প্রায় দুই লাখ টেখা (টাকা) ঋণ করিয়া ৪০ কেয়ার জমি করছিলাম, ধানও খুব ভালা হইছিল, হাওরের ধান দিক্কা ইবার ঈদ নিয়ে কতো স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু একটা বেড়ি বানের (বাঁধ) অভাবে পাহাড়ি ঢলের পানি আমরার হাওরের সব ধান পানির নিচে গেছেগি। আমার সোনার ধান পানির নিচে সোনার মতো ঝলমল করছে, কিন্তু একটাও ধান আর কাইট্টা আনতে পারলাম না। ৪০ কেয়ারের মাঝে ৫ থাকি ৭ কেয়ার জমির ধান পানির নিচ থাকি কাটাইতে পারলামনে যদি আমার কাছে কিছু টেখা থাকতো। আমার সর্বশেষ আর কিছু রইছে না আমি এখন ঋণের টেখা কিলা দিমু আর ছোট ছোট তিনটা বাচ্চারে কিলা খাবাইমু ইতা চিন্তায় আমার জান যায় যায়। চোখের কোণের পানি মুছতে মুছতে এভাবেই জানিয়েছেন সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার জান্দরটুপি এলাকার কৃষক সোনু মিয়া।
হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ জেলার লাখ লাখ মানুষের জীবিকার প্রধান অবলম্বন এই বোরো ফসল। কিন্তু হাওর ভর্তি সেইসব সোনার ধান ঘরে তোলার স্বপ্ন যেন চোখের সামনেই তলিয়ে গেলো পানির নিচে। গত ৩০ মার্চ মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জি থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ জেলার নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থা অব্যাহত থাকার কারণে সর্বপ্রথম সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার নজরখালী বাঁধ ভেঙে টাঙ্গুয়ার হাওরের ফসল ডুবে যাওয়াসহ একের পর এক ছোট-বড় কয়েকটি হাওরের ফসলহানি ঘটেছে। বাঁধ ভেঙে সর্বনাশ ঘটেছে ডুবে যাওয়ার জমির ২৩ হাজার কৃষক পরিবারের। সরকারি হিসাবে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ছয় হাজার হেক্টর ফসলি জমি। তবে স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বললে কৃষকদের দাবি ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি। কৃষকদের হিসাব মতে, এ বছর এ পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে।
হাজারো কৃষকের বছরের স্বপ্ন এখন একলগি (নৌকা চালানোর বাঁশ) পানির নীচে। ঈদ এসেছে এই হাওরপাড়ের মানুষের জন্য কষ্ট নিয়ে।
হাওরপাড়ের গ্রামগুলো ঘুরে দেখা গেছে, কারো ভাবনায় ঈদ আনন্দ নেই। বরঞ্চ এক বছর কীভাবে খেয়ে বেঁচে থাকবেন, এ বছর তারা চলবেন কীভাবে। সেই ভাবনায় সময় কাটছে তাদের। হাওরজুড়ে আর্তনাদ করছে কৃষকের দীর্ঘশ্বাস।
তিন ছেলে, দুই মেয়ে আর বৃদ্ধ স্ত্রীকে নিয়েই হাওরপারের কৃষক আবুল হোসেনের ৭ সদস্যসংখ্যা পরিবার। পরিবারের আয়ের উৎস একমাত্র বোরো ধান। এই ধান তাদের সারা বছরের ধন। বিকল্প কোনো আয় নেই, নেই কোনো সহায়সম্পদ। সেই ফসল হারিয়ে এখন অসহায় তারা।
হাওরপাড়ের কৃষকদের সঙ্গে কথা হলে জামালগঞ্জ উপজেলার কৃষক আবুল হোসেন বলেন, এইবার একবায়দি নতুন ফসল তোলার আনন্দ, লগে রোজার ঈদ। দুই আনন্দের স্বপ্ন বুনছিলাম, কিন্তু পাহাড়ি ঢলে তলাইয়া গেছে সবতা। ছেলে শার্ট-প্যান্ট, মেয়েরে জামাকাপড় কিনিয়া দিমু। আর পিঠা চিড়া করমু মেহমান মুসাফির আইবো, আমরাও আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে যাইমু। কিন্তু বৈশাখ আইয়া সব নিছেগি। আমরার ঈদের আনন্দ মলিন হইগেছে।
হাওর বাঁচাও আন্দোলন জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদ নূর আহমদ বলেন, এবার যাদের ধান গেছে তাদের এবার কোনো ঈদ নেই। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে তাদের পাশে সরকারকে দাঁড়াতে হবে। কৃষকের পরিবারের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়াসহ সব ধরনের সহযোগিতা দিতে হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এবার জেলায় ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এ পর্যন্ত জেলায় ১৯টি হাওরে প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, নির্বাহী কর্মকর্তা ও কৃষি অফিসারের কাছ থেকে তালিকা নিয়ে যে কটি হাওর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের ১০ লাখ টাকা, চাল ও শুকনা খাবার সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। ঈদের আগে ওই হাওরপাড়ের কৃষকদের খাদ্য ও নগদ সহায়তা দেওয়া হবে। সহায়তা প্রদানে বর্গাচাষিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।