুধু তাই নয়, তারা দুই কর্মকর্তাকে বনানীর বাসায় জোর করে আটকে রেখে নির্যাতন এবং সাদা কাগজে সই নেন।